চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১৪

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১৪
Writer Asfiya Islam Jannat

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে কিঞ্চিৎ প্রহর পূর্বে। হিম অনলে স্নিগ্ধ পরিবেশ। পাখির কিচিরমিচির শব্দ গুঞ্জিত হচ্ছে বৃক্ষের আঁকেবাঁকে। সাধারণ দিনকার তুলনায় আজ ঘুমটা আগেই ছুটে গেল স্পর্শীর। নিজ থেকে নাকি পাখির মিষ্ট ধ্বনিতে তা বলা মুশকিল। চোখ ভর্তি ঘুম নিয়েই পিটপিট করে চাইলো সে। ঈষৎ নড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে অনুভব হলো সে কারো দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। ভ্রু কুঁচকে এলো তার, চোখ টানটান করে তাকালো৷ নির্বাণ বিগত রাতের ন্যায় ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। গভীর তন্দ্রায় বিভোর সে। নির্বাণকে নিজের নিকটে দেখে মুহূর্তেই এক মুঠো রক্তিম আভা ছেঁয়ে গেল স্পর্শীর মেদহীন গালে। লজ্জায় দৃষ্টি নত করলো সে। নীরবেই একবার নিজের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করলো।

কাল নির্বাণের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কখন যে বসে থাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তার জানা নেই। মাথাটা বোধহয় দীর্ঘ রাত্রী যাবৎ একপাশে হেলেই ছিল। যার দরুন এখন মেরুদণ্ড ও ঘাড়ের চারিপাশে সুক্ষ্ম ব্যথার আবির্ভাব হতে শুরু করেছে। স্পর্শী এক্সারসাইজ করার মত আলতো ভাবে কয়েকবার ঘাড় দু’দিকে কাত করলো। ব্যথা কমলো না, আগের ন্যায় রইলো। স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের পানে। ঘুমন্ত অবস্থাতে বড্ড নিষ্পাপ লাগছে তার মুখখানি। আদুরে বাচ্চাদের মত ঠোঁট ফুলিয়ে আছে সে। ঘন চুলগুলো প্রচন্ড এলোমেলো। ঘুমের মাঝেই চোখের পাতা ঈষৎ নড়ছে। স্পর্শী নিভৃতেই মুচকি হাসে। আনমনেই হাত বাড়িয়ে নির্বাণের এলোমেলো চুলগুলো বিন্যস্ত করার ক্ষীণ চেষ্টা চালালো। অকস্মাৎ নির্বাণ নড়েচড়ে উঠে স্পর্শীকে আরও নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে দিতে সে অনুভূতির শিহরণে পুরো জমে গেল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রখর কাঁপন ধরলো সর্বাঙ্গে। লজ্জায় কুঁকড়ে গেল মন,হৃদয়। বেশ কিছুক্ষণ সময় শব্দহীন কেটে যাওয়ার পর স্পর্শী স্বাভাবিক হয়। আপন ভাবনায় ডুব দিল সে, মিলাতে চেষ্টা করলো কিছু সমীরণ। অবাক হলো নিজের কর্মকাণ্ডেই। যেখানে রুদ্রের সাথে রিলেশনে থাকাকালীন সে কখনো রুদ্রকে তার হাত পর্যন্ত ধরতে দেয়নি। রুদ্র হাত ধরতে চাইলে স্পর্শী কড়া বাক্য শুনাতে পিছ পা হতো না, সেখানে আজ এই মানুষটা তাকে এইভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে তাও সে টু শব্দ পর্যন্ত করছে না। কেন? উত্তর পেল না স্পর্শী। তবে সে বেশ বুঝতে পারছে আজ তার হৃদয় অজানা এক ভালো লাগায় বন্দী।

রুদ্রের সাথে থাকাকালীন কখনোই তার এইরকম অনুভূতি হয়নি যেমনটা নির্বাণের সাথে হয়। নির্বাণের নামমাত্র এখন তার হৃদস্পন্দন তড়িৎ বেগে লাগাতে শুরু করে। ভালো লাগা যেন জোয়ার বয়ে আনে। নিজের মধ্যে পরিবর্তনগুলী দেখে স্পর্শী নিজেও বিস্মিত, বিমূঢ়,হতবাক। তার নিজের কাছে করা প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর নেই একটিরও। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। কিছুক্ষণ নির্বাণের পানে তাকিয়ে থেকে জানালার বাহিরে তাকালো। সূর্যের উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে, বেলা বাড়ছে। স্পর্শী এইবার খুব সতর্কতার সাথে নির্বাণের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। খেয়াল রাখলো কোনভাবে যেন নির্বাণের ঘুম না ভাঙ্গে। মানুষটাকে আরও কিছু প্রহর শান্তিতে ঘুমাতে দিতে চাইছিল নাকি এমন অবস্থায় তার সামনে বিড়ম্বনায় পড়তে চাইছিল না বলে এই চাওয়া পোষণ করা সেটা স্পর্শীই ভালো জানে।

নির্বাণকে পাশে শুয়ে দিয়েই বিছানা ছাড়লো স্পর্শী। ঢিলে হয়ে আসা হাতখোপাটা খুলে পুনরায় ভালোমত হাতখোপা করে নিল। নিজের জামাকাপড় ঠিকঠাক করে চলে গেল ওয়াশরুমে।

সকালের নাস্তা শেষে ড্রয়িংরুমে বাড়ির মধ্যস্থ,যুবতী,কিশোরীর দল গোল করে বসলো স্পর্শীকে ঘিরে। বিভিন্ন কথার আসর বসেছে ওকে নিয়েই। স্পর্শী নম্রতার সাথেই সকল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। সকালে উঠার পর পরই নিলুফা বেগম ধীরে ধীরে সকলের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। যার দরুন, কিছু ঘন্টার ব্যবধানেই সে কৌতূহলের বস্তু হয়ে উঠেছে ছোট-বড় সকলের জন্য। দীর্ঘ সময় তাদের মাঝে থাকার পর, তাদের কথার প্রেক্ষিতে স্পর্শী যতটুকু জেনেছে তা হলো,
নির্বাণের মা নিলুফা বেগমরা চার ভাইবোন। তিনি বংশের তৃতীয় সন্তান। বড় দুইজন ভাই হচ্ছেন রাদিন আর রাসেল। ছোট জনের নাম ইমদাদুল। তিন ভাই একত্রেই বউ,বাচ্চা নিয়ে তাদের বাবা সমীর শেখের ছায়াতলেই থাকেন। তাদের মা মারা গিয়েছেন কয়েক বছর পূর্বেই। ছোটজন চাকুরীজীবী হলেও বাকি দুইজন সমীর শেখের সাথেই হটেলের ব্যবসায় নিয়জিত। অবশ্য, নিলুফাও তার বাবা এবং ভাই রাদিনের সাথেই ব্যবসায় আছেন। সেই সূত্রে কয়েকটি রেস্তোরাঁর মালিকানা এখন তারই হাতে। তবে, নির্বাণের বাবাকে নিয়ে কেউ তেমন কিছু তথ্য দেয় নি। কথায় কথায় নির্বাণের বাবাকে কথা উঠলেও মুহূর্তেই তা নিলুফা সুক্ষ্মভাবে নিজের কথার ভাঁজে ঘুরিয়ে ফেলেন। অর্ধ-আর্ধ তথ্যে স্পর্শী পড়ে যায় ধোঁয়াশায়। সাথে কিছুটা সন্দেহ হয় নিলুফা কিছু লুকাচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তী আর আমলে নেয় না বিষয়টা। অন্যদের দিকে মনোযোগ স্থির করে।

আড্ডা মাঝে ইমদাদুলের স্ত্রী রোকেয়া কিছুটা ঠেশ্ দিয়েই বলেন, “মেয়ে দেখতে মাশাআল্লাহই তবে গায়ের রং একটু চাপা। আমার ভাইয়ের মেয়ের কথা বলেছিলাম না তোমায় নির্বাণের জন্য? ওর চামড়া এর চেয়ে বেশ পরিষ্কার ছিল। দেখতেও তো পরীর চেয়ে কম ছিল না। কিন্তু তুমি গুরুত্ব দিলা না। ওকে কিন্তু আমাদের নির্বাণের পাশে ভালোই মানাতো।”
কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র মন ক্ষুণ্ণ হলো স্পর্শীর। আঁধার নামলো মুখে। খুবই কষ্টে ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা সৌজন্যমূলক হাসিটুকু বিলীন হতে দিল না। স্থীর রাখলো। তার গায়ের রঙ অতিরিক্ত চাপা না হলেও ছোট থেকে প্রায় সই এই নিয়ে ব্যঙ্গার্থ উক্তি শুনতে হয়েছে। তখন খনিকের জন্য মন খারাপ হলেও এতটা খারাপ লাগেনি যতটা না আজ লাগছে। এত মন খারাপের উৎস সে জানে না৷ হতাশা জড়িত নিঃশ্বাস ফেলে সে আড়চোখে তাকালো নিজের শ্বাশুড়ি নিলুফার দিকে। নিফুলার মুখে ছেঁয়ে আছে কাঠিন্য ভাব। হাতের তর্জনী উঠিয়ে নাকের ডগা হতে চশমাটা পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলল সে, “আমার ছেলে তো আর অসাধারণ বা চাঁদের টুকরা না যে পরীর মত বউ আনবো। অতি সাধারণ একজন। তাই ওর সাথে মানানসই অতি সাধারণ বউ-ই ঘরে তুলেছি।”

নিলুফার কথার সুক্ষ্মতায় কারো মুখে আর খেই রইলো না। নীরব হলো পরিবেশ। স্পর্শীও বিস্মিত নয়নে দেখলো নিলুফাকে। সাথে তার পক্ষ নেওয়ায় কিছুটা খুশিও। এই কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে সে বুঝে গিয়েছে তার শ্বাশুড়ি মোটেও কোন নরম ব্যক্তির মানুষ নন। অত্যান্ত প্রখর,সূঁচালো ব্যক্তিত্বের অধিকারী সে। কখন কাকে কিভাবে মোক্ষম জবাব দিতে হয় তা ভালো করেই জানেন সে।
নিলুফার কথায় রোকেয়া কিছুটা নিভে গেলেও প্রকাশ করলো না। বরং কথা ঘোরানো জন্য বলল, “আপা আমি তো এইভাবেই বলেছিলাম কথাটা। কিছু মনে করবেন না।”

নিলুফা কিছু বললেন না। নীরবেই তার অভিব্যক্তি নরম করলেন। পুনরায় সকলে কথাতে মশগুল হলো। হঠাৎ স্পর্শীর চোখ গিয়ে আটকালো দরজার দিকে। নির্বাণ আর নাহিদ একত্রে বাসার ভিতর ঢুকছে, হাতে কিছু ঔষধ-পত্র আর টুকটাক জিনিসপত্র। দুই ভাইকে আসতে দেখে বৈঠকখানার আসর ভাঙ্গে৷ বড় কয়েকজন উঠে নির্বাণের থেকে জিনিস বুঝে নিয়ে চলে রান্নাঘরের দিকে। অন্যরা চলে যায় নিজ নিজ কাজে বা রুমে। ছোটরা ছুটে পিছনের বাগানতলীতে। থেকে যায় শুধু নিলুফা, স্পর্শী আর এই বাড়ির বড় বউ হামনা। রাদিনের স্ত্রী। নির্বাণ তারই কাছে এসে ঔষধের ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে ঔষধের সময়সূচিগুলো সম্পর্কে অবগত করতে থাকে।
নাহিদ টেবিলের উপর পলিথিনে মোড়ানো ব্যাগটি রেখে ধপ করে বসে স্পর্শীর পার্শ্বেই। গলার কাছে টি-শার্টটি সামনের দিকে টেনে ধরে বুকে মধ্যে ফুঁ দিতে দিতে বলে, “আল্লাহ! কি গরম। গরমে তো শিক কাবাব হতে গেলাম। ঠান্ডা পানি দিতে বলো তো মা।”

নিলুফা নাহিদের কথা শুনে বলে, “তোর মেজো মামী শরবত বানাতেই গিয়েছে। অপেক্ষা কর।”
নাহিদ বা হাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে কপালে সোজা টান দিয়ে ঘামটুকু একবারে ঝেড়ে ফেলে৷ ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বলে, “আচ্ছা।”
অতঃপর স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বিস্তৃত হেসে বলে, “তা ভাবী কি খবর? কালকে তো আপনার সাথে কথাই বলা হলো না। আমাকে চিনেছেন তো?”
স্পর্শী হালকা হেসে বলে, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আর চিনবো না কেন? আপনি নাহিদ ভাইয়া তাই না?”
“হ্যাঁ! আপনার কুটুশখানি মিষ্টি একটা দেবর। আমাকে ভুলা চলবে নট বুঝলেন।”
স্পর্শী কিঞ্চিৎ হেসে মাথা দুলিয়ে বলল, “বুঝলাম।”

নাহিদ নিদারুণ এক হাসি উপহার দিয়ে বলে, “এইতো আমার কিউট ভাবীটা আমায় বুঝেছে। তা ভাবী, ভাইয়া আপনার উপর অত্যাচার করে না তো? টিচার মানুষ বুঝেনই, রাগ নাকের ডগায় নিয়ে ঘুরে। ভুল হইলেই তো চটাশ চটাশ বেতের বারি বসিয়ে দেয়। ডেভিল একটা! সো বি সেফ ভাবী।”
স্পর্শী কিছু বলতে যাবে তার আগে নির্মাণ নাহিদের দিকে চোখ রাঙ্গানি দিয়ে বলে, “আমি কিন্তু এইখানেই আছি।”
নাহিদ নির্বাণ এর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বলে,
” তো? তুই সামনে আছিস বলেই কি আমার তোর তারিফের ফুলঝুরি বর্ষণ করতে হবে? সত্য বলা ফরজ। এখন সামনে যেই থাকুক।”

নির্বাণ তার সামনে সোফার উপর রাখা কুশনটা নাহিদের মুখের উপর ছুঁড়ে মেরে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “নিজের সত্য কথা নিজের কাছে রাখ। কেউ শুনতে চাই নি।”
অকস্মাৎ বালিশটা ছুঁড়ে মারায় নাহিদ আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়নি। যার দরুন কুশোনটা এসে তার নাকে বারি খায়। নাহিদ ডান হাত দিয়ে নিজের নাক ঘষে বলে, “আমি আগে থেকেই জানতাম তোর আমার উঁচু নাক পছন্দ না। আজ প্রমাণ হয়েই গেল। বালিশ ছুঁড়ে আমার নাক চ্যাপ্টা বানানোর ষড়যন্ত্র করতে লজ্জা করে না তোর?”
নির্বাণ রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো নাহিদের দিকে। আনমনে বিরবির করলো, “এমনেই আমি তার অপ্রিয়। এর মধ্যে এই অপদার্থটায় আবার আগুনে ঘি ঢালার কাজ করতাসে।”

এইদিকে দুই ভাইয়ের কাহিনী দেখে স্পর্শীর দম ফেটে হাসি পেলেও কোনমতে ঠোঁট দু’টো চেপে বসে রইলো। নিলুফা নাহিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “নাহিদ বেশি হচ্ছে।”
নাহিদ এইবার বাধ্য ছেলের মত চুপ হয়ে যায়। তবে বিরবির করে কিছু একটা বলল, কিন্তু কারো কান অবধি সেটা পৌঁছালো না। কথার ফাঁকে আবার রোকেয়া বেগম শব্দহীন ভাবেই জায়গাটি প্রস্থান করেছেন। নির্বাণ এইবার নিলুফার পাশে বসে বলে,
“মা, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“বল।”

“আমি মাত্র তিনদিনের ছুটি নিয়েছিলাম ভার্সিটি থেকে। সে ছুটি তো ফুরিয়ে আসছে, আমি তাহলে এখন ফেরত যাই? কাজ আছে হাতে প্রচুর। পরে অনুষ্ঠানের সময় না-হয় ব্যাক করবো।”
নিলুফা স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “জিনিসটা ভালো দেখায় না,নির্বাণ। তার উপর বড় ভাইজানও এখন অসুস্থ, বড় ছেলে হিসেবে তোমাকেই সব দেখতে হবে। ছুটি বাড়িয়ে নাও, একবারে আমাদের সাথেই যাবে তুমি। আর কাজ থাকলে এইখান থেকে সেটা করার ব্যবস্থা করো।”

নির্বাণ প্রত্যুত্তর করলো না কোন। বাধ্য ছেলের মত নিজের মায়ের মতামত মেনে নিল। স্পর্শী সবটাই সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো। দুই ভাইয়ের মধ্যে তেমন মিল না থাকলেও একটা দিক দিয়ে বেশ মিল। দুইজনই নিজ মায়ের ভীষণ বাধ্য এবং তাকে প্রচন্ড মান্য করে। ভালো লাগলো বিষয়টা স্পর্শীর নিকট।
নির্বাণ এইবার নিজ জায়গায় থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঘামে অর্ধভেজা শরীর নিয়ে এগিয়ে গেল রুমে দিকে। ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন তার। নির্বাণ রুম থেকে প্রস্থান করতেই আলিয়া দুই গ্লাস ঠান্ডা শরবত নিয়ে হাজির হন। এক গ্লাস নাহিদকে ধরিয়ে দিয়ে চারদিকে চোখ বুলান নির্বাণের খোঁজে। নিলুফা তা দেখে বলেন, “স্পর্শী মা, নির্বাণের জন্য শরবতটা ওর রুমে নিয়ে যাও।”
স্পর্শী মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। অতঃপর গ্লাস ভর্তি লেবু শরবত নিয়ে। রুমে আসতেই দেখতে পায় নির্বাণ কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে৷ তৎক্ষনাৎ সে বলে উঠে, “শরবতটা খেয়ে ফ্রেশ হতে যান।”

নির্বাণ পিছন ঘুরে তাকায়। স্পর্শীর হাতে গ্লাস দেখে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, “দাও।”
স্পর্শী গ্লাসটা বাড়িয়ে দেয়। নির্বাণ এক চুমুকে অর্ধেক শরবতটুকু খেয়ে বাকিটা স্পর্শীর দিকে এগিয়ে দেয়। স্পর্শী মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “আর খাবেন না? অর্ধেকটা খেলেন যে?”
“বাকিটা তুমি খাবে।”

শান্ত কন্ঠে বলল কথাটা নির্বাণ। অতঃপর স্পর্শীকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গ্লাসটা ওর ধরিয়ে দেয় আর নিজে চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ নির্বাণ বলে উঠে, “এখন থেকে আমার সবকিছুতে তোমার সমান অধিকার আছে৷ তাই পরবর্তীতে আমি না বললেও নিজের অধিকার আদায় করে নিবে।”
কথাটা বলেই নির্বাণ ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। আর স্পর্শী হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই পানে। অতঃপর ঘটনাক্রমে বুঝতে পেরে স্মিত হাসি ফুটে উঠে অধর দু’টির কোলজুড়ে।

রাদিন কিছুটা সুস্থ হতেই বিয়ের ঢাক-ঢোল আবার বাজতে শুরু করলো। অনুষ্ঠানের দিন-কাল পুনরায় নির্ধারিত হলো। যার দরুন সকাল থেকে সম্পূর্ণ ঘরময় ব্যস্ততার লাইন লেগেছে। পরেরদিনই মাহিনের হলুদসন্ধ্যা, এরপর বিয়ে,বউভাত। ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। বাড়ির ছোট-বড় সকলেই কিছু না কিছু করতে ব্যস্ত। ছোটরা খেলাধুলা করতে ব্যস্ত তো বাড়ির ছেলেরা অনুষ্ঠানের বাহ্যিক কাজে। মেয়েরা ব্যস্ত সাজগোছ আর রান্না নিয়ে। স্পর্শীও যোগ দিয়েছে মেয়েদের দলেই।
সারাদিন প্রায় নিলুফার সাথে রান্নাঘরে কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে একটি রুমের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় রাব্বি সাহেবের ছোট মেয়ে মিশ্মিকে দেখতে পেল স্পর্শী। বিছানার এককোনে চোখে-মুখে আঁধার নামিয়ে বসে আছে সে। হাতে এক ভাঁজে ছোট মেহেদীর কোণটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, আর বিরবির করে কিছু বলছে সে। তা দেখে স্পর্শী এগিয়ে গেল ওর দিকে। স্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে তোমার? মন খারাপ করে বসে আছো যে?”

মিশ্মি দৃষ্টি তুলে অভিযোগের সুরে বলে, “দেখ না ভাবী। সবাই ওইরুমে একেক করে মাহিন ভাইয়ের হলুদের জন্য মেহেদী দিচ্ছে। আমাকেও দিয়ে দিতে বলেছিলাম মেহেদী কিন্তু ওরা ছোট মানুষ বলে আমাকে রুম থেকে ভাগিয়ে দিল।”
“তুমি মেহেদী দিতে চাও?”
মিশ্মি হ্যাঁ-সূচক দুই দিকে মাথা নাড়ালো। স্পর্শী তা দেখে মিষ্টি হেসে বলে, “আমি দিয়ে দেই তাহলে তোমায়?”
কথাটা শোনামাত্র মিশ্মি চোখ দু’টি চকচক করে উঠলো। উৎফুল্ল সুরে বলল সে, “সত্যি তুমি আমায় দিয়ে দিবে? তুমি মেহেদী দিতে পারো?”
“হ্যাঁ পারি। দিয়ে দিব?”

মিশ্মি দ্রুত মাথা দুলিয়ে হাতের ভাঁজে থাকা মেহেদীর কোণটি এগিয়ে দেয় স্পর্শীর দিকে। স্পর্শীও কিঞ্চিৎ হেসে কোণটি নিয়ে মিশ্মিকে মেহেদী পড়িয়ে দিতে শুরু করে। ঘন্টা দুই-একের মাঝেই মেহেদী পড়ানো শেষ হয়ে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে মেহেদীর ডিজাইনটি মারাত্মক সুন্দর লাগে মিশ্মির কাছে। সে প্রফুল্লচিত্তে বলে উঠে, “অনেক সুন্দর হয়েছে ভাবী। আমার অনেক পছন্দ হয়েছে মেহেদী দেওয়াটা। থেংক ইউ! দাঁড়াও আমি এখনই সবাইকে আমার মেহেদীটা দেখিয়ে নিয়ে আসি।”
স্পর্শী সম্মতি জানাতেই মিশ্মি ছুটে যায় ওর বাকি কাজিনদের কাছে। স্পর্শী সব গুছিয়ে উঠতে যাবে তার আগেই হুড়মুড় মিশ্মির কাজিনরা রুমে ভিতর ঢুকে পড়ে। সকলে একত্রে আবদার ধরে বসে মেহেদী দেওয়ার। তাদের নাকি স্পর্শীর দেওয়া মেহেদী অসম্ভব রকমের পছন্দ হয়েছে। দিলে মেহেদী এখন তার কাছেই দিবে তারা। স্পর্শী এইবার বিপাকে। মনে মনে চারদিকে চোখ বুলাতেই দেখতে পেল মেয়ের সংখ্যা ছয়-সাতজনের কম নয়। সকলের দৃষ্টির অগোচরেই শুকনো ঢোক গিললো সে। এতজনকে মেহেদী পড়িয়ে দেওয়া কষ্টসাধ্য হলেও ‘না’ করতে পারলো না স্পর্শী। রাজি হলো সকলের আবদারে। অতঃপর শুরু হলো তার রক্তিম আভায় হাত দু’টি সজ্জিত করার কাজ।

ঘন্টা পেরিয়ে গুটি কয়েক প্রহর লেগে গেল সকলের মেহেদী দিয়ে উঠতে উঠতে। ঘাড়,হাত,চোখ টনটন করছে এখন। তীক্ষ্ণ ব্যথার অনুভূতি হ্রাস করছে তাকে। স্পর্শী আড়মোড়া ভেঙে, কতক্ষণ হাত ঝাড়লো। অতঃপর একপলক তাকালো ঘড়ির দিকে। রাত এগারোটার বেশি বাজে। মাঝে বিরতি নিয়ে রাতের খাবার এর মাঝেই খেয়ে নিয়েছে সে। অন্যথায় এখন হয়তো খিদের জ্বালায় মরতে হতো তাকে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে। এগিয়ে যায় তার জন্য বরাদ্দ করা রুমে৷ রুমে এসে আগে হাতে লেগে থাকা মেহেদীটুকু ধুয়ে নেয়। জায়গায় মেহেদীর দাগ বসে গিয়েছে। অতঃপর চোখে-মুখে পানির কয়েকটা ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এসে বিছানার ধারে নির্বাণকে বসা দেখতে পায় সে। স্পর্শী মুখ হাত মুছে সামনে এগিয়ে যেতেই নির্বাণ বলে উঠে,

“তুমি মেহেদী দাও নি কেন?”
স্পর্শী অবসন্ন কন্ঠে বলে, “সময় পাইনি। আর আপাতত মেহেদী দেওয়ার মত আমার মধ্যে শক্তি অবশিষ্টও নেই।”
নির্বাণ স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “টেবিলে উপর মেহেদী রাখা আছে। যাও নিয়ে আসো, এখনই দিবে তুমি।”
স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকালো টেবিলের দিকে। সত্যি সত্যি সেখানে একটা মেহেদী পড়ে আছে। স্পর্শী হেয়ালির কন্ঠে বলে, “কাল সকালে দিলে দিব নে। এখন আর ভালো লাগছে না। ঘুমোব এখন।”
নির্বাণ কন্ঠে কাঠিন্য ভাব মিশিয়ে বলে, “কাল সকলের হাত মেহেদীরাঙ্গা থাকবে আর আমার বউয়ের হাত ফ্যাকাসে। তা হয় না! তুমি এখনই দিবে, আমার সামনে। এরপর ঘুমাবে তুমি।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১৩

নির্বাণের পীড়াপীড়িতে স্পর্শী অবশেষে বাধ্য হলো রাজী হতে। পুনরায় বসলো মেহেদী হাতে নিয়ে। বা হাতের উল্টোপিঠে আর তালুতে খুবই সহজসরল একটা ডিজাইন এঁকে নিল সে। মেহেদী দেওয়া শেষ হতেই নির্বাণ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে একবার দেখলো হাতটা। অতঃপর স্পর্শীর হাত থেকে মেহেদীর কোণটা নিয়ে নিল নির্বাণ। তালুর এককোনে কিছু একটা লিখার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করলো। কয়েক মিনিটে ব্যবধানে হয়তো সফলও হলো। স্পর্শী তাকালো সেদিকে। হাতে এককোনে ইংরেজিতে ক্যাপিটাল লেটারে ‘N’ লিখেছে নির্বাণ। অক্ষরটা চোখে পড়ামাত্র স্পর্শীর চোখ বৃহৎ আকার ধারণ করলো। চোখের কানায় কানায় অপার বিস্ময় ভর্তি করে তাকালো নির্বাণের পানে। নির্বাণ তখন ঠোঁটের কোনে ছোট হাসি ঝুলিয়ে বলে, “নাও পার্ফেক্ট।”
স্পর্শী এইবার অবসন্ন কন্ঠে বলে, “ঘুমোই আমি এখন?”

নির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আমি মেহেদী পড়াতে জানলে হয়তো তোমার কষ্টটা লাঘব পেতো।”
নির্বাণের কন্ঠে স্পষ্ট আবেগ। মুহূর্তেই স্পর্শী নির্বাক,নিরুত্তর হয়ে তাকিয়ে রইলো নির্বাণের পানে। খুঁজে পেল না সে উত্তর দেওয়ার মত কোন শব্দ।

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১৫