চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১৩

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১৩
Writer Asfiya Islam Jannat

ক্লান্ত অপরাহ্নের শেষ প্রহর। হরিদ্রাভ আকাশটি আবৃত সিঁদুর রাঙা মেঘে। বায়ু চলাচলের অভাবে বাড়ির সাথে লাগোয়া কাঠগোলাপের গাছটি নিষ্প্রাণ প্রায়। মাঝে মধ্যে দুই-একটা পাখি উড়াল দিতেই প্রাণোচ্ছল মনে দুলিয়ে উঠছে সে। অকস্মাৎ প্রশান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশটা বিক্ষুব্ধ করলো কেউ। চারদিক কম্পিত করে গাড়ির হর্ণ বাজলো। জানান দিল কারো আগমনের, অপেক্ষার প্রহর যেন তখনই ভাঙলো। হর্ণের আওয়াজ শুনে স্পর্শী মাথায় কাপড় টেনে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। স্থিরচিত্তে এগিয়ে গেল বৈঠকখানার দিকে। কয়েক কদম চলে থমকালো সে, পর্যবেক্ষণিক দৃষ্টিতে চোখ বুলালো আশেপাশে। সবই অপরিচিত মুখ। তবুও অপরিচিত মানুষের ভীড়ে আনমনে খুঁজে বেড়ালো পরিচিত সেই মুখ। অবশেষে অগণিত মানুষের ভীড়ে ক্ষুদ্র ফাঁকের মধ্য দিয়ে দেখা মিললো কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। পরক্ষণেই ঠোঁটের কোনে ঠাঁই পেল সরু এক হাসি, বুক চিরে বেরিয়ে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস।

দিনশেষে রাদিন সাহেবকে সাথে নিয়ে ফিরেছে নির্বাণ। আশেপাশের মানুষদেরও খোঁজ এখনই মিললো। অবশ্য ছোটরা আগেই ফিরে এসেছিল তবে স্পর্শীর ঠিকমতো কথা বলা হয়ে উঠেনি কারো সাথেই। দুপুরের এক ঝলক নির্বাণের মা নিলুফার সাথে দেখা হলেও পরবর্তীতে আর হয়নি। কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য এসে ফ্রেশ হয়ে, সকলের জন্য বৃহৎ আকৃতির টিফিনবক্সে খাবার পুরে নিয়ে যান। এখনই ফিরেন সবার সাথে। উৎকন্ঠা, ব্যগ্রতা, ক্লান্তি স্পষ্ট সকলের মুখপানে। রাদিন যে এই বাড়ির অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মান্য-গণ্য ব্যক্তি তা বুঝার বিকল্প নেই। রাদিন মাথা হেলিয়ে শুয়ে আছেন সোফায়, পাশেই বয়স্ক এক ব্যক্তি গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টি তাকিয়ে আছেন নিচের দিকে। স্পর্শী একপলক তাকালো তার পানে। ভেবে নিল তিনি সম্ভবত নির্বাণের নানাজান। হঠাৎ ভরাট কন্ঠে তিনি বলে উঠেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— কাল রাত থেকে সকলেই অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছ, এখন দিয়ে রেস্ট নাও। আর রাদিনকে ওর রুমে শুয়ে আসো।
ভীড়ের মাঝেই একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি বলে উঠেন, “আচ্ছা আব্বা।”
বয়স্ক ব্যক্তিটি উঠে নিজ রুমে চলে যেতেই বাকিরাও ধীরে ধীরে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। নির্বাণ, নাহিদ ও আরও একজন মিলে রাদিনকে নিজ পৌঁছে দিলেন। স্পর্শী সবই রুমের এককোনে দাঁড়িয়ে দেখলো কিন্তু কোন শব্দ করলো না৷ আসলে এই মুহূর্তে তার কি বলা বা করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারলো না। কিছু মুহূর্ত নীরবেই কেটে যেতে নিলুফা এসে দাঁড়ান স্পর্শীর নিকটে। হাতের তর্জনী দিয়ে নাকের ডগা থেকে চশমাটা পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে মন্থর কন্ঠে বলে,
— তখন তাড়ায় ছিলাম বলে খোঁজ-খবর নিতে পারিনি। তোমার এইখানে থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো? খাওয়া-দাওয়া করেছ ঠিক মত?

স্পর্শী হ্যাঁ-সূচক মাথা দুলিয়ে বলে, “জি মা।”
“জানি সবই অচেনা তোমার। তবে পরিবেশটা এখন প্রতিকূলে বুঝতে পারছো। সব ঠিক হোক আমি ধীরে-সুস্থে সকলের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিব।”
স্পর্শী নিচু কন্ঠে বলে, “সমস্যা নেই মা। আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে, আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।”
“হুম যাচ্ছি। তুমিও এখন রুমে যাও।”
স্পর্শী আলতোভাবে মাথা নাড়লো। নিলুফা চলে যেতেই স্পর্শীও ঘুরে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল তার জন্য বরাদ্দ করা রুমের দিকে।

বিছানার উপর পা তুলে বসে আনমনেই ফেসবুক স্ক্রোল করছে স্পর্শী। কখনো বা ইন্সটাগ্রামে চক্কর দিয়ে ইউটিউবে ঢুকছে। মন বসছে না কিছুতেই। অবশেষে বিতৃষ্ণায় ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে পাশে ফোনটা ফেলে দিল স্পর্শী। পরিচিত মানুষগুলোও আজ নামের পাশে সবুজ বাতিটি জ্বালাতে নারাজ, সময় যেন আজ এগুতেই চাইছে না। স্পর্শী বিরক্তিতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, গভীর দৃষ্টিতে তাকালো ওয়াশরুমের দরজার দিকে। ভিতর থেকে এখনো টাপুরটুপুর পানির শব্দ আসছে। স্পর্শী দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলো একবার, প্রায় এক ঘন্টার বেশি হতে চললো নির্বাণ ওয়াশরুমে। বের হওয়ার নাম গন্ধ নেই তার। স্পর্শী বিরবির করলো,

“এই মানুষটা এতক্ষণ লাগিয়ে ওয়াশরুমে করছেটা কি? সোনারতরী খুঁজে পেয়েছে নাকি ভিতরে? এত সময় তো মেয়েদেরও লাগে ন..”
কথাটা শেষ হওয়ার পূর্বেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে নির্বাণ বেরিয়ে এলো। সিক্ত গায়ে কালো রঙের টি-শার্টটি আঁটসাঁট হয়ে আছে। মাধুর্য বাড়াচ্ছে স্নিগ্ধ মুখের। চিবুক গড়িয়ে আধো ভেজা চুলগুলো থেকে পানি পড়ছে টিপটিপ করে। একহাতে তোয়ালে ধরে কোনরকম চুলগুলো মুছে নিচ্ছে সে। হাব-ভাব এমন কোনমতে এই কার্যক্রিয়া শেষ করে বিছানায় যেতে পারলেই হয়। নির্বাণ কোনরকম চুলগুলো মুছে তোয়ালেটা সাইডে রাখা একটা চেয়ারের উপর মেলে দিল। অতঃপর কোনদিক না তাকিয়ে সোজা স্পর্শী পাশে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। দৃষ্টিতে ক্লান্তি ভর করা মাত্র আঁখিপল্লবের কপাট বন্ধ করে নিল। হঠাৎ নির্বাণ পাশে এসে শুয়ে পড়তেই স্পর্শী কিছুটা ভড়কে উঠে। পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে বলল,

“আপনার জন্য আলিয়া মামী একগ্লাস শরবত দিয়ে গিয়েছিলেন। এনে দেই,খাবেন?”
নির্বাণ চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় বলে, “এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আমার জায়গায় না-হয় তুমি খেয়ে নাও।”
“আমি খেয়েছি। দুইজনের জন্যই দিয়ে গিয়েছিল।”
নির্বাণ ক্লান্ত স্বরে উত্তর দেয়, “অহ আচ্ছা। তুমি দুপুরে খেয়েছিলে?”
“হুম! আপনি খেয়েছিলেন?”

“না।”
স্পর্শী অবাক হয়ে বলে, “এখনো খান নি কেন?সেই সকালে খেয়েছিলেন তো।”
নির্বাণ ছোট করে বলে, “সময় পায়নি।”
“তাহলে কিছু খেয়ে না-হয় ঘুমান।”
“উহু!”
স্পর্শী আর কথা বাড়ালো না, নীরব থাকলো। অতঃপর বাহির থেকে স্পর্শীর জন্য নিলুফার ডাক পড়তেই স্পর্শী একপলক নির্বাণের পানে তাকিয়ে স্থিরচিত্তে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

রাতে খাবারের পর্ব আজ দ্রুতই চুকে গিয়েছে। সকলে ক্লান্ত থাকায় আগে ভাগেই খেয়ে ঘুমোতে চলে গিয়েছে। নিলুফা আজ চাইছিলেন সকলের সাথে স্পর্শীর পরিচয়টা ভালোভাবে করিয়ে দিতে কিন্তু সকলের অবসন্ন, বিষণ্ণ ভাব দেখে দমে গেলেন তিনি। ভাবলেন, পরিস্থিতি ঠিক হলে এইসব করা যাবে। শুধু সবাইকে এতটুকুই জানালেন স্পর্শী তার বড় বউ। অতঃপর নির্বাণের কাজিন মাহিনের বিয়ে নিয়ে আলোচনা উঠে৷ রাদিন সাহেবের সুস্থ হতে কিছুটা সময় প্রয়োজন বিধায় তারা কনে পক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনা করে বিয়েটা পিছিয়ে নেন। সকল গুরুত্বপূর্ণ কার্যলাপ শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়েই যে যার রুমে ছুটে সামান্য বিশ্রামের আশায়।

দ্রুত ঘুমানোর অভ্যাস না থাকায় স্পর্শী নিজের মুঠোফোনে দৃষ্টি স্থির করলো। নির্বাণ তার প্বার্শেই শুয়ে আছে। মাঝে মধ্যে এপাশ-ওপাশ করে মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর বিরক্তিতে মৃদু শব্দ করছে৷ স্থির থাকতে চাইছে কিন্তু কোন এক কারণ বসত পারছে না। নির্বাণের এমন কার্যক্রম স্পর্শীর দৃষ্টিতে ধরা দিতেই স্পর্শী মুঠোফোনটা বন্ধ করে বালিশের পাশে রেখে দিল। মিইয়ে যাওয়া স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কি মাথা ব্যথা করছে?”
নির্বাণ অস্ফুটস্বরে বলে, “হু!”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১২

কথাটা বলে বেশ কিছুক্ষণ নিভৃতে কেটে যাওয়ার পরমুহূর্তেই নির্বাণ স্পর্শীর দিকে ঘুরে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলো। আধো আধো কন্ঠে বলে, “মাথা ধরেছে খুব, চুলগুলো একটু টেনে দিবা?”
নির্বাণের এহেন কান্ডে স্পর্শী চমকালো। বেশ চমকালো। সর্বাঙ্গ জুড়ে বয়ে গেল অজানা শিহরণ, হিম হয়ে আসলো হাত-পা। ঈষৎ কাঁপনও ধরলো। মুখের খেই হারিয়ে শুধু ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তবে নির্বাণের আদুরে আবদারটি মনে সূঁচের ন্যায় বিঁধলো। নাকচ বা উচ্চবাক্য ব্যবহার করতে পারলো না নির্বাণের বিপরীতে৷ খানিকটা ইতস্তত করেই নীরবে হাত টেনে নিয়ে গেল নির্বাণের চুলের দিকে, খুব সপ্তপর্ণে চুলগুলো টেনে দিতে লাগলো। মাথায় নরম হাতের স্পর্শ পেতেই নির্বাণের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো কিঞ্চিৎ হাসির রেখা। আনমনেই প্রস্তুতি নিল প্রগাঢ় তন্দ্রায় ডুব দেওয়ার।

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১৪