চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৫

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৫
Writer Asfiya Islam Jannat

“বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও এমন অপকর্ম করতে লজ্জা করে না? কিভাবে পারো নিজের স্বার্থ হাসিল করতে একজনকে ঠকিয়ে আরেকজনের বিছানায় উঠে পড়তে? বিবেকে বাঁধে না তোমার?”
রুদ্রের কথায় স্পর্শী এবার কোন প্রত্যুত্তর করল না। শুধু নির্বাক,নির্জীব,স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলো রুদ্রের মুঠোফোনে ভাসতে থাকা ছবিগুলো এবং তার উপরে লেখা ক্যাপশনটার দিকে। মুখের ভাষা হারালো যেন তখনই। কিয়ৎকাল ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই পুরো বিষয়টা ধীরে ধীরে তার নিকট পানির মত পরিষ্কার হয়ে দাঁড়ালো। তার মানে, সকাল থেকে ঘটা তার সাথে যাবতীয় ঘটনার সূত্রপাত এখান থেকেই।

“কি এখন কথা বলছো না কেন? সত্য সামনে আসতেই কথা সব নাই হয়ে গেল?”
রুদ্রের হুংকার স্বরূপ কন্ঠে স্পর্শীর ধ্যান ভাঙ্গলো। সে একপলক শীতল দৃষ্টিতে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে পুনরায় মোবাইলের কৃত্রিম স্ক্রিনে ভাসতে থাকা সেই ছবিগুলোর দিকে তাকালো। ছবিগুলো তার এবং নির্বাণের ভিন্ন মুহূর্তের। যা কি-না সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে অতি মিষ্ট। যার মধ্যে নেই কোন অশ্লীলতা, অশালীনতা, আছে শুধু পবিত্রতা, শুদ্ধতা। কিন্তু কালক্রমে বিষয়টা সম্পূর্ণ বিপরীত রূপ ধারণ করেছে। শুধুমাত্র ছবিগুলো তুলে ধরার ভঙ্গিমা এবং শিরোনামে কিছু অকথ্যকথনের জন্যে। যার দরুন তাদের সম্পর্কটা কেউ ভালো দৃষ্টিতে নয় বরং নোংরা দৃষ্টিতেই দেখবে। উপরন্ত শিরোনামটা এমন যে, “শিক্ষকতার নাম নিয়ে শিক্ষক এবং ছাত্রী অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত। জল গড়িয়ে গিয়েছে বহু দূর। দেখুন! নিচের ছবিগুলো তাদের এই অবৈধ মেলামেশার প্রমাণ।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লেখাগুলো পড়ামাত্র স্পর্শীর শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল। তিন বাক্যের শিরোনাম অথচ নির্বাণ এবং তার সম্পর্ককে বনাম করতে যথেষ্ট। তাদের চরিত্রে নোংরামির দাগ লাগাতে ঢেড়। রুদ্র ফের বিদ্রুপ করে বলল, “কি কথা বের হচ্ছে না এখন? সব হাওয়া ফুঁস? আমি কখনো ভাবি নি এই ভোলাভালা চেহেরার পিছনে এমন কুৎসিত এক চেহেরা লুকিয়ে আছে।”
স্পর্শী মন্থর দৃষ্টিতে তাকালো, “সবসময় যে চোখের দেখা সত্যি হয় তা কিন্তু নয়।”

“তাই নাকি? তাহলে তুমি বলতে চাইছো এই ছবিগুলো মিথ্যে? ছবির মধ্যে থাকা মানুষ দু’টি তুমি আর নির্বাণ স্যার না? এডিট সব? বোকা মনে হয় আমাদের? তুমি বলবে আর আমরাও চোখ বন্ধ করে তা মেনে নিব? সত্য যেখানে সামনে সেখানে তোমার মিথ্যে বলার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।”

রুদ্রের কথার বিপরীতে স্পর্শী কোন প্রত্যুত্তর করলো না। নীরব রইলো। আপাতত কিছু বলা মানেই বৃথা, কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না সে-টা সকলের দৃষ্টিতে লুকিয়ে থাকা অবজ্ঞা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কতটা ক্ষীণ সেই দৃষ্টি। একটি পোস্ট সকলের চোখে তাকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছে ভাবতেই স্পর্শীর মন দুমড়ে মুচড়ে গেল। গলা ধরে এলো বারংবার। এর মাঝেই নিধি,কেয়া,সামি এবং মাহিন সেখানে এসে হাজির হয়। ভীড় ঠেলে কোনমতে সামনে গিয়ে রুদ্র আর স্পর্শীকে সামনা-সামনি দেখে তাদের আর বুঝতে দেরি-নি ঘটনা যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। তারা দ্রুত স্পর্শীর পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তাকে আড়াল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে।

এদিকে, স্পর্শীর চুপ থাকাটা রুদ্র স্পর্শীর দূর্বলতা ভেবে পুনরায় আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হলো, “প্রথমে তুমি আমার সাথে ছিলে। আমার সাথে প্রেম,ভালোবাসার নাটক করে ঘুরিয়েছ কয়েকমাস। এরপর আমাকেই ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করে ফেললে তুমি। সকলের সামনে চরিত্র খারাপ আমারটাই দেখালে। কিছু বলেনি তখন, প্রমাণ ছিল না বলে। কিন্তু এখন? প্রমাণ সকলের হাতেই। নিজের স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে স্যারের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছ। রাত পর্যন্ত হয়তো কাটিয়েছ। খাঁটি বাংলায় জানো তো এ সম্পর্ককে কি বলে, পরকীয়া।”

সামি চেঁচিয়ে অকথ্য ভাষায় রুদ্রকে একটি শব্দ দিয়ে সম্মোধন করে বলল, “ভাষা ঠিক করে কথা বল। সাহস কিভাবে হয় তোর স্পর্শীকে নিয়ে এভাবে বলার? তুই জানিস আদৌ কাকে নিয়ে কি বলছিস?”
সামির কথা শুনে রুদ্র মোবাইলে একটা ছবি বের করে
সামির সামনে তুলে ধরে বলে,

“তাই নাকি? তাহলে বল এই ছবিগুলো মিথ্যে, এডিট। পারবি বলতে? পারবি না, কারণ এইখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, স্পর্শী নির্বাণ স্যারের গাড়িতে উঠছে। নির্বাণ স্যারকে নিয়েই নিজের বাসায় ঢুকছে। এর মানে আমরা কি বুঝবো? বল? ছোট বাচ্চা নয় এখানে কেউ, এডার্ল্ট সবাই। ছবিগুলোর অর্থ সবাই ভালোমতই বুঝি আর জানি।”

অতঃপর স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে, “নিজের সিজিপিএ বাড়ানোর আশাতেই করছো এইসব তাই তো? তুমি তো তুমি, দুশ্চরিত্রতা মেয়ে একটা। কিন্তু স্যারও এমন কাজে লিপ্ত দেখে ঘেন্না হলো। বদরাগী হলেও ভালো ভেবেছিলাম তাকে, কিন্তু এই কি-না তার আসল চেহেরা? না জানি এমন ভাবে কত মেয়ের জীবন নষ্ট করেছেন তিনি। তবে এবার স্যার যেমন ছাত্রীও তেমনই পড়েছে তার ভাগ্যে। দুইজনের চরিত্রেই সমস্যা আছে। স্ল্যা*…..”

পরবর্তী কথাগুলো এতই অশ্রাব্য ছিল স্পর্শী নিজের ধৈর্য আর ধরে রাখতে পারলো না। গলারস্বর দ্বিগুণ করে বলল, “জাস্ট শাট আপ। আর একটা বাজে কথা বললে খারাপ হয়ে যাবে বলছি। কি জানো তুমি আমার আর নির্বাণ স্যারের সম্পর্কে? আদৌ জানো কিছু? না জেনে শুনে কাউকে নিয়ে এভাবে জার্জ করার সাহস তোমায় কে দিয়েছে? সবাইকে নিজের মত রাস্তার নর্দমারকীট ভাবা বন্ধ কর।”
“পরকীয়া যদি নাই হয় তাহলে বলো তোমাদের মাঝের সম্পর্ক কি? কিসের ভিত্তিতে তুমি গলা উঁচিয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছ?”
রুদ্রের প্রশ্নে স্পর্শী তৎক্ষনাৎ উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুললো, “আমি নির্বাণ স্যারের ব…..”

‘ব’ উচ্চারণ করতে গিয়েও স্পর্শী থমকে গেল৷ কোন জড়তার কারণে বলা হয়ে উঠলো না তার, সে নির্বাণের বউ। উপরন্ত, বিয়ের প্রথমরাতেই নির্বাণ স্পর্শীকে বলে দিয়েছিল, সে তার পারসোনাল আর প্রোফেশনাল লাইফ দু’টোই আলাদা আলাদা রাখতে চায়। এখন যদি সে তাদের বিয়ের বিষয়টা খোলাসা করে দেয় তাহলে সবটাই ঘেটে যাবে। কোন কিছু বলার আগে হলেও নির্বাণের সাথে তার একবার কথা বলা প্রয়োজন। ধৈর্য ধারণ করতে হবে তাকে নাহলে পুরো বিষয়টাই ঘেটে যাবে।
স্পর্শীকে চুপ হয়ে যেতে রুদ্র শ্লেষোক্তি করে বলল, “তুমি নির্বাণ স্যারের কি? বল! এখন বলছ না কেন? মানুষকে বলার কোন গ্রহণযোগ্য সম্পর্ক খুঁজে পাওনি নাকি? তাহলে আমি বলছি, নির্বাণের স্যারের কাছে তুমি ব্যা* মা* ব্যতীত কিছুই না।”

কথাটা শোনামাত্র মাহিন রুদ্রের কলার চেপে ধরে ওর নাক বরাবর ঘুষি মেরে বসে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে রুদ্র মাটিতে পড়ে যায় এবং সামি তখনই পা দিয়ে রুদ্রের পায়ের কাছে লাথি মেরে বলে অশ্রাব্য ভাষায় কিছু গালমন্দ করে বলে, “তোর সাহস কিভাবে হয় স্পর্শীকে এসব বলার? তোকে তো আজ আমি…”

কথাটা বলে শেষ করার পূর্বেই রুদ্রের বন্ধুরা মাহিন আর সামির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং রুদ্রকে নিচ থেকে উঠিয়ে দাঁড় করায়। বৃহৎ এক গন্ডগোল বাঁধলো তখনই। আশেপাশে ভালোই ভীড় জমেছে। সকলেই নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা, সমালোচনা করেই চলেছে,এগিয়ে আসছে না কেউ। অনেকে মজা নিচ্ছে তো অনেকে আবার মোবাইল বের করে ঘটনা সব শুট করছে। অনেকে আবার ভীড়ের সুযোগ নিয়ে মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে, অপ্রীতিকর উদ্দেশ্যে। অবশ্য আমাদের বাস্তব জীবনের চরিত্র এইটাই। কেউ এখানে কারো আপন নয়। নিজ স্বার্থ না থাকলে কেউ কখনো এগিয়ে আসবে না। কখনো না!

রুদ্রের বন্ধুবান্ধব সংখ্যায় একটু বেশি হওয়ায় সামী ও মাহিন তাদের সাথে পেরে উঠলো না। আহত হলো খানিকটা। এর মাঝেই তাঁদের আরও আহত করতে রুদ্রের বন্ধুদের মধ্যে একজন নিচ থেকে ছোট একটি ইটের টুকরো হাতে নিয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে মারলো। তবে সেটা সামি বা মাহিন কারো গায়ে না লাগলেও, দুর্ভাগ্যবশত স্পর্শীর কপালে গিয়ে সেই ইটের টুকরোটা লাগলো এবং সাথে সাথে কপালের চামড়া ফেটে উষ্ণ রক্তের সরু ধারা কিনার ঘেঁষে চুয়ে চুয়ে পড়তে শুরু করলো। স্পর্শী চাপা আর্তনাদ করে কপাল চেপে ধরলো। রুধিরাক্ত হলো হাত। রক্ত দেখে কেয়া উদ্বিগ্ন,বিচলিত হয়ে পড়লেও নিধি দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে স্পর্শীর কপালে চেপে ধরলো৷

এদিক, সামিকে আহত দেখে রুদ্র নিজের ক্রোধ প্রকাশ করতে পিছ পা হলো না। সামি-র কলার চেপে ধরে বলল, “স্পর্শীকে বললে তোর এত গায়ে লাগছে কেন? তুই কি ওর আরেক ভা** নাকি?”
অতঃপর স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে, “আর কয়টা লাগে তোমার? একজন দিয়ে হয় না? শা* বা…”
রুদ্র নিজের কথা শেষ করার পূর্বেই পিছন থেকে রাশভারি কন্ঠে কেউ খুব জোড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠে, “কি হচ্ছে এখানে?”

মানুষটির আওয়াজে এতই জোর আর দৃঢ়তা ছিল যে সকলেই সে সময়ের জন্য স্থির হতে বাধ্য হলো। কৌতূহলের বসে সকলের দৃষ্টি গেল পিছনের দিকে। সামনে নির্বাণকে তারা আগের ন্যায় ভয় বা সম্মান না দেখাতে চাইলেও, পিছনে ডিপার্টমেন্টের হেড-কে দেখে দমে গেল সকলে। কোন প্রকার রা করলো না কেউ। নির্বাণ পুনরায় চেঁচিয়ে উঠলো, “কি হচ্ছে এখানে?”
কথাটা বলা শেষেই নির্বাণ দৃষ্টি গিয়ে আটকালো রক্তেমাখা স্পর্শীর মুখপানে। ক্ষণেই যেন রক্তক্ষরণ শুরু হলো বক্ষঃস্থলের অন্তরালে। মন হলো উৎকন্ঠিত, ব্যগ্র, উদ্বিগ্ন কিন্তু অভিব্যক্তি রইলো অতি শীতল।

স্পর্শীও নিধির সাথে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে দুর্বলচিত্তে তাকালো নির্বাণের পানে। দৃষ্টিতে না বলা অনেক কথা,অনেক অভিযোগ। ব্যর্থ,আহত অনুভূতি। নির্বাণ চোখ সরালো আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিজেকে শক্ত রাখা দায় হয়ে দাঁড়াবে তার জন্য। এর মাঝে মাহিন আধোস্বরে পুরো ঘটনাটা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু রুদ্র থামিয়ে দিয়ে নিজের মত বানোয়াট কাহিনী বলতে শুরু করলো যেখানে দোষী স্পর্শীরা। তারই প্রতিবাদ জানাতে নিধি,কেয়া বলে উঠল। নির্বাণ তখন কেয়া,নিধিকে চুপ করতে বলে শৈথিল্য দৃষ্টিতে একবার রুদ্রকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। যদিও সে পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবগত তাও কিছু বলল না সে। নীরবে ডিপার্টমেন্ট হেডের সাথে কথা বলে রুদ্র এবং তার বন্ধুদের পাঠানো হলো এডমিনিস্ট্রেশনের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করার জন্য। মাহিন আর সামি খানিকটা আহত হওয়ায় তাদের মেডিক্যাল রুমে পাঠানো হলো, চিকিৎসার জন্য। বাকিদের নিজ নিজ কাজে চলে যেতে বলা হলো। ধীরে ধীরে ভীড় কমে আসতেই নির্বাণ স্পর্শীর হাত ধরে সেই জায়গা থেকে নিয়ে আসলো। তবে, তাদের যাওয়ার পানে সকলে একবার আড়চোখে তাকাতে ভুলল না। কথা বলার জন্য হট গসিপ লাগবে তো নাকি?

খালি একটি ক্যাবিনে বসে আছে স্পর্শী। পিনপতন নীরবতা বিরাজমান চারদিক জুড়ে। ক্যাবিনটা টাপসি ম্যামের, নির্বাণের সাথে তার সখ্যতা আছে বলে স্পর্শীর করুণ অবস্থা দেখে সে রুমটা ছেড়ে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, তিনি নির্বাণ আর স্পর্শীর ব্যাপারে সবই জানেন তাই বিষয়টা নিয়ে তিনি আর ঘাটেন নি। নীরবে প্রস্থান করেছেন জায়গায়টি। নিধি ও কেয়া গিয়েছে সামি ও মাহিনের কাছে, কিছু দরকার কি-না দেখতে।

স্পর্শী হাত গুটিয়ে মলিন মুখে বসে আছে। তার পাশেই কোলে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে বসে আছে নির্বাণ। বৃদ্ধা আঙুল এবং তর্জনীর মাঝে শুভ্র তুলোর অংশটি চেপে ধরে তাতে হ্যাক্সিসল লাগাচ্ছে। অতঃপর কপাল হতে স্পর্শীর হাত এবং রক্তে ভেজা কাপড়টি সরিয়ে দিয়ে খুব সন্তর্পণে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে চেপে ধরে। ক্ষণেই তীব্র যন্ত্রণায় স্পর্শী ঈষৎ কেঁপে উঠে ঠোঁট, চোখ খিঁচে বসে রইলো৷ নির্বাণের যেন এবার অন্তঃস্থলের দহনক্রিয়া বাড়লো। হাতের স্পর্শ আগের ন্যায় আরও কোমল হলো। তার আপ্রাণ চেষ্টা প্রিয়তম মানুষর যাতে সামান্যটুকু কষ্ট না হয়। শুকিয়ে যাওয়া রক্ত উঠিয়ে নিতেও কি যত্ন তার, যেন একটু ঘর্ষণে কোমল মানবীটি ঝড়ে পড়বে। মাঝে মধ্যে জ্বালার পরিমাণ কমাতে নির্বাণ স্পর্শীর কপালের সামনে মুখ এনে ফুঁ দিচ্ছে। ব্যাকুল কন্ঠে প্রশ্ন তার, “জ্বালা করছে? আর একটু, এতো হয়ে গিয়েছে। সামান্য আঘাত, ঠিক হয়ে যাবে।”

নির্বাণ মুখে বলছে ঠিকই ‘সামান্য আঘাত’ কিন্তু হৃদয় যে বলছে অন্য কথা। যেখানে প্রেয়সীর ক্ষুদ্রতর আঁচড় তার বোধগম্য হয় না সেখানে আজ তার রক্ত জড়েছে। শান্ত সে কিভাবে থাকে? স্পর্শী চোখ মেলে নিবার্ণের দিকে তাকালো। তার মুখের অভিব্যক্তি এতটাই করুণ যে দেখে মনে হচ্ছে ব্যথা সে না বরং নির্বাণ নিজে পাচ্ছে। খেয়াল হলো, নির্বাণের হাত কাঁপছে৷ সেই কাঁপাকাঁপা হাতেই পুরো ড্রেসিংটা শেষ করলো নির্বাণ। সবশেষে মাথায় ওয়ান-টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও হয়ে গিয়েছে। বেশি ব্যথা করছে না তো?”

শেষ প্রশ্নটি করা মাত্রই যেন শক্ত নারীর মনটি দুর্বল হয়ে পড়লো। পাড়লো না আর নিজেকে ধরে রাখতে, আপন মানুষটার কাছে এসে ভেঙ্গে পড়লো সে। বুক চিরে বেরিয়ে এলো তীব্র আর্তনাদ। সম্মানহানির আত্মগ্লানি যেন তাড়া করে বেড়াতে শুরু করলো। ফুপিয়ে উঠলো সে, নয়নের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো তপ্ত জলের বিবর্ণ ধারা। ক্ষণেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি আগলে নিল তাকে, ঠাঁই পেল তার বুকে ঊষ্ণ আলিঙ্গনের মাঝে। নির্বাণ বলল, “হুস! কাঁদে না। আমি আছি না তোমার পাশে?”

আশকারা পেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক মনটি সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোরীর মনে রূপান্তরিত হলো। ক্ষীণ কন্ঠে টেনে টেনে কথা বলল সে, “সবাই আমাকে অনেক নিচু চোখে দেখছে। বাজে, বিশ্রী ভাষায় গালি দিচ্ছে। রুদ্র তো সবার সামনে বলেই দিয়েছে আমি নাকি…”
অশ্রাব্য ভাষায় বলা সে কথাটি বলে স্পর্শী পুনরায় ফুঁপিয়ে উঠলো। নাক টানতে টানতে বলল, “সবাই আমাদের সম্পর্ক খারাপ চোখে দেখছে। নোংরা ভাষায় সম্মোধন করছে। কিন্তু আপনার আমার সম্পর্ক নোংরা না, তাই না? বলুন না?”
নির্বাণ স্পর্শীর পিঠে হাত গলিয়ে দিয়ে বলে, “শান্ত হও। নোংরা বললেই আমাদের সম্পর্ক নোংরা হয়ে যাবে না। সত্য এইটাই, তুমি আমার বিয়ে করা বউ।”

স্পর্শী কিছু বলল না ফুঁপিয়ে গেল। সে তো জানে তাদের সম্পর্ক কি কিন্তু মানুষের দেওয়া এত এত অপবাদ কি আর ভোলা যায়? পুরো ক্যাম্পাস জুড়েই এখন তাদের কথা চলছে। নোংরা চোখে, বিশ্রী ভাষায় তুলে ধরা হচ্ছে তাদের সম্পর্ক। একটি নারীর কাছে তার সম্মান সব-চাইতে মূল্যবান। আর আজ সেই সম্মানই হানি হয়েছে। কিভাবে সবটা মেনে নিবে সে? কিভাবে? এখনো যে তার কানে রুদ্রের অশ্রাব্য ভাষা ও অকথ্যকথন কানে ভেসে বেড়াচ্ছে তার।

স্পর্শীর ভিতরকার অবস্থা নির্বাণ সম্পূর্ণরূপে ধরতে না পারলেও আংশিক আঁচ করতে পেরেছে ঠিকই। সান্ত্বনা দিতে নয়, সত্যিকার অর্থেই বলে উঠলো সে, “তোমার সম্মান হানি আমি হতে দিব না স্পর্শী, এতটুকু বিশ্বাস করো আমার উপর। সবকিছুর হিসাব আমি নিব এবং বিশেষ খেয়াল রাখবো কোন ছুট যাতে সে না পায়। সর্বোচ্চ শাস্তিটা যেন লায়। তোমার সকল কষ্টের, ঝরা প্রত্যেকটা রক্তের ফোঁটার এবং অশ্রুর সবকিছুর দাম তাকে দিতে হবে।”

স্পর্শী তখনও নির্বাক। কান্না করতে করতে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই ভারী হয়ে এসেছে তার। নির্বাণ স্পর্শীর মাথায় আদরমাখা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “সব ব্যবস্থা করা হয়ে গিয়েছে, এতো আর কিছু সময়ের ব্যবধান। এরপর সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কর না৷”

মিনিট ত্রিশের পরই ক্লাসের সিআর এসে জানালো ক্লাসে সবাই এসে পড়েছে, নির্বাণ চাইলে এখন ক্লাস নিতে পারে। নির্বাণ হ্যাঁ সূচক উত্তর জানিয়ে দিয়ে সিআর-কে বিদায় করে দেয়। অতঃপর খুব সন্তর্পণে স্পর্শীর চোখ-মুখ মুছে দিয়ে তার হাতের ভাঁজে হাত ডুবিয়ে দিয়ে অগ্রসর হয় ক্লাসরুমের দিকে। নিধিরা যখন ওর কাছে পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবগত করতে এসেছিল তখনই সে বুঝেছিল পুরো বিষয় সে নিজ থেকে পরিষ্কার না করলে কিছুই হবে না। তাই সে সিআর-কে আর্জেন্ট ক্লাসের নোটিশ দেয় এবং সকলকে দুই ঘন্টার মাঝে থাকতে বলে। সে সাথে আজ এবসেন্ট থাকলে নাম্বার কাটা হবে বলেও সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছিল। সিআরও নির্বাণের কথা অনুযায়ী সকল গ্রুপ আর সাইটে খবরটা দিয়ে দেয় এবং ঘন্টাখানিকের মাঝেই স্টুডেন্টরাও ক্লাসরুমে একত্রিত হয়।

নির্বাণ আর স্পর্শী ক্লাসেরুমে প্রবেশ করার পর পরই সকলের নজর যায় তাদের উপর। বাঁকা চোখে সকলেই তখন দুইজনের হাতের বাঁধনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে তাদের অপ্রীতিকর ভাবনার আসড়। কেন না, ক্লাসে উপস্থিত কম-বেশি সকলেই প্রায় চলমান ঘটনা নিয়ে অবগত। বিগত ভোররাতে নির্বাণ আর স্পর্শীর ছবি পোস্ট হলেও বেলা হওয়ার পূর্বেই ছবিগুলো সব জায়গায় ভাইরাল হয়ে যায় এমন সকলের নিউজফিডে চলে যায়। যার দরুন, কেউ আর অজানা থেকে যায় না বিষয়বস্তুটি থেকে।

স্পর্শী একবার মাথা তুলে চোখ বুলালো চারদিকে। সকলের চোখেই তখন ঘৃণা,অবজ্ঞার রেশ বিদ্যমান। ওষ্ঠ্যের কোণে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। কেউ কেউ এখনো ফোন বের করে ছবি তুলছে, ভিডিও করছে তাদের। পরবর্তীতে রংচং মাখিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে বলে হয়তো। সকলের এমন মনোভাব স্পর্শীর সহ্য হলো না, দ্রুত মাথা নুয়ে নিল সে। ক্ষীণ প্রচেষ্টা করলো নির্বাণের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার। তবে পারলো না, হাত ঢিলে করার জায়গায় আরও শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরলো নির্বাণ।

মুখের সামনে মাইকটা ভালোমত সেট করে বলতে শুরু করলো, “রিসেন্টলি ভার্সিটির মেইন গ্রুপে এবং বিভিন্ন রিলেটেড গ্রুপে আমাদের দুইজনকে নিয়ে কিছু ছবি পোস্ট হয়, সেগুলো নিশ্চয়ই দেখেছ তোমরা। ছবিগুলো নিয়ে সকলের অনেক মতামত, অনেক চিন্তাধারা। আমাদের সম্পর্ক নিয়েও সকলের বেশ সন্দেহ, কৌতূহল। কিন্তু উপযুক্ত তথ্যের অভাবে সকলেই দ্বিধায় ভুগছো। তবে আসল সত্যটা না জেনেই যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছ, হ্যারাস করছ আমাকে এবং স্পর্শীকে। একবারও কি চেষ্টা করেছ সত্যটা জানার? তা আর করবে কেন? রসমাখা একটা নিউজ পেলেই হয়, সেটা সত্য নাকি মিথ্যে যাচাই না করেই শেয়ার করতে জানো তোমরা। উল্টো পারলে আরও এক্সট্রা মশলাপাতি মাখিয়ে বড় করে বিষয়টা তুলে ধরো তোমরা। কিন্তু তোমরা ভুলে যাও কেন, একই মুদ্রার যেমন বিপরীত মুখ থাকে, তেমনই একটি ঘটনারও দু’টি দিক থাকে। ছবিগুলো সত্য ঠিকই কিন্তু সেখানে তুলে আমাদের সম্পর্কটা মিথ্যে। এখন আমার আর স্পর্শীর সম্পর্ক নিয়ে তোমাদের সকলের যত কৌতূহল তাই তো?”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৪

এতটুকু বলে নির্বাণ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। পুরো ক্লাস তখন নীরব, মনোযোগী। কেন যেন নির্বাণের অকম্প কন্ঠ তাদের আকৃষ্ট করছে পরবর্তী কথার শোনার। হয়তো বা আগে নির্বাণ কখনো পড়ার বাহিরে এমনভাবে কথা বলেনি তাই আগ্রহ আজ তুলনামূলক একটু বেশি৷ সকলেই এখন অপেক্ষায় নির্বাণেই পরবর্তী কথাটি শোনার জন্যে। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে নির্বাণ দৃঢ়কণ্ঠে বলে, “স্পর্শী আমার বিয়ে করা স্ত্রী। সি ইজ দ্যা ওয়াইফ অফ নির্বাণ সাইয়্যেদ।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৬