জলকাব্য পর্ব ২ || লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

জলকাব্য পর্ব ২
লেখিকা:সুরাইয়া আয়াত

বহু নিস্তব্ধতা কাটিয়ে নীলু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
” আম্মু তোমরা আমাকে একটু এসে নিও যাও না, অনেকদিন হলো বাসায় যাইনা, তোমাদের জন্য বড্ড মন খারাপ করে ৷ তাছাড়া তোমরাও তো আর আসো না , তোমরা কি মেয়েকে পরের ঘরে তুলে দিয়ে একেবারেই পর করে দিয়েছো ?”
নীলুর মা খানিকটা ঝাঝিয়ে বলল
” বড়লোক জামাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছি, টাকা পয়সা থাকতে আবার এতো একঘেয়েমি কিসের , তাছাড়া এমনিতেও তুই না এলে আমাদেরকেই যেতে হতো, মাস শেষের পথে রুদ্র তো এখনো কোন টাকা পয়সা পাঠালো না, সে না হয় ব্যাস্ত মানুষ তার মনে নাই থাকতে পারে কিন্তু তোর তো মনে থাকার কথা, তুই কি পারিস না টাকার কথা ওকে মনে করিয়ে দিতে !”

নীলুর বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে, ওর নিত্য৷ন্তই খুব কষ্ট হচ্ছিল তাই ওর মায়ের কাছে ফোন করেছে নাহলে নিজের সুখ দুঃখ প্রকাশ করার জন্য ওর মায়ের কাছে অন্তত ফোন করতো না ৷ উনি মনে করেন টাকাটাই জীবনের সবকিছু , টাকা না থাকলে জীবনে সুখ নেই, নীলুর বাবার অগাত টাকা না থাকলেও তিনি তার স্ত্রী এবং সন্তানকে খুব ভালোবাসেন ৷ নীলুর ময়ের কথা অনুসারে নীলুর বাবা সংসারে বিলাষিতার জন্য কাড়িকাড়ি টাকা ঢালতে পারেননি তাই তিনি এই সংসারে কখনো কোন সুখ খুঁজে পাননি ৷ উনি যখনই নীলুর বাবাকে নীলুর সামনে টাকা নিয়ে খোটা দেন তখন নীলু চুপ করে মাথা নীচু করে থাকে, টাকা টাই যে জীবনের সবচেয়ে বড়ো জিনিস নয় সেটা ও বুঝলেও ওর মাকে ও বোঝাতে পারে না,হয়তো সেই সাধ্যটুকুও নীলুর নেই ৷ বয়সে এবং সম্পর্কে বড়ো মানুষদের বড়ো বড়ো কথার মাঝে চাপা পড়ে যাই নীলুর মতো কমবয়সী কতো হাজারো ছেলেমেয়ের চাপা আর্দনাত ৷
নীলু ফুপিয়ে কাঁদবে সেই মুহূর্তে নীলু ওর বাবার কন্ঠ পেয়ে প্রান ফিরে পেলো ৷

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” কে ফোন করেছে? কে আমার নীলু মা নাকি ? দাও দাও কথা বলি ৷”( একগাল হাসি নিয়ে)
নীলুর মা প্রমা বেগম ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, বেশ কর্কশ কন্ঠে বললেন
” তোমার মেয়ে এই বাসায় আসতে চাইছে, তার নাকি স্বামীর বাসায় মন টেকে না,এমনিতেই রুদ্র এই মাসে টাকাটা ঠিকঠাক পাঠালো না , আমাদের একেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তার ওপর সে আসবে বলছে ৷ বোঝাও তোমার মেয়েকে, মন দিয়ে সংসার করতে বলো, এমন করলে ও স্বামী হাতের বাইরে চলে যাবে বলে দিলাম তখন যেন আবার কাঁদতে কাঁদতে এখানে এসে আবার হাজির না হয় ৷”

কথাগুলো বলে গজগজ করতে করতে নীলুর মা নীলুর বাবার হাতে ফোন ধরিয়ে উঠে চলে গেলেন ৷ প্রমা বেগমের সব কথাই নীলুর কানে এসেছে ৷ ওর মায়ের এমন ব্যাবহার নীলুর কাছে অস্বাভাবিক নয়, নীলুর বিয়ের পর থেকে যেন উনার ব্যাবহার গুলো আরো বেশি নিম্নমানের হয়ে গেছে,মাস গেলে রুদ্র টাকা পাঠায় , নিজেকে ইনকাম করতে হয় না বলেই হয়তো গলার জোরটা বেড়ে গেছে ৷ এতে নীলু প্রতিবাদ করেনি কখনও, যতই হোক ওনারা ওর নিজের বাবা মা ৷
প্রমা বেগম চলে যেতেই নীলুর বাবা তৌফা সাহেব বিড়বিড় করে বললেন

” কোথায় কি বলতে হয় সেটাও জানে না, সারাক্ষন মেয়েটাকে কিছুনা কিছু দিয়ে খোটা দিতেই আছে ৷ মাঝে মাঝে আমি অবাক হয় এটা ভেবে যে একটা মায়ের মন এতোটা নিষ্টুর হতে পারে কীভাবে ৷”
কথাগুলো বলে উনি পুনরায় হাসার চেষ্টা করে বললেন
” কিরে নীলু মা কেমন আছিস ? ভালো আছিস তো মা ?”
কথগুলো ফিসফিস করে বললেও তা ঠিকই নীলুর কানে পৌছেছে, ওর বাবা মানুষটা আছে বলেই হয়তো এতো বিতৃষ্নার মাঝে ও এখনো বেঁচে থাকার প্রেরনা পাই ৷
নীলু ফিকে কন্ঠে বলল

” এই তো বাবা আছি কোনরকমে, তোমাদের ছেড়ে থাকি , মন টেকে না, সারাদিন বাসায় একা থাকি ৷ তোমরা এসে না হয় কদিন থেকে যাও, তাতে করে তোমাদের ও ভালো লাগবে আর আমারো ভালো লাগবে ৷”
উনি খানিকটা ভাঙা গলায় হেসে বললেন
” তোর মায়ের কথায় কষ্ট পেয়েছিস নীলু মা আমার ? জানিসই তো তোর মা বরাবার একটু ঠোঁট কাটা ধরনের মানুষ, কোথায় কি বলতে হয় জানে না, মুখে যা আসে বলে দেই , ওর কথায় কিছু মনে করিস না, কখন মুড ঠিক থকে বোঝা মুশকিল ৷”

নীলু নিজের মনের অজান্তেই মুচকি হসলো ৷ ওর বাবা সত্যি টা চপা দেওয়ার জন্য কত মিথ্যা শান্তনাই না দিচ্ছে নীলুকে শুধুমাত্র নীলুর এই অবস্থায় যেন মন খারপ না হয়ে যাই ৷ নীলুর চোখে জল চলে এসেছে ৷
“আচ্ছা বাবা নামক মানুষগুলো এতো ভালো হয় কেন?আমার সন্তান হলেও কি রুদ্র এমন ভাবেই ভালো বাসবে নাকি সেও হবে আমার মায়ের মতো একটা ব্যাতিক্রমী চরিত্র ৷”

প্রশ্ন গুলো নিজের মনকেই করলো নীলু কারন ওর এইসব অবাঞ্চিত প্রশ্ন গুলো সমাজে তুলে ধরলে তা খুবই হাস্যকর হিসাবে লাগবে কারন সমাজের প্রতিটা মানুষের জীবন তো আর দুঃখ দিয়ে পরিপূর্ণ হয় না, কারোর কারোর জীবনে সুখ নামক জিনিসটাও থাকে যা নীলুর কাছে কখনোই ছিলোনা ৷ সুখ নামক জিনিসটা নীলুকে হাতছানি দিয়ে বারবার চলে যাই তবুও নীলু সেই সুখের সন্ধানী, যদি কখনো সুখ আসে এই আশায় ৷
” কিরে মা তুই না এক্ষুনি তোর মাকে বলছিলিস যে তুই আসবি , তাহলে এখন আবার আমাদের যেতে বলছিস যে ৷”
নীলু ওর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে বলল

” আসলে আমি তো রুদ্রর কথাটা ভবিইনি , কতোটা বোকা আমি ৷ আমি চলে গেলে ওকে দেখবে কে ,তাছাড়া ওর এখন কাজের অনেক চাপ, নাহলে ওউ আমার সাথে যেতো ৷”
” ওহহ আচ্ছা ৷ আচ্ছা তোর মায়ের সাথে একটু কথা বলে দেখি ও কি বলে ৷”
নীলু স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতেই বললো
” আচ্ছা ৷”
” আচ্ছা নীলু মা এখন রাখি, ওদিকে চা টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে রে ৷”
” আচ্ছা যাও ৷”

নীলু ফোনটা কেটে দিলো ৷ ফোন কেটে নীলু ওর পেটের ওপর হাত রাখলো, ওর গর্ভেই রূদ্র আর ওর সন্তান বেড়ে উঠছে , সে এতো সব জটিলতা বোঝেনা, নীলু নিজেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না, ভারসাম্যহীন লাগছে নিজেকে বড্ড , আর সেখানে ওইটুকু শিশু সে কি করে বুঝবে এতো জটিলতা ! তার ভবিষ্যৎটাও কি একটা এতিমের মতোই কাটবে ? কথাগুলো ভেবে নীলু হাটু ভাজ করে হাটুতে মুখ বুজে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো ৷ মনটা বড্ড বিষন্ন , সবকিছুতেই কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছে নীলু ৷

” কি হলো এখানে ডাকলে কেন আবার?”
রাগী গলয় বলে উঠলো রূদ্র ৷
মিঠি আলতো হাতের স্পর্শে রূদ্রর হাতের ওপর হাত রেখে বলল
” কি হয়েছে এভাবে কথা বলছো কেন ?কোন সমস্যা ?নীলুর সাথে কি ঝামেলা হয়েছে?”
রূদ্র এবার মিঠির হাত ঝাড়ি মেরে বলল
” কি আবার হবে, নীলু সব জানতে পেরে গেছে, ও কালকের সব কথায় জানে ৷”
” তো ও এখন কি চাই ?”
” ও কি চাই আমি কি করে জানবো ? আমি রেগে গিয়ে রাগের মাথায় চড় মেরে চলে এসেছি , কোন কথাও বাড়াইনি আর ৷”
” তুমি ওকে ডিভোর্স কেন দিয়ে দিচ্ছো না ?”

” ডিভোর্স মানেই কি ডিভোর্স ? তাছাড়া ও প্রেগনেন্ট ওকে এখন ডিভোর্স দিতে গেলে অনেক সমস্যা , এত কিছুই হতো না যদি না সেদিন ভুলবশত তোমার সাথে,,,,,”
কথাটা বলে থেমে গেল রুদ্র , ওর এখন মাথার ঠিক নেই ৷
মিঠির রাগ হচ্ছে এখন, রুদ্র এতোটা সহজে কথাগুলো বলে দিলো !
রুদ্র খানিকক্ষন কপাল চাপড়ে বললো
“শোনো মিঠি দেখো এই কদিনে আমাদের সম্পর্ক অনেকটা দূর এগিয়ে গেছে তাই তোমার সাথে এভাবে আর চলা আমার পক্ষে সম্ভব না , এর একটা বিহিত করা দরকার ৷”
রুদ্রর কথা শুনে মিঠি চমকে গেল, এক প্রকার দম আটকে আসছে ওর ৷
” কি চলছো টা কি তুমি ? এখন যদি আমাকে দূরে সরে যাওয়ার কথা বলো তাহলে কিন্তু আমি সহ্য করবো না বরে দিলাম ৷ ”
রুদ্র নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল

” এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেন? শান্ত হও , তোমাকে আমি বিয়ে করবো ৷ আর আপাতত কোর্ট ম্যারেজ করবো , সামাজিক বিয়েটা এখনই সম্ভব না ৷ তাছাড়া সব সামলে ওঠার ও একটা ব্যাপার আছে তাই আর কি ৷”
মিঠি খুশিতে ডগমগ ৷ উত্তেজিত হয়ে বলল
” সত্যি বলছো রুদ্র? আমিও চাই এই অবৈধ সম্পর্কের একটা পূর্ণতা আসুক ৷ ফাইনালি ! কিন্ত নীলুর কি হবে ? আমি কিন্তু আমার সংসারে ওকে সহ্য করতে পারবো না কোনভাবেই, এমনিতেও ও আমার থেকে বয়সে প্রায় 3 বছরের ছোট তাও ওকে ভাবী বলতে হয় তাতে আমার চরম আপত্তি ছিলো তুমি তো জানো ৷ শুধু তোমার মায়ের জন্য ওকে ভাবী বলতে হয় ৷ যত্তসব ৷”

” নীলুকে আপাতত জানাবো না , তবে একবার নীলুর বেবিটা হতে দাও তারপর আমি আমার বেবিকে নিজের কাছে রাখবো আর নীলুকে ডিভোর্স দেবো ৷ মাসে মাসে ওর বাবা আর মা কে হাত খরচা পাঠাতে হয়, এক্সট্রা না হয় নীলুর জন্যও পাঠিয়ে দেবো তাহলে হয়তো আর কোন আপত্তি থাকবে না ৷”
” ওর বাচ্চাকে নিজের কাছে রাখার কি দরকার ? দরকার পড়লে আমরা বাচ্চা নেবো ৷”
রুদ্র শান্ত কন্ঠ কন্ঠে বলল
” আর যাই হোক বেবিটা আমারই অংশ তাই সেই ব্যাপারটা নিয়ে তুমি কোন কথা না বললেই বেটার হয় ৷ আই থিংক উই ক্যান স্কিপ দিস টপিক রাইট নাও ৷”
” ওকে ,কিন্ত সবটা মাথায় রেখে ৷”

গিটারটা হাতে নিয়ে শ্রাবন ঘরে ঢুকলো ৷ ঘরে ঢুকে গিটারটা ধুলোর আচ্ছন্ন মেঝেতে ফেলে দিলো ৷ঘরটা যে কতোদিন ঝাট দেই না তর কোন হিসাব নেই ৷
শ্রাবন বাসায় পৌছাতেই শ্রাবনের মা বলে উঠলো
” কতোবার বলেছি এসব গানটান রেখে কোন একটা ভালো চাকরির চেষ্টা কর ৷ তুই যে পড়ালেখাতে খারাপ তেমনটা তো নয়, যথেষ্ট ভালো তুই , এভাবে কেন নিজের ভবিষ্যৎটাকে নষ্ট করছিস বলতো ? আজ তোর অপ্রতিষ্টিত আর গানের কারনে নীলু মা আজ অন্য ঘরের বউ, হয়তো সেখানে সুখেই আছে কিন্তু আজ সে আমাদের ঘরের বৌ হলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেত ৷”
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল

জলকাব্য পর্ব ১

” এই চার আঙুলের দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ছোট্ট কপালটাতে যদি আজ নীলুর নাম লেখা থাকতো তাহলে কারোর সাধ্য ছিলোনা তা খন্ডানোর ৷ কিছু পাওয়ার জন্য তা আগে কপালে লেখা থাকতে হয় ৷ আল্লাহ হয়তো নীলুকে আমার জন্য সৃষ্টি করেননি,আমার কপালে নীলুর নামটা লেখেননি ৷”
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন আর বললেন
” কতো জোরই না করেছিলাম নীলুর মাকে , নীলুকে আমাদের বাসার বৌ করে আনার জন্য কিন্তু কোন ভাবেই রাজী হয়নি ৷ তার কথা অনুযায়ী যেখানে টাকাপয়সা নেই সেখানে সুখ নেই ৷”
শ্রাবন তাচ্ছিল্যর হাসি হেসে বলল
” আছে হয়তো ভীষন সুখী কে বলতে পারে ৷”

কথাটা বলে জানালার কাছে চলে গেল ৷ ওর এই ঘরের এই ছোট্ট জানালা দিয়ে পুরো শহরটা যেন দেখা যাই, চোখ বুলিয়েই যেন শহরটা ভ্রমন করা যাই ৷ চাইলেই যেন নীলুকে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখা যাই, শহরের অলিতে গলিতে গিটারের সুরের সাথে নীলু কে অনুভব করা যাই ৷
পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালো ৷ নীলুর বিয়ের পর নতুন এই বদ অভ্যাসটার জন্ম হয়েছে ৷
সিগারেটের গন্ধ সহ্য না করতে পেরে শ্রাবনের মা রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন ৷
এভাবে জীবনটা আর ঠিক কতোদিন ?
টাকা পয়সাতেই যদি আজ সুখ পাওয়া যেত তাহলে আজ বস্তির একটা ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে সুখের বসবাস হতো না, আর উচ্চবিত্তদের সম্পর্কের ভাঙন ঘটতো না ৷

জলকাব্য পর্ব ৩