চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৯

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৯
Writer Asfiya Islam Jannat

চলতি সময়ের মধ্যেই যেন সূর্যকরোজ্জ্বল গগনের মন ক্ষুণ্ণ হলো। আঁধার নামলো মেঘের কোল ঝুড়ে।
শেফালি ফুলের নরম গায়ে অনিল আঁচড় কাটতেই দোলায়মান হলো তারা। কয়েকটা ঝরে পড়লো নিমেষে। ঝপঝপ শব্দ করে শালিকের দল উড়ে গেল দিগন্তে। হয়তো আজ ধরণির বুক জুড়ে নামবে এক মুঠো শীতলতা। বদ্ধ এক কক্ষে হাতে উষ্ণ কফির কাপটি চেপে নির্বাণ কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সকল কিছু তাপসিকে খুলে বলল। অতঃপর জানালার বাহিরে তাকিয়ে দেখতে থাকলো বিষণ্ণ আকাশটিকে। পাশেই তাপসি দু’হাতের মাঝে কফির কাপটা চেপে ধরে অপ্রসন্ন কন্ঠে বললেন, “ভিসি স্যার এইটা কিভাবে বলতে পারলেন যে, আপনি শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্ক হীন করেছেন? এই কথাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? তাহলে তো বলা চলে, পৃথিবীর সব শিক্ষকই এই হীন কাজটি করেছেন, কেননা তারাও কোন না কোন স্টুডেন্টকেই বিয়ে করেছেন। এখন কি সবাইকে সাসপেন্ড করবেন নাকি তিনি? হাস্যকর লাগলো ব্যাপারটা আমার কাছে।”

নির্বাণ স্মিত হাসলো, “আপনি এখনো ধরতে পারেননি বিষয়টা। শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্কটা অযুহাতমাত্র দেখিয়েছেন তিনি, আসল কাহিনী হচ্ছে আমি সামান্য একজন লেকচারার হয়ে তার পারমিশন ছাড়াই ট্রাইবুনালদের ডেকেছিলাম আর তাকে কিছু না জানিয়ে কাহিনি করেছিলাম সেটাই তার ইগোতে লেগেছিল। যার জন্য তিনি মিটিংয়ে নিজ থেকে আমার কথা উঠিয়ে, নিজেই সকল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর তিনি এসব করেছেন শুধুমাত্র নিজের পাওয়ার দেখাতে। কিন্তু সে তো আর জানে না, ভিতরের খবর কোনটাই আমার অজানা না।”
“আজব তো! এটা কোন কথা নাকি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আপনি নিজেই একবার ভাবুন, তার যদি শিক্ষক-ছাত্রীর বিয়ে নিয়ে সমস্যা হতো তাহলে মুহিব স্যারের বিয়েতে গিয়ে তিনি এক হাড়ি দই খেয়ে শেষ করতেন নাকি? মুহিব স্যারও তো এই ভার্সিটিরই অন্যের ডিপার্টমেন্টের এক ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন। তাও ঘটা করে। কথা কিন্তু তখনও কম উঠেনি, বেশ সমালোচনায় ছিলেন তিনি। তবে সেটা নিয়ে কি ভিসি স্যারের মাথাব্যথা হতে দেখেছেন? না, কারণ ভার্সিটি লেভেলে এসে এই বিষয়টা অতি সাধারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও পাছে লোকে সব জায়গায় কথা বলে। সবাই সবকিছু ভালোভাবে নিতে পারেনা। এখনো এমন কিছু মানুষ আছে যারা শিক্ষক-ছাত্রীর বিয়ে ভালো চোখে দেখে না।”

তাপসি ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালেন, “তা নাহয় বুঝলাম কিন্তু আপনি কি তাহলে লোকভয়ের জন্য ছেড়ে দিলেন চাকরিটা?”
নির্বাণ দৃষ্টি কফির কাপটায় নিবদ্ধ করে বলল, “ভুল বললেন। লোকভয় আমার মধ্যে কোন কালেই ছিল না। আর থাকবেও না। আমি চাকরিটা ছেড়েছি অন্য কারণে।”
তাপসি কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি সেই কারণ?”
“মন উঠে গিয়েছে এই প্রফেশন থেকে। আগের মত সেই টান অনুভব করি না। কালক্রমে রিজাইন আমি করতামই। হয়তো আজ না করে একমাস পর করতাম, পার্থক্য শুধু এখানেই।”

“বুঝলাম। তবে আপনি যখন সব জানতেন তখন ভিসি স্যারের মুখের উপর কিছু বললেন না কেন?”
“তার সাথে তর্কে জড়ানোর ইচ্ছা আমার ছিল না তাই। বললে তো কত কিছুই বলা যায়। হয়তো আজ মুখ খুললে এমন কিছু বলে ফেলতাম যা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তখন আবার বিশ্রি এক ঘটনা ঘটে যেত।”
তাপসি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “আপনি পারেনও বটে। তা আপনার কি মনে হয় স্যারের মুখের উপর রেজিগনেশন লেটার দিয়ে এসেছেন তিনি ঝামেলা করবেন না?”

নির্বাণ কাপে আলতোভাবে অধর ছুঁয়ে নির্বিকার কন্ঠে বলল, “ঝামেলা করার সুযোগ নেই তার কাছে। কারণ আমি এখানকার সাধারণ একজন লেকচারার, কোন প্রফেসর না যে যখন তখন রিজাইন করতে পারব না বা তিনি আমার উপর কোন এলিগেশন লাগিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করবেন।”
“আছেন আর কতদিন?”
“মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত আছি৷ ”
তাপসি আড়ষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে আর এক সপ্তাহ?”
“হ্যাঁ।”
“এরপর কি করবেন ভেবেছেন?”

নির্বাণ একপলক তাকালো তাপসির দিকে, “পরিকল্পনা আছে একটা। যদি সেটার মতই সব তাহলে সেটেল হতে বেশি সময় লাগবে না আশা করি।”
“যাক ভালোই।”
নির্বাণ স্মিত মুখে তাকিয়ে কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে বলল, “উঠি এখন। আমার ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। থ্যাংক্স ফর দ্যা কফি।

তাপসি মৃদু হাসলো। নির্বাণ সেন্টার টেবিলের উপর থেকে নিজের বই নিয়ে বেরিয়ে গেল। কলাভবনের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য দাঁড়ালো। নিষ্প্রভ চাহনিতে তাকালো সুদূরে মাথা উঁচিয়ে থাকা বটমূলটার দিকে। তারই নিচে বন্ধুমহলের আড্ডায় স্পর্শী ম্লানমুখে বসে আছে। মাঝে মধ্যে বন্ধুমহলের কথায় মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে তুলছে ঠোঁটের কোণে। বুঝতে দেরি নেই, বিগত দিনের ঘটনা থেকে এখনো ঠিকঠাক বেরিয়ে আসতে পারেনি সে।

রেশ রয়ে গিয়েছে এখনো৷ যদিও মেয়েটাকে সে কয়েকদিন ভার্সিটি আসতে নিষেধ করেছিল, সাথে কোনকিছু নিয়ে মন খারাপ করতেও কিন্তু মেয়েটা তার কথা শুনলে তো। বড্ড অবাধ্য সে। এই যে এখনো, ঝোড়ো হাওয়ার মাঝে বসে আছে৷ ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লেগে গেলে? তার উপর কখন ঝুম বৃষ্টি নেমে পড়ে কে জানে? বুদ্ধি-সুদ্ধিও বোধ হয় লোভ পাচ্ছে মেয়েটার। স্পর্শীকে নিয়ে কি যে করবে নির্বাণ কে জানে? দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দ্রুত কয়েকটি শাণিত শব্দে বাক্য এঁটে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল স্পর্শীকে। অতঃপর মুঠোফোনটা পকেটে পুরে হাঁটা দিল ক্লাসের দিকে।

আকাশ জুড়ে তখন কৃষ্ণমেঘের রাজত্ব। দিবালোক হয়েও যেন নিশুতি রাতের প্রহর চলছে। কিঞ্চিৎ সময় যেতে না যেতেই গা ঝাঁকুনি দিয়ে এক পলশা বৃষ্টি নামলো তপ্ত ধরার মধ্যখানে৷ আলতোভাবে ছুঁয়ে সিক্ত করে তুললো শুভ্রতায় মোড়ানো কোমল ফুলের গা। অকৃত্রিম ঘ্রাণে মাতোয়ারা হলো আশপাশ। নিজের মন ভোলাতে বিষণ্ণচিত্তে সামনে দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল স্পর্শী। শীতল কণাগুলো ছুঁয়ে দিতে থাকলো ম্রিয়মাণ নয়নে। অকস্মাৎ ফোনটা বেজে উঠলো তার। নির্বাণ ফোন দিয়েছে৷ স্পর্শী ফোন তুলতেই নির্বাণ জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় তুমি?”

স্পর্শী আশপাশে তাকিয়ে সে এখন কোথায় তা জানালো নির্বাণকে। জায়গায় সনাক্ত করতে পেরে নির্বাণ বলল, “সেখানে দাঁড়িয়ে থাকো আসছি আমি। ভুলেও ভিজবে না৷”
স্পর্শী অবসন্ন কন্ঠে সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখলো। কিয়ৎকাল পরই নির্বাণ গাড়ি নিয়ে স্পর্শীর সামনে হাজির হলো। ভিতর দিয়ে গেট খুলে দিয়ে স্পর্শীকে দ্রুত ভিতরে এসে বসতে বলল সে৷ স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে নীরবে উঠে বসে দরজা লাগালো। নির্বাণ এবার পকেট থেকে রুমাল বের করে স্পর্শীর আর্দ্র হাতটি মুছে দিল। অতঃপর মুখে-চোখে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জলগুলো মুছে দিল খুব যতনে। কপালের কিনারে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটাও দেখে নিল একবার, তাতে পানি ঢুকেছে কি-না। মেয়েটা যে বেখেয়ালি আচরণ করে, তার দ্বারা কোন ভরসা নেই৷ নির্বাণের চিন্তিত মুখ দেখে স্পর্শী বলল, “আমি ঠিক আছি।”

নির্বাণ তাও সরে আসলো না। ভালোমত আঘাতটা দেখে নিল আরেকবার। অতঃপর সরে এসে গম্ভীর কন্ঠে বলল, “তোমাকে আজ ভার্সিটি আসতে মানা করেছিলাম আমি।”
স্পর্শী মাথা নত করলো। আজ ভার্সিটি আসতে চায়নি সে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু নোটসের জন্য আর ল্যাব স্যারের আর্জেন্ট ডাক পড়ায় অগত্যা আসতে হলো তাকে। এখন এতে কি করবে সে? মিনমিন কন্ঠে উত্তর দিল সে, “গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। আবার ল্যাব স্যারও ডেকেছিলেন সবাইকে তাই…..”
“বুঝেছি আর বলতে হবে না৷ সকালে খেয়েছ কিছু?”

স্পর্শী মাথা দোলালো৷ যার অর্থ সে খেয়েছে। নির্বাণ এবার আর কিছু না বলে স্পর্শী সান্নিধ্যে এগিয়ে দিয়ে তার সিটবেলটা লাগিয়ে দিল। সাথে সিটটা কিছু পিছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে বলল, “রেস্ট নাও এখন। মাথা কোনরকমের প্রেশার দিও না।”
একটু থেমে আবার বলল সে, “পানি পড়েছে মাথায় একটু, কাপড়টা নামিয়ে নাও। নাহলে পরে মাথাব্যথা করবে। এখানে আমি বাদে তো কেউ নি।”

স্পর্শী স্মিত মুখে তাকালো। মাথার কাপড় নামিয়ে গা আলগা করে বসলো সিটে। নির্বাণ সেদিক আর তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করলো। কিছু সময় ড্রাইভ করার পর পরই গাড়িটা থামলো। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই নির্বাণ গাড়ি থেকে নেমে গেল। স্পর্শী সেদিকে হতবিহ্বল নয়নে তাকালো। তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন জাগলো মনে, “আরেহ! হঠাৎ লোকটার কি হলো? এই বৃষ্টির মধ্যে গেল কোথায় সে?” প্রশ্নটির জবাব খুঁজে পেতে বেশি অপেক্ষা করতে হলো না স্পর্শীর। কিছু সময়ের ব্যবধানেই নির্বাণ একটা পলিথিন হাতে নিয়ে ফেরত এলো৷ স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই নির্বাণ পলিথিনটা স্পর্শীর কোলে দিয়ে নিজের চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকাল। অল্প সময়ের ব্যবধান হলেও বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছে নির্বাণ। স্পর্শী অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে সেদিক তাকিয়ে একবার নিজের কোলে তাকালো, আইসক্রিম রাখা আছে তাতে। স্পর্শী স্তম্ভিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এইটা আনতে বাহিরে গিয়েছিলেন?”

নির্বাণ ছোট করে বলল, “হু!”
“আপনি পাগল? বৃষ্টিতে ভিজে কেউ আইসক্রিম আনতে যায়?”
নির্বাণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো, “সমস্যা কি এতে?”
“সমস্যা নেই বলছেন?”
“নেই তো।”
স্পর্শী ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “হঠাৎ এমন পাগলামি করলেন কেন?”
“বৃষ্টির দিনে আইসক্রিম খাওয়া কি তোমার অভ্যাস নয়?”

স্পর্শী থমকালো। গোল গোল চোখে তাকালো। ঠোঁটের কোণে ফুটল নিরন্তর হাসি। কোন এক সময় কথায় কথায় স্পর্শী নির্বাণকে জানিয়েছিল বৃষ্টিমুখর দিনে আইসক্রিম খাওয়া তার ছোটবেলার অভ্যাস। প্রায়শই সে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বা ভিজতে ভিজতে আইসক্রিম খেতে প্রচন্ড পছন্দ করে। এমন সময় তার মন খারাপ থাকলেও সেটা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কথাটি সে একবারই বলেছিল নির্বাণকে। সেই হিসাবে মানুষটা সেই কথা এখন অবধি মনে রেখেছে তা ভাবতেও পারেনি স্পর্শী। বিস্ময়-বিহ্বল কন্ঠে সে বলল, “আপনার এখনো মনে আছে কথাটা?”

নির্বাণ মনে মনে বলতে চাইলো, “প্রেয়সীর মন ভোলানোর বিষয়বস্তু কি আর ভুলে থাকা যায়?”
কিন্তু মুখে বলল অন্যভাবে, “ভুলার বিষয়বস্তু তো ছিল না যে, মনে থাকবে না।”
স্পর্শীর হাসলো। কোল থেকে পলিথিন ব্যাগটা নামিয়ে রেখে নিজের ওড়নার একপাশ টেনে বলল, “এদিক আসেন। মাথায় পানি জমে আছে এখনো, মুছে দিচ্ছি।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৩৮

নির্বাণ একবার ‘দরকার নেই’ বলতে গিয়েও বলল না। স্পর্শীর নরম চাহনিতে আহত হয়ে পরাজিত সৈন্যের ন্যায় মাথা ঝুঁকিয়ে নিল। স্পর্শী আর এদিক-সেদিক না তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিল৷ নির্বাণের চুল ভালোমত মুছে দিয়ে স্পর্শী ক্ষান্ত হলো, নির্বাণও আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। ততক্ষণে স্পর্শী পলিথিন থেকে কোণ-আইসক্রিমটা নিয়ে খেয়ে শুরু করেছে। নির্বাণ আড়চোখে একবার তাকালো। স্পর্শীর অধরের কোণে মাধুর্য লেগে থাকতে দেখে মন প্রশান্ত হলো। যদি প্রণয়িনী নারীটি জানতো তার সামান্যটুকু হাসির জন্য মানবটি প্রলয়কারীও হয়ে উঠতে পারে তাহলে হয়তো সে কখনোই মন ক্ষুণ্ণ করার স্পর্ধা করতো না।

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪০