ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ৬

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ৬
মেহা মেহনাজ

“কি হলো? উঠে আসুন!”
বকুলের হুশ ফিরে। আশেপাশে গাঢ় সন্ধ্যা নেমে গেছে। পাখিদের কলতান মিলিয়েছে। ঘরে ফেরা প্রয়োজন। বকুলের আচানক ভীষণ রাগ লাগল অচেনা পুরুষের উপরে! সে তৎক্ষনাৎ ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর স্বরে জবাব প্রদান করে,

“লাগবো না।”
তারপর নেমে যায়। অন্ধকারেই পুকুরের পানিতে হাত-পা, কনুই, সম্ভাব্য যেখানে যেখানে কাদা লেগেছে, ধৌত করে। বালতি ধুয়ে আবার পানি নেয়। তুষার একবার বলতে চাইলো, লাগবে না আর, কিন্তু কি মনে করে আর বলল না। এবার ঠিক ঠিক পারলো ও। বালতিটা উপরে তুলে নিজে প্রায় ভেজা অবস্থায় উঠে এলো।
তুষার বিনয়ের সঙ্গে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“অনেক কষ্ট দিলাম! আমি দুঃখিত।”
বকুল না তাকিয়েই জবাবে বলে উঠে,
“অন্ধকারে হাত-মুখ ধুইতে পারবেন?”
“পারব। কিন্তু আপনি কি একটু দাঁড়াবেন? আমার এমন অন্ধকারে একা থাকার অভ্যেস নেই। মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে।”
বকুল আঁড়চোখে তুষারের উপস্থিতি অনুভব করার চেষ্টা করে। সত্যিই ভীষণ তমসাচ্ছন্ন প্রদোষকাল। বকুল বলল,
“আইচ্ছা।”

তারপর এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে রইলো। তুষার আর কিচ্ছুটি না বলে চুপ করে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বকুল ও কথা বলে না। কেমন নিস্তব্ধতা নেমে আসে প্রকৃতিতে। অচেনা মুখটির উপর থেকে কেন যেন গাম্ভীর্যতা কা*টছে না। অথচ তাঁর কোনো দোষ নেই! বকুল নিজের দোষে পা পিছলে পড়েছে…

বাবা-মায়ের ভীষণ আদরের একমাত্র ছেলে তুষাদ। পুরো নাম তুষার মাহমুদ। একটি বোন আছে। বয়সে ওর চেয়ে আট বছরের বড়। বাবা-মায়ের শেষ বয়সের সন্তান ও। আদরের দুলাল। দেখা যায় পানি টা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে হয়। শখের বশে সাহিত্য জগতে পা দিয়েছিল সে। সেখান থেকে শুরু এবং আজ এতকিছু! অল্প বয়সেই দারুণ সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তুষারের ইচ্ছা নিজ দেশ ছাড়িয়ে কলকাতাতেও সাফল্যের পদচারণা করার। সেই লক্ষ্যে সে ছুটে চলছে। টুকটাক কিছু কাজের পাশাপাশি একটা নতুন থিম লেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনমতো কোনো থিমই তার মাথায় এই মুহূর্তে ধরা দিচ্ছে না। এই নিয়েই মানসিক ভাবে বিরক্ত সে। সেই বিরক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যেই এতদূরের এই মনপুরায় আসা ওর…

রাতের খাবার দ্রুতই খাওয়া হলো। সাধারণ রান্না কিন্তু তুষারের মনে হলো, বহুদিন এত চমৎকার রান্না খাওয়া হয়নি! খাওয়া শেষে ও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। মকবুল পাশেই বসে রয়েছেন। তুষার জিজ্ঞেস করল,
“কাকীর রান্নার হাত অসাধারণ কাকা।”
মকবুল দায়সারাভাবে প্রত্যুত্তর করেন,
“আইজকা আমার মাইয়াই রানছে।”
“আপনার মেয়ে?”

তুষার ভাবতে লাগে। এ বাড়িতে আসার পর মোটামুটি সকলের সাথে পরিচিত হয়েছে সে। দুইটা ছেলে দেখেছে। একজনের নাম সবুজ, আরেকজন আকাশ। সেই সাথে দেখেছে কাকীকে। কিন্তু মেয়ে হিসেবে কাউকে তো দেখেনি। তবে কি সন্ধ্যেবেলা ওই অদ্ভুত কাণ্ড ঘটানো মেয়েটাই মকবুলের মেয়ে? ওর কথাই বলছেন তিনি?
মকবুল বললেন,
“আমার মাইয়াডারে মনে অয় দেহো নাই বাজান। তাই চিনবার পারতাছো না।”
তুষার অন্যমনস্ক গলায় জবাব প্রদান করে,
“হু…”

“ওরে আমি কইছিলাম তোমার লগে পরিচয় করাইয়া দিমু, ওয় কইলো আইবো না সামনে। তাই আর জোর করি নাই।”
“বুঝতে পেরেছি। লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়…”
“না বাজান, আমার মাইয়াডার মনের মধ্যে লজ্জা শরম এডি কিছু নাই। ভয়ডর বলতে কিচ্ছু নাই। যদি থাকতো, তাইলে আইজকা কপালে শনির দশা নিয়ে ঘুরতো না। আমার মাইয়াডা বড় বেজাত। নিজের ভাগ্য নিজে খাইলো।”
মকবুলের নাসিকাপথ ভেদ করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তুষার বুঝলো, এখানেও কোনো গল্প রয়েছে। লুকায়িত গল্প। গল্পটা কি জানার জন্য তার মন আঁকুপাঁকু করে উঠে। মকবুল জায়গা ত্যাগ করার আগেই তুষার ফের তাঁকে ডেকে উঠল,

“কাকা, আপনার মেয়ের নাম কি?”
মকবুল তাকালেন,
“বকুল…অজাতটার নাম বকুল।”
তুষার ঠোঁট নাড়ে, শব্দ হয় না। অজান্তেই বার কয়েক নামটা উচ্চারণ করল। তার মন বলল, এই মেয়ের জীবনের গল্পটা তাকে শুনতে হবে। হতে পারে, নতুন থিম লেখায় ওর গল্পটা কোনো না কোনো ভাবে কাজে দিলো।

দুই ভাইয়ের মধ্যে আকাশ বড়। বয়স বারো বছর। ছোটটার সাত। সবুজ পাটিতে বসে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে। পাশেই বকুল এবং তার সৎ মা বসে রয়েছে। বকুল এসেছিল সবুজকে খাওয়ার জন্য নিয়ে যেতে। সবুজ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যতক্ষণ না ওকে মার্বেল কিনে দেওয়া হবে, ও খাবে না। বকুল শেষমেশ তিক্ত হয়ে বলল,
“আমি কিন্না দিমুনি কাইলকা। অহন উঠ, কয়ডা খাইয়া ল।”
সবুজ সঙ্গে সঙ্গে কান্না থামিয়ে তাকাল,

“সত্যি?”
বকুল মাথা দোলায়,
“সত্যি। আয়, উঠ।”
সবুজ উঠে দাঁড়াতেই আরজু কথা বলে উঠলেন,
“তুই টেহা কই পাইছোস?”
বকুল জবাব দিলো না। আরজু উঠে দাঁড়ালেন,
“কিরে বলোস না কেন? তুই টেহা পাইছোস কই? চুরি করছোস?”
বকুল কপাল কুঁচকে বলল,

“চুরি করবাম কেন?”
“তাইলে টেহা পাইছোস কোই থেকা? চুরিই করছোস। কার টেহা চুরি করছোস?”
“আমি কারু টেহা চুরি করি নাই। এইডা আমার জমানো টেহা।”
“জমানো টেহা?”
“হ, আমার জমানো টেহা। ওই বাড়ি যহন আছিলাম, শাশুড়ি মায়ে দিতো মাজে মইধ্যে। হেই টেহা আমি আহনের সময় নিয়া আইছি। আমার আঁচলেই বান্ধা আছিলো।”
“কয়ডাদিন ধইরা ঘরে বাজার সদাই কিচ্চু নাই। তুই চোখ দিয়া দেইখাও টেহা দেস নাই ক্যান আমারে?”
“বুবুর টেহা তোমারে ক্যান দিবো মা?”

হুট করে মাঝ দিয়ে সবুজ তোতা পাখির মতো কথা বলে উঠে। আরজু ঠাস করে ওর গালে চড় বসায় সঙ্গে সঙ্গে। এক হাত দিয়ে সবুজের দুই গাল চাপ দিয়ে ধরেন।
“বুবু মা*রাস? এই বুবু তোরে ভাত দেয় হ? ওয় তোর সৎ বইন। যহন জাদু কইরা মা*ইরা ফালাইবো, তহন বুজবি গোলামের পু*ত।”
বকুল এগিয়ে আসে,
“আম্মা, ছাইড়া দেন। আমি টেহা বাইর কইরা দিতাছি। ওরে মাইরেন না।”
আরজু সবুজ কে ছেড়ে দিলেন।

“নটি মা*গী স্বার্থ দেহো হ? বাপ-ভাই না খাইয়া ম*রে আর তোমার ধারে টেহা থাকতেও তুমি বাইর করো নাই। কেসকি দিয়া বইয়া থাকো। আহুক রাইতে তোর বাপ, তারপর তোর বিষ আমি মজামু। আমার ঘরে থাইকা আমার লগেই স্বার্থপরগিরি…”
আরজু এসে বকুলের গালেও সজোরে চড় বসিয়ে দিলেন। বকুলের দুই চোখ ছলছল করছে। সে একটি কথাও না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় দাঁড়াতেই মানবের অবয়বটি চোখে পড়ল। তুষার নির্নিমেষ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বকুল সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে নেয়। উল্টোদিক ঘুরে আবার বাড়ির ভেতর এগিয়ে চলে। রেখে যায় তার সঙ্গে একটুখানি কথা বলার জন্য তৃষ্ণায় কাতর একখানা মুখ!

ও বাড়ি থেকে আসার সময় কাকতালীয় ভাবে টাকার পুটলিটা আঁচলেই বাঁধা ছিল। ওর খেয়াল ও ছিল না। খেয়াল থাকলে সব বিসর্জনের মতো টাকা ক’টাও বিসর্জন দিয়ে আসতো। বড় যত্নে গড়া সবুজ শাক-সবজি, মোরগ-মুরগি, হাঁস এবং এসবের ডিম- এগুলো রুনু বেগমই বিক্রি করে দিতো। কিছু টাকা বকুলকেও দিতেন তখন। বকুলের কখনো আলাদা কোনো কিছু কেনার প্রয়োজন মনে হয়নি। সেই টাকার পুটলিটা খুলতেই পঞ্চাশ পয়সা, এক টাকা, দুই টাকা থেকে শুরু করে বিশ টাকা পর্যন্ত অনেক গুলো নোট বেরিয়ে এলো। বকুল হিসেব জানে না। টাকাগুলি সব ভাঁজকৃত,মোড়ানো। সে পুনরায় টাকাগুলি পুটলির ভেতর রেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
ঘরের মুখে এসে দাঁড়াতেই অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা চাপা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

“কত হয়েছে?”
“ওমাগো!” বকুল মৃদু আওয়াজে চিৎকার করে উঠে। তুষার দ্রুত আঁধারের বুক চিঁড়ে ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
“আরে আমি আমি! আমি তুষার! ওই যে, সন্ধ্যায় আমার জন্য পানি আনতে গিয়ে পা পিছলে পড়লে যে.. মনে আছে?”
বকুল ধাতস্থ হয় এবার। হুট করে কোথাথেকে এক মুঠো রক্তিম আভা ওর শুষ্ক মুখের উপর ভর করল।
“আছে।”

“কত টাকা হলো?”
“আমি গুণতে পারি না।”
“আমি গুণে দেই?”
“দরকার কি? দেহি সরেন। আমার যাওয়া লাগবো।”
বকুল পা বাড়াতেই তুষার নিচু কণ্ঠে ডাকে,
“বকুল!”
বকুল থমকে যায়। এই প্রথম কারো মুখে নামখানা কেমন অন্যরকম ঠেকলো!
বকুল তাকাল,
“কি?”
“কথা আছে।”
“কি কতা?”

“অনেক কথা। সব তোমায় বলব। একটু আলাদা ভাবে দেখা করতে পারবে?”
বকুল জবাব না দিয়ে ভ্রু কুঁচকালো।
তুষার সাবধানের সঙ্গে বলল,
“কোনো আজেবাজে কথা না। শুধু তোমার দশটা মিনিট সময় আমার চাই। দয়া করো..প্লিজ!”
প্লিজ শব্দের অর্থ বকুলের অজানা। তবে ও বুঝলো, তুষার অনুরোধ করছে। ওর কণ্ঠে আকুতি। কেন যেন না করতে গেলে কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে।

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ৫

তুষার ফের অনুনয় করে উঠে,
“দশ মিনিট!”
বকুল দম ছাড়ে। বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল,
“আইচ্ছা।”
তারপর এক ছুটে দৌড়ে জায়গা ত্যাগ করল। তুষার হতভম্ব চোখে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কোথায়, কখন দেখা করবে- তা তো বলে গেল না!

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ৭