চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৬

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৬
Writer Asfiya Islam Jannat
“কে কার চোখের বিষ আর কে কাকে দেখতে পারে না শুনি?”
কথাটা কর্ণগোচর হতেই সকলে পিছন ফিরে, দৃষ্টির সম্মুখে নির্বাণকে দেখেমাত্র ভড়কে উঠে। নিজেদের বিস্ময় সামলে তারা কোনমতে তড়িঘড়ি করে নির্দিষ্ট স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। স্পর্শীও উঠে দাঁড়ায়, বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নির্বাণের দিকে। এই মূহুর্তে সে নির্বাণকে এইখানে আসা করেনি। আশঙ্কার মাঝে আছে সকলেই, নির্বাণ কোথা থেকে কতটুকু শুনেছে কে জানে? যদি সবটাই শুনে থাকে? ভয়ে সকলের জবুথবু অবস্থা প্রায়।
নির্বাণ একপলক সকলের দিকে তাকিয়ে নিধির দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়, “বল! কি যেন বলছিলে? কে কার চোখের বিষ? “
নিধি  অস্ফুটস্বরে বলে, “ক..কেউ না তো স্যার, এমনি বলছিলাম আমি।”
কথাটা বলে নিধি কিঞ্চিৎ হাসার করে। পরক্ষণেই নির্বাণের অভিব্যক্তি দৃঢ় হয়ে আসে। সে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় নিধির দিকে। নিরংশু কন্ঠে বলে, “অহ আচ্ছা।”
কেউ আর প্রত্যুত্তর করলো না, মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। নির্বাণ এইবার বোর্ডের সামনে যায়, মাইক হাতে নিয়ে কয়েকটা ফাঁকা বারি দেয় তার উপর। পরমুহূর্তেই সম্পূর্ণ ক্লাসের মনোযোগ নির্বাণের উপর এসে স্থির হতেই সে গলা পরিষ্কার করে আগতপ্রায় অনুষ্ঠান সম্পর্কিত ধারণা ও নির্দেশনা দিয়ে বলে,
“অনুষ্ঠান যেহেতু অতি নিকটে সেহেতু তোমাদের মধ্যে কাজগুলো আমি এখনই ভাগ করে দিচ্ছি। ভালো ভাবে কাজগুলো বুঝে নিবে। আমি কিন্তু কোন ধরণের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবো না। তাই সাবধান! মন দিয়ে কাজ করবে, কোন প্রকার হেলা করবে না।”
সকলে একপ্রকার ভয়েই মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। এরই মাঝে তাপসি এসে হাজির হয় রুমে।  সে এবং নির্বাণ পরস্পরের মাঝে কাজের বিষয়টা আলোচনা করে, কয়েকটা দল গঠন করে তাদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেয়। তাপসি অন্য এক গ্রুপকে বুঝাতে ব্যস্ত হলে নির্বাণ স্পর্শীদের কাছে এসে ওদের উদ্দেশ্যে বলে, “তোমাদের ব্যাক স্টেজের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সেখানের সবকিছু তোমরা সামলাবে। আর এই অনুষ্ঠানে কে কি করছে তার সম্পূর্ণ লিস্ট আমাকে আজকে সন্ধ্যার মধ্যে দিবে। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”
স্পর্শীরা স্মিত হেসেই সম্মতি জানায়। কেন না, এইখানে কাজ করতে ইচ্ছুক না-হলেও কিছু করার নেই। তারা বাধ্য নির্বাণের কথা শুনতে।
সায়াহ্নের শেষ প্রহর। পুঞ্জিভূত মেঘের আড়ালে রক্তিমা আকাশে হরিদ্রা সূর্যটির প্রায় ডুবি ডুবি অবস্থা। বাতাসে তখনও তপ্ততা বিরাজমান, গরম পড়েছে বেশ। মাহিন পকেট থেকে রুম বের করে কপালের ঘামটুকু মুছলো। নীরবে অডিটোরিয়ামের এক কিনারে বসে পুনরায় নিজের করা লিস্টের দিকে ভালোমত চোখ বুলালো। কাপালে ঈষৎ ভাঁজ, মনে ভয়। লিস্টের কোথাও কোন ভুল নেই তো? তার থেকে এক হাত দূরত্বেই কেয়া আর স্পর্শী তাদের কাজ নিয়ে কথাবার্তা বলছে। আরও তিন-চার আছে তাদের সাথে কিন্তু কাজের দরুণ তারা বেশ দূরত্বেই অবস্থানরত আছে। বাকিরা কাজ শেষ করে আগেই চলে গিয়েছে। হঠাৎ নিধি ধুপধাপ পায়ে এগিয়ে আসে, হাতে থাকা কিছু কাপড়ের কুণ্ডলী মেঝেতে ফেলে দিয়ে মাহিনের পাশে বসে পড়ে। হায়-হুতাশ করতে করতে একটু জোরেই বলে,
— হিটলারের জ্বালায় আর বাঁচলাম না রে। এইবার আমি সত্যি মরেই যাব। একদম ফিনিশ! এত কাজ দুইদিনের মধ্যে কিভাবে সম্ভব? চব্বিশ ঘণ্টার জায়গায় ছাব্বিশ ঘন্টা খেটেও তো পারুম না।
নিধির উচ্চরোল কন্ঠ দূরত্বে অবস্থিত ছেলে-মেয়েদের কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হতেই তারা নিধির দিকে ঘুরে বাঁকা চোখে তাকায়৷ মাহিন তা দেখে নিধির মাথায় চাপড় মেরে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,
— এমন বাঁশ গলা কেন তোর? গলার স্বর একটু নিচু করা যায় না? বুঝে-শুনে কথা বল একটু, তোর জন্য কবে না জানি নির্বাণ স্যারের হাতে বাঁশ খাই।
নিধি মন্থর কন্ঠে বলে, “আমি কি ওদের খেয়াল করে বসে আছি নাকি? আজীব!”
মাহিন বিরবির করে বলে, “তা দেখবি কেন, বেদ্দব?”
এর মাঝেই স্পর্শী আর কেয়া ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিধি ওদের দেখে বলে, “আমি নিশ্চিত হিটলারে আমার পুরো কথাই শুনছিল৷ তাই তো আমাদের এখন গাধার মত খাটাচ্ছে৷ এত কাজ কেমনে করে মানুষ? আমি বাসায় যামু ভাই। ভাল্লাগেনা আর!”
কেয়া রোষা কন্ঠে বলে, “স্যার শুনেছি কি-না জানি না তবে তুই যদি এখন তোর ভ্যাদভ্যাদানি অফ না করিস আই সোয়ের তোকে আমি এখন একটা আছাড় মারবো।”
“এমনে বলিস কেন? তোর কি মায়া হয় না আমার উপর?”
মাহিন বিরক্তিকর কন্ঠে বলে, “মাথা খাইস না বইন। এমনেই কাজের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে আছি। হিটলার আর লেডি হিটলারের জ্বালায় জীবন তেজপাতা আমার।”
কেয়া ফাজলামো করে বলে, “তবে দুইজনের বিয়ে হলে সেই হবে রে। এক হিটলার আরেক হিটলারেই টাইট দিতে পারবো।”
নিধি নাক কুঁচকে বলে, “কিন্তু ভবিষ্যতে যে হিটলারের বংশধর হইবো তার কি? পরে তো আমার নাতি-নাতনিটির জান খাইবো। যেমন এখন আমার খাইতাসে।”
স্পর্শী কথাটা শুনে নিধির দিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকায়, “হইসে থামবি তোরা? আমার আর ভাল্লাগতাসে না।”
কেয়া হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,  “তোর আবার কি হলো?”
স্পর্শী মুখ ঘুচে বলে, “কিছু না।”
কেউ আর এই বিষয় নিয়ে এত একটা ঘাটলো না, চুপ হয়ে গেল। অতঃপর যে যার মত কাজ গুছিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলো। হঠাৎ মাহিন স্পর্শীর কাছে এসে বলে, “স্পর্শী এই লিস্টটা তুই একবার চেক কর তো। সব ঠিক আছে কি-না দেখ। কোন কিছু বাদ পড়ে নাই তো? আমি বুঝতাসি না।”
স্পর্শী লিস্টটা হাতে নিয়ে ভালোমতো একবার চোখ বুলায়, “ঠিকই তো লাগছে।”
 “তাহলে একটু কষ্ট করে স্যারকে গিয়ে একটু দিয়ে আয় না। আমি এখন বাসায় যাব রে, আর্জেন্ট কাজ আছে।”
স্পর্শী ইতঃস্তত কন্ঠে বলে, “কিন্তু…”
“যা না প্লিজ। লিস্টটা স্যারকে দিয়ে তুই একবারে বেরিয়ে যাইস। আমারও এখন চলে যাব।”
স্পর্শী কিছু বললো না। দৃষ্টির অগোচরেই তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো।
টিচারস রুম এখন প্রায় ফাঁকা। দুই-তিন টিচার বাদে কেউ নেই বললেই চলে। সাধারণ এই সময় ভার্সিটি পুরো ফাঁকা থাকলেও অনুষ্ঠানের কার্যবলীর জন্য এখনো জনমানবহীন হয়নি পরিবেশ। স্পর্শী গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়ায় রুমের সামনে, হালকা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে কে কে আছে রুমে। নির্বাণ ব্যতীত রুমে আরও দুইজন টিচারকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্পর্শী। অতঃপর মৃদুস্বরে অনুমতি চায় ভিতরে আসার। অনুমতি পাওয়ার পর মুহূর্তেই স্পর্শী ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নির্বাণের দিকে। নির্বাণ তখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ দেখতে ব্যস্ত। স্পর্শী নিঃশব্দে নির্বাণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, লিস্টটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে, “স্যার আপনি যে লিস্টটা চেয়েছিলেন। দেখেন সব ঠিক আছে কি-না।”
নির্বাণ চোখ তুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় স্পর্শীর পানে। অতঃপর ওর হাত থেকে লিস্টটা নিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সেটা। এরই মাঝে বাকি দুইজন টিচার কোন এক কাজে উঠে বাহিরে চলে যায়। রয়ে গেল শুধু স্পর্শী আর নির্বাণ। স্পর্শী সেটা আড়চোখে খেয়াল করলেও বাহিরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না দেখালেও ভিতরে ভিতরে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো। পুরো রুম জুড়ে তখন অন্যরকম নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুক্ষণ পর নিসাড় পরিবেশটাকে অবকাশ দিয়ে নির্বাণ বলে, “হ্যাঁ সব ঠিক আছে।”
স্পর্শী গোপনে ছোট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “আচ্ছা। তাহলে আমি এখন আসি?”
নির্বাণ কিছু না বলে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্পর্শীর পানে। স্পর্শীর এতে বেশ অস্বস্তিবোধ করে। সে এক হাতের মুঠোয় আরেক হাত পুরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। মানুষটার সামনে আসলেই এখন তার যত অস্বস্তি, উৎকন্ঠা,ব্যগ্রতা কাজ করে। আগে তো করতো না, এখন কেন করে কে জানে?
হঠাৎ নির্বাণ বলে উঠে, “রাত হয়ে এসেছে প্রায়। তুমি পার্কিং-এ গিয়ে অপেক্ষা কর, আমি বাসায় নামিয়ে দিচ্ছি।”
কথাটা কর্ণধারে এসে বারি খেতেই স্পর্শী কিছুটা ভড়কে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে, “তার দরকার নেই। আমি যেতে পারব।”
নির্বাণ তীক্ত কন্ঠে বলে, “জিজ্ঞাসা করিনি আমি। চুপচাপ গিয়ে দাঁড়াও, আসছি আমি।”
স্পর্শী পুনরায় মানা করতে চাইলেও নির্বাণের দৃঢ় দৃষ্টি দেখে কিছু বলল না। নির্বাণের ব্যবহার সে প্রচন্ড অবাক হলেও অভিব্যক্তিতে তা প্রকাশ করলো না। কোনমতে মাথা হেলিয়ে বাহিরে চলে আসলো।
 বড় রাস্তায় গাড়ি উঠতেই ফাঁকা রাস্তার দেখা মিলে, গতি বাড়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ। হিম অনলের ছোঁয়া পেতেই স্পর্শী খুব সপ্তপর্ণে জানালার কাঁচটা আরেকটু নামিয়ে নেয়। মাথাটা সামান্য হেলিয়ে দেয় জানালার দিকে। পুরো গাড়ি জুড়েই নিদারুণ নীরবতা। বেশ কিছুক্ষণ নিভৃতে,নীরবে কেটে যেতেই নির্বাণ মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আমি মানুষটা কি আসলেই তোমার বড্ড অপ্রিয়?”