চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২৯

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২৯
Writer Asfiya Islam Jannat

“তবে…. তাকে আমি একদা বাবা বলে জানতাম।”
কথাটা স্পর্শী কর্ণধারে এসে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র নয়ন জোড়া বড় হয়ে এলো তার। দৃষ্টি ভর্তি বিস্ময় নিয়ে তাকালো নির্বাণের পানে। কথাটা তার ঠিক মত বোধগম্য হলো না বিধায় সে অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করল, “জানতাম মানে?”
নির্বাণ সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত কন্ঠেই বলল, “বাবা ছিলেন উনি আমার। তবে এখন আর নেই।”
স্পর্শী স্থির হলো, অতি শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। প্রশ্ন করল না আর একটিও। মৌন রইলো। কেন জানি তার মনে হলো এখন এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা মানে নির্বাণকে কষ্ট দেওয়া। তবে স্পর্শীর বিশ্বাস নির্বাণ তাকে এই সম্পর্কে নিজ থেকেই বলবে, তাই হতো মনে কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও প্লাটা প্রশ্ন করলো না সে।

নির্বাণও কোন প্রকার টু শব্দ করল না। আপনমনে গাড়ি চালিয়ে গেল। মুহূর্তেই পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে উঠল। মিনিট কয়েক নীরবে কেটে যেতেই হঠাৎ গাড়ি থামলো। স্পর্শী চারদিকে চোখ বুলাতেই বুঝতে পারল তারা এসে পড়েছে৷ নির্বাণ আগে নিজের সিটবেল খুলে দ্রুত বেরিয়ে এলো, সামনে দিয়ে ঘুরে স্পর্শীর কাছে এসে দরজা খুলে তাকে ধরে নামতে সাহায্য করল। রোদের তাপটা আজ যেন একটু বেশি। হঠাৎ রোদের সংস্পর্শে আসায় তাপের তেজ সহ্য করতে পারলো না স্পর্শী৷ চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল সে। নির্বাণ স্পর্শীর অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠল, “টান লেগেছে? ব্যথা করছে পেটে?”
স্পর্শী পিটপিটিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলো। স্মিত মুখে বলল, “না! হঠাৎ রোদের আলো চোখে পড়ায় সহ্য করতে পারিনি৷”
কথাটা শোনামাত্র নির্বাণ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো, “আচ্ছা। তুমি এদিক আসো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথাটা বলে সে স্পর্শীকে ভালো মত নিজের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে নিল। এমন ভাবে স্পর্শীকে দাঁড় করালো যাতে তার সুঠাম দেহের সম্পূর্ণ ছাঁয়াটুকু স্পর্শীর ক্ষুদ্রতর দেহটাকে আড়াল করতে সক্ষম হয়। এবং সেটা হলোও। তীব্র উত্তাপের মাঝে কিঞ্চিৎ আরাম অনুভব করায় স্পর্শী ভালো মত তাকালো। নির্বাণের কর্মকাণ্ড দেখে তার ঠোঁটের কোণ মৃদু প্রসারিত হলো। মাঝে মধ্যে মানুষটার কাজ এমন যে মুগ্ধ না হয়ে পারাই যায় না। নির্বাণ খুব যত্নসহকারে স্পর্শীকে ধরলো অতঃপর আস্তে আস্তে ভিতরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে৷

ক্লান্ত সায়াহ্নের প্রহর শেষে কালো চাদরে আচ্ছাদিত হলো সমস্ত নগরী। কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘের এলোমেলো চলাচল দক্ষিনা অনিলের দোলে। ঝিম ধরা পরিবেশ। ইফতার, নামাজ সেরে যার যার রুমে বসে অবসন্ন সময় কাটাছে সকলে। আচমকাই খোলা জানালা হতে এক মুঠো শৈথিল্য বাতাস হুড়মুড় করে ঢুকলো, তপ্ত পরিবেশটা শীতল করে দিয়ে আবার একই রাস্তা দিয়ে ফুড়ুৎ করে পালালো। স্পর্শী নিধির সাথে কথা বলতে বলতেই একবার বারান্দার দিকে তাকালো। মিনিট দশেক হলো নির্বাণ বারান্দায় গিয়েছে, এখনো আসেনি। স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো। নির্বাণকে দেখার জন্য উঠতে চাইলো কিন্তু ফোনে কথা বলছে বলে আর গেল না। মিনিট কয়েক অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল।

নিধির সাথে কথা গিয়ে শেষ হলো আরও মিনিট পাঁচেক পড়। নির্বাণ তখনও রুমে আসেনি বলে স্পর্শী মোবাইল মাথার বালিশের পাশে রেখে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো, ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। নির্বাণ চুপটি মেরে বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত দৃষ্টি তার আকাশের অভ্যন্তরে। স্পর্শী দরজার সামনে এসেই স্থিরচিত্তে দাঁড়ালো।
সকালে তখন বাসায় আসার পর থেকেই নির্বাণ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। দরকার ব্যতীত বেশি একটা কথা বলে নি, রুম থেকেও বের হয়নি। স্পর্শী নির্বাণকে স্পেস দিতে চেয়েছিল তাই বিষয়টা ঘাটায়নি। স্পর্শী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো, “কি করছেন?”

নির্বাণ চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। স্পর্শী বারান্দার সামনে দেখে সত্বর এগিয়ে এলো। শাসনের কন্ঠে বলল, “তুমি উঠে এসেছ কেন? কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিতে।”
“আরেহ আমি ঠিক আছি। এতটা অক্ষম হয়ে যাই নি যে ঘরের মধ্যেই এদিক-সেদিক চলাফেরা করতে পারবো না।”
নির্বাণ চোখ পাকিয়ে তাকালো, “বেশি বুঝো তুমি। চল ভিতরে।”
স্পর্শী আবদারের সুরে বলল, “বসি এখানটায় কিছুক্ষন?”

নির্বাণ একবার কড়া কন্ঠে ‘না’ করতে গিয়েও করতে পারলো না। পৃথিবীর সকল মানুষের মুখের উপর সে ‘না’ বলতে পারলেও এই এক নারীকে সে কিছুতেই ‘না’ বলতে পারে না। এমনটা কি আদৌ হওয়ার কথা ছিল? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। খুব সন্তর্পণে স্পর্শীর হাতটা ধরে বলল, “আচ্ছা আসো।”

কথাটা বলে নির্বাণ বারান্দার একপাশে রাখা ছোট বেতের মোড়াতে স্পর্শীকে বসিয়ে দিল। নিজেও একটা মোড়া টেনে স্পর্শীর পাশে বসলো। আলতো হাতে স্পর্শীর মুখের সামনে পড়ে থাকা এক গাছি চুল কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে কন্ঠস্বর নিচু করে বলে, “যতদিন না পুরোপুরি ঠিক হচ্ছো ততদিন এভাবে হাটা চলার চেষ্টা করবে না। হয় আমাকে ডাক দিবে, না-হয় মা বা স্পৃহাকে ডাকবে।”

স্পর্শী মাথা দোলালো। আবছা অন্ধকারে নির্বাণ প্রত্যুত্তরে কি রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ তা বোঝা গেল না। তাই স্পর্শী নির্বাণের বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করবে কি-না এ নিয়ে দ্বিধায় পরে গেল। কিয়ৎক্ষণ নিভৃতে কেটে যেতেই নির্বাণ বলে উঠল, “কি প্রশ্ন করতে চাচ্ছ করে ফেলো। আমাকে প্রশ্ন করতে জড়তা কিসের তোমার?”
নির্বাণের কথায় স্পর্শী মুহূর্তে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, “না মানে তেমন কিছু না…”
“সকালের ব্যাপারে জানতে চাইছো তাই তো?”

স্পর্শী কিছুটা সংকোচবোধ করলো তাই প্রত্যুত্তরে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল। নির্বাণ স্পর্শীকে চুপ থাকতে দেখে নিচু কন্ঠে বলতে শুরু করলো,

“ছোট থাকতে আট-দশটা ফ্যামিলির মতই হ্যাপি ফ্যামিলি ছিল আমাদের। যদিও ডা.মোহাম্মদ সাইয়্যেদ মানে আমার বাবাকে তেমন একটা কাছে পাইনি আমি আর নাহিদ। পেশায় তিনি সার্জন ছিলেন, তো সে সুবাদে বেশির ভাগ সময়ই তিনি ঢাকার বাহিরে যাওয়া-আসা করতে হতো তার। তার জন্য রাত-দিন ছিল না যখন ডাক পড়ত তখনই ছুটে যেত। ছোট থেকে দেখে আসায় বিষয়টা আমাদেরও সয়ে গিয়েছিল। কখনো এসব নিয়ে বাসায় ঝগড়া বিবেধ লাগেনি। তবে নাহিদের হওয়ার বেশ কয়েকবছর পর থেকেই দেখতাম বাবা-মায়ের মাঝে বেশ মন-মালিন্য চলে। বাবা ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হলে সপ্তাহেও ফিরে না। মাসে হাতে গণা দুই-তিনবার ফিরে, এমন এক অবস্থা৷ আর মাস শেষে টাকা-টা ঠিক পাঠিয়ে দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করে ফেলতেন। আমার দুই ভাই ছোট থেকেই বাবাকে তেমন কাছে পায়নি তাই তার প্রতি আমাদের এতটা টান ছিল না। তার বাসায় থাকা না থাকা আমাদের জন্য একই ছিল। মা-ই আমাদের সকল দেখাশোনা করতেন।

অতঃপর আমার যখন আঠারো আর নাহিদের বারো বছর তখন ডা.সাইয়্যেদ তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঘরে উঠেন। মা এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে, তারা আরও তিন বছর আগেই বিয়ে করেছেন আর সম্পর্ক ছিল বহু পূর্ব থেকেই এবং ডা.সাইয়্যেদ এতদিন লুকিয়েই সংসারও করে এসেছেন। এখন তিনি মাকে ডিভোর্স দিতে চান, দ্বিতীয় পক্ষের সাথে থাকতে চান তাই তিনি তাকে ঘরে তুলেছেন। এ সংসার আর তিনি চান না। মা তখন ভেঙে পড়লেও শুধু একটা প্রশ্ন করেছিল, ‘এইটাই তার শেষ কথা কি-না?’ তিনি উত্তর হ্যাঁ-তেই দিয়েছিলেন। এরপর মা আমাদের কাছে এসে কোন ভণিতা না করে পুরো বিষয় খুলে বলে আর জিজ্ঞেস করে, ‘আমরা কার সাথে থাকতে চাই?’ দুই ভাই আমরা মা-কে বেছে নেই।

ব্যস, এরপর এক কাপড়েই মা আমাদের নিয়ে সেই ঘর ছাড়েন এবং ফোন করে নানাজানকে সব জানায়। নানাজান তখনই বড় মামাকে পাঠায় মাকে নিতে। এরপর আরও অনেক কাহিনী। তাদের ডিভোর্স ফাইল হয়, আমাদের কাস্টাডির জন্য এপ্লাই করা হয়। সব এখানে মা নানাজান আর মামার সাহায্যে নিজ উদ্যোগেই করেন। ডা.সাইয়্যেদও এগুলোই চাচ্ছিলেন যার জন্য সব ঝামেলাবিহীন শেষ হয়ে যায়। আমাদের কাস্টাডিও সহজে মা পেয়ে যায়। কারণ ডা.সাইয়্যেদ আমাদের এভাবেও চাননি। এরপর থেকেই আমাদের আলাদা পথ চলা। মা নিজের মত জীবন গুছিয়ে নিলেন, মামাদের সাথে ব্যবসায় যোগ দিলেন। আমাদের পড়াশোনাও তিনি চালিয়ে নিয়ে গেলেন। বলতে মা-ই আমাদের পুরো পৃথিবী ছিল। আর আমাকে বা নাহিদকে কেউ বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে এইটাই বলতাম আমাদের বাবা মৃত বা নেই।”

এতটুকু বলে নির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর আবার বলতে শুরু করে, “সেই ঘটনার বছর খানিক পর ডা.সাইয়্যেদ আমাদের কাছে আসেন এবং ফিরে যাওয়ার অনেক অনুরোধ করেন। কারণ তার দ্বিতীয় স্ত্রী নাকি তখন বাসা থেকে কয়েক ভুড়ি স্বর্ণ আর টাকা নিয়ে পালাতক। খোঁজ নেই কোন। যার দরুণ আজ সে আমাদের কাছে ফিরেছে। কিন্তু তার প্রতি আমাদের ক্ষোভ,ঘৃণা এত ছিল যে তিনি বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। আর না কোনদিন পেরেছে।”

কথা শেষে নির্বাণ স্পর্শীর পানে তাকালো। স্পর্শী মাথা নত করে বসে আছে। বলার মত কোন ভাষা নেই তার কাছে। কি বাই বলবে? এখনকার দিনে এরূপ ঘটনার অভাব নেই সমাজে। এক দম্পতির বিচ্ছেদ যে কতটা ভয়াবহ তা শুধু তাদের সন্তানদের কথা শুনে এবং অবস্থান বিবেচনা করেই বোঝা যায়। স্পর্শীকে চুপ থাকতে দেখে নির্বাণ ধীরগতিতে স্পর্শীর একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, “এইটা ভাবার প্রয়োজন নেই আমি তোমার থেকে সত্যিটা লুকিয়েছি বা কিছু৷ এই ঘটনাটা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকলেও এইটা আমাকে প্রদর্শন করে না আমি কেমন বা আমার চরিত্র কেমন। তাই বিষয়টা কখনো গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়নি, বলাও হয়নি। আজ মনে হলো বিষয়টা তোমার জানার প্রয়োজন তাই জানালাম। নাহলে ভবিষ্যতে এ নিয়ে সমস্যা হলে হতেও পারে।”

স্পর্শী নরম সুরে বলল, “না সমস্যা নেই।”
নির্বাণ এইবার কণ্ঠস্বর ভারী করে বলল, “আজ আমি তোমার থেকে দুটো কথা চাই। দিবে?”
“দেওয়ার আমি চেষ্টা করব।”
“কথাটা আমি আগেও বলেছি তোমায় তবুও আজ আবার বলছি, কখনো আমার মাকে কষ্ট দিও না। আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু আমার মায়ের কষ্টটা না৷ তিনি আমাদের বড় করতে গিয়ে অনেক সহ্য করেছেন, মানুষের কটুকথা শুনেছেন, যা হয়তো বলারও উর্ধ্বে।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ২৮

স্পর্শী আশ্বস্ত কন্ঠে বলল, “আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো যাতে মা কখনো আমার দ্বারা কষ্ট না পান। চিন্তা করবেন না।”
“হু! আর শেষ এই কথাটাই চাই, কখনো আমাকে মিথ্যা বলবে না বা এমন কথা লুকাবে না যা তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস ভাঙ্গে৷ মনে রেখ, আমার বিশ্বাস যদি একবার ভাঙ্গে তাহলে দ্বিতীয় কোন সুযোগ নেই।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩০