ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৬(২)

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৬(২)
সাইয়্যারা খান

রোদ সুইসাইড এটেপ্ট করেছিলো। এনগেজমেন্ট ভাঙার পরের দিনগুগো মোটেও সহজ ছিলো না রোদের জন্য। এলাকার মানুষজন নানান সময় নানা ধরনের কথা বলতো। সবসময়ে আদরে বড় হওয়া রোদ যেন এসব সহজে সহ্য করতে পারলো না। ডিপ্রেশন নামক রোগে আক্রান্ত হলো আস্তে আস্তে। সারাদিন সবার সাথে তেমন একটা কথাও বলত না। নিজেকে অকার্জ মনে হতে লাগলো। বারবার মনে হতো কি দরকার ওর এই দুনিয়াতে? একা একাই গুমরে কেঁদে উঠতো রোদ। ডিপ্রেশন একটা ভয়াবহ রোগ যা সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আক্রান্ত ব্যাক্তিকে দেখলেও বুঝার উপায় নেই সে আসলে কতটা সাফার করছে। একসময় সেই ব্যাক্তি বেছে নেয় সবচেয়ে সহজ মাধ্যম নিজেকে মুক্তি দিতে আর তা হলো সুইসাইড।

ড্রিপ্রেস্ড যে রোদ ছিলো তা পরিবারের কেউ ভাবতে পারে নি। রোদের বড় চাচি আর মা রোদের গাইনি চিকিৎসার কথা তুলতেই রাদ কড়া করে নিষেধ করলো। বোনকে সামলাতে আগে সময় দেওয়া উচিত। পরে এসব নিয়ে ভাবা যাবে। আগে তো দেখতে হবে রোদ নিজে কতটা প্রস্তুত।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এলাকায় এক বড় বোনের বিয়ে বলে দাওয়াত করা হয় রোদের পুরো পরিবারকে। রোদ যাবে না বললেও ভাই-বোনদের চাপে পরে রাজি হলো। সব কাজিনরা গেল হলুদের অনুষ্ঠানে। বাসার সবাই চাচ্ছিলো রোদ ঐ সব থেকে বের হয়ে আসুক। অনুষ্ঠানে একে একে সবাই হলুদ লাগাচ্ছিলো। রোদ যেই না বসলো ওমনি পাশ থেকে এক মহিলা বলে উঠলেন,
— বিধবা আর বাজা মেয়েদের হলুদ লাগাতে নেই এতে কনের সমস্যা হয়।

“বাজা” কথাটা যেন রোদের কানে সুচের মতো বিধলো। টলমল করে উঠলো চোখ। বসে থাকা কনে রোদের হাত চেপে ধরে প্রতিবাদ করে উঠলো এসব অহেতুক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কিন্তু মহিলা দমে যান নি বরং আরো চেচামেচি শুরু করে দিলো। রুদ্র তারাতাড়ি রাদকে ডেকে আনলো। রোদের হাত ধরে সবার উদ্দেশ্য কিছু কড়া কথা শুনিয়ে সবাইকে নিয়ে বাড়ী ফিরে আসলো। কিন্তু ততক্ষণে রোদ যেন একদম চুপ করে গিয়েছিলো। রাদ বোনের হাত ধরে অনেকক্ষণ বুঝায় এসবে কান না দিতে কিন্তু একজন ডিপ্রেশনের রুগীর কাছে এসব সান্ত্বনা বাণী তুচ্ছ।

রাদ যাওয়ার পরেই দরজা বন্ধ করে দেয় রোদ। ভাবতে থাকে এতদিনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা। কত মানুষ কত কিছুই না মন্তব্য করে ওকে নিয়ে। মানুষ শুনতে কম এবং শুনাতে বেশি ভালোবাসে। সকল ঘটনায় যেন রোদ ভাবতে বাধ্য হলো এ জীবন তুচ্ছ। কোন দরকার নেই বেঁচে থাকার। ডিপ্রেশন হলো এমন একটি রোগ যা মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলে আর জীবন নামক জিনিসটা থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। রোদ উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে ছুড়ি নিয়ে বা হাত বরাবর চালিয়ে দেয়। কিন্তু ভীতু রোদ একটু পরই র*ক্ত দেখে ঙ্গান হারানোর উপক্রম কারণ পরিবারের সাপোর্ট পেয়ে রোদের ডিপ্রেশন ততোটাও প্রখোড় ছিলো না। হঠাৎ করেই গলা ফাটিয়ে রোদ ডাকতে লাগলো,

— ভাইয়া! ভাইয়া!
মাত্রই চোখ লেগেছিলো রাদের। রোদের ডাক শুনে ধরফরিয়ে উঠে দৌড়ে এলো। বাকিরাও ততক্ষণে এসে পরলো। সেন্সলেস অবস্থায় মেঝেতে পরে ছিলো রোদ, হাত থেকে র*ক্ত পরছিলো। ভয় পেয়ে যায় সবাই। রাদ তারাতাড়ি কোলে তুলে হসপিটালে নিয়ে যায়। ততটাও গভীর ভাবে কাটে নি তাই ডক্টর ব্যান্ডেজ করে দিলো আর জানালো র*ক্তে ভয় থাকায় ঙ্গান হারিয়েছে।

রোদ এতদিনে ততটা ভয় না পেলেও নিজের কান্ডেই নিজে বেশি ভয় পেয়েছিলো। এরপর থেকেই বিগত ৬ মাস ধরে মায়ের কাছে ঘুমায় রোদ। মাঝে মাঝে রাদ আর রুদ্রও ঐ রুদ্রর মেঝেতে বা সোফায় ঘুমায়। কিন্তু তবুও পেনিক অ্যাটাক হয় রোদের যাতে করে ওর হা, পা কাঁপতে থাকে এবং অতিরিক্ত হলে ঙ্গান হারায়। কিন্তু পরিবারের সাপোর্টে রোদের সমস্যা অনেকটাই সুস্থের পথে।

রাদ প্রায় প্রায় ঘুরতে নিয়ে যেত রোদকে। নিজের অফিসেও সাথে করে নিয়ে যেত প্রায়। রাদের অফিসের সামনেই বড় একটা পার্ক আছে। রোদ রাদকে বলেই সেদিন পার্কে যায়। রাদ ছিলো মিটিং এ। রোদ বসে বসে কটন ক্যানডি খাচ্ছিলো তখনই কারো কান্না শুনতে পেয়ে সামনে তাকায়। একটা মেয়ে পরে গিয়ে কান্না করছিলো। দুপুর টাইম হওয়ায় তেমন কেউ ছিলো না। রোদ উঠে তারাতাড়ি ধরে কোলে তুলে বেঞ্চে বসায়। সুন্দর ছোট মোট প্রায় সাড়ে তিন অথবা চার বছরের একটা মেয়ে। হাটুতে ব্যাথা পেয়েছে। রোদ ব্যাগ থেকে পানি বের করে হাটু ধুয়ে ছোট্ট একটা ব্যান্ডজ লাগিয়ে দিলো। মেয়েটা তখনও বুকের দিকে হাত গুজে অল্প স্বরে কেঁদে যাচ্ছে। রোদ ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললো,

— বাবু তোমার সাথে কে আছে?
ছোট মেয়েটা কোন উত্তর দিলো না। রোদ বুঝলো হয়তো ভয় পেয়েছে তাই আদর করে জিজ্ঞেস করলো,
— আচ্ছা ঠিক আছে তোমার নাম কি?
— মিশি।
মিহিয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো মিশি। রোদ একগাল হেসে নিজের কটন ক্যান্ডিটা একটু ছিড়ে মিশির মুখে দিয়ে বললো,
— মজা না?
মিশি ও মিষ্টি করে হেসে বললো,
— হু।

রোদ পুরোটা মিশিকে খায়িয়ে দিলো। ব্যাগ থেকে নিজের পানির বোতলটা বের করে মিশির মুখের সামনে ধরতেই মিশি খেয়ে নিলো। রোদ ওর মুখ মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার আম্মু কোথায় বাবু?
মিশি অবুঝ স্বরে বললো,
— আম্মু তো নেই।
রোদ একটু কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
— আব্বু?
মিশি খুশি হয়ে গেল বাবার কথা শুনে কারণ এই উত্তর ওর জানা তাই খুশি হয়ে বললো,
— বাবাই?
— হু হু তোমার বাবাই কোথায়?

মিশি কিছু বলার আগেই একজন সুদর্শন তাগড়া পুরুষ হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের সামনে এলো। মিশিকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে অস্থির কন্ঠে বললো,
— এখানে কখন এলা মা?
মিশি বাবার বুকেই লেগে রইলো। আদ্রিয়ান মেয়েকে চুমুতে আর আদরে ভরিয়ে তুললো। এতক্ষণ শ্বাসটা আটকে ছিলো যেন। রোদ আস্তে করে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,
— ভাইয়া পানি খাবেন?
আদ্রিয়ান একপলক তাকিয়ে পানিটা খেয়ে নিলো। খুবই দরকার ছিলো এটার। মিশি বুক থেকে উঠে রোদের দিকে তাকালো। রোদ একটু হেসে গাল টেনে দিলো। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— এদিকে পরে গিয়েছিল।
আদ্রিয়ান অস্থির হতেই রোদ বললো,
— আরে ভাইয়া হাটুতে একটু ছিলেছে।
তবুও যেন আদ্রিয়ান শান্তি পেল না। মেয়েকে নিয়ে অফিসে ডুকে পড়লো। এরপর থেকে অনেকবারই রোদের সাথে মিশির দেখা হয়েছে। আদ্রিয়ান তো যাকে তাকে মেয়ের সাথে মিশতে দিবে না তাই খোঁজ নিতেই জানতে পারলো, পাশের বিল্ডিং এর অফিসের মালিকের মেয়ে রোদ সাথে আরো কিছু জানতে পারলো রোদকে ঘিরে। ছোট এই মেয়ের সাথে এতকিছু ঘটেছে ভাবতেই একটু খারাপ লাগলো আদ্রিয়ানের।

রোদ তখন প্রায় প্রায় মিশির জন্য নুডুলস, পাস্তা রান্না করে আনতো। ঐ পার্কে বসিয়েই খায়িয়ে দিতো। রোদের সুস্থতা তখন সবারই চোখে পরলো। শুধু মাঝে মধ্যে প্যানিক অ্যাটেক হতো এই যা। আদ্রিয়ানের সাথেও প্রায়ই কথা হতো। মিশি ততদিনে রোদে অভস্ত্য হয়ে গিয়েছিলো। ও যেন কিছুটা মায়ের আদর পেত রোদ থেকে। রোদও মিশির মায়ায় আটকে গিয়েছিলো। যেখানে আমরা সাধারণ পশু পাখি পালতেই ওদের প্রতি কতটা মায়ায় জড়িয়ে যাই সেখানে তো রোদ- মিশি দুজনই মানুষ।

মিশি তখন প্রায় রোজই রোদকে চেতো কিন্তু চাইলেই রোদ আসতে পারছিলো না সামনেই ছিলো ওর মেডিক্যাল এক্সাম। মিশির মন খারাপ আর কান্না থামাতে রোদ ভিডিও কলে কথা বলতো তাতেও তেমন লাভ হয় নি। তখন আদ্রিয়ান কিছুটা স্বার্থপর হয়ে উঠলো। রোদের দূর্বল জায়গা ও জানতো তাই তো সোজা রোদের বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলো। রোদের বাবা এই প্রথম নিজের বড় ভাইয়ের অনুমতির প্রয়োজন মনে করে নি। তার মেয়ে যেখানে ভালো থাকবে সেটাই সে করবে। রোদের মাও না করে নি।

রাদ না করলেও পরে বুঝে যে রোদ তো স্বাভাবিক হ’য়েছে মিশির সাথে থেকেই। আগের মতো হচ্ছে। তাহলে কেন নয়? এরকম হাজারো চিন্তার মাঝে রাজি হলো সবাই। তবুও রোদের অনুমতি ব্যাতিত তারা কিছুই করবে না। রোদকে জিজ্ঞেস করতেই রোদও কি ভেবে যেন হ্যাঁ করে দিলো। মেডিক্যালের এক্সামের পরদিন ই কাবিন করে নিলো আদ্রিয়ান।

এতো তাড়াতাড়ি রোদের পরিবার না করলেও আদ্রিয়ান তাদের বুঝিয়েছে। রাজি করিয়েছে। নিজের মেয়ের জন্য যা দরকার সব করেছে আদ্রিয়ান। রোদের পরিবারকে আসস্ত করেছে রোদের খেয়াল রাখার।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৬

[ অতীত সম্পর্কিত সকল তথ্য শেষ। এখন থেকে শুধু বর্তমান চলবে]

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৭