ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ৭

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ৭
মেহা মেহনাজ

খবর এলো সবুজের মারফতে। ডায়েরি আর কলম হাতে তুষার তখন নিজের রুমে ব্যস্ত। তার সমস্ত জল্পনা কল্পনা এক করে সে ভাবছে নতুন কিছু কথা লেখার। এমনই সময়ে দরজায় টোকা পড়ল। তুষার চিন্তার গতিপথে লাগাম টেনে ডেকে উঠল,
“কে?”
এক জোড়া কৌতুহলী চোখ উঁকি দেয়।
“আমি।”
সবুজ সন্তর্পণে ঘরের ভেতর ঢোকে।
“তুমি! আসো আসো, ভেতরে আসো।”
“আপনারে একটা কথা কইবাম।”
“হ্যাঁ বলো, আমি শুনছি…”

“বুবু আপনেরে আর খানিক পরে পুকুরের ওইনে গিয়া খাড়াইতে কইছে। এললা এললা পারবেন না?”
সন্ধ্যায় হাত-মুখ ধুয়ে আসা ওই পুকুরের কথা বলছে সবুজ, বুঝতে মোটেও অসুবিধে হলো না তুষারের। সেই সময়েই অন্ধকার ছিল জায়গাটা। আর এখন এই রাতের বেলা…ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে রয়েছে। তুষারের একটুখানি আতংক সৃষ্টি হলো মনে। তবুও সাহস হারালো না। আর তাছাড়া তো বকুল তো থাকবেই সাথে।
তুষার বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কখন যেতে বলছে?”
“এই মনে করেন, আর খানিক পর।”
এই ‘আর খানিক পর’ টা আসলে কতটা সময় পর সেটা বুঝে উঠতে পারে না তুষার। তবুও সে ঘাড় নাড়লো।
“ঠিক আছে। তোমার বুবু কে বলে দিও, আমি আসবো।”
“আইচ্ছা।”
সবুজ দৌড় দিতে নেয়। তুষার পুনরায় তাকে ডেকে উঠে বলল,
“আর শোনো, ওকে বলে দিও যেন দ্রুত চলে আসে। আমি একা অপেক্ষা করব!”
সবুজ সম্মতি সূচক মাথা দোলালো,
“আইচ্ছা।”

রাত কালো হয়। তবে সেই কালোর গভীরতা কতটুকু, তা সম্পর্কে এই প্রথম অভিজ্ঞতা হলো তুষারের। শহুরে মানুষ ও। ছোট থেকে বড় হওয়া সবটাই ঢাকাতে। রাতের ঢাকা কখনো নিকষ কালো অন্ধকার হয় না। রাস্তায় মাথায় উঁচু করে গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ন বাতি গুলো হলদে আভা ছড়িয়ে যায় গোটা রাত জুড়ে। এর আগে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়ার জন্য সবসময় যেসব জায়গায় উঠেছে ও, সবখানেই ভালো মানের হোটেল ছিল। এই প্রথম এরকম কোনো গন্ডগ্রামে একেবারেই ভিন্ন ধারার একটি পরিবেশের স্রোতে গা ভাসিয়েছে ও।

অবশ্য তুষারের বাবা-মা কেউ কিছুই জানেন না এখনো। তারা জানেন ছেলে একটা ভালো জায়গায় আছে, হোটেলে উঠেছে। কারো বাসায় এভাবে পেয়িংগেস্ট হিসেবে আছে শুনলে ওর মা এতক্ষণে নির্ঘাত খুঁজে খুঁজে চলে আসতো। ছেলে তার অন্তপ্রাণ। ছেলের একটুখানি কষ্ট নিজের সহ্য হয় না!

তুষার এসেছে প্রায় মিনিট সাতেক হতে চললো। না, ও ঘড়ি দেখেনি। এই আঁধারে কোথায় কি আছে তাই ভালো করে দেখা যায় না! হাতে একটা ছোট হারিকেন। টিমটিম করে হালকা আলো দিচ্ছে। মকবুল এটা ওকে দিয়েছিলেন বিকেল বেলা। বলেছিলেন, রাতের বেলা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে নামলে সাথে করে নিয়ে নামতে। অপরিচিত জায়গা, তার উপর রাত, প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু আলোর মাত্রা একেবারেই তীব্র নয়। আধা হাত দূরের জিনিসও চোখে পড়ে না। বরং ওই সল্প আলো ওর চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট করে তুলছে আরও!

তুষার বিরক্তি নিয়ে এদিক ওদিক চাইলো। মেয়েটা এখনো আসছে না কেন? তবে কি সে আসবে না? নাকি তুষার ঠিকঠাক চিনে জায়গা মতো আসতে পারেনি? সাতপাঁচ হাবিজাবি চিন্তায় ওর মগজ ভরে উঠে। ঠিক এমনই সময়ে পেছন থেকে আচানক ডাকটা ভেসে আসে।
“এই যে…”
তুষার ভূত দেখার ন্যায় চমকে পেছন ঘুরে তাকালো। হারিকেনের মৃদু আলোয় বকুলের তেল চিটচিটে মুখটা চিকচিক করে উঠে।

“কন, কি কইবেন? কি কইবার লিগা ডাকছেন এমতে?”
ওর কণ্ঠে তাড়া, কপালে ঈষৎ ভাঁজ স্পষ্ট। তুষার মনে মনে হাসে। মেয়েটা বেশ বিরক্তি নিয়ে তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছে দেখা যায়।
“বিরক্ত করলাম খুব?”
“হেইডা না…আপনে কি কইবার চান, সেইডা বলেন। আমি জবাব দিয়া যাই গা। কত রাইত হইছে দেখছেন?”
তুষার আকাশ পানে তাকিয়ে বলল,
“অনেক রাত?”
বকুল ভ্রু কোঁচকালো,

“আপনে কি অন্ধ? রাইতকানা? চোক্ষে দেহেন না এইডা রাইত না দিন?”
তুষার এবার হেসে ফেলল।
“তুমি কি আমার উপর খুব বিরক্ত হচ্ছো বকুল?”
“বিরক্ত হইবাম ক্যান?”
“আসার পর থেকেই কপাল কুঁচকে রেখেছো, চোখেমুখে উৎপীড়ন, কণ্ঠে তাড়া। তাই ভাবলাম..”
বকুল ‘হুউফ’ করে একটা ছোট্ট শ্বাস ছাড়ে। কণ্ঠে শীতলতা ঢেলে বলে উঠে,

“দেহেন, আপনে ডাকছেন, আমি আইছি। এহন যা কইবার চান কন, আমি উত্তর দিয়া যাইগা। এইডা আপনেগো শহর না। গেরাম। এইহানের মাইনষের হিসাব-কিতাব আলাদা। কেউ যদি দেইখা ফেলে আপনের লগে আমারে, এই রাইতে এমনে কতা কইতেছি, তাইলে সর্বনাশ হইয়া যাইবো। এই লিগা আমি তাড়া দিবার লাগছি।”
তুষার বুঝল। ও নিজেও জানে। তাই আর দেড়ি করল না। অধরের হাসি মুছে সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
“আমি তোমার গল্পটা জানতে চাই। আমাকে তোমার গল্পটা বলো।”

“আমার গল্প?”
বকুল বিস্মিত হলো।
“আমার আবার কিয়ের গল্প? কি কইতাছেন আপনে?”
“আমি জানি, তোমার ভেতর একটা গল্প লুকিয়ে আছে। অনেক কথা জমে আছে। যেগুলো কাউকে বলতে চাও তুমি, কিন্তু পারো না! আমি সেই কথাগুলোই শুনতে চাই।”
“আরে না! আমার ভিত্রে কিসের কতা লুকায় থাকব! কিসের গল্প! কি যে কন না.. এই এডি কওয়ার লিগা ডাকছেন আপনে?”
“অগ্রাহ্য করছো?”

“ভাবছি কি না কি জরুলি কতা কইবেন। ধুরো..আমি বাড়িত গেলাম।”
বকুল সত্যি সত্যি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তুষার সঙ্গে সঙ্গে ওর পেছন ধরে।
“যদি কোনো গল্পই না থাকে, যদি কোনো কথাই না থাকে লুকোনো, তাহলে জিজ্ঞেস করায় ওমন চোখে জল এলো কেন? এখন কি এটাও অস্বীকার করবে বকুল?”
বকুল থমকে গেল। তবে ফিরলো না ওর দিকে। তুষার ফের বলে উঠল,
“কথা জমালে নিজেরই কষ্ট বাড়ে বকুল। তাই কথাকে উড়িয়ে দিতে হয়। একটুখানি হৃদয়ের সবটুকু শুধু সুখ স্মৃতি দিয়ে ভরে রাখো। সব দুঃখ বিলিয়ে দাও।”

বকুল কথা বলল, বিষন্ন গলা-
“আমার তো সেই রহমের সুখের স্রিতি নাই। আমার যা আছে সব…”
“দুঃখের, তাই তো? আমি সেই কথা গুলোয় শুনতে চেয়েছি। আমাকে বলা যাবে না?”
“আমি কাউরে বলতে চাই না। আপনে আমারে মাপ করেন। আর আমার কতা হুইনা আপনের লাব কি?”

“সব জায়গায় লাভ-ক্ষতির হিসেব কষাটা ধাঁতে নেই বকুল। তবুও বলছি, আমি এখানে এসেছি বেশ কয়েকটি হরর সিনেমার ডায়লগ লিখতে। এর পাশাপাশি আরও একটি উদ্দেশ্য অবশ্য আছে। আরও একটা নতুন থিম আমাকে বানাতে হবে। সেই নতুন থিমেই তোমার গল্পটা আমাকে উপকার করতো হয়তো। জানো বকুল, আমরা লেখকরা সবখানে গল্প খুঁজে বেড়াই। আমাদের কাছে জীবন মানেই টুকরো টুকরো অনেক গল্পের সমাহার। এই যে আজ আকাশ নিকষ কালো অন্ধকার, এটা দেখে তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো বকুল?”

বকুল তুষারের দিকে ঘুরলো এবার। তারপর আকাশের দিকে মুখ করে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। যেন তুষারের ছোঁড়া প্রশ্নটির উত্তর খুঁজছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারল না ওই আকাশের ভাষা। বকুল তুষারের দিকে তাকাতেই তুষার খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
“আজ আকাশের অভিমান হয়েছে। তাই তো এত অন্ধকার। আকাশের আজ খুব মন খারাপ। দেখো, শেষরাতে বৃষ্টি নামবে।”
বকুল আহাম্মকের ন্যায় চেয়ে রইলো।
“আকাশের আবার মন খারাপ কি জিনিস?”
তুষার অল্প হাসে,

“ওসব একজন সাহিত্যিকের চোখেই ধরা পড়বে। যার হৃদয়ে প্রেম নেই, সে প্রকৃতির ভাষা বোঝে না।”
এহেন কথার পিঠে কি জবাব দিবে বা দেওয়া উচিত- মাথায় ঘোরে না বকুলের। সে আরও একবার গগণের দিকে চাইলো। দেখে মনেই হচ্ছে না বৃষ্টি হবে! তার ভেতর এখন শীতকাল! এই লোকের নির্ঘাত মাথায় সমস্যা আছে!
শীতকাল শব্দটা মনে পড়তেই ওর সর্বাঙ্গ কেমন কেঁপে উঠে। গায়ের উপর অনেক বছরের নোংরা, পুরোনো, রঙচটা সোয়েটার চাপানো। হাত-পা ঠান্ডায় জমাট বেঁধেছে। কথায় কথায় খেয়ালই হয়নি এতক্ষণ, রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এমন নিশুতি রাতে কোথাও কেউ জেগে আছে নেই। বকুল দ্রুততার সঙ্গে বলে উঠল,

“বাড়িত আহেন। হারিকেনের আলোও নিভা আইতাছে।”
তুষার তাকাল, সত্যিই, তেল কমে গেছে।
“আজকে তোমার গল্পটা তাহলে শোনা হলো না।”
বকুল এবার একটু রাগই হলো। কণ্ঠে কাঠিন্য যোগ করে বলল,
“আমার কোনো গল্প নাই। এক কতা কয়বার কইয়াম? আপনে আব্বার মেহমান দেইখা কিছু কইতাছি না। অন্য কেউ হইলে…”
বকুল কি ভেবে যেন কথা থামিয়ে দিলো। তুষার বেশ মজা পেল। ছোট্ট মেয়েটার তেজপূর্ণ রূপ তাকে চমকিত করেছে। তুষার বলল,
“কি? থামলে কেন? বলো, কি করতে?”
“শশশশশ!”

এক আঙুল নিজের ঠোটের উপর রেখে তুষারকে কথা বলতে বারণ করল ও। তারপর তড়িৎ গতিতে তুষারের হাত থেকে হারিকেনটা কেড়ে নিলো এক প্রকার। তুষার অবাক হয়। ফের কিছু বলতে নেওয়ার আগেই ফুঁ দিয়ে হারিকেনের আলোটুকু নিভিয়ে দিলো বকুল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুটঘুটে ভৌতিক অন্ধকার গ্রাস করে নিলো দুইজনকেই। তুষারের বুকের ভেতর তখন আতংক খেলা করছে। হরর সিনেমার ডায়লগ লিখতে এসে এ কোন সত্যিকারের ভূতুড়ে ঘটনার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে সে?
“আমার লগে আহেন।”

তুষার শুনলো। কিন্তু নড়তে পারল না। সবকিছু ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। হুট করে নিজের বাম বাহুতে একটা টান অনুভব করল। বকুল ওর একটা হাত ধরে টেনে কোথাও একটা নিয়ে চলে। শুষ্ক পাতা, খসখস শব্দ হচ্ছে। তিরিশ সেকেন্ডের মাথায় বকুল আর তুষার পুকুর পাড়ের চেয়ে অনেকটা অদূরে এসে গা ঝোপের ভেতর লুকিয়ে পড়তে সক্ষম হলো।
আরও তিরিশ সেকেন্ড কেটে যায় নীরবতায়। তুষার চোখে কিচ্ছুটি দেখে না। চারিদিকে কবরের অন্ধকার। শুধু অনুভব করে, ওকে একা ফেলে কোথাও যায়নি বকুল। ও আছে, একদম বুকের বাম পাশেই গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নীরবতা ভেঙে বকুলই কথা বলে উঠল প্রথমে।
“আরেকটু হইলে বাঁশ খাইতাম। এমনেই সবাই কয় আমি নটি, এরপর আজীবনের লিগা গায়ে চরিত্রহীনার দাগখান লাইগা যাইতো।”

বকুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।
“আহেন, আমার হাত ধইরা আহেন।”
পুনরায় নিজ থেকেই তুষারের এক বাহু চেপে ধরে ও। যেভাবে টেনে টেনে এনেছিল এখানে, সেভাবেই টেনে টেনে বের করে নিয়ে যায় অন্য দিকে। বাড়ির রান্নাঘরের পাশে, একটা নারিকেল গাছ লাগানো আছে। ওটার গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল দুজনেই। সবকিছু মিলিয়ে ৩-৪ মিনিট সময় পেরিয়েছে। তুষার স্তব্ধ হয়ে শুধু অনুভব করে গেছে সবকিছু।
বকুল বলল,

“এরম ঢেঁড়স পুরুষ আমি আগে কহনো দেহি নাই। আপনে টের পান নাই, আমার সৎ মায়ে যে বাইর হইছিল?”
“ক…কই? না তো।”
“তা পাইবেন কেমনে! আপনের মাতা বর্তি খালি আজেবাজে প্রশ্নে ভরা। আম্মায় দেখলে কি হইতো একবার ভাবছেন?”
তুষার অপরাধী মুখ করে তাকিয়ে রইলো। বকুল অনেকটা ধমকের সুরে বলল,
“যান বাড়িত যান। গিয়া একটা ঘুম দেন মিয়া। ঘুম হয় না দেইখা আপনের মাতায় এসব আউল ফাউল প্রশ্ন ঘোরে খালি। কি হইলো? খাড়াইয়া রইছেন কি লিগা? যান কইতাছি…”

কেন যেন একটুও তর্কে জড়ালো না ছেলেটা। জড়াতে ইচ্ছে করল না ওর। চুপচাপ বাধ্য ছেলের মতো বকুলের কথা অনুসরণ করে দুই পা এগিয়েছে কি এগোয়নি, বকুল পুনরায় বলে উঠল,
“না, না, একলা যাওনের কাম নাই। হাতে বাতি নাই। এমুন আন্ধারে আমার দেখতেই কষ্ট লাগতেছে সবকিছু আর আপনে তো সবসময় আলো ঝলমলে পরিবেশে বড় হইছেন। পরে কিছু বুঝবেন না, দেখবেন না, উষ্টা খাইয়া উল্ডায়ে থাকবেন। কুনু দরকার নাই। আসেন, আমিই দিয়া আসতাছি।”

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ৬

বকুল তৃতীয় বারের মতো ওর হাত চেপে ধরল।
সেই রাতে সত্যি সত্যি বৃষ্টি হলো। যেন তেন বৃষ্টি নয়, সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন বৃষ্টি। বকুল সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টির তান্ডব দেখে তক্ষুনি ছুটলো তুষারের ঘরের দিকে…

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ৮