চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪১

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪১
Writer Asfiya Islam Jannat

‘সময়’- তিন বর্ণের সম্মিলনে গঠিত ক্ষুদ্র শব্দটি প্রচন্ড নিষ্ঠুর বোধহয়৷ কারো চাতক পাখির ন্যায় মন যে অপেক্ষার প্রহর গুণতে মগ্ন, ক্লান্ত সে-টা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের গতিবেগে ছুটেই চলেছে। ধীরে নয়, দ্রুত। মায়া-দয়া না দেখিয়ে, অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতম করে পাষাণ হওয়ার পরিচয় দিচ্ছে যেন। দহনক্রিয়া বাড়লো, অশান্ত হলো মন। আজ প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলল নির্বাণের সাথে স্পর্শীর কোনরকমের কথাবার্তা নেই, দেখা-সাক্ষাৎ নেই।

মানুষটা আদৌ ভালো আছে নাকি খারাপ সে খবরটুকু পর্যন্ত নেই স্পর্শীর নিকট। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পুরোপুরিভাবে। স্পর্শী না-হয় অভিমানে খোঁজ নেয়নি, তাই বলে কি নির্বাণও নিবে না? এটা কোন কথা? মানুষটা কি মনে করে তার একাই রাগ আছে, স্পর্শীর নেই? কি বাই বলেছিল এমন সেদিন যে এত রাগ দেখাতে হবে তার সাথে? তার কথার প্রেক্ষিতেই তো সে কথাটা বলেছিল সে। প্রত্যক্ষভাবে তার দোষ কোথায় এখানে? আনমনে কথাগুলো আওড়ে স্পর্শী ক্ষান্ত হলো। পাহাড়সম অভিমান নিজের স্থান দখল করে নিল ছোট মনের এককোণে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ডুবন্ত সাঁঝের হরিদ্রাভ-রক্তিমা আকাশের গহীনে নিষ্প্রভ নয়নে তাকালো সে। ঈষৎ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর স্পর্শীর হাতের মুঠোয় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা ফোনটার কেঁপে উঠামাত্র চোখের তারা চিকচিক করে উঠল। কিঞ্চিৎ আশা নিয়ে ঝটপট তাকালো সেদিক৷ আদৌ কোন মেসেজ বা কল এসেছে কি-না কাঙ্ক্ষিত মানুষটির হতে দেখতে। কিন্তু স্ক্রিনে ‘গ্রামীণ সেরা অফার’ মেসেজটি দেখে মেজাজ চটে গেল তার। আজব তো! এই কোম্পানি ওয়ালাদের কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি? দিনে কত মেসেজ পাঠায় তারা? বিরক্তিকর! এদিকে যার মেসেজ দেওয়া কথা তার যেন ব্যস্ততার অন্ত নেই।

আচ্ছা,মানুষটার কি একটুও মনে পড়ে না তার কথা? দহন হয় না বক্ষঃস্থলে? তার তো হয়। প্রচুর হয়। তাই তো সেদিন থাকতে না পেরে অভিমান ভুলে ফোন করেছিল নির্বাণকে। একবার নয়, কয়েকবার। কিন্তু ফোন তার কখনো বন্ধ ছিল, কখনো বা আনরিচেবল। তখন থেকেই অভিমানের ঘনত্ব দ্বিগুণ হয়। চেষ্টা করে না আর যোগাযোগ করার। কথাটা ভেবে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেললো সে। শূন্য অনুভব হলো অন্তঃকরণে। মনের মাঝে সে যতই রাগ পুষে রাখুক না কেন সত্য এটাই নির্বাণ তার অভ্যাসে,বদভ্যাসে নয় বরং প্রিয় এক অসুখে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে, যা কখনো নিরাময় হওয়ার নয়। তার প্রতি নির্বাণের যত্নশীলতা-দায়িত্বশীলতা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথার পৃষ্ঠে লুকিয়ে থাকা আবেগ-অনুভূতি এতটা প্রখর যে মানুষটাযে ভুলে থাকা অসম্ভব। নির্বাণ বিহীন যেন তার জীবন নির্জীব,নিষ্প্রাণ। ভালো লাগার ছিটে ফোঁটা নেই তাতে। আছে শুধু বিষণ্ণতা৷

মধুর এক ধ্বনি গুঞ্জিত হলো চারদিক, গোধুলির আকাশ আঁধার আকাশের গহীনে ঢাকা পড়ল। স্পর্শী বারান্দা থেকে রুমে এসে অবসন্ন পায়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে, মুঠোফোনটা বিছানায় ফেলে ওযু করে সালাত আদায় করে নিল। শেষে মোনাজাতে নির্বাণের নামটা রাখতে ভুলল না। রাগ-অভিমান দীর্ঘ হোক তবুও সুস্থ থাকুক মানুষটা। সালাত শেষে স্পর্শী পার্শিয়াকে নিয়ে বিছানায় উঠে বসলো, মন ভুলাতে ল্যাপটপে একটা মুভি ছেড়ে দিল। কিয়দংশ সময় এভাবেই কেটে যাওয়ার পর কলিংবেলের আওয়াজ তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো। তবে স্পর্শী সেদিক খেয়াল দিল না এতটা, সম্পূর্ণ মনোযোগ তখন নিবদ্ধ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলতে থাকা ‘স্পাইডার ম্যান’ মুভিটার দিকে।

সবচেয়ে ইন্টেরেস্টিং পার্টটাই চলছে এখন, নেত্রপল্লব ফেলাও দায়। অকস্মাৎ কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কন্ঠস্বর এসে তরঙ্গিত হলো কর্ণগোচরে। ভড়কে উঠলো সে। সচকিত দৃষ্টি তাকালো আশেপাশে, মনের ভুল ভাবলো একবার। কিন্তু পুনরায় বাহির হতে মানুষটার শব্দধ্বনি শুনতে পেয়ে প্রায় তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে দাঁড়ালো সে৷ দরজার কাছে এসে সামান্য ফাঁক করতেই ড্রয়িংরুমে বসে থাকা শ্যাম পুরুষটির উপর দৃষ্টি পড়লো। ঠিক তখনই মরুভূমি মনে এক পশলা বৃষ্টি নামলো, তৃষ্ণার্ত চাহনি প্রসন্নচিত্তে জ্বলজ্বল করে উঠলো। কতদিন পর মানুষটি একটু দেখা।

যেন শতযুগ। স্পর্শীর দরজার আড়াল থেকেই একমনে, একদৃষ্টিতে দেখতে থাকলো৷ নির্বাণ তখন সাহেলা আর মিজানের সাথে কথায় মশগুল। মাঝে মধ্যে কারো খোঁজে আশপাশ তাকাচ্ছে। স্পর্শী আনমনে হাসলো। পরক্ষণেই নির্বাণের কর্মকাণ্ডের কথা মনে পড়তে অভিমানের দল মাথা চাড়া দিল। সে দরজা ভিড়িয়ে চুপচাপ ল্যাপটপের সামনে বসল। মনোযোগ বাহিরে থাকা সত্ত্বেও জোড়পূর্বক মুভি দেখতে থাকলো।
একটু পর দরজা খোলার শব্দে সেদিক চোখ তুলে তাকালো স্পর্শী। নির্বাণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। হঠাৎ নির্বাণ বলে উঠে, “পার্শিয়া, রুম থেকে যাও তো।”

স্পর্শী বিরোধিতা করে বলে, “পার্শিয়া তুই কোথাও যাবি না। এখানে চুপচাপ বসে থাক।”
নির্বাণ সরু চোখে তাকালো, শান্ত কন্ঠে বলে, “পার্শিয়া থাকলে কিন্তু তোমায় লজ্জায় পড়তে হবে। পরে আমাকে কিছু বল না।”
স্পর্শীর কথার যথার্থ অর্থ ধরতে পেরে রোষানল দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের পানে। এদিকে পার্শিয়া কি বুঝলো কে জানে, সে মৃদুস্বরে ডেকে উঠে খাট থেকে নেমে নীরবে নির্বাণের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। নির্বাণ সেটা দেখে মৃদু হাসলো। ধীরে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে স্পর্শীর সান্নিধ্যে এসে বসলো। এক ঝলক ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে বলে, “সাথে চিপস,পপকর্ণ, কোক নিয়ে বসো নি?”

স্পর্শী আড়চোখে একবার তাকালো নির্বাণের দিকে, অতঃপর মনোযোগ দিল মুভিতে। ভাব এমন, মুভি না দেখলে সে এখনই মারা যাবে। নির্বাণ স্পর্শীর কানের কাছে উন্মুক্ত চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলে, “এখনো রাগ করে আছো?”
স্পর্শী উত্তরের বদলে ভিন্ন এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল নির্বাণের দিকে, “কেন এসেছেন আপনি? কাজ কি এখানে আপনার?”
“কেন কাজ ছাড়া আসা কি নিষেধ? নাকি জরিমানা আছে?”
স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। এমনকি ঘুরে তাকালাও না নির্বাণের দিকে। নির্বাণ আচ্ছন্ন স্বরে বলল, “বেশি রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।”

স্পর্শী ব্যঙ্গার্থ করে বলে, “হাহ! লুক হু ইজ টকিং।”
নির্বাণ স্মিত হাসলো, “পঞ্চগড় ছিলাম এতদিন, নেটওয়ার্কের বাহিরে। যার জন্যে ফোন দেওয়া সম্ভব হয়নি কোনভাবে, জানাতেও পারিনি তোমায় কিছু। তোমাকে সেদিন বাসায় নামিয়ে পরেরদিন ভোরেই রওনা দিয়েছিলাম। আর্জেন্ট নোটিশে যেতে হয়েছিল সেখানে, তাড়াহুড়োই ছিলাম তাই জানিয়ে যেতে পারিনি তোমাকে৷ ভেবেছিলাম সেখানে গিয়ে জানাব কিন্তু পরে নেটওয়ার্ক মিলে নি তাই বলাও হয়নি। আজ সকালেই এসেছি আর এখন এখানে। ”
স্পর্শী বলল, “হুম ভালো। আমি কে বাই হই আপনার যে জানাবেন আমায়? আদৌ কি কিছু হই?”
নির্বাণ স্পর্শীর দুই গালে হাত গলিয়ে নিজের দিকে মুখ ঘুরালো। মন্থর কন্ঠে বলে, “কিছু না, আমার সবকিছু হও তুমি। বুঝেছ? পরেরবার এভাবে বলবে না।”

স্পর্শী এক রোখা কন্ঠে বলল, “কেন বলব না? একশোবার বলব। কিছু হই না আমি আপ…”
কথাটা শেষে হওয়ার পূর্বেই নির্বাণ সন্তপর্ণে নিজের অধর স্থাপন করলো স্পর্শীর অধরযুগলে। সুহৃত্তম ব্যক্তিটির সান্নিধ্য পাওয়ামাত্র বরফের ন্যায় গলে পড়ল সকল অভিমান। সর্বগ্রাসা হলো অনড় নারীর মন। কিয়ৎক্ষণ পর নির্বাণ সরে এসে বলো, “এখন বল কি বলছিলে।”

স্পর্শীর অভিব্যক্তি রক্তিমার চাদরে বেষ্টিত হলো। লাজুকলতা দেখা দিল নয়নের আনাচেকানাচে৷ নজর তোলা গেল না আর। নির্বাণ নিচু হয়ে স্পর্শীর গালে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলে, “সরি বউ! আর রাগ করে থাকে না।”
এমন আবেগ মাখা ডাক শোনার পর কার সাধ্য আছে মানুষটার সাথে রুষ্ট হয়ে থাকার? তার তো নেই। একবারেই নেই। স্পর্শী নিজের রাগ ভুলিয়ে নির্বাণের কাঁধের দিকে একাংশ শার্ট মুঠো করে ধরে বুকের বা দিকে মাথা হেলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে, “আপনি অনেক বাজে। অনেক! এমন কেউ করে? আমি ভেবেছি আপনি আমার সাথে রাগ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। জানেন, কত কষ্ট হয়েছিল আমার তখন?”

“আর এমন হবে না। প্রমিস!”
“হু!”
“একটা কথা জানো কি তোমার সাথে রাগ করার গুণটি আল্লাহ আমাকে দেয়নি। একটুও দেয়নি।”
“একদম ভালো করেছে।”
স্পর্শীর বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে নির্বাণ হাসলো। শান্ত কন্ঠে বলে, “তিন পর আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। রেডি থেকো, ওকে?”
“হঠাৎ কেন?”
স্পর্শী জিজ্ঞেস করলো। নির্বাণ উত্তরে বলল, “দুইজনের মুড রিফ্রেশমেন্টের দরকার তাই৷ অল্প সময়ের ব্যবধানে কম তো আর হলো না।”
স্পর্শী কিছুক্ষণ চুপ থেকে নির্বাণের কাছ থেকে সরে এসে বলে, “আমি যাব না।”
“কেন?”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪০

স্পর্শী মুখ ঘুরিয়ে বলে, “এভাবেই! যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। ক্যান্সেল করে দিন টিকেটগুলো।”
নির্বাণ ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায়, “আমি বাসায় পারমিশন নিয়ে নিয়েছি অলরেডি। এখন মানা করে লাভ নেই, আমরা যাচ্ছি এটাই ফাইনাল।”
স্পর্শী রেগে গিয়ে বলে, “আমি যাব না, আপনি গেলে একা যান।”
নির্বাণ উঠে দাঁড়ালো, “আচ্ছা, দেখা যাবে।”
কথাটা বলে নির্বাণ বেরিয়ে গেল। আর স্পর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার যাওয়ার দিকে তাকালো৷ মনে মনে অসন্তুষ্ট হলো প্রচুর। মানুষটা চাকরি গিয়েছে সবে, আর এখনই এত খরচ করা কি ঠিক?

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪২