চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩২+৩৩

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩২+৩৩
Writer Asfiya Islam Jannat

পরবর্তী সময়গুলো গড়ালো খুব দ্রুত। চলমান স্রোতের ন্যায়। মাস বদলালো, রমজান শেষে ইদ এলো। রৌদ্রজ্বল এক সাধারণ সকাল হলো অন্যরকম। ছোট সোনাপাখির দল ঘুম থেকে উঠে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নতুন জামা গায়ে জড়িয়ে ছুটলো বাড়ির গুরুজনদের পিছন পিছন, সালামি পাওয়ার আশায়। গৃহকর্মীরা সে যে সূর্য উঠার আগে রান্নাঘরে ঢুকলো বের হলো একবারে ঘেমে নেয়ে। টেবিলে পরিবেশিত হলো নানান ধরনের মিষ্টান্ন, মজাদার খাবার। পরিবেশটা মড়ানো উৎসব এবং খুশির আমেজে।

স্পর্শী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সজ্জিত করতে ব্যস্ত। কাঁধের পাশে নীল পাড়ের বেগুনি রঙের আঁচলটা ভালোমতো আটকে দিয়ে কুঁচিতে মন দিল সে৷ কোমর অব্দি ছড়ানো সিক্ত চুলের শেষাংশ থেকে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ে ভিজে যেতে থাকলো শাড়ি, ব্লাউজের কিনার। কিন্তু সেদিকে কি আর রমনীর খেয়াল আছে? সে তো মগ্ন অন্যের ধ্যানে। কতদিন পর কাঙ্ক্ষিত মানুষ মানুষটিকে সামনাসামনি দেখতে চলেছে, খুশি কি আর সহে তার? সপ্তাহ খানেক হলো মানুষ চলে গিয়েছে তার সান্নিধ্য হতে৷ ব্যস্ততা আছে বলে। যাওয়ার পর আর না ফিরলেও খোঁজ নিয়েছে প্রতিনিয়ত।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কাজের সুবাদে ঢাকার বাহিরে অবস্থান করেও প্রতিদিন নিয়মমাফিক ফোন করে তদারকি করেছে ঠিকই। দূরে থেকেও নিজের শরীরের সামান্যটুকু অযত্ন নিতে দেয়নি স্পর্শীকে। মাঝে মধ্যে স্পর্শী অভিমান করলে, তাকে ভিডিও কলে বসিয়ে নিজের যাবতীয় কাজ সেরেছে ব্যস্ত পুরুষটি। তবুও একা হতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত দূরে থেকেও সুস্থ করে তুলেছে তাকে। কিঞ্চিৎ দূর্বলতা থাকলেও সেটা গায়ে লাগার মত নয়।

স্পর্শী চোখে কাজল টানা মাত্র সাহেলার ডাক পড়ল, নির্বাণ এসেছে। মুহুর্তেই হার্টবিট মিস করলো যেন। মনটা হলো উৎফুল্ল, প্রফুল্ল। কোনমতে নিজের সাঁজ শেষ করে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল ড্রয়িংরুমের দিকে। সোফায় মিজান সাহেবের পাশে হাতে ফিরনির পিরিচ নিয়ে বসে আছে নির্বাণ। দুইজনের মধ্যে চলছে ব্যাপক আলোচনা৷ স্পর্শী ড্রয়িংরুমে পদচারণ করতেই নির্বাণের দৃষ্টি গেল সেদিকেই। একমনে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেদিক কয়েক মুহূর্ত। মোহগ্রস্ত নয়নে দেখতে থাকলো নীলাঞ্জনে আবৃত এলোকেশী কন্যাকে। অধরের কোণে দেখা দিল মিষ্টি হাসি৷ স্পর্শীর অবস্থাও বিপরীতমুখী নয়। সেও ব্যস্ত হলো নীলাভ্র রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত শ্যাম পুরুষের স্নিগ্ধ মুখটি দেখতে। কয়েক সেকেন্ড নিভৃতে গড়িয়ে যেতেই নির্বাণ দৃষ্টি সরালো, পুনরায় মনোযোগ দিল মিজান সাহেবের কথায়। ভাব এমন যে, সে এতক্ষন মনোযোগ দিয়েই মিজান সাহেবের কথা বলছিলো এদিক তো সে ভুলেও তাকাই নি। স্পর্শীর ভ্রু কুঞ্চিত হলো, “নির্বাণ কি খেয়াল করেনি সে আজ তার পছন্দ মত সেজেছে? পরিপাটিভাবে শাড়ি পড়েছে, হাত ভর্তি মেহেদী দিয়েছে, চোখে কাজল টেনেছে, কিছুই কি খেয়াল করিনি সে? এত অবজ্ঞা কিসের?”

বেশ অভিমান হলো স্পর্শী৷ রাশ ভারি অভিমান নিয়ে নিজের দিকে তাকালো সে। কোনদিক খাপছাড়া লাগছে কি-না পর্যবেক্ষণ কর‍তে৷ কিন্তু কোন খুঁত খুঁজে পেল না। এরই মাঝে স্পৃহা স্পর্শীর পাশে এসে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো, “তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?”
স্পর্শী পাশ ফিরে তাকালো, “কিছু না। আচ্ছা দেখতো, আমাকে কি আজ বাজে লাগছে?”
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকালো, “কই না তো। এই শাড়িতে তো বেশ মানিয়েছে৷ সুন্দর লাগছে।”

স্পৃহার কথা শুনে স্পর্শী দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। স্পৃহাও স্পর্শীকে অনুসরণ করে সেদিকই তাকালো। অকস্মাৎ বলে উঠলো, “তুই আর ভাইয়া কি কাপল আউটফিট পড়েছিস নাকি? কাটিং, ডিজাইন সব সেম যে?”
স্পৃহার কথা শুনে স্পর্শী একবার নিজের দিকে এবং নির্বাণের দিকে তাকালো৷ তার শাড়ির উপর অংশ গাঢ় নীল এবং নিচের কুঁচির অংশ বেগুনি, গোলাপির সংমিশ্রণে তৈরি। নির্বাণের পাঞ্জাবীও ঠিক তেমনই৷ ইদ উপলক্ষে ওই বাড়ি থেকেই তার জন্য এই শাড়ি আর কিছু কামিজ নিয়ে এসেছিল নাহিদ। পাশাপাশি সাহেলা,মিজান,স্পৃহার জন্যও৷ গতকাল রাতেই নির্বাণ ফোন করে জানিয়েছিল নিলুফা তাকে যেতে বলেছেন, তাই সে সকালবেলা ওকে নিতে আসবে। সেই সাথে জোড় দিয়ে বলেছিল, সে যেন তাদের দেওয়া শাড়িটা পড়ে। তার মানে কি নির্বাণ জেনে শুনেই তাকে শাড়ি পড়তে বলেছিল?

পরবর্তীতে আর কিছু ভাবার পূর্বেই স্পৃহা বলল, “মা তোকে ভিতরে ডাকছে। চল!”
স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকালো অতঃপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল সাহেলার রুমের দিকে। স্পর্শী নিজ অবস্থান থেকে সরে যেতেই কারো আড়দৃষ্টি সরল হলো। প্রিয়তম মানুষটাকে মন ভরে দেখতে না পারার আক্ষেপে দীর্ঘশ্বাস বেরোলো বুক চিরে।

ত্রিশ মিনিটের উর্ধ্বে হলো স্পর্শী শ্বশুরবাড়ি এসেছে। এই প্রথম এখানে আসা তার৷ যার দরুণ, স্পর্শীর আপ্যায়নে কোন কমতি রাখে নি নিলুফা৷ স্পর্শী বাসায় আসামাত্রই তাকে নিজের সাথে সাথে রাখছেন। নাহিদের সাথে দেখা হলে সে কুশল বিনিময় করে বাহিরে চলে যায়, পুরোনো বন্ধুমহলের সঙ্গে আড্ডা দিতে।
স্পর্শীর নিলুফার সাথে কথার ফাঁকেই চারদিকে চোখ বুলালো। নির্বাণদের ফ্ল্যাটটা তিন/চারজন থাকার জন্য মাত্রাতিরিক্ত বড় বলা চলে। বেডরুম, ড্রয়িং, ডায়নিং বাদে ছোট একটা স্টাডি রুম আছে। সেখানের পুরোটাই কাগজপত্র আর বইয়ে ঠাশা। বুঝতে অপেক্ষা নেই স্টাডিরুমটা কার। নিলুফা স্পর্শীকে নিজ উদ্যোগে একবার পুরো বাসাটা ঘুরিয়ে দেখালেন। অতঃপর স্পর্শীকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে আড্ডায় মশগুল হলেন। সময়টা পাড় হলো সেখানেই।

বাসায় আসার পর স্পর্শীকে নিলুফার সাথে ব্যস্ত দেখে নির্বাণ নিজের রুমে চলে গেল। ভাবলো, কিছু সময়ের ব্যাপার। সে অপেক্ষা করে নিবে৷ কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যখন মিনিট,সেকেন্ড পেরিয়ে ঘন্টায় পদার্পণ করলো তখনই শ্যাম পুরুষটির শান্ত মন অধৈর্য হয়ে উঠলো। বদ্ধ রুমে ক্ষান্ত হয়ে বসে থাকতে না পেরে এদিক-সেদিক ঘুরঘুর করতে থাকলো। শেষে কাজ না পেয়ে স্টাডিরুম থেকে একটি উপন্যাসের বই নিয়ে সোফায় বসে পড়লো। নিজের সবটুকু মনোযোগ বইয়ের পাতায় স্থির করার ব্যর্থ প্রয়াস করলো কতক্ষণ। কিন্তু যার মন অন্যতে মগ্ন, সে কি আর পারে কবির উপন্যাসিক অক্ষর-বর্ণের মায়ায় নিজের মনকে ভোলাতে?

কিছুসময়ের ব্যবধানে স্পর্শী নিলুফার রুম থেকে বের হলো৷ স্পর্শীকে দেখামাত্র নির্বাণ তড়িঘড়ি করে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজলো, মুহুর্তেই অভিব্যক্তি স্থিরচিত্ত করে ফেললো সে। ভাব এমন, সে এতক্ষণ যাবৎ ধরে একমনে বই-ই পড়সিল। অথচ কিয়ৎক্ষণ পূর্বের দৃশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম।
স্পর্শী ধীর পায়ে নির্বাণের কাছে এসে বসে। নির্বাণ দৃষ্টি তুলে তখনই, “কথা শেষ হলো?”
স্পর্শী হাতে পরিহিত স্বর্ণের বালার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ! মা নামাজ পড়বেন এখন।”
“অহ আচ্ছা। বালা কে দিয়েছে মা?”

স্পর্শী সম্মতি জানালো, “হুম, ইদ উপলক্ষে দিয়েছেন।”
কথাটা শুনে নির্বাণ হাতের বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। মন্থর কন্ঠে বলল, “রুমে চল৷”
স্পর্শী কথা বলল না আর। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো, ছোট ছোট পা ফেলে চললো নির্বাণের পিছু পিছু। অভিমানের রেশ তখনও বিদ্যমান। নির্বাণের রুমে ঢুকতেই স্পর্শী থমকালো। রুমটা তুলনামূলক একটু বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সামন্যটুকু ধূলিকণা খুঁজে পাওয়া দায়। সে সাথে, সব জিনিস সাজানো-গোছানো। যেন সে-টাই তাদের আদর্শ স্থান। এমন কি বিছানার চাদরও একদম টান টান, কোন ভাঁজ নেই তাতে। বিশৃঙ্খলতা তো নেই-ই। কোন ছেলে মানুষের রুম যে এত সুন্দর, গোছানো-সাজানো হতে পারে তা হয়তো নির্বাণের সাথে বিয়ে না হলে জানাই হতো না। অপরদিকে, স্পর্শী হচ্ছে নির্বাণের বিপরীত। সে বরাবরই আগোছালো প্রকৃতির৷ ঠেকায় না পড়লে কখনো নিজের রুম গুছায় না। একটা জিনিস নিয়ে অন্য জায়গায় রেখে দেওয়া তার স্বভাব। শেষে কি-না স্পর্শী তার বিপরীতমুখী কাউতে আবদ্ধ হলো? হুমায়ুন আহমেদ ঠিকই বলেছেন, “এই পৃথিবীর প্রায় সবাই, তার থেকে বিপরীত স্বভাবের মানুষের প্রেমে পড়ে।”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। নৈঃশব্দ্যে হেটে গিয়ে বিছানার উপর বসলো। নির্বাণ দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে ডেক্সটপ টেবিলের উপর বইটা রেখে নিচের ড্রয়ারটা খুলে কিছু একটা করতে থাকলো। অতঃপর ঘুরে স্পর্শীর দিকে তাকালো, “তোমার চোখের নিচে কাজল লেপ্টে গিয়েছে। টিস্যু আছে সেখানে মুছে নাও, বাজে দেখাচ্ছে।”

স্পর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের দিকে। গল্প, উপন্যাসে এই লেপ্টে যাওয়া কাজল নিয়েই কবিরা কয়েক’শ লাইন লিখে ফেলে, অথচ এই মানুষটাকে দেখো। স্পর্শীর অভিমানের পাল্লা ভারী হলো। সে আকাশ সমান রাগ নিয়েই উঠে দাঁড়ালো, কিছুটা শব্দ করেই হেটে গেল আয়নার সামনে। আয়নাতে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে এলো তার। তার কাজল তো লেপ্টে যায়নি, তাহলে নির্বাণ মিথ্যে বলল কেন? ঘুরে দাঁড়াতে চাইলো সে কিন্তু তার পূর্বেই নির্বাণ তার পিছে এসে দাঁড়ালো। আয়নার ভিতর দিয়েই স্পর্শী নির্বাণের দিকে তাকিয়ে রোষিত কন্ঠে বলল, “মিথ্যে বললেন কেন আপনি? ঠিকই তো আছে সব।”
“তাই নাকি?”

নির্বাণের হেয়ালিপূর্ণ কন্ঠ। স্পর্শীর এবার প্রচন্ড রাগ হলো। একে তো সকালবেলা তার দিকে ঘুরেও তাকায়নি, আসার সময়ও গাড়িতে সাধারণ দুই-এক বাক্য ছাড়া কোন কথাই বলেনি সে, বাসায় এসেও একই হাল, এখন আবার হেয়ালি করছে। মানে চাচ্ছেটা কি সে? স্পর্শী একরাশ বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে সরে আসতে নিলে নির্বাণ বাঁধ সাধলো। নির্বাণ স্পর্শীকে তার দিকে ঘুরিয়ে পকেট থেকে ছোট একটা বক্স বের করে স্পর্শীর হাতে দিল। স্পর্শী দ্বিধাগ্রস্ত নয়নে তাকালো নির্বাণের দিকে। নির্বাণ তা দেখে বলল, “খুলো!”

স্পর্শী এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে বক্সটা খুললো। বক্সের ভিতরে নিদারুণ সাদা ও নীল রঙের পাথরের কারুকাজ করা লাভ শেপড এক জোড়া এয়ারিং আর পেনডেন্ট। মগ্নতা,স্নিগ্ধতার প্রভাব এত ছিল যে স্পর্শী স্তব্ধ না হয়ে পারলো না। নির্বাণ কিছু না বলে নিভৃতে বক্স থেকে পেনডেন্টটা নিয়ে স্পর্শীকে পুনরায় আয়নার সামনে ঘুরিয়ে দিল। খুব সন্তর্পণে স্পর্শীর চুলগুলো একপাশে নিয়ে তার গলায় পেনডেন্টটা পড়িয়ে দিল। অতঃপর স্পর্শীর কোমরে হাত গলিয়ে দিয়ে তার কাঁধের পাশে আলতোভাবে অধর ছুঁয়ে দিয়ে চিবুক রাখলো। বিভোর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “পছন্দ হয়েছে?”

স্পর্শী দ্রুতগতিতে মাথা নাড়লো, “অনেক!”
বিয়ের পর এই প্রথম নির্বাণের কাছ থেকে কোন উপহার পাওয়া তার। পছন্দ না হয়ে উপায় আছে? বস্তুত, উপহারটা এখন তার জানের চেয়েও প্রিয়।
নির্বাণ মিহি হাসলো, “আর শাড়ি?”
স্পর্শী কিছুটা অবাক হয়ে বলে, “শাড়িটা কি আপনি নিজে কিনেছেন?”

“হু! এই প্রথম মা বাদে কোন নারীর জন্য শাড়ি কিনেছি। অনেক ঘুরেও কোন শাড়ি পছন্দ হচ্ছিল না তোমার জন্য। শেষে এই কাপল আউটফিটটাই নজর কেড়েছিল। কিন্তু তোমার পছন্দ নিয়ে একটু কনফিউজড ছিলাম। তবুও কেন জানি মনে হয়েছিল তোমাকে এই রঙে বেশ মানাবে। এখন দেখছি আসলেই মানিয়েছে।”
স্পর্শী হৃষ্টচিত্তে অধরের কোণে হাসি ফুটালো, “আপনার দেওয়া সবকিছুই আমার প্রিয়।”
“আর আমি প্রিয় নই?”

আচমকা নির্বাণের এমন প্রশ্নের পৃষ্ঠে স্পর্শী লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। মুহুর্তেই প্রত্যুত্তর করতে পারলো না কিছু। আমতা আমতা করলো কিছুক্ষণ, “না মানে হ্যাঁ….ধুর।”
“কি বল?
স্পর্শী মাথা নুয়ে লজ্জালু কন্ঠে বলল, “জানি না।”
নির্বাণ হাসলো, “থাক জানতে হবে না।”

কথাটা বলে আয়নার মধ্য দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো স্পর্শীর দিকে৷ ক্ষণেই বলে উঠলো, “তোমাকে না আমি লিপস্টিক দিতে মানা করেছিলাম? বিশেষ করে এই রঙেরটা।”
স্পর্শী ভ্রু সংকীর্ণ হলো, “কেন দিলে কি হয়েছে?আপনি বললেই আমার লিপস্টিক দেওয়া ছাড়তে হবে না-কি? আমি তো লিপস্টিক দিবই।”
মুহূর্তেই নির্বাণ স্পর্শীর কানের কাছে এসে ফিসফিসালো, “কি হয় তা না-হয় এখনই দেখে নাও।”

কথাটা বলেই নির্বাণ আচমকা স্পর্শীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল, কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই স্পর্শীর অধরযুগল নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে এসে তাতে নিজের অধরযুগল স্থাপন করলো। ঘটনাক্রমে, স্পর্শী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দিতেই ভুলে গেল। তাকিয়ে থাকলো ফ্যালফ্যাল করে। এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুতি ছিল না। ধীরে ধীরে প্রণয়ের রঙ গাঢ়তর হতেই স্পর্শী মিইয়ে গেল, নয়ন দুইটি কপাট বন্ধ করলো নিমিষেই। কিয়ৎকাল এভাবেই অতিবাহিত হওয়ার পর নির্বাণ সরে এলো, নিম্ন কন্ঠে বলল,
“মাঝে মধ্যে কিছু নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের শাস্তিগুলো এমনও হয়। বুঝেছ?”

সায়াহ্নের রক্তিমা ছেঁয়ে যাওয়া আকাশের অন্তরালে সূর্যের অস্বস্তি মিশে যেতেই স্পর্শীকে সাথে নিয়ে নির্বাণ রওনা হলো। চারিপাশ উজ্জ্বল করতে রাস্তার ধারে জ্বলতে শুরু করলো হরিদ্রা রঙের সোডিয়াম লাইটগুলো। বন-গাছালি পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চললো শা শা করে। স্পর্শী মনও স্থাপিত হলো সেদিকেই, আচরণে তখনও লজ্জাবত্তা বিদ্যমান। মিনিট কয়েক নিভৃতে কেটে যেতেই নির্বাণ পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলে উঠে, “সামনের সপ্তাহ থেকে কিন্তু ভার্সিটি খোলা, মনে আছে তো?”

“হুম আছে।”
“শরীর খারাপ করলে ভার্সিটি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি নোটস করে পরে তোমায় দিয়ে দিব নে।”
স্পর্শী মৃদুকন্ঠে বলল, “সেটার প্রয়োজন পড়বে না বোধহয়।”
“না লাগলেও নিবে, পড়ালেখায় বেশ পিছিয়ে আছো তুমি। ইম্প্রুভমেন্ট দরকার তোমার, সো আমার দেওয়া নোটসগুলো ভালো মত পড়বে। এইবার সিজিপিএ খারাপ হলে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখ আছে।”
শেষের কথাটা বেশ গাম্ভীর্যতার সাথে বলল নির্বাণ। স্পর্শী নাক ফুলিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলল, “শুরু হয়েছে হিটলার স্যারের হিটলারগিরি। এ জন্যই স্যারদের বিয়ে করা উচিৎ না। একদমই না।”

গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে স্পর্শীর কথাগুলো নির্বাণ শুনতে পেল না। তাই জিজ্ঞেস করলো, “কিছু বলছ?”
“বলছি, এখন থেকে ভালো মত পড়ব।”
নির্বাণের অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো না সে স্পর্শীর কথা আদৌ বিশ্বাস করেছে, তবে এ বিষয়ে আর কিছু বলল না। অন্য কথাতে চলে গেল সে, “আচ্ছা! আর ভার্সিটি খুললে কিন্তু তুমি আমার সাথেই যাওয়া আসা করবে।”
“কেন?”
“তোমাকে নিয়ে আমি কোন রিক্স নিতে চাচ্ছি না।শরীর এখনো দূর্বল তোমার, তাই কিছুদিন তোমার একা যাওয়া আসা নিষেধ।”
স্পর্শী এর প্রেক্ষিতে আর কিছু বলল না। ছোট করে শুধু ‘আচ্ছা’ বলল।

ছুটিগুলো ফুরিয়ে গেল খুব দ্রুত। ফের ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ হলো জীবন। স্পর্শীর ভার্সিটিও খুলে গিয়েছে এক সপ্তাহ হলো। এর মধ্যে দুর্বলতার জন্য সে ভার্সিটি যেতে পেরেছে মাত্র দুইদিন থেকে তিনদিন। তাও নির্বাণের সাথেই। ভার্সিটির ভিতরে দুইজনকে আলাদা আলাদা থাকতে হলেও দূর থেকে স্টুডেন্ট-টিচারের সম্পর্ক বুঝিয়ে রেখেই নির্বাণ যতটুকু পেরেছে স্পর্শীর খেয়াল রেখে গিয়েছে। নিজের পক্ষ থেকে কোন ক্রটি রাখেনি সে। স্পর্শীও বেশ সাবধানতার সাথে চলাফেরা করে গিয়েছে। সে সাথে, নির্বাণের সাথে যাওয়া-আসা করার সময়ও বেশ সচেতন ছিল। স্পর্শীর বন্ধুমহলের সকলেও এতে বেশ সাহায্য করেছে। তবে পিঞ্চ করতে ভুলে নি কেউ।

হাসি-খুশিই যাচ্ছিল সকলের জীবন। তবে সেটা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। নিষ্প্রভ এক সকালে ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ঙ্কারী বাতাস লেগে গেল স্পর্শীর ও নির্বাণের জীবনে। যা কি-না তাদের জীবনের পুরো মানচিত্র-ই উল্টে দিল।
আকাশটা নিত্যদিনকার মতই স্বচ্ছ। রৌদ্রতেজের ক্ষিপ্ত রূপ হতে ধরণীকে রক্ষা করতে শুভ্র মেঘের অহর্নিশ আনাগোনা। সকাল তখন নয়টা, সকালে ক্লাস না থাকায় স্পর্শী তখনও ঘুমের রাজ্যে নিমজ্জিত। এমনই সময় স্পর্শী ফোনটা উচ্চ মাত্রায় শব্দ করে বেজে উঠে। প্রথমবারের আওয়াজে স্পর্শীর ঘুম না ভাঙলেও দ্বিতীয়বার ফোনটি বেজে উঠতেই তার ঘুম ভেঙে যায়৷ আধ-নিভন্ত চোখেই স্পর্শী হাতরে হাতরে নিজের মোবাইলটা খুঁজে বের করলো। কলটা রিসিভ করে কানের কাছে মুঠোফোনটা ধরতেই নিধি চেঁচিয়ে উঠে, “কই তুই?”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩১

সাত-সকাল এমন প্রশ্ন শুনে স্পর্শীর মেজাজ একটু খারাপই হলো। সে মেজাজ দেখিয়ে বলল, “কই আর থাকব? বাসায় আছি ঘুমাচ্ছি। কি হয়েছে?”
নিধি উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “এদিকে তো বিশ্রি একটা কাণ্ড ঘটে গিয়েছে।”
“কি হয়েছে সেটা বল।”
“রুদ্র……”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৪