চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৭

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৭
Writer Asfiya Islam Jannat
“আমি মানুষটা কি আসলেই তোমার বড্ড অপ্রিয়?”
কথাটা কর্ণকুহর হতেই স্পর্শীর পিলে চমকে উঠে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নির্বাণের পানে। নির্বাণের দৃষ্টি তখন রাস্তাতে নিবদ্ধ, দেহভঙ্গি বেশ অমায়িক। হঠাৎ এমন প্রশ্নের মানে খুঁজে পেল না স্পর্শী। নির্বাণ কি তাহলে দুপুরের কথাগুলো শুনে ফেলেছিল? কথাটা মস্তিষ্ক জুড়ে তরঙ্গিত হতেই স্পর্শীর হৃদস্পন্দন তার বাদ্যযন্ত্রের ন্যায় বাজতে থাকে। বিচলিত হয়ে উঠে মন। নির্বাণের প্রশ্নের কি উত্তর দিবে সে এখন? সত্য বলা দুষ্কর হলেও মিথ্যাই বা কি বলবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। নিজেকে স্বাভাবিক করতে ফাঁকা কয়েকটা ঢোক গিলে। আনমনে কথা গুছিয়ে নিয়ে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,
“তেমন কিছু নয়।”
নির্বাণ সামনের দিকে তাকিয়েই বলে, “তাহলে কেমন কিছু?”
স্পর্শী এইবার প্রত্যুত্তর করার মত কিছু খুঁজে পেল না। তাই চুপ করে রইলো। যেখানে নির্বাণের সবটাই জানা, সেখানে কি মিথ্যা বলা সাজে? স্পর্শীকে নীরব থাকতে দেখে নির্বাণ বলে, “আমি সত্যিটা শুনতে চাইছি তোমার থেকে। কোন ধরনের বানোয়াট কাহিনী নয়।”
স্পর্শী জানালার বাহিরে মুখ করে মিনমিনে স্বরে বলে, “হ্যাঁ! আপনি আমার অপ্রিয়। তবে এতটাও না।”
“অপ্রিয় হওয়ার কারণ?”
“কারণ তো আর আপনার অজানা নয়। আপনার কঠোর ব্যক্তিত্বের জন্যই কম-বেশি ভার্সিটির সকলের কাছেই আপনি অপ্রিয়।”
নির্বাণের শান্ত কন্ঠে বলে, “আমি অন্যদেরটা নয় বরং তোমার কাছে অপ্রিয় হওয়ার দিকগুলো জানতে চাইছি।”
প্রশ্নটা ঠিক ধরতে না পেরে স্পর্শী ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
“মানে শুধু কি আমার কঠোর ব্যক্তিত্বের জন্যই আমি তোমার অপ্রিয় নাকি কোন চারিত্রিক দোষ তোমার নজরে পড়েছে? কোন সমস্যা আছে আমার মধ্যে?”
নির্বাণের কথায় স্পর্শী বিমূঢ়তা,বিহ্বলতায় মুখের খেই হারিয়ে ফেলে। একপ্রকার বিষম খেয়েও খেল না সে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নির্বাণের পানে। এইমাত্র কি বললো নির্বাণ? চারিত্রিক দোষ? সে তো নির্বাণকে ভালো মত চিনেও না পর্যন্ত। আদৌ তার চারিত্রিক দোষ আছে কি-না সে কিভাবে জানবে? ক্ষণেই পরিবেশ বিব্রতকর হয়ে উঠলো স্পর্শীর নিকট। সে দৃষ্টি নত করে হাত কচলাতে শুরু করে। অকস্মাৎ নির্বাণ বলে উঠে,
“নীরবতা কিন্তু সম্মতির লক্ষণ।”
স্পর্শী এইবার আরও বিব্রতবোধ করে। দৃষ্টি নত রেখেই ইতস্তত সুরে বলে, “সেরকম কিছু না। আপনি স্যার হিসাবেই আমার কাছে অপ্রিয়।”
ক্ষণেই নির্বাণের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে সরু হাসির রেখা। মৃদুস্বরে বলে সে, “তোমার ভালো লাগায় আমি অপ্রিয় হলেও, আমার ভালো না লাগায় তুমি অপ্রিয়।”
আশেপাশে চলাচলকারী গাড়ির তীক্ষ্ণ শব্দে নির্বাণের কথাটা স্পর্শী ঠিকমত শুনতে পেল না। খেয়ালও করা হলো না নির্বাণের ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা হাসিটুকু। স্পর্শী আনমনা হয়েই বলল, “কথাটা ঠিক শুনতে পায়নি।”
নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল,  কিছু বললো না। স্পর্শী তখনও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নির্বাণের পানে। কিছু প্রহর এইভাবেই নীরবে গড়িয়ে যাওয়ার পর নির্বাণ গাড়ি থামায়। অকস্মাৎ গাড়ি থামিয়ে দেওয়ায় স্পর্শী হকচকিয়ে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে, “গাড়ি থামালেন কেন?”
নির্বাণ কিছু না বলে নিজের সিটবেলটা খুলে। অতঃপর খানিকটা ঝুঁকে আসে স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী তা দেখে ভয়ে মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে দেয়, “কি হয়েছে?”
নির্বাণ স্পর্শীর একদম নিকটস্থে এসে তার সিটবেল খুলে দেয়। মুখটা স্পর্শীর কান বরাবর স্থির রেখেই বলে, “আমরা এসে পড়েছি।”
নির্বাণ এত কাছে আসায় স্পর্শীর প্রায় রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে, কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না সে। কোনমতে শুধু বলে, “হু?”
নির্বাণ স্পর্শীর কাছ থেকেই সরে এসে হালকা হেসে বলে, “তোমার বাসায় এসে পড়েছি আমরা। নামো!”
স্পর্শী এইবার সম্বিৎ ফিরে পায়, সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় চারপাশে। ওদের কোলানীর সামনেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। স্পর্শী এইবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়, ঘুরে তাকায় নির্বাণের দিকে। নির্বাণের ঠোঁটের কোনে তখন এক টুকরো হাসি বিদ্যমান। স্পর্শী বেশ কিছু সময় একমনে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। নির্বাণের সাথে পরিচয় হওয়ার পর এই প্রথম সে তাকে হাসতে দেখেছে। এ যেন কোন বিরল বস্তুর সন্ধান পাওয়া। ভার্সিটিতে নির্বাণ সর্বদাই গাম্ভীর্য পূর্ণ, তাকে কখনো হেসে-খেলে কথা বলতে দেখা যায় না। বাকি আট-দশটা স্টুডেন্টের মতই স্পর্শীও ধরেই নিয়েছিল নির্বাণ হাসতে জানে না। তবে আজ তা যেন ভুল-প্রমাণিত হলো।
স্পর্শী এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নির্বাণ আবার তার দিকে কিছুটা ঝুঁকলো, “আমাকে দেখার আজীবন সময় পাবে। এখন বাসায় যাও, রাত বাড়ছে।”
কথাটা বলে নির্বাণ সরে আসে। ক্ষণেই স্পর্শীর ভরাট গাল দু’টিতে ছেঁয়ে গেল প্রগাঢ় রক্তিমা। সে দৃষ্টি নত রেখেই মিনমিনে স্বরে বলল, “আসি!”
কথাটা বলেই স্পর্শী হাতের মুঠোয় ব্যাগ চেপে তৎক্ষনাৎ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। দ্রুত পায়ে হাঁটা দিল সামনের দিকে, ভুলে করেও তাকালো না পিছনের দিকে। ভাব এমন, পিছনে তাকালেই যেন তার সর্বনাশ।
পুব আকাশে ছেঁয়ে আছে হরিদ্রাভ আলোর ছটা। কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘের অন্তরালে খেলা করছে ছোট শালিকের দল। রক্তিমায় আবৃত পলাশ গাছের শেষ প্রান্তে সূর্যের প্রথম আলো পড়তে না পড়তেই আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে উঠে পরিবেশ। মন্থর শব্দে বেজে উঠলো শোকগাথা। বেলা হওয়ার সাথে সাথে জাবির প্রাঙ্গণ হয়ে উঠলো কোলাহলে পরিপূর্ণ। সেই সাথে, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সূচনা হলো তখনই। হরেক রঙের শাড়ি ও পাঞ্জাবী পরিহিত নর-নারীর সমারোহ চারদিকে। সকলেই ব্যস্ত কোন না কোন কাজে।
নির্বাণ ভলেন্টিয়ারদের আরেক দফা আদেশ-নির্দেশনা দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ব্যাক স্টেজের দিকে। সব ঠিক-ঠাক আছে কি-না পরোক্ষ করতে। নিজ গন্তব্যে এসে নির্বাণ থমকালো, অনিচ্ছাকৃতভাবেই দৃষ্টি গিয়ে আটকালো কাঙ্ক্ষিত নারীর উন্মুক্ত পিঠের দিকে৷ সবসময় সংযত রাখা দৃষ্টি আজ প্রথমবারের মত রূপান্তরিত হলো বেহায়াপনায়। নারীটি উল্টোমুখ করে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে বিভিন্ন আকার ভঙ্গিমা করতে করতে কাউকে কি যেন বুঝাচ্ছে৷ সে কথাতে এতই মশগুল যে, কেউ তাকে খুব গভীরভাবে তা বুঝতেই পারলো না। নারীটির কথা শেষ হতেই সে ঘুরে দাঁড়ালো, নির্বাণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো নারীটাকে। গায়ে আটপৌরে শাড়ি জড়িয়ে, কৃত্রিম রঙে সাজিয়েছে নিজেকে। হাতে এক মুঠ রেশমি চুড়ির ঝংকার তুলে, কাঁধের একপাশে খোঁপা ফেলে কৃত্রিম ফুল গেঁথেছে তা-তে৷ এই অকৃত্রিমতায় যেন আজ নির্বাণ খুঁজে পেল অপার্থিব এক সৌন্দর্যের সন্ধান। মনের মাঝে উঠলো উথালপাথাল ঢেউয়ের জোয়ার। আগেও সে এই বেশে অনেক নারীকেই দেখেছে, কিন্তু কখনও কোন নারীর প্রতি এমন আকর্ষণবোধ করেনি। তবে আজ কেন আকর্ষিত হচ্ছে সে? নারীটির উপর তার অধিকার বলে?
নির্বাণ একধ্যানে তাকিয়ে থাকে স্পর্শীর দিকে। গভীরভাবে পরোক্ষ করতে থাকলো তাকে। হঠাৎ স্পর্শীর কাজলরেখা দৃষ্টিতে নির্বাণের দৃষ্টি মিলিত হতেই, সে দেখতে পেল তার সর্বনাশিনীকে। ক্ষণেই সর্বাঙ্গে খেল গেল তীব্র শিহরণ। মনে পড়ে গেল, চৈত্র মাস নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কাব্যিক বাণীটির কথা৷ নির্বাণ দৃষ্টি নত করে বিরবির করলো, “চৈত্র মাস তো নয়, এ যেন সর্বনাশা মাস। পুরুষজাতীর শিষ্টতা বিনাশ করতেই এই মাসের আগমন।”
নির্বাণ একপলক দৃষ্টি তুলে স্পর্শীকে দেখে আনমনে বলে, “সর্বনাশা মাসে পুরুষজাতি কোন নারীর দৃষ্টির মাধুর্যে শহীদ হবে না, সেটা অসম্ভব। একবারেই অসম্ভব!”
“নিষিদ্ধ জায়গায়গুলো এইভাবে উন্মুক্ত রাখতে নেই, দৃষ্টি বেসামাল হয় কারো।”
কোন আগন্তুকের মিইয়ে যাওয়া কন্ঠ স্পর্শীর কর্ণকুহরে ঝংকার তুলতেই ঈষৎ কেঁপে উঠে সে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে যায় শীতল শিহরণ। স্পর্শী কিছু বুঝে উঠার আগেই আগন্তুকটির পুনরায় বলে উঠে,
 “পিছন দিয়ে শাড়ি ঠিক কর।”
কন্ঠস্বরটা এইবার বড্ড চেনা লাগে স্পর্শীর কিন্তু ঠিক ধরতে পারলো না কন্ঠটা কার। তৎক্ষনাৎ পিছন ঘুরে দাঁড়ায় সে, কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। ঈগল দৃষ্টি চারদিকে নজর বুলিয়ে, বোঝার চেষ্টা করে কথাটা আসলে তাকে কে বলেছে। কিন্তু ভিড়ের মাঝে আগেই আগন্তুকটি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যার দরুন, স্পর্শী বুঝতেই পারলো না কে তাকে সেই কথাগুলো বলেছিল৷ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের দিকে তাকালো, পিছনে নিয়ে গেল হাত।
কোমরের পাশে লাগানো সেফটিপিনটা টানে খুলে গিয়েছে, যার ফলে কোমরের একাংশ প্রদর্শিত হয়ে আছে বহির্ভাগে। ক্ষণেই স্পর্শী লজ্জায় নিমজ্জিত হলো। কাজে এতটাই মগ্ন ছিল কখন শাড়ির পিন খুলে গিয়েছে বুঝতেই পারে নি৷ স্পর্শী দ্রুত পিছন দিক দিয়ে আঁচল টেনে নিজেকে আবৃত করলো। পুনরায় চারদিকে চোখ বুলালো পরিচিত কাউকে খুঁজতে। আশপাশে কাউকে না পেয়ে স্পর্শী সামনের দিকে এগিয়ে গেল কিছুটা। সামনে নিধিকে দেখতে পেয়ে স্পর্শী ওর নাম ধরে ডাকে। ডাক শুনে নিধি কাছে আসতেই স্পর্শী সবটা বলে, ওকে নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।
নিজ কার্য শেষে স্পর্শী আর নিধি বেরিয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। স্পর্শী মন্থর কন্ঠে বলে,”থেংক্স রে।”
নিধি তটস্থ সুর বলে,”থেংক্স পরে দিস, এখন তারাতাড়ি চল। বহুত কাজ বাকি আছে ভাই। সব ঠিকমত না হলে স্যার পরে আমাদের ক্যালাবে।”
“হুম চল।”
স্পর্শী আর নিধি কিছুদূর যেতেই পাশ থেকে কেউ  শিস বাজিয়ে উঠে। স্পর্শী সেটা উপেক্ষা করে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে কেউ বলে উঠে,
“রূপে বুঝি আজ পা মাটিতেই পড়ছে না তোমার। আমাকে না দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে যাচ্ছ।”
স্পর্শী এইবার থমকায়। পাশ ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রুদ্রের দিকে। কঠোর কন্ঠে বলে, “রাস্তার লোককে দেখার মত কি আছে?”
রুদ্র বাঁকা হেসে বলে, “মানলাম আমি রাস্তার লোক। তবে, এই রাস্তার লোকের সাথেই এককালে অনেক সময় কাটিয়েছ। ভুলে গেলে?”
“মুখ সামলে কথা বল।”
“মুখ সামলেই কথা বলছি, জাননন!”
শেষের কথাটা একটু টান দিয়ে বলল রুদ্র। স্পর্শী কিছু বললো না, শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রুদ্রের দিকে। নিধি একবার রুদ্রের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্পর্শীর হাত ধরে চলে আসার জন্য বললো।  এমন সময় রুদ্রের আর কিছু বন্ধু এসে দাঁড়াল সেখানে। সকলের অভিব্যক্তি গা-জ্বালানোর মত। একজন রুদ্রের কানে কিছু ফিসফিস করতেই রুদ্র অতি বিশ্রী চাহনিতে তাকায় স্পর্শীর পানে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার ভালো মত দেখে নিয়ে বলে,
“একরাতের জন্য মন্দ নয়।”
কথাটা কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হতেই স্পর্শীর ক্রোধ সকল সীমা পেড়িয়ে গেল। সে উচ্চস্বরে বলে, “মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ রুদ্র। আজ বারাবাড়ি করলে খারাপ হয়ে যাবে বলছি।”
রুদ্র পুনরায় হেসে বলে, “খারাপ কি বললাম? সাধারণ একটা বাক্য বলেছি তাতে এত জ্বলার কি আছে? আর আমি তো তাও একরাতের কথা ভেবেছি, অন্য কেউ হলে ফিরেও চাইতো না। তোমার মত কালো মেয়েকে কেই বা চাইবে?”
স্পর্শী ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো, রাগে তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। স্পর্শীর এখন ইচ্ছে করছে কাঠিন্যে পরিপূর্ণ কয়েকটা বাক্য রুদ্রের দিকে ছুঁড়ে দিতে কিন্তু পারছে না। কন্ঠস্বর কেমন নিম্প্রভ হয়ে পড়েছে, শব্দ সব যেন দলাপাকিয়ে বসে আছে কণ্ঠনালীতে। স্পর্শী নিধির এক হাত শক্ত করে ধরে। নিধি এইবার চেঁচিয়ে বলে,
“জাস্ট সাট আপ রুদ্র। আর কত নিচে নামবে তুমি? তোমাকে তো আজ আমার পশুর সাথেও তুলনা করতে ঘৃণা হচ্ছে।”
রুদ্র বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে, “সত্যি সবসময় গায়েই লাগে।”
স্পর্শী এইবার নিজেকে ভিতরে ভিতরে খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে শক্ত গলায় বলে, “সত্যি গায়ে লাগে কি-না জানি না। তবে কুকুরের ঘেউ ঘেউ এট লিস্ট আমার গায়ে লাগে না। অন্যের লাগলে লাগতে পারে।”
ক্ষণেই রুদের অভিব্যক্তি বদলে যায়। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতেই স্পর্শী আবার বলে,
“একটা কথা কি জানো? কুকুরের অভ্যাস হলো যেখানে সেখানে মুখ দেওয়া। একশ এক জায়গায় মুখ দিয়ে, মুখে ঘা করা। তুমিও হচ্ছ সেই কুকুর৷ সময় থাকতে ঠিক হয়ে যাও, নাহলে কোথায় কোন ঘা হবে বুঝতেও পারবে না। আর আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করার কিছু নেই। আমার জীবনের গতি ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে।”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলে, “গতি বলতে?”
“বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার আর আমার বর আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।”
কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না স্পর্শী। নিধির হাত ধরে বড় বড় পা ফেলে সে জায়গায় থেকে চলে আসলো।
ফাঁকা একটা ক্লাসে নতজানু হয়ে বসে আছে স্পর্শী। শক্ত মন হয়ে পড়েছে নিস্তেজ। চোখের কানায় জমে এসেছে লঘু অশ্রুজল। যেকোনো সময় নিজ সীমানা পেরিয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়বে গাল,চিবুক বেয়ে। তারই পাশে নিধি আর কেয়া। স্পর্শীকে এইটা সেটা বলে বুঝ দিচ্ছে। তারই অন্যপাশে মাহিন ও সামি দাঁড়িয়ে নিষ্প্রভ চাহনিতে দেখিছে সব। সকল ঘটনা শুনে তারা স্তব্ধ। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ঈষৎ পূর্বেই। মানুষ এত নিকৃষ্ট কিভাবে হয়?
অকস্মাৎ স্পর্শী মাথা তুলে, এক ফোঁটা জল আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে৷ অযত্নে লেপ্টে গেল চোখের কিনারে লেগে থাকা কাজলটুকু। অস্ফুটস্বরে সে জিজ্ঞেস করে, “আমি কি আসলেই দেখতে এতটা কুৎসিত, কালো? আমাকে কি সত্যি কেউ চাইতে পারে না?”
নিধি এইবার ধমকে উঠে, “কিসব বাজে বকছিস তুই? তুই কুৎসিত বা কালো হতে যাবি কেন? তুই হচ্ছিস পরিস্ফুটিত গোলাপ। যার মধ্যে কোন দাগ নেই, কোন কৃত্রিমতা নেই। কুৎসিত তো ওই জা****বাচ্চা। ওর তো সবই কালা।”
কেয়া স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “ওই গাধা! তুই কালো আর উজ্জ্বল শ্যামলার মধ্যে পার্থক্য বুঝিস না? নিজেকে তোর কোনদিক দিয়ে কালো মনে হয়? এত মিষ্টি একটা চেহারা কুৎসিত লাগে তোর? থাপড়িয়ে সব দাঁত ফেলে দিব, ফাজিল মেয়ে। ওই আবালের কথা কানে নিয়ে বসে আছিস কেন? ওর কথার দাম আছে কোন?”
সামি এগিয়ে এসে বলে, “একদম কাঁনবি না। এই চোখের জল কার জন্য ফেলিস? ওকে না তুই ভালোবাসিস না? তাহলে ওর কথা তোকে ইফেক্ট কেন করছে? আর কালো হলেও কি? কালো মানুষ কি সুন্দর না? যে যার রূপে সুন্দর। গায়ের রঙ দিয়ে সুন্দর, কুৎসিত যাচাই করাটা বিকৃতি মস্তিষ্ক মানুষের কাজ।”
স্পর্শী মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “আমি জানি সেটা। কিন্তু তবুও আজ ওর কথাগুলো কেন যেন ইফেক্ট করছে আমাত। তবে ভুলতে পারছি না কথাগুলো।”
মাহিন বলে, “তোর মত মেয়ে আমি অনেক কম দেখেছি স্পর্শী। তুই সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে না। যেহেতু আজ তোর উপর কারো কথা ইফেক্ট করছে, সেহেতু কথাগুলো তোর মনে গভীর দাগ কেটেছে বুঝতে পারছি। দেখ, যে যার মত সুন্দর৷ আল্লাহর সৃষ্টি কি কখনো কুৎসিত হতে পারে? আর তুই দেখতে একদমই বাজে না। বরং একটা মিষ্টি আর হাস্যজ্বল চেহেরার অধিকারী তুই। তোর ব্যক্তিত্ব সর্ব্দাই তোকে সবার আলাদা করে। তোকে যে পাবে সে অনেক ভাগ্যবান হবে রে। এইটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি।”
সকলের কথায় স্পর্শী একটু স্বাভাবিক হয়। মন খারাপের মেঘগুলো সরে যেতে শুরু করে। সে হালকা হেসে বলে, “মাখন দেওয়া ভালোই শিখেছিস মোটু।”
মাহিন বিরাগপূর্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, “আমার মনের কথাগুলো তুই মাখন বলে চালিয়ে গেলি? এই তোর বিচার?”
সামি বিদ্রুপ কন্ঠে বলে, “ভালো কথা বলেছিস তো তাই গায়ে লাগে নাই মাইয়ার। তোর বলা উচিৎ ছিল, স্পর্শী তোর মত তেতো মেয়ে আমি একটাও দেখিনি। তোর ত্যাড়া চোখের চাহনি, তোর আঁকাবাঁকা হলুদ দাঁতের হাসি সবাইকে আহত করে রে। তোর সোলার ঝাড়ুর মত চুলে উকুনের বাসা দেখিতে সবাই উতলা হয় পড়ে। তোর মত একটা মেয়ে যার জীবনে যাবে তার জীবন কয়লার কারখানা হয়ে যাবে।”
সামির কথা শেষ হতেই সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠে। কেয়া বলে, “সেই বলেছিস ইয়ার। উফফ! পুরাই জোস।”
 স্পর্শী হাসতে হাসতে বলে, “থাক ভাই, মাফ কর আমায়। আমার রূপের গুণগান আর তোকে গাইতে হবে না। বুঝলি আমি মেলা সুন্দর।”
নিধি বলে, “এই তো বাছা লাইনে আসছো। এরপরের বার খালি আজেবাজে কথা শুনে সেন্টি খাইস তুই। মিটাইয়া সেন্টু গেঞ্জি বানিয়ে ফেলুম।”
নিধির কথায় স্পর্শী হেসে বলে, “আচ্ছা বানাইস।”
অতঃপর অযত্নেই চোখের কোনে জমে থাকা জলটুকু মুছে নেয়। লেপ্টে যাওয়া কাজল আরেকটু ছড়িয়ে হয় কিন্তু সেদিকে স্পর্শী নজর দেয় না। কেয়া এইবার তাড়া দিয়ে বলে, “অনেক কথা হলো, এইবার উঠ তাড়াতাড়ি। নির্বাণ স্যার যদি একবার ধরতে পারে আমরা কাজে ফাঁকি দিচ্ছি তাহলে আমরা ফিনিশড বস।”
সকলে কেয়ার কথায় সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়ে, এগিয়ে যায় বাহিরের দিকে। এমন সময় স্পর্শীর মেসেজ টোন বেজে উঠে। স্পর্শী হাতে থাকা মুঠোফোনের দিকে একনজর বুলায়।
“অনুষ্ঠান শেষে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসবে। তোমার সাথে কথা আছে আমার।”
অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা এই মেসেজটা দেখে ক্ষণেই স্পর্শীর ভ্রু কুঁচকে আসে। অন্তর্নিহিত মস্তিষ্ক বুঝে উঠতে পারলো না বার্তাটির প্রেরক কে? পুনরায় মেসেজ টোন বেজে উঠতেই দৃষ্টি গিয়ে থমকালো স্ক্রিনে।
“আমি নির্বাণ।”
মেসেজটা আনমনে পড়া মাত্র স্পর্শী থমকে যায়। বিস্ময়ে চোখ কোটর হয়ে আসে তার।
ক্লান্ত অপরাহ্ণে পরিবেশ খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। বাতাসেও ছেঁয়ে আছে অলসতা৷ সূর্যও নিস্তেজ হয়ে হেলে পড়েছে পশ্চিমা আকাশে। ভ্যাপসা গরমের এই বিকেলে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েই মিনিট দশেক হলো স্পর্শী নির্বাণের গাড়ির ভিতর বসে আছে। অথচ নির্বাণের কোন খবরই নেই। গাড়ি খোলা রেখে কোথায় গিয়েছে কে জানে? প্রচন্ড গরম লাগা সত্ত্বেও গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে রেখেছে সে, যাতে তাকে কেউ দেখে না ফেলে। এসি যে অন করবে সেই উপায়ও নেই। বিতৃষ্ণায় এইবার মুখ ঘুচে এলো স্পর্শীর। মনে মনে ঠিক করলো, আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে এরপরও যদি নির্বাণের দেখা না মিলে তাহলে সোজা বাসায় চলে যাবে।
কথাটা আনমনে আওড়িয়ে মাথাটা সিটে এলিয়ে দিল। আঁচলটা ধরে সামনে টেনে এসে কপাল ও গলার ঘামটুকু মুছে বাতাস করতে থাকলো। নয়ন দু’টির কপাট বন্ধ করে অপেক্ষারর প্রহর গুনতে থাকলো। মিনিট দুই-এক না গড়াতেই গাড়ির দরজা খুললো,কেউ এসে বসলো তার পাশের সিটে। শব্দ পেয়ে স্পর্শী তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকালো। সামনে নির্বাণকে দেখামাত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। নির্বাণ একপলক তাকালো স্পর্শীর ঘর্মাক্ত মুখশ্রী পানে। নাকের ডগায় মুক্তার ন্যায় ঘামের বিন্দুগুলো চিক চিক করছে। চোখের নিচের কাজল খানিকটা লেপ্টে আছে, গাঢ় রঙের লিপস্টিকটি কিনার দিয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ছড়িয়ে গিয়েছে। হঠাৎ নির্বাণের মনে নিষিদ্ধ এক ইচ্ছা নাড়া দেয়। তার ইচ্ছে করে স্পর্শীর নিকটস্থ হয়ে খুব সপ্তপর্ণে লেপ্টে যাওয়া কাজলটুকু মুছে দিতে। ছড়িয়ে যাওয়া লিপস্টিকটুকু আরেকটুকু ছড়িয়ে দিতে। ইচ্ছেগুলো মাথা চাড়া দিতেই নির্বাণ দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলে, নিজেকে নিজেই ধিক্কার জানায় এই অশোভন চিন্তা ভাবনার জন্য। প্রখর ব্যক্তিত্বের যেন আজ কলঙ্ক লেগে গেল।জীবনে এই প্রথমবারের মত কোন কলঙ্ক লাগলো তার গায়ে। আগে তো কখনো এমন ইচ্ছা জাগে নি তার মনে, তাহলে আজই কেন? মন আজ এত বেহায়াপনা করছে কেন?
ভাগ্যিস! সামনের মানুষটি তার মনের কথা শুনতে পায় না। না-হলে কি এক বিড়ম্বনাতেই না পড়তো হতো তাকে। স্বচ্ছ চরিত্রের প্রতিচ্ছবি হয়তো ধূলিসাৎ হয়ে যেত।
“কি ভাবছেন এত?”
স্পর্শী অকস্মাৎ প্রশ্নে নির্বাণ চোখ খুলে তাকায়। নিজেকে স্বাভাবিক করেই বলে,
“কিছু না।”
কথাটা বলে নির্বাণ ইঞ্জিন স্টার্ট করলো। এসিটা দ্রুত অন করে, পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। ক্ষণেই হিম শীতল বায়ু স্পর্শীর গায়ে পরশ বুলাতে শিথিল হয়ে পড়ে শরীর। স্পর্শী মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আমার সাথে আপনার কি যেন কথা ছিল?”
নির্বাণ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে, “হুম ছিল, তবে এইখানে নয়।”
স্পর্শী কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কোথায়?”
“গেলেই দেখতে পাবে।”
কথাটি বলা শেষ হতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। স্পর্শী এইবার আর পাল্টা প্রশ্ন করলো না, নীরবেই গা-টা এলিয়ে দিল সিটে।