ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা শেষ পর্ব
মৌমি দত্ত
মেয়েরা চুপিসারে আফিমদের বাড়িতে এসে ঢুকলো। ছেলেরা এখন এক রুমে থাকে আর মেয়েরা সবাই এক রুমে। ক্লান্ত মেয়েরা সোজা চলে গেলো রুমে। রিপোর্টগুলো রুহি আলমারিতে লকারে ভরে রাখলো। ইনায়াত আর আফরা ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে এর মধ্যেই। রুহি খাটের উপর বসে অনবরত আনমনা হয়ে পা দোলাচ্ছে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো ইনায়াত,,
– কিরে ঘুমাবি না??
– হুম ঘুমাবো আপি। আর শুনো কাল সকালেই আমরা থানায় যাবো। আর কাল দুপুরের দিকে আমার পরিচিত লোকটার কাছে সব ডকুমেন্টস জমা দিয়ে আসবো। ওকে??
আফরা আর ইনায়াত ও সম্মতি জানালো।রুহিও ফ্রেশ হয়ে এলো। এরপর তিনজনই খাটে পাশাপাশি ঘুমিয়ে পড়লো। সকাল হবার অপেক্ষা ও উত্তেজনার থেকেও তাদের মাঝে বিষাদ ও ক্লান্তিটাই বেশি।
ভোর বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেছে তিনজন মেয়েরই। সবাই একসাথে নামাজ আদায় করে নিলো। আলমারিতে জায়নামাজ ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে থমকে গেলো আফরা। আচমকা না চাইতেও মন চাইছে শাড়ি পড়ে একটু বৌ বৌ সাজতে। পরক্ষনেই তাচ্ছিল্য হাসলো আফরা। স্পর্শ ইদানীং তার দিকে তাকায়ই না। শাড়ি পড়ে রমনী সাজবে কার জন্য। হতাশ মুখে আলমারি বেঁধে পিছনে ফিরতেই চমকে উঠলো আফরা। দাঁত কেলিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুহি আর ইনায়াত। দুজনের চোখে মুখে দুষ্টুমি স্পষ্ট। আফরা হালকা ঢোক গিলে বললো,,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
– কি হলো তোদের আবার??
মেয়েরা কিছুই বললো না। আফরাকে টেনে এনে খাটে বসিয়ে দিলো তারা। রুহি গিয়ে আলমারি খুলে একটা নীল জমিনে সাদা পার,, একটা লাল জমিনের কালো পার আর একটা কালো জমিনের সোনালী পারের শাড়ি বের করলো। ইনায়াত ড্রেসিং টেবিলের বক্স থেকে সেফটিপিন,, কানের,, টিপ,, চুড়ি বের করছে ম্যাচ করে। আফরা বুঝলো এই দুই মেয়ের মাথায় পাগলামী চেপেছে। মুচকি হাসলো সে শুধু সম্মতিসূচক।
প্রায় আধা ঘন্টা পর তিন মেয়ের শাড়ি পড়া হলো।
রুহি পড়েছে নীল ব্লাউজ কনুইয়ের একটু নিচ পর্যন্ত,, নীল শাড়ি সাদা পার,, হাতে সাদা কাঁচের চুড়ি,, কানের ছোট ঝুমকো। জলকুমারি লাগছে তাকে।
আফরা পড়েছে লাল শাড়ি কালো পাড়,, লাল ব্লাউজ রুহির মতোই কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত,, হাতে লাল চুড়ি,, কানে ছোট্ট ঝুমকো।জলন্ত আগুনের মতোই দেখতে লাগছে তাকে।
আর ইনায়াত পড়েছে কালো শাড়ি সোনালী পার,,কালো ব্লাউজ,, হাতে কালো চুড়ি,, কানে ঝুমকো।মায়াবিনী যাদুকরীর মতোই লাগছে ইনায়াতকে।
তিনজনই চুল হাত খোঁপা করেছে আর কপালে কালো টিপ। মুখে বা চোখে কোনো সাজ নেই। এখন তাদের তিনজনকে লাগছে পরিপূর্ণ রমনী। অসময়ে যেন বসন্ত এসে হানা দিয়েছে ঐ ছোট্ট রুম জুড়ে। তিন রমনীর হাসির খিলখিল ধ্বনি পুরো রুমে সৃষ্টি করেছে অদ্ভুত এক আবহাওয়া,,,যাতে নেশা ধরানোর ক্ষমতা আছে।
সকাল সাতটার দিকে ঘুম ভাঙ্গলো স্পন্দনের। মাথা চেপে ধরে উঠে বসলো। মাথা কিছুটা পরিষ্কার হয়ে আসতে অবাক হলো স্পন্দন। সে রুমে এলো কিভাবে সে প্রশ্ন মাথার ব্যাথা দ্বিগুন বাড়িয়ে দিলো। দুই পাশে মরার মতো পড়ে ঘুমিয়ে আছে তাহজিব আর আফিম। স্পন্দন দুজনকে ধাক্কা দিয়ে তুললো। দুজনেরও মাথা ব্যাথা। অবশ্য হবে না-ই বা কেন?? তিন জন কাল রাতে কম তো গিলেনি বারে। পরক্ষনেই তিন ছেলে যেন নিজ জায়গায় জমে গেলো মাথায় একটা প্রশ্ন আসতেই। ” তারা বাসায় কিভাবে এসছে?? মেয়েরা তাদের অমন অবস্থায় দেখেছে?? ”
দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ৮ টার কাছাকাছি নিচে নামলো তিন ছেলে পাশাপাশি হেঁটে সিড়ি বেয়ে। তিনজনেরই কেমন যেন গা শিউরে উঠছে ভবিষ্যত ভাবনা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে। কিন্তু শেষ সিড়ির কাছে এসেই থমকে গেলো তিনজনের পা। টেবিলে তিনটা চেয়ারে বসে আড্ডা দিচ্ছে রুহি,, ইনায়াত আর আফরা। তিনজনেই হেসে উঠছে একসাথে কিংবা পালা করে। কি মধুর লাগছে দেখতে। যেন বিয়ে করা বৌ।
হঠাৎই ইনায়াতের চোখ গেলো সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের দিকে। ইনায়াত চোখের ইশারায় রুহি আর আফরাকে তাকাতে বললো। রুহি আর আফরাও তাকালো ছেলেদের দিকে। মেয়েরা উঠে দাঁড়ালো।
– কি হলো?? আসুন মহারাজারা!! আপনাদের আসন গ্রহন করুন।
ব্যঙ্গ করে বললো রুহি। তার চোখ তাহজিবের দিকে জ্বলন্ত লাভার মতো তাকিয়ে আছে। তাহজিব মাথা নিচু করে ফেললো।
– হ্যাঁ,, হ্যাঁ আসুন। কাল তো অনেক কষ্ট হয়েছে আপনাদের। তাই না??
ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো আফরা। ছেলেরা ধীর পায়ে মাথা নিচু করে এসেই বসলো।
– দোস্ত মনে তো হচ্ছে,, মেয়েরা ক্ষেপ্পা হয়ে আছে।
ফিসফিসিয়ে বললো তাহজিব। স্পন্দন শুকনো ঢোক গিলে ফিসফিসিয়ে বললো,,
– হবে না!! কাল কে জানে কতোটা মাতলামি করেছি।
আফিম চুপ হয়ে তাকিয়েই আছে ইনায়াতের দিকে। তবে বাকি দুইজনের কথা তার কানে এসেছে। নিজের তাকিয়ে থাকা জারি রেখে ফিসফিসিয়ে বললো আফিম,,
– কি আর করবে বল?? দোষটা আমাদের তা তো মানিস তোরা। বড়জোড় একটু কথা শুনাবে। তোরা এতোকিছু দেখলি এটা ভেবে দেখলি না যে মেয়েরা আজকে কতো সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে। তিনজনকেই আজ সত্যিই আমাদের বিয়ে করা বৌ লাগছে।
স্পন্দন আর তাহজিবও সব ভয় ভুলে তাকিয়ে রইলো নিজ নিজ প্রেমিকার দিকে। মেয়ে তিনজন ছেলেদের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে লজ্জা পেলো। সব রাগ ভুলে তিনজন মিলে আফিম,, স্পন্দন ও তাহজিবকে ব্রেকফাস্ট বেড়ে দিতে লাগলো। এতোকিছুর মধ্যে আফিমই মুখ খুললো সবার প্রথমে,,
– আই এম সরি গার্লস,,, আমাদের কাল অতোটা ড্রাংক হয়ে বাড়ি ফেরা উচিত হয়নি।
কথাটা আফিম সব মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেও তাকিয়ে ছিলো ইনায়াতের দিকে। ইনায়াতের হার্টবিট যেন দ্বিগুন হয়ে গেছে আফিমের এতো নেশা চাহনিতে। ইনায়াত তাই অস্থির ভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। তখনই তাহজিব বললো,,
– হ্যাঁ,, আমাদের মনে রাখা উচিত ছিলো যে তোমরাও আছো। এমন সময় এসব একপ্রকারের অশালীনতা।
তাহজিব এক হাতে কান ধরে ইশারায় কিউট মুখ করে সরি বললো রুহির দিকে তাকিয়ে। রুহি মুচকি হেসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
– তাই আমরা সত্যিই সরি জানাচ্ছি মন থেকে। নেক্সট টাইম,,, আসলে নেক্সট টাইম না। আর কখনোই আমরা এমন কাজ করবো না। প্রমিজ।
আফরার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো স্পন্দন। তাকালে যেন চোখই সড়তে চাইছে না। তাই সরাসরি তাকাতেও পারছে না স্পন্দন। আফরার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। বুঝতে কষ্ট হলো না স্পন্দন তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কারণটা কি তা না বলে এই এড়িয়ে চলার কি দরকার??
আজকে সব রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে ইনায়াত। সে এক কথায় জানিয়ে দিয়েছে রান্নাঘরে আফরা বা রুহির আসার দরকার নেই কোনো। ইনায়াতের জেদের কাছে হার মানলো আফরা আর রুহি। রুহি ভাবলো ছাদটা একটু পরিষ্কার করে সাজিয়ে নেবে। সে জানেনা ক’দিন বাকি তাদের হারিয়ে যাওয়ার। এই ক’টা দিন একসাথে থাকতে চায় সে। এটা তিনজন মেয়েরই ভাবনা। শেষের ফলাফল কি হবে জানা নেই মেয়েদের। তবে কিছু সুখময় স্মৃতি মনের সিন্দুকে জমা করে নিতে কোনো সমস্যা নেই। ছেলেরাও জানিয়ে দিয়েছে আজ মেয়েদের সাথে সময় কাটাবে। তাই তারা বের হচ্ছে না। আর আফরা আজকে বাগানে সময় কাটাবে ভেবে নিয়েছে। রুহি ইতোমধ্যে কল করে রেখেছে তার পরিচিত এক মানুষকে। সে একটু বাদেই ডেলিভারি ম্যানের রুপ ধরে আসবে। তখন তার হাতে সব কিছু তুলে দেবে। সে নিজ দায়িত্বে সব করে নেবে।
ছেলেরা নিজেদের রুমে বসে আছে। তিনজনই খুব চিন্তায় আছে।
– আমরা কি ভুল করছি নিজেদের ওদের থেকে দূরে রেখে?? আই মিন,,, ওরা ভুল ভেবে বসে থাকবে না তো??
তাহজিব প্রশ্ন করলো জানলার পাশে বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। পুশ আপ করছে স্পন্দন। এই কথা শুনে সে মেঝেতেই ঘর্মাক্ত গা এলিয়ে দিলো। আফিম একটা ছোট্ট বল ক্রমশ দেওয়ালে ছুড়ে দিচ্ছে আর ক্যাচ করছে,, আবারও ছুড়ে দিচ্ছে।
– আমরা ঠিক করছি না।
আফিম নিজের কাজ করতে করতে বললো। তাহজিব আর স্পন্দন তাকালো আফিমের দিকে। স্পন্দন তখন বললো,,
– মানে??
– তুই একজন মাফিয়া,, তাহজিবও মাফিয়া,, আমি একজন ব্যবসায়ী। আমাদের ফিল্ডে আমাদের কম শত্রু নেই। কে জানে কখন আমাদের কার কি হয়ে যায়। আর কোনো কিছু না হলেও কাল সম্পর্কে আমরা কেও কিছু জানিনা। কোনো ভরসা নেই কাল কি হবে। আমরা আজকের সময়টা কেন নষ্ট করছি??
তাহজিব প্রশ্ন করলো। তিন যুবকই নীরব তাকিয়ে রইলো একে অপরের দিকে। এরপর তাহজিব বের হয়ে এলো মুক্ত বাতাসের জন্য। পা চালালো ছাদের দিকে। স্পন্দন নিজের ঘাম মুছতে মুছতে ওয়ার্ক আউট করবে বলে নেমে এলো বাগানে। আফিমও আর কি করবে?? বের হয়ে এলো রুম থেকে। নেমে এলো সিড়ি বেয়ে নিচে। তখনই চোখ আটকে গেলো রান্নাঘরের দিকে। বেহায়া মন আর অবাধ্য পা জোড়া এগিয়ে চললো ইনায়াতের দিকে। ইনায়াত তখন আঁচল কোমড়ে গুঁজে সবজি কাটছে বোর্ডের উপর রেখে। হঠাৎই দুটো হাত কোমড় আঁকড়ে ধরলো তার। শিউরে চমকে উঠলো ইনায়াত। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা আফিমের স্পর্শ। হালকা কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে ইনায়াতের। আফিম ইনায়াতের ঘর্মাক্ত কাঁধে নাক ঘষলো কয়েকবার।
– কি করছেন আফিম?? এটা রান্নাঘর।
আফিমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটলো। ইনায়াত তাকে মেনে নিয়েছে বুঝতে কষ্ট হলো না। নাহয় না দেখেই স্পর্শ চিনে নেওয়া,, নাম ধরে ডাকা এসব হতো না। ইনায়াতের ঘাড় থেকে মুখ উঠিয়ে কানের লতিতে ঠেকালো আফিম ঠোঁট। ইনায়াত আরেক দফা কেঁপে উঠলো। হাত থেকে ছুড়ি ইতোমধ্যেই পড়ে গেছে তার। ইনায়াতের খালি হাত নিজের কোমড়ে পেঁচিয়ে থাকা আফিমের হাত দুটো খামচে ধরলো আবেশে।
– ছাড়ুন আফিম।
কাঁপা স্বরে বললো ইনায়াত কোনো ভাবে।
– উহু!! এভাবেই থাকো। বেশ বৌ বৌ লাগছে। আমার বৌ লাগছে।
ধীর কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো আফিম ইনায়াতের কানের কাছে। এরপর আলতো করে কামড়ে দিলো ঘাড়ে। এরপর কানের লতিতে। ইনায়াত সহ্য করতে না পেরে ঝট করে ফিরে মুখ লুকালো আফিমের বুকে। আফিমও পরম আবেশে জড়িয়ে নিলো প্রিয়তমাকে বুকে।
স্পন্দন বাগানের দিকে আসছিলো। তখনই।আফরার কন্ঠে মৃদু চিৎকার আর ধপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনলো। চমকে উঠলো স্পন্দন। চোখ ঘুড়িয়ে সব দিকে দেখে বুঝলো ঝোঁপের আড়ালে কিছু একটা আছে। এগিয়ে গেলো ঝোঁপের ভিতর। দেখলো কাঁদায় পড়ে আছে আফরা। বারবার উঠে বসার চেষ্টা করলেও হাত পিছলে কাঁদায় পড়ে যাচ্ছে সে। তা দেখে হেসে ফেললো স্পন্দন। বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে এটিট্যুড নিয়ে বললো,,
– আফরামনি?? কাঁদা কম পড়েছে?? এইটুকুনি কাঁদায় মাখামাখি করে মন ভরবে তো??
স্পন্দনের টিপ্পনি বেশ বুঝতে পারলো আফরা। রাগে কটমট করে তাকালো স্পন্দনের দিকে। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। গত কয়েকদিন ধরে এভাবে পার্সোনালি কথা তাদের হয়নি। আর বাদ বাকিদের সামনে যা হয়েছে তাও না হওয়ার সমান। আফরা নিজে নিজেই উঠতে চেষ্টা করলো। স্পন্দন মুচকি হেসে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো আফরার দিকে। আফরা দেখেও পাত্তা দিলো না। নিজের মতোই উঠতে চাইলো। ইতোমধ্যে পুরো শাড়ি,, সারা শরীর,, কাঁদায় মাখামাখি। ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করলো স্পন্দন।
– কি ব্যাপার?? হাত দাও।
আফরা তাও কিছু বললো না। কোনমতে অনেক চেষ্টার পর উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো আফরা। কোমড়ে,, হাতে সব জায়গায় কাঁদার ছড়াছড়ি। আফরা বাসার দিকে পা বাড়াচ্ছিলো। তখনই স্পন্দন আচমকা আফরাকে কোলে তুলে নিলো কথাবার্তা ছাড়াই। মুখে তার রাগ আর জেদ স্পষ্ট।
– কথা বলবে না???প্রতিজ্ঞা করেছো নাকি আমাকে এড়িয়ে চলার ??
স্পন্দন জিজ্ঞেস করলো। আফরার চোখে অভিমানেরা ভীর করেছে জলের রূপে। আফরা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। স্পন্দন আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিলো আফরাকে নিজের সাথে।
– ঠিক আছে। আমিও দেখি কথা কিভাবে না বলে থাকো।
এই বলেই স্পন্দন পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। কোনভাবে পা টিপে ঘরে ঢুকে উঁকি মেরে দেখে নিলো আফরাদের রুমে কেও আছে নাকি। এরপর রুম খালি দেখে দ্রুত ঢুকে পড়লো মেয়েদের রুমে। দরজা পা দিয়ে ঠেলে লাগিয়ে দিলো। আফরা এখনো মোচড়ামুচড়ি করছে। স্পন্দন আফরার দিকে কটমট করে তাকাতেই ভেঙ্গচি কেটে আফরা অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। চোখের পানি গড়িয়ে পড়া স্পষ্ট। স্পন্দন আফরাকে নিয়ে ঢুকে পড়লো ওয়াসরুমে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো স্পন্দন। নামিয়ে দিলো ধীর গতিতে আফরাকে। আফরা স্পন্দনের দিকে একবার তাকিয়ে চলে আসতে চাইলো। কিন্তু স্পন্দন আফরার হাত ধরে এক টান দিলো। আফরা এসে পড়লো স্পন্দনের বুকে। স্পন্দন শাওয়ার অন করে দিলো আফরার দিকে তাকিয়েই। হঠাৎ চোখে মুখে পানি পড়তেই চমকে উঠলো আফরা। সড়ে আসার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। স্পন্দন আফরাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে দুইদিকে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। পানির স্রোত স্পন্দনের শরীর বেয়ে পড়ছে আফরার শরীরে। স্পন্দনের চোখে রাগ স্পষ্ট।
– কেন এড়িয়ে যাচ্ছো আমাকে?? কি সমস্যা?? কথা বলো।
আফরা অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে নিলো।
– আফরা আমাকে ভুল কিছু বলতে বা শোনাতে বাধ্য করো না।
আফরা তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো।
– আর কি কি ভুল করতে পারো তুমি??? একটু বলবে স্পন্দন???
রাগ কেটে গিয়ে বিষ্ময় ফুটে উঠলো স্পন্দনের মুখে।অবাক হয়ে বললো,,
– মানে!! কি বলতে চাইছো তুমি!!
আফরা মৃদু হেসে বললো,,
– কি আর বলতে চাইবো?? বলো??? তোমার হাতের গুটি ছাড়া,,,আমি আর কিছুই না।
স্পন্দন এক প্রকার হুঙ্কার ছেড়ে বললো,,,
– শাট আপ আফরা।যাষ্ট শাট ইওর ননসেন্স।
– ননসেন্স?? ভালোই বলেছো।ননসেন্স-ই বটে।তুমি অসাধারণ হতে পারো।তবে,,আমি অসাধারণ নই।আমি সাধারণ একটি মেয়ে।আর পাঁচ,, দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই আমারো ইচ্ছে করে,,, আমার ভালোবাসার মানুষটি আমার প্রশংসা করুক।আমার সাথে কিছু সময় কাটাক।আমার দিকে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকুক।কিন্তু???তুমি???এর একটা ও কি তুমি করেছো??? না।করোনি তুমি।বাকি সব বাদ দাও।তুমি তো আমার দিকে তাকাতেও চাও না।আড় চোখে পর পুরুষের মতো তাকাও।এমন মনে হয়,,,,যেনো আমরা একজন আরেকজন কে চিনি না।সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমার মাঝে খামতি টা কোথায় স্পন্দন??? নাকি অজান্তেই কিছু ভুল করেছি আমি। আমার খামতি,,, আমার ভুলগুলো আমায় বলে তো দিতে পারো স্পন্দন!! আমি নয় আমার খামতি গুলো পূরণ করে নিবো।
যদিও এতে আমার ভালোবাসার অপমান হবে।তবুও,,, কি আর করবো বলো??? তোমাকে ভালোবেসে,,,আমি আমার আত্মসম্মানবোধ,,,আত্মঅহংকার,, লাজ,, লজ্জা,,, সবই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি।বেহায়া মেয়ের মতো কি,,কি – ই না করছি।
এসব শুনে স্পন্দন চিৎকার করে উঠলো।
– চুপ করো আফরা। দয়া করে চুপ করো।
এটুকু বলেই স্পন্দন আফরার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো।
-আমি মানছি আমার ভুল আছে।তবে তুমি যেটা ভাবছো সেটা আমার ভুল না।সেটা সম্পূর্ণ তোমার ভাবনার ভুল। আমি তো তোমাকে কখনো বলিনি,,যে,,তোমার মাঝে কমতি আছে বলে আমি তোমায় এড়িয়ে চলছি। আমি তোমাকে এড়িয়ে চলছি,, কারণ আমার মাঝে অস্বস্তি কাজ করছিলো। অপরাধবোধ হচ্ছিলো আমার।তোমার সম্মতি ছাড়াই,,তোমাকে জোর করে কাছে টেনে নিয়েছিলাম।যেটা অবশ্যই আমার ভুল।আমার মনে হচ্ছিলো,,, তুমি আমায় ভুল বুঝেছো,,,তুমি আমায় ভুল বুঝবে।
স্পন্দন আরো কিছু বলতে চাইছিলো।কিন্তু ততক্ষণে আফরা হালকা পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে স্পন্দন এর কলার টেনে,,,তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। আচমকা এমন হওয়াতে স্পন্দন কিছু বলতে চাইছিলো।কিন্তু আফরা সে সুযোগটুকু দিলো না।তার আগেই নিজের ঠোঁটজোড়া মিলিয়ে দিলো স্পন্দনের ঠোঁটের মাঝে।
পুরো ছাদটা নিজের মতো করে সাজিয়ে,,, রুহি তার চুলের খোঁপা খুলে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে,, চোখ বন্ধ করে। চোখ বন্ধ থাকলেও রুহির বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তাহজিব এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে।
চোখ বন্ধ রেখেই রুহি বললো,,,
– কিছু লাগবে তোমার??
তাহজিব প্রচন্ডরকম অবাক হলো। মনে মনে ভাবলো,,, মেয়েটা চোখ বন্ধ রেখেও আমার অস্তিত্ব বুঝতে পারে না কি???
রুহি চোখ খুলে তাহজিবের দিকে তাকালো।
তাহজিব গম্ভীর মুখেই প্রশ্ন করলো,,
– আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে কেন??
– জানো??ইনু আপির না ভীষণ জ্বর কাউকেই জানায়নি। তা নিয়েই বেশ চিন্তায় আছি।
এ কথা শুনে আঁতকে উঠলো তাহজিব।রুহিকে সে নিঃসন্দেহে ভালোবাসে।তবে মানুষ প্রথম ভালোবাসার মায়া সম্পূর্ণভাবে কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারে না।তা অসম্ভব। তাহজিব এর ক্ষেত্রেও তাই।কিছুটা মায়ার টান,,রয়েই গেছে।অস্থির গলায় তাহজিব বললো,,,
– কি বলছো তুমি?? ও ওষুধ খেয়েছে?? দাঁড়াও সবাইকে জানিয়ে দিই।
এ বলে হন্তদন্ত হয়ে তাহজিব ছাদের দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছিলো।তখন-ই রুহি তাচ্ছিল্য ভরে হেসে বলে উঠলো,,,
– ইনুপ্পির কোনো জ্বর নেই।আমি তোমায় মিথ্যে বলেছি।
এ কথা শুনে থেমে গেলো তাহজিব এর পা।ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি নিয়েই ঘুরে তাকালো সে রুহির দিকে। গম্ভীর স্বরেই বললো,,
– এমন ঠাট্টার মানে কি রুহি???
রুহি ধীর গতিতে হেঁটে তাহজিব এর কাছে এসে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে তাহজিব এর চুল ঠিক করতে করতে বললো,,
– তোমাকে এড়িয়ে চলার অভিমান আর অভিযোগ,,, মুহূর্তেই চাপা পড়ে গেছে ইনুপ্পির চিন্তায়।তাই না তাহজিব??
তাহজিব থমকে গেলো। এ প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। তা জানা আছে ভালোই।
রুহি আবারও মুচকি হেসে বললো,,
– আগে,, তোমাকে না পেয়েও,, ভালোবেসে সন্তুষ্ট ছিলো যে মন,,এখন তুমি তার হবে জেনেও,,,সে মন ভালোবেসে কেন তুষ্ট হতে পারছে না??
তাহজিব এর কাছে এ প্রশ্নের ও কোনো উত্তর নেই।রুহি ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে গলার স্বর উঁচিয়ে বললো,,,
– আজ তোমার কাছে উত্তর নেই বলেই,,তোমায় এড়িয়ে চলছি। যেদিন তোমার কাছে উত্তর থাকবে,, সেদিন আমি চাইলেও তোমাকে এড়িয়ে যেতে পারবো না।হোক সে উত্তর আমার পক্ষে,, কিংবা বিপক্ষে।
আপনারা মনে হয় গল্পটা ভালো মতো পড়েন না।কারণ পড়লে বুঝতে পারতেন,,আমি বলেই দিয়েছি আগের পর্বে,, যে,,রুহি চিকিৎসার জন্যেই বিদেশ যাবে।তাই দয়া করে ❝চিকিৎসা না করিয়ে,, অসুস্থ মানুষ ফাতরামি করছে,,,রুহি ন্যাকামো করছে,,❞ এসব বলবেন না।আমার মা’ কে ক্যান্সার এর জন্যেই মারা যেতে দেখেছি।তাই আমার নূন্যতম হলেও ধারণা আছে এ রোগ নিয়ে।
আজকের রান্নাবান্না ছিলো রাজকীয়। ইনায়াত একা হাতে সবটা সামলালেও সার্ভ করবার সময় রুহি আর আফরা জোর করেই আসলো। আর ইনায়াত গেলো ফ্রেশ হতে। ওয়াসরুমে এসে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেই কাঁধের দিকে জ্বলে উঠলো ইনায়াতের।
” আহহহ ” করে মৃদু আওয়াজ করে সড়ে এলো শাওয়ার থেকে। ওয়াসরুমের আয়নায় ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁধে দেখতেই চমকে উঠলো ইনায়াত। জ্বলজ্বল করছে আফিমের দেওয়া লাভ বাইট। আফিম তাকে রান্নাঘরে কাজের সময় জড়িয়ে ধরেছিলো বলে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছিলো কাজে । তাই ইনায়াত দুই একটা ধমক দিয়ে আফিমকে রান্নাঘর থেকে তাড়িয়ে ছিলো সেই সময়। কিন্তু বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে আফিম নিজের অভিমান প্রকাশ করেও যখন ইনায়াতের মন গলাতে পারলো না। তখন রান্নাঘর ছেড়ে বের হবার আগে ইনায়াতের ঘাড়ে শক্ত করে কামড়ে দিয়েছে। ইনায়াতের মুখ লাল হয়ে এলো লজ্জায়। শুকনো একটা ঢোক গিলে কোনোমতে শাওয়ার নিয়ে আরেকটা লাল রঙ্গের শাড়ি পড়ে বের হয়ে এলো। নিচে নেমে দেখলো ছেলেরা বসে পড়েছে টেবিলে। সিড়িতে থাকাকালীনই নজরে এলো আফিমকে। চোখাচোখি হতেই মুখের রক্তিম আভা আরো গাঢ়ো হয়ে এলো। ইনায়াত ধীর পায়ে এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়লো।
এদিকে স্পন্দন খানিক বাদে বাদেই ঠোঁট কামড়ে হাসছে। দৃষ্টি তার আফরার দিকে নিবদ্ধ। তখন আফরা স্পন্দনকে কাছে টেনে নিলেও খানিক বাদে স্পন্দনকে ছেড়ে দিয়েছিলো হালকা ধাক্কা দিয়ে। স্পন্দনকে ধাক্কা দিয়ে ওয়াসরুম থেকে বের করে দিয়েছিলো। স্পন্দনের সামনে এরপরে আর যায়নি আফরা। সামনে পড়লেই আফরাকে চোখের ইশারায় লজ্জায় ডুবিয়ে মারছে স্পন্দন ।
আর তাহজিব বিমর্ষ হয়ে বসে প্লেইটে আঁকিবুঁকি করছে চামচ দিয়ে। রুহির দিকে একবার তাকাতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এলো তাহজিবের। মেয়েটা মানুষের সামনে হাজারো কষ্ট,, চিন্তা চেপে এতো স্বাভাবিকতার নাটক করে কেন?? আর করেই বা কিভাবে??
ছেলেরা সকলে খাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলো ছাদে চায়ের কাপ নিয়ে বসবে। তিনজন ছেলেরই কখনো কফি ছাড়া আয়েশ করে চা খাওয়া হয়নি। তাই মেয়েরাই বলেছে আজকে চায়ের মজা উপভোগ করতে। ছেলেরা ছাদে বসে আছে। খেলা,, বিজনেস এসব নিয়ে কথা বলছে।
মেয়েরা বসে আছে একরাশ চিন্তা নিয়ে সোফায়।
– রুহি?? ঐ মানুষ তো এলো না।
ভয় নিয়ে বললো ইনায়াত। আফরা বললো,,
– এখন ছেলেরা উপরে থাকতেই কাজটা শেষ করে নিলে ভালো হতো। একবার ওরা নিচে নামলে তো ধরা পড়ে যাবো। এরপর কি যে হবে!! বুঝতে পারছিস তো তোরা??
রুহির নিজেরও চিন্তায় অবস্থা কাহিল। এমন সময় বাইকের আওয়াজ শোনা গেলো। দাঁড়িয়ে পড়লো তিনজন মেয়েই। ইনায়াতের পাশে তিনজনেরই ডকুমেন্টস রেডি করা ছিলো প্যাকেটে। ওটা হাতে তুলে নিলো পূর্বপ্রস্তুতি স্বরুপ।
ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে তিনজন ছেলেই আড্ডা দিচ্ছিলো। তখনই নিচে গেইট দিয়ে একটা বাইক ঢুকতে দেখে তিনজনেই অবাক হলো।
– এই ভরদুপুরে মেয়েরা আবার কি আনালো??
তাহজিব প্রশ্ন করলো।
– চল,, নিচে গিয়ে দেখি।
স্পন্দন বললো। তিনজন ছেলেই নিচে নেমে আসলো। সিড়ি বেয়ে নামার সময় দেখলো তিনজন মেয়েই কথা বলছে ডেলিভারি ম্যানের মতো দেখতে লোকটার সাথে।
– এরা ডেলিভারি ম্যানের সাথে এতো কি কথা বলছে??
অবাক হয়ে নিচে নামতে নামতে প্রশ্ন করলো আফিম। তিনজন ছেলেই সবে শেষ সিড়ি পার করে নেমেছে। তখনই দেখলো ইনায়াত একটা বড়সড় প্যাকেট এগিয়ে দিচ্ছে ডেলিভারি ম্যানটার দিকে। স্পন্দন ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেলো। পিছন পিছন আফিম আর তাহজিবও আছে।
– এটা কিসের প্যাকেট??
ভারী গলায় প্রশ্ন করলো স্পন্দন। চমকে উঠলো তিনজন মেয়ে। আফরা ভয়ে রুহির হাত খামচে ধরলো। ইনায়াতের হাত থেকে পড়ে গেলো প্যাকেটটা। ছেলেরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আফিম এসে তুলে নিলো প্যাকেট মাটি থেকে। তিন ছেলে পাশাপাশি থেকে প্যাকেটের ভিতরের জিনিস বের করে দেখতেই মুখ হা হয়ে গেলো তাদের। মেয়েদের বার্থ সার্টিফিকেট,,রুহির মেডিক্যাল রিপোর্টস থেকে শুরু করে সব ধরনের ডকুমেন্টস আছে। সাথে মোটা একটা টাকার বান্ডিলও আছে। ছেলেরা অবাক হয়ে মেয়েদের দিকে তাকাতেই দেখলো মেয়েদের চোখে ভয় স্পষ্ট। যেন চুরি করে চোর ধরা পড়েছে এমন ভাব। স্পন্দন কঠোর মুখে ডেলিভারি ম্যানটার দিকে তাকালো। যে ইতোমধ্যেই ভয়ে কাঁপছে। আফরা তাকে আসতে তো বলেছিলো। কিন্তু দি তাহজিব খান আর বিজনেস টাইকুন আফিম আহসান। আবার ডাক্তার ও বিজনেস টাইকুন স্পন্দন আজাদ আছে তাদের সাথে এই কথা জানায়নি।কিছু না জেনে এসে গিয়েছে বলেই বোকামো করেছে,,,ভাবছে সেই লোকটা।
– আপনি যাবেন?? নাকি কিছু নেবেন??
কঠোর গলায় প্রশ্ন করলো আফিম শার্টের হাতা গুঁটাতে গুঁটাতে। লোকটি বোকা বোকা হেসে দিলো এক দৌড়। কোনোমতে বাইকে উঠে তা স্টার্ট দিয়ে পালালো। স্পন্দন দরজা লাগাতে গিয়েই দেখলো আসিফ আর কামাল আসছে।সাথে আরভিদ সাহেবও আছে। স্পন্দন তাদের নীরবেই ভিতরে আহবান জানালো। ভিতরে ঢুকে কিছু বলবার আগেই থেমে গেলো আসিফ,, কামাল আর আরভিদ সাহেব। সবার মুখ থমথমে। আফরা রুহিকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে ভয়ে। ইনায়াত মাথা নিচু করে হাত কঁচলে যাচ্ছে। আরভিদ কিছু বলতে যাবে এর আগেই তাহজিব ইশারায় থামালো।
– এখন এই রুমে আমরা মেয়েদের কিছু প্রশ্ন করবো। আর মেয়েরা সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। এর বাইরে এখন কেও কথা বলবে না।
স্পন্দন সবাইকে ইশারায় সোফা দেখিয়ে দিলো। সবাই গিয়ে নীরবে সোফায় বসলো মেয়েরা ছাড়া। মেয়েরা এখনো ভয়ে আছে। মেয়েরা যাচ্ছে না দেখে চিৎকার করে উঠলো তাহজিব।
– হোয়াট?? এখন কি কাহিনি করবে???এখানে দাঁড়িয়ে??
মেয়েরা এই হুংকারে সুড়সুড় করে গিয়ে সোফায় পাশাপাশি বসলো। ছেলেরা গিয়ে তাদের অপজিট সোফায় পাশাপাশি বসলো।
– এখন কি মুখ খুলবে তোমরা?? নাকি…
প্রশ্ন করলো আফিম। আফরার কান্নার আওয়াজ বেড়ে উঠলো খানিকের জন্য।
– ডকুমেন্টস কেন দিচ্ছিলে??
প্রশ্ন করলো স্পন্দন।
– আর টাকা কেন দিচ্ছিলে??
তাহজিব প্রশ্ন করলো। এর মাঝেই আবার আফিম চিৎকার করে উঠলো। রুহি আর ইনায়াত কিছু বলবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো মনে মনেই। একে অপরের দিকে চোখের ইশারায় বললোও কথাটা। কিন্তু আফরার অতোকিছু খেয়াল নেই। আফরা হিঁচকি হিঁচকি তুলতে তুলতে বললো,,
– আমি সব বলবো। শুধু বকিস না ভাইয়া প্লিজ। আই এম সরি।
আফিমের দিকে তাকিয়ে বললো আফরা। আফিম শান্ত চোখে তাকালো আফরার দিকে। স্পন্দন বললো,,
– আফরা,, কেউ রাগ করবো না যদি সবটা বলো।
রুহি আর ইনায়াত চমকে তাকালো আফরার দিকে। মাথা নাড়িয়ে ইশারায় না জানালো। কিন্তু আফরার সেদিকে খেয়াল নেই।
আফরা এক এক করে সব প্ল্যানিং বলে ফেললো। তাহজিবের বাসায় চুরির কথাও বললো। সবটা শুনে আরভিদ সাহেব,, আসিফ আর কামাল চমকে তাকালো মেয়েদের দিকে। আরভিদ সাহেবের মুখ আজ কঠোর হয়ে আছে।
এতোদিন মেয়েকে সব কিছুতে ছাড় দিলেও এবার তার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন আরভিদ সাহেব। রুহি অসহায় চোখে তাকালো আফরার দিকে। আফরা কেঁদেই চলেছে। কঠোর হয়ে এলো তিনটি ছেলেরই মুখ। আফিম উঠে দাঁড়ালো। মোবাইল বের করে কিছু একটা করতে লাগলো। স্পন্দন আর তাহজিব ভ্রু কুঁচকে আফিমের দিকে তাকালো। আফিম আসিফ আর কামালের দিকে তাকিয়ে বললো,,
– আসিফ,, কামাল,,কাজী আর উকিল ডাকো। মালা আনো,, মিষ্টি আনো। আর হ্যাঁ আমাদের রুহির ডকুমেন্টস নিয়ে পাসপোর্ট অফিস যাও। আজকেই আমাদের তিনজনের বিয়ে হবে। আর এরপর আমরা সবাই এব্রোড যাচ্ছি রুহির চিকিৎসার জন্য।
– কিইইইই??
তিনজন মেয়ে একসাথে চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু তাহজিব আর স্পন্দনের যেন বিষয়টা পছন্দ হলো খুবই। আরভিদ সাহেব তাহজিবের দিকে তাকালো।
– বাবা,, এখনো ৮ মাস বাকি রুহির ১৮ হতে।
তাহজিব উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে বললো,,
– চিন্তা করবেন না। বিয়ে এখন হবেই তবে আপনার মেয়ের বয়সের খেয়াল আমি সবদিক দিয়েই রাখবো।
আরভিদ সাহেব আর কিছু বললেন না। রুহি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললো,,
– বাবা,, আমি বিয়ে করবো না বলে দাও।
আরভিদ সাহেব অভিমানে মেয়ের দিকে তাকালেন না। আফরা উঠে দাঁড়িয়ে বললো,,
– আমিও বিয়ে করবো না।
– আমিও করবো না।
ইনায়াতও তাল মেলালো। তখনই রুহি বলে উঠলো,,
– আমার এখনো ১৮ হয়নি। এই বিয়ে হবে না।
– আর আমার এই বিয়েতে মত নেই আপাতত।
ইনায়াত বললো। আফরা বললো,,
– কোনো লেহেঙ্গা নেই,, ফটোগ্রাফার নেই,, সাজ নেই,, মজা নেই। ধ্যাত!!
আফরার কথা শুনে অবাক হলো সবাই। সবাই ভেবেছিলো কোন সিরিয়াস কারনে বিয়ে করবে না বলছে আফরা। স্পন্দন হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,,
– রুহিকে ট্রিটমেন্ট করাতে বিদেশ নিয়ে যাবো। এরপর সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলে ধুমধাম করে বিয়ে হবে সবার এক স্টেজে।
খুশীতে লাফিয়ে উঠে বললো আফরা,,
– আমি রাজি তাহলে।
ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ৩০+৩১
ইনায়াত আর রুহি কটমট করে তাকালো আফরার দিকে। আফরা মিইয়ে গেলো মূহুর্তে।
আসিফ গিয়ে কাজি আর উকিল আনলো। কামাল গিয়ে মিষ্টি আর মালা আনলো,, সাথে ফটোগ্রাফার। আফিম জোসেফ আর লাবিবাকে কল দিয়ে ভিডিও কলে বিয়েতে সামিল করলো। হাতে গোণা দু’ এক ঘন্টার মাঝেই বিয়ে হয়ে গেলো তিন জুটির। ইনায়াত আর আফরার ধর্মীয় আর আইনগত ভাবে বিয়ে হলেও,,রুহির শুধু ধর্মীয় মতে বিয়ে হয়েছে।আইনগত ভাবে না হওয়ার কারণ,, এখনো ১৮ বছর হয়নি তার । আরভিদ সাহেব বেশিক্ষন অভিমান করে থাকতে পারলেন না। মেয়ে ও মেয়েজামাইকে মন ভরে দোয়া দিলেন। জোসেফ আর লাবিবাও খুশী। তারা দ্রুতই ফিরে আসবে জানিয়েছে।
পরিশিষ্ট:
রুহি-তাহজিব,, স্পন্দন-আফরা আর আফিম-ইনায়াত জুটি গেছে জার্মান৷ রুহির ট্রিটমেন্টের জন্য। যদিও না চাইতেও এটাকে ছেলেরা হানিমুনের পিচ্চি ভার্সন হিসেবে নিয়েছে। প্রায় ৬ মাসের ট্রিটমেন্টের পর রুহি সুস্থ হলে সবাই দেশে ফিরে এলো। রুহির ১৮ বছর হতেই আবারও খুব ধুমধাম ভাবে বিয়ে হলো তিন জুটির। তাদের জন্য সবাই মন থেকে দোয়া করবেন।
Golpo ta khub khub khub khub khub khub sundor hoyeche khub khub khub khub valo o legeche