চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৪

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৪
Writer Asfiya Islam Jannat

“রুদ্র……”
হঠাৎ রুদ্রের নাম শুনেই আপনা-আপনি স্পর্শীর ভ্রুকুঞ্চন হয়ে এলো। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “রুদ্র কি? কি করেছে ও?”
নিধি কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু বলতে পারলো না। তার আগেই ওর কাছ থেকে সামি মুঠোফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, “কিছু করে নাই ওই। ওর আজগুবি কথা, কানে দিস না।”

স্পর্শীর কপালের ভাঁজ এবার দ্বিগুণ হলো, “মানে কি? কি লুকাচ্ছিস তোরা? হয়েছেটা কি?”
“তেমন কিছু না। দুপুরে তোর বাসায় আসব আমরা সবাই, তখন সামনা-সামনি সব বলব নে। আর হ্যাঁ, আজ ভার্সিটি আসার প্রয়োজন নেই।”
“মানে কি?”
“তোর এত মানে জানা লাগবে না। আপাতত যা বলেছি তা কর।”
স্পর্শী পাল্টা কোন প্রশ্ন করার পূর্বেই সামি “রাখছি”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বলে ফোনটা কেটে দেয়। স্পর্শী কান থেকে ফোন নামালো, কিয়ৎক্ষণ বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে নিজের মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি হয়েছে সেটার ধারণা ঠিক করতে না পারলেও, তার বুঝতে দেরি নেই ভার্সিটিতে বড় ধরণের কোন কাহিনী হয়েছে। যা কি-না ঘটিয়েছে রুদ্র, কিন্তু তাকে এখন সেই বিষয়ে বলা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তাও বুঝে উঠতে পারলো না স্পর্শী। আচ্ছা, বিষয়টা আবার তাকে ঘিরে নয় তো? ভাবনাটা মাথায় আসা মাত্র স্থির হয়ে আর বসে থাকতে পারলো না স্পর্শী, দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ভার্সিটি যেতে হবে তাকে, ঘটনা কি হয়েছে তা না জানা পর্যন্ত অশান্ত মনের অবকাশ মিলবে না।

“তুই কি পাগল? কোন আক্কেলে তুই স্পর্শীকে ফোন করে সব বলতে গেসোস? একটু কি কথা পেটে রাখা যায় না?”
সামি নিধির উদ্দেশ্যে ক্রোধাগ্নি কন্ঠে বলে উঠল। নিধি পাল্টা প্রশ্ন করলো, “না বলে আর কতক্ষণ?তোর কি মনে হয় আমি না বললে স্পর্শী এ সম্পর্কে কিছু জানতে পারব না? ভার্সিটিতে এখন সবচেয়ে হট এন্ড ট্রেন্ডি টপিক এটাই। সবার মুখে মুখে একই কথা। চারদিকে কি এক বিশ্রি অবস্থা দেখসোস?”

সামি বলল, “মানছি সবটা। কিন্তু ফোনে বলে তুই পুরো ঘটনা ঠিক মত বুঝাইতে পারবি? বুঝাইলেও এরপর স্পর্শী কি রকম রিয়্যাক্ট করবে সেই খেয়াল আছে? ভেঙ্গে পড়বে ওই। ওকে সামলানোর জন্য হলেও আমাদের থাকতে হবে।”
কেয়া বলে উঠে, “কিন্তু স্পর্শীকে জানানো প্রয়োজন। যত যাই হোক, সম্পূর্ণ বিষয়টা ওকে নিয়েই। ইতিমধ্যে কত দেরি হয়ে গেসে দেখসোস?”

সামি সম্মতি জানিয়ে বলে, “জানি,কিন্তু আমি বলতাসি না যে জানাব না। যাব তো ওর বাসায়, তখন জানাবো। এখন তার আগে দেখি কিছু একটা করা যায়নি। নির্বাণ স্যার কোথায় জানোস? তার কানে খবরটা কি গেসে নাকি না, সেটা জানা দরকার। না জানলে তাকে জানাতে হবে আগে। এরপর যা করার সেই করতে পারবে, বিষয়টা আমাদের সকলের নাগালের বাহিরে।”
মাহিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “হ্যাঁ এটা করা যায়। তবে, রুদ্র কত নিম্নমানের কাজ করসে সেটা দেখসোস? মানে কি থেকে কি বানাইযয়া দিসে পুরো বিষয়টা? আমার তো গা জ্বলতাসে। ওই শালাকে পাই একবার, জিন্দা যদি পুঁতে না ফেলসি।”

নিধি অপভাষায় একটা কটুকাটব্য করে বলে, “নাম নিবি না ওর। মানুষের কাতারে পড়ে ওই? নর্দামার কিট একটা! রিভেঞ্জ নিতে গিয়ে একটা মেয়ের সম্মানে কিভাবে হাত দিতে পারলো ওই? নরপিশাচ একটা।”
কেয়া মন্থর কন্ঠে বলে, “সব দেখে তো আমারই কান্না পাচ্ছে সেখানে স্পর্শী কিভাবে সহ্য করবে মানুষের এই কটুকথা, ব্যঙ্গার্থ,বাজে কথাগুলো? এমন না হলে কি হতো না? খুব জরুরি ছিল এমন হওয়া?”

নিধি ক্ষীণ স্বরে বলে, “গুজব রটাতে সময় লাগে না, বুঝলি? শুধু এক কান থেকে আরেক কানে গেলেই হয়, বাকিটা চোখের পলকেই আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে।”
সামি বলে, “থাক আপাতত এই কথা বাদ দে। আগে চল, নির্বাণ স্যারকে খুঁজি। এমনেই দেরি হয়ে গেসে।”
মাহিন সাঁই জানিয়ে বলল, “হুম চল।”

ভাড়া মিটিয়ে স্পর্শী রিকশা থেকে নামলো৷ মাথায় ওড়নাটা ভালো মত টেনে, নিধিকে কল করবে বলে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতে করতেই এগুলো সামনের দিকে। ব্যাগ থেকে মুঠোফোনটা বের করে চারপাশে একবার তাকাতেই বুঝতে পারলো প্রায় শতাংশ মানুষ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কেউ বা পাশের জনকে ডেকে ফিসফিসিয়ে কি যেন বলছে আর ফোনের মধ্যে কিছু একটা দেখিয়ে তার দিকেই ইশারা করছে৷ বিষয়টা অতিমাত্রায় দৃষ্টিকটু ঠেকলো স্পর্শীর কাছে৷ সে সাথে কৌতূহল জাগলো মনের মাঝে। নিজের দিকে একবার তাকালো, তার পোশাক-আশাকে কোন ক্রটি আছে কি-না দেখতে। কিন্তু চোখে পড়ে পড়ার মত কিছু পেল না। স্পর্শী বুঝে উঠতে পারলো না, তাকেই ঘুরে ঘুরে মানুষ কেন দেখছে। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে স্পর্শী নিধিকে ফোন লাগালো। নিধি ফোন ধরা মাত্র স্পর্শী জিজ্ঞেস করে উঠলো, “কই তোরা?”

নিধির মিহি কন্ঠে প্রত্যুত্তর করলো, “টিচার্স রুমের এদিকে আছি, কেন?”
“আমি ভার্সিটিতেই আছি, স্মৃতিস্তম্ভের দিকে যাচ্ছি।”
নিধি আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলল, “কিহ! তোকে না আসতে মানা করলো সামি? তাও কেন আসলি তুই?”
“কারণ তো বলেনি, কেন আসব না? আসলে সমস্যা কোথায়? আর হয়েছেটা কি বলবি তোরা?”
স্পর্শীর কথা অনাগ্রহ করে নিধি সামিকে ডাক দিল। স্পর্শী ফোনের এপার থেকেই শুনতে পেল নিধি বলছে, “স্পর্শী ভার্সিটিতে আসছে। কি করব এখন?”
সামি প্রত্যুত্তর করলো, “ড্যাম ম্যান! ওকে না মানা করলাম আমি আসতে? উফফ! মেয়েটা একটা কথাও শুনে না। কই এখন ওই?”

নিধি বলল, “স্মৃতিস্তম্ভের দিকে যাইতাসে বলল।”
“চল ওইদিকে তাড়াতাড়ি।”
শেষ কথাটা কে বলল সেটা বুঝে উঠার আগেই নিধি বলে উঠলো, “তুই ওদিকটায় থাক, আমরা আসতাছি৷”

স্পর্শী “আচ্ছা” বলার পূর্বেই লাইন কেটে গেল। কপালের ভাঁজ যেন এবার দৃঢ় হলো স্পর্শীর। হচ্ছেটা কি? এমন আচরণ কেন করছে সবাই? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই তার ডান-পাশ থেকে কারো উচ্চস্বরের বিদ্রুপের হাসি শুনতে পাওয়া গেল, সে সাথে কাউকে নিয়ে অপ্রীতিকর কিছু কথা। যা ছিল অতিমাত্রায় জঘন্য। গা ঘিন ঘিন করে উঠলো স্পর্শীর। সে পুনরায় আশেপাশে তাকালো, কথাগুলো কে বলেছে তা দেখার জন্য। কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারলো না কথাটা কারা বলেছে৷ তবে একটা জিনিস পরিলক্ষিত করতে পারলো যে, এখনো মানুষ ওকেই দেখে চলেছে এবং নিজের মধ্যে সমালোচনা করে চলেছে।

চোখে-মুখে সকলের চরম অবজ্ঞা আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব এবং ঠোঁটের কোণে শ্লেষের হাসি৷ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে স্পর্শীর শুধু এটাই মনে হলো সবটা যেন তার জন্য, তার প্রাপ্য এসব। কিন্তু কি করেছে সে? মানুষ কেন তাকে এভাবে দেখছে? কারণ খুঁজে পেল না । চরম হতাশায় পড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো স্পর্শী। সেই সাথে, সকলের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় প্রচন্ড অস্বস্তিবোধ করলো সে। আজ সবাই এমন কেন করছে কে জানে? কোন কিছু বুঝতে না পেরে হাঁটা দিল সামনের দিকে। কিছু দূর যেতেই রুদ্র এবং ওর বন্ধুরা স্পর্শীর সামনে এসে ওর পথ আটকালো। তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে রুদ্র বলে উঠলো, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

মুহুর্তেই স্পর্শীর অভিব্যক্তি বিরক্তিতে পরিপূর্ণ হলো, “দিস ইজ নান অফ ইউর বিজনেস।”
রুদ্র রম্য কন্ঠে বলে, “অহ তাই নাকি?”
স্পর্শী কথা বলতে চাইলো না। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে রুদ্র স্পর্শীর হাত ধরে বসলো, “আরেহ! কোথায় যাচ্ছ? কথা তো শুনে যাও আমার?”
রুদ্র হাত ধরামাত্র স্পর্শী এক ঝাটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল, “সাহস কিভাবে হয় তোমার আমার হাত ধরার?”

রুদ্রের ঠোঁটের তখন বিদ্রুপাত্মক হাসি, “আমি হাত ধরলেই তোমার গায়ে ফোঁসকা পড়ে যায় অথচ যখন অন্যদের বিছানায় উঠে পড় তখন কিছু হয় না? গা জ্বলে না? ঘৃণা হয় না নিজের প্রতি? মরে যেতে ইচ্ছে করে না?”
স্পর্শী চেঁচিয়ে উঠে, “একদম চুপ! তোমার সাহস কিভাবে হয় আমাকে নিচু মানের কথা বলার? হু দ্যা হেল ইউ আর?”
“অহ প্লিজ! আর নাটক কর-না৷ এখানে উপস্থিত সকলেই তোমার আসল চেহেরা জানে৷ তুমি যে কতটা নিম্নমানের এবং রাস্তার মেয়ে তা আর এখন কারো অজানা নয়। তাই আর সতী সেজে লাভ নেই। রাস্তার ব** বাদে তুমি কিছু না। এর বেশি তোমার দাম….”

আর কিছু বলার পূর্বেই স্পর্শী রুদ্রের গালে নিজের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে থাপ্পড় মেরে বসে। প্রচন্ড রাগে শরীর কাঁপছে তার। স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আর একটা কথাও নয়। আমি কেমন তা আমি ভালো করেই জানি। কারো দেওয়া দুই টাকা দামের ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট আমার লাগবে না। যে নিজেই নর্দমার কীট সে কি আর অন্যকে জাস্টিফাই করবে?”
রুদ্র ও স্পর্শীর কন্ঠ শুনে আশেপাশে তখন অনেকই জোড়ো হয়ে গিয়েছে। নিজের মাঝেই বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা করে চলেছে। তা দেখে রুদ্র মুচকি হাসলো। গালে হাত দিয়েই বলে, “তার মানে বলতে চাইছো, তুমি সতী? একদম পিউর আর ইনোসেন্ট? যদি তাই হয়, তাহলে এই ছবিগুলোর মানে আমাকে একটু বুঝাবেন মিস.স্পর্শী উপস মিসেস.স্পর্শী। আপনি তো আবার বিবাহিত। রাইট?”

কথাটা বলে রুদ্র ফোন বের করে স্ক্রোল করে কিছু ছবি বের করে স্পর্শীর সামনে তুলে ধরে এবং উচ্চস্বরে বলে, “বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও এমন অপকর্ম করতে লজ্জা করে না? কিভাবে পারো নিজের স্বার্থ হাসিল করতে একজনকে ঠকিয়ে আরেকজনের বিছানায় উঠে পড়তে? বিবেকে বাঁধে না তোমার?”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩২+৩৩

রুদ্রের কথায় স্পর্শী এবার কোন প্রত্যুত্তর করল না। শুধু নির্বাক,নির্জীব,স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলো রুদ্রের মুঠোফোনে ভাসতে থাকা ছবিগুলো এবং তার উপরে লেখা ক্যাপশনটার দিকে। মুখের ভাষা হারালো যেন তখনই। কিয়ৎকাল ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই পুরো বিষয়টা ধীরে ধীরে তার নিকট পানির মত পরিষ্কার হয়ে দাঁড়ালো। তার মানে, সকাল থেকে ঘটা তার সাথে যাবতীয় ঘটনার সূত্রপাত এখান থেকেই।

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৫