তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর পর্ব ১৬

তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর পর্ব ১৬
রাজিয়া রহমান

নবনী শিমলার কথামতো সিভি জমা দিয়েছে এসএম ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে।শিমলাই তাকে ওদের ওয়েবসাইটে ভ্যাকেন্সি দেখে সিভি জমা দেয়ার কথা বলেছিলো।আরো কয়েক জায়গায় নবনী সিভি জমা দিয়ে রেখেছে কিন্তু কোনো ডাক আসছে না।

২৮ তারিখ দুপুরে নবনী মেইল পেলো আজকে তার ইন্টারভিউ এসএম ইন্টারন্যাশনালে।দুরুদুরু বুকে নবনী রেডি হতে গেলো। একটা আকাশী রঙ জামদানী শাড়ি পরে চুল খোঁপা করে নবনী পথে পা বাড়ালো। এসএম ইন্টারন্যাশনালে এসে নবনীর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। ৭,৮,৯তলা নিয়ে এদের অফিস।এতো সুন্দর ডেকোরেশন করা, দেখেই নবনীর মনে হলো এখানে চাকরি পাওয়া অসম্ভব। ওয়েটিং রুমে মোট ২৫ জন ক্যান্ডিডেট অপেক্ষা করছে তাদের ডাক পড়ার।নবনী দেখলো সবাই ভীষণ সিরিয়াস হয়ে বসে আছে। মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝা যাচ্ছে এরা কতোটা কনফিডেন্ট।নবনীর কান্না পেলো এসব দেখে।তার নিজেকে মনে হলো সবচেয়ে অপদার্থ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নবনীর সামনের চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটার হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা শুরু হলো। ওদিকে ইন্টারভিউর জন্য নাম ডাকা শুরু হয়েছে। মেয়েটাকে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না।নবনী বসে থাকতে পারলো না।এতো ট্যালেন্ট ক্যান্ডিডেটদের জন্য সে চাকরি পাবে না তা বুঝে গেছে নবনী।উঠে গিয়ে মেয়েটাকে ধরে রেস্টরুমে নিয়ে গেলো। মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,”আমার ব্যাগে ইনহেলার আছে আপু,তবে শেষ ওটা।বাইরে থেকে আমাকে একটা ইনহেলার এনে দিন প্লিজ।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ”

মেয়েটার অবস্থা দেখে নবনীর ভীষণ খারাপ লাগলো। ছুটে বের হলো অফিস থেকে। তারপর লিফটের জন্য গিয়ে দেখলো লিফট নিচে।নবনী আর দাঁড়ালো না। সিড়ি ভেঙে নিচে নামলো।বাহিরে কোনো ফার্মেসী নেই,নবনী ১০ মিনিটের মতো হাটার পর একটা ফার্মেসি পেলো দ্রুত একটা ইনহেলার নিয়ে আবারও ছুটলো অফিসের দিকে।এবার এসে দেখে লিফট উপরে আছে,১৭ তলায়।নবনী এক সেকেন্ড সময় ও দাঁড়িয়ে থেকে নষ্ট করতে চায় না।হাঁপাতে হাঁপাতে উপরে উঠতে লাগলো। ৭ তলায় আসতেই নবনীর পা যেনো অবশ হয়ে এলো।মনে জোর সঞ্চয় করে নবনী রেস্ট রুমে গেলো। গিয়ে দেখে মেয়েটা এখনো চটপট করছে।নবনী ইনহেলার দিতেই ৩পাফ নিলো মেয়েটা।কিছুক্ষণ পর মেয়েটা সুস্থ হলো।নবনীর যেনো ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেলো।

মেয়েটাকে নিয়ে ওয়েটিং রুমে আসতেই দেখে এখনো ইন্টারভিউ চলছে।নবনী এসে দাড়াতে না দাড়াতে নবনীকে ডাকা হলো।
দোয়া ইউনুস পড়ে নবনী ভেতরে এগিয়ে গেলো।
শফিক আহমেদ একা বসে আছেন কেবিনে।তার সামনে একটা ল্যাপটপ। নবনী গিয়ে সালাম দিতেই তিনি বসতে বললেন।ধন্যবাদ জানিয়ে নবনী বসলো।
শফিক আহমেদ নবনীকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বললো,”শুধু একটা প্রশ্ন করবো।আই-কিউ টেস্ট। প্রচলিত একটা প্রশ্ন,সবাই জানে,তবুও জিজ্ঞেস করছি।বাংলায় কোন শব্দটিকে আমরা ভুল লিখি?”
নবনী এই প্রশ্নের উত্তর জানে।ব্যাংকে আবেদন করার পর পড়েছিলো।মিষ্টি হেসে বললো,”ভুল শব্দটা। ”

শফিক আহমেদ বললেন,”এবার আপনি যেতে পারেন।”
একে একে সবার ইন্টারভিউ নেওয়া হলো।সবাই বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ফলাফল জানার জন্য।কিছুক্ষণ পরে কোম্পানির এইচ আর এসে জানালো,নবনীকে কোম্পানি সিলেক্ট করেছে কোম্পানি।
নবনী অবাক হলো,একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সে কিভাবে সিলেক্ট হলো বুঝতে পারছে না।বুঝতে পারলো একটু পরে যখন প্রজেক্টরে একটা ভিডিও প্লে করা হলো।
সেখানে নবনী দেখলো একটু আগে সে ওই মেয়েটাকে হেল্প করার জন্য যা যা করেছে সবকিছুর ভিডিও।

শফিক আহমেদ এসে বললেন,”এই মেয়েটি আমাদের অফিসেই জব করে।এটা ছিলো আপনাদের জন্য মেইন টাস্ক।শুধু কাজ জানলেই চলবে না,মানবিক গুণ ও থাকতে হবে।আমার কাছে মানবিক গুণের কদর একটু বেশি। আপনারা এতো জন মানুষ বসে ছিলেন,কেউ একবার তাকালেন না মেয়েটার দিকে।অথচ এই মেয়েটা অচেনা একটা মেয়ের জন্য এতোকিছু করেছে।আমার ছেলের পিএ হিসেবে আমি মানুষ চেয়েছি,আপনাদের মতো স্বার্থন্বেষী নয়।ধন্যবাদ সবাইকে।”
নবনীকে জয়েনিং লেটার দেওয়া হলো। আগামী মাসের এক তারিখে নবনীর জয়েনিং। এক অবিশ্বাস্য আনন্দ নিয়ে নবনী বাসার দিকে পা বাড়ালো।

নিতু সকালে ঘুম থেকে উঠলো। নামাজের পর তাহেরা বেগমকে চা বানিয়ে দিয়ে আসলো। তাহেরা বেগম পেছন থেকে ডেকে বললেন, “প্রতিদিন বাহিরের খাবার ভালো লাগে না।আজ থেকে বাসায় রান্না করবে।ফ্রিজে গরুর মাংস আছে দেখো।মাংস নামিয়ে রান্না বসাও।লুবনার জন্য ইলিশ ভাজা করবে।আর পাতলা ডাল।”
নিতু জ্বি আচ্ছা বলে চলে গেলো। সেদিনের পর থেকে নিতু চেষ্টা করে সব কিছু মেনে নিতে।সে আসলে দেখতে চায় সমস্যাটা কার।তার নিজের নাকি এদের?সে নিজেই কি এদের সবাইকে ভিলেন ভাবছে নাকি এরা সত্যিই ভিলেন।কয়েকদিন ধরে এটা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে নিতু দেখলো এরা কেউই তাকে পছন্দ করে না।সবার মনোভাব যেনো নিতু এই বাসায় কাজ করতে এসেছে। এছাড়া নিতুর সাথে তাদের সম্পর্ক নেই।

মাংসের পুটলি বেসিনে ভিজেয়ে ভাতের পানি চাপিয়ে দিলো চুলায়।অন্য চুলায় ডাল বসালো ।ভাতের জন্য চাল ধুয়ে,মাংসের জন্য মশলা বেড়ি করতে লাগলো। পেঁয়াজ কেটে ফ্রিজে গিয়ে চেক করলো আদা রসুন বাটা আছে কি-না।
কোথাও আদা রসুন বাটা না পেয়ে নিজেই আদা রসুন কেটে নিলো। তারপর তাহেরা বেগমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “মা বাসায় ব্লেন্ডার আছে?”
তাহেরা বেগম মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বললো,”আছে,কি করবে?”
নিতু বললো, “আদা রসুন ব্লেন্ড করে নিবো।মাংসে দেয়ার জন্য।”
তাহেরা আঁতকে উঠে বললো, “না না তা হবে না।আদা রসুন জিরা সব মশলা শিল পাটায় বেটে নিবে।ব্লেন্ডারে করা মশলায় তরকারির স্বাদ পাওয়া যায় না। আমার ওসব পছন্দ নয়।”

নিতু চলে গেলো। দিশার দরজার সামনে গিয়ে ডাকতে লাগলো দিশাকে।দিশা বিছানায় শুয়ে ফেসবুক স্ক্রোল করছে।নিতুর ডাক শুনে দিশা বিরক্ত হয়ে দরজা খুললো।
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? ”
নিতু চুলে খোপা করতে করতে বললো,”রান্নাঘরে আসো,আমাকে মশলা বেটে দিতে হবে।রান্না শেষ করে আমাকে অফিসে যেতে হবে। ”

দিশার মনে হলো তাকে কেউ সপ্তম আকাশ থেকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। অবাক হয়ে বললো, “কি বললে তুমি?আমি মশলা বাটবো? আমার দিকে তাকাও তুমি। আমার স্কিন দেখেছ?গ্লাস স্কিন আমার,আমার হাত পা দেখ,পেডিকিউর মেনিকিউর করা।এসব বুয়ার কাজ করলে এসব ঠিক থাকবে আমার?আমার দিকে তাকিয়ে ও কি তুমি এটুকু বুঝতে পারছো না সবাই শ্বশুর বাড়িতে কাজ করতে আসে না।কেউ কেউ রাজত্ব করতে আসে।”

নিতু হতভম্ব হয়ে বললো, “রূপের বড়াই দেখাচ্ছো তুমি আমাকে?তোমার মতো পার্লারে গিয়ে শুয়ে থাকি না বলে কি কোনদিকে পঁচে গেছে আমার?
নাকি তুমি মনে করো তুমি মিস ওয়ার্ল্ড? যার মিস ওয়ার্ল্ড হয়েছে না খোঁজ নিয়ে দেখো তারাও নিজের কাজ নিজে করে। আর তাছাড়া আমি তোমার স্কিন কেয়ার রুটিন জানতে চাই নি।তোমার গ্লাস স্কিন ধুয়ে তুমি তোমার শাশুড়ী আর ননদকে নিয়ে পানি খাও।রান্নাঘরে কাজ বাকি আছে আমার সাথে কাজ করতে আসো।”
দিশা অগ্নিশর্মা হয়ে তাহেরা বেগমকে ডাকতে লাগলো। তাহেরা বেগম দিশার ডাক শুনে ছুটে এলেন।দিশা শাশুড়ীকে দেখেই বলতে লাগলো, “আপনার বাসায় যদি আমাকে কাজ করে খেতে হয় তবে বলে দিবেন আমাকে,আমি আমার বাবার বাসায় চলে যাবো।”

তাহেরা বেগম বললেন,”তোমাকে কে কাজ করতে বলেছে?”
নিতু বললো, “আমি বলেছি।আমাকে মশলা বেটে দিতে বলেছি ওকে।কেনো,অপরাধ হয়েছে না-কি? ”
তাহেরা বেগম কিছুটা তেঁতে উঠলেন।নিতুকে বললেন,”সামান্য একটু মশলা বাটবে তাও পারছো না?এজন্য অন্য কারো হেল্প লাগে নাকি?দিশা এসব করেছে না-কি কখনো যে ও এসব করবে এখন?ও এসব পারে না।নয়টার সময় দিশাকে দুটো ডিম সিদ্ধ করে দিবে,সাথে কাজু বাদাম আর ব্ল্যাক কফি দিবে।ভুলে যেও না এটা আজ আবার।”

নিতু অনেক কিছু বলতে গিয়ে ও নিজেকে কন্ট্রোল করলো।শাশুড়ীর সাথে তর্ক করবে না।দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের রুমের দিকে গেলো। তামিম ঘুমে ছিলো। তামিমকে টেনে ঘুম থেকে তুললো।
ঘুমঘুম চোখে তামিম জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? ”
নিতু কথা না বলে তামিমকে রান্নাঘরের দিকে টেনে নিয়ে গেলো। তারপর হাতে মশলার বাটি ধরিয়ে দিয়ে বললো,”আমাকে মশলা এসব বেটে দিবে এক্ষুনি। যদি তা না পারো তবে রান্না করো।এই যে ডাল চুলায়,ডাল রান্না করবে,মাছ ভাজবে।আমি মশলা বেটে দিচ্ছি।
কোনটা করবে ভেবে বলো।”

তামিম রাগ হতে গিয়েও রাগলো না।নিতুর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো নিতু ভীষণ রেগে আছে। এখন তামিম উল্টোপাল্টা কিছু বললে হিতে বিপরীত হবে সব।
নিতুর নাক,কপাল ঘামছে।পিঠের ব্লাউজ ঘামে ভিজে গেছে।বিনুনি করা নিতুকে ভীষণ মায়াবী লাগছে।তামিম তাকিয়ে রইলো নিতুর দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তামিম বুঝতে পারলো,সে নিতুকে না নিতুর মধ্যে নবনীকে খুঁজছে। নবনীকে দেখছে।
ভালো করে তাকিয়ে দেখলো না নিতুর মুখে কোনো ঘাম নেই,পরনে থ্রিপিস,চুলেও খোপা করা। বিনুনি নেই।

তামিমের ভীষণ কষ্ট হলো।নবনীর এই রূপ তো সে প্রতিদিন দেখতো তবে কেনো এরকম মুগ্ধ নয়নে তাকায় নি নবনীর দিকে?
কি ক্ষতি হতো যদি একদিন ঘেমে ভিজে যাওয়া মুখখানার ঘাম মুছে দিতো নিজের হাতে।
অথবা আদর করে নবনীর লম্বা চুলগুলো বিনুনি থেকে মুক্ত করে দিতো?
আজ কেনো বুকের ভেতর এরকম হাহাকার করছে?
নবনীর জন্য কেনো বুকে এতো কাঁপন অনুভব করছে?
হায় নবনী,সে তো সোনার হরিণ। তাকে কি আর ফিরে পাবে সে?দেয়ালের ওপাশে থেকেও যে সে আজ ভীষণ পর।

নিতু বললো, “এরকম ধ্যান করতে হবে না আমার দিকে তাকিয়ে। মশলা বেটে দাও আমাকে।আজ খুব খারাপ হবে নয়তো। তোমার মা’কে আমি কিছু বলবো না,তুমি রাগ হবে।তবে তোমাকে আমি ছাড়বো না আজ।দুনিয়ার সব মানুষ মশলা ব্লেন্ড করে নেয়,তোমার মায়ের তাতে আবার নখরা দেখা দিয়েছে বেশ ভালো কথা।আমিও নিতু,এক চুল ছাড় দেওয়া আমার রক্তে নেই।অন্যায় সহ্য করার মানুষ আমি নই।এই কয়েকদিনের বহুত সহ্য করে ছিলাম।”
তামিম বুঝতে পারলো, আজ আর রক্ষা নেই তার।বাধ্য হয়ে নোড়া তুলে নিলো হাতে। তারপর আদা বাটতে গেলো।
কিন্তু কিভাবে বাটবে সে মশলা?

এগুলো পিষতে তো পারছে না।নোড়ার এক মাথা দিয়ে আঘাত করে করে থেঁতলে নিলো আদা রসুন। নিতু দেখেও কিছু বললো না।যেভাবে পারুক করুক।
একটু আদা আর রসুন থেঁতলেই তামিমের বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। তারপর জিরা বাটার পালা।তামিম যতোই নোড়ার মাথা দিয়ে থেঁতলাতে চায় পারে না। বুঝতে পারলো তামিম এগুলোকে বাটতে হবে। উপায় নেই।দুই হাতে নোড়ার দুই পাশ ধরে তামিম যতোই বাটতে চায়,কিছুতেই পারে না।একটু পেস্ট হয় তো তার সাথে অনেকটা গোটা জিরা নোড়ার ওপাশে চলে যায়। ৩০ মিনিট জিরার সাথে যুদ্ধ করার পর তামিম যেই পেস্ট করলো জিরার তাতে তার নিজেরই হাসি পেলো। হাত দিয়ে ধরতেই বুঝা যায় এখানে সব জিরাই আস্ত রয়ে গেছে।
এটুকু করেই তামিম দেখতে পেলো হাতের তালুতে ফোসকা পড়ে গিয়েছে। দুই হাত লাল হয়ে আছে।

তামিমের মন খারাপ হয়ে গেলো ভীষণভাবে।নবনীকে তো সবসময় দেখতো রান্নাঘরে বসে বক্স ভর্তি করে মশলা বাটতে।কখনো তো তামিম বুঝতে চায় নি নবনীর কষ্ট হচ্ছে কি-না। কোনো দিন তো একবার হাত দেখে নি নবনীর।
মশলা বাটতে এতো কষ্ট তামিমের ধারণা ছিলো না। অথচ নবনী হাসিমুখে সব কাজ করে নিতো। আজ বড় আফসোস হলে তামিমের।নবনী যদি একটু প্রতিবাদ করতো তবে কি ক্ষতি হতো,এভাবে হয়তো নবনীকে হারাতো না তামিম আর।
তাহেরা বেগম রান্নাঘরের সামনে এসে দেখলেন তার ছেলে বসে বসে মশলা বাটছে।চমকে উঠলেন তাহেরা বেগম। দৌড়ে এসে ছেলেকে বললেন,”এসব কি করছিস তুই এখানে?তোকে কে বলেছে এসব কাজ করতে?এসব মেয়েদের কাজ তুই করতে গেলি কেনো?”

নিতুর পক্ষে আর চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না। মাথায় রক্ত উঠে গেলো নিতুর।
নিতু মাছ ভেজে মাংস বসালো রান্নার জন্য।তারপর মাংস কষতে দিয়ে পেছন ফিরে বললো,”আমি বলেছি মা আমার স্বামীকে আমাকে মশলা বেটে দিতে।স্ত্রীর কাজে সাহায্য করা তো রাসুলের সুন্নত। আপনার পুত্রবধূকে দিয়ে কিছু করানো যাবে না তার স্কিন নষ্ট হয়ে যাবে বলে।বাসায় গ্লাস নেই,তাই সবাই ওর গ্লাস স্কিনে চেহারা দেখে।ওই গ্লাস স্কিনে দাগ পড়লে তো আপনাদের গায়ে সেই দাগ লেগে যাবে।আপনার মেয়েও রাজ কন্যা। আপনি তো মা রাজমাতা।আমি নিরীহ রাঁধুনি আর কি করবো বলেন,কাজে হেল্প করার জন্য আমার স্বামীকে ছাড়া কাউকে পেলাম না পাশে।আমার কাজে হেল্প ও হবে, আমার স্বামীর সুন্নত পালন করাও হবে মা।”

তাহেরা বেগম তেড়ে গেলেন নিতুকে থাপ্পড় দিতে। তার আগেই নিতু হাত চেপে ধরে ফেললো।মুচকি হেসে নিতু বললো, “ডমেস্টিক ভায়োলেন্স এখন আর চলে না মা।জানেন তো মা, সরকার দেশে পারিবারিক সহিংসতা আইন ২০১০ প্রণয়ন করেছে,২০১৩ সালে এই আইনের বিধিমালা প্রণয়ন হয়।একটা মামলা করে দিলে না,এই তেজ আর দেখাতে পারবেন না।এজন্য আমার খুব খরচ ও হবে না।অসহায়,দরিদ্রদের জন্য ও সরকারের আইনগত সহায়তা সংস্থা আছে,প্রতিটি ইউনিয়নে। এরা বিনামূল্যে আমাকে আইনজীবী নিয়োগ করে দিবে মা।
ভাববেন না আবার এই মামলা অন্য সব মামলার মতো ঘুরবে শুধু দীর্ঘদিন, আপনার জন্য মামলা করলে আপনার নামে নোটিশ জারির ৬০ দিনের মধ্যে এই মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।

তাই ভবিষ্যতে ভুলেও হাত উঠাতে আসবেন না আমার গায়ে।”
তাহেরা বেগম বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে ছেলে কিছু বলবে সেই আশায়।
কিন্তু তামিম কিছু বললো না,এসব দেখতে দেখতে তামিম বিরক্ত হয়ে গেছে। নিজে তো কিছু বলতে পারে না তাই হঠাৎ করে তামিমের মনে হলো,নিতু যা বলেছে ঠিক বলেছে।একটু ভয় পাওয়া উচিত মায়ের।সবাইকে নবনী ভাবলে তো চলবে না।
কিছু না বলে তামিম তাই চলে গেলো।

দিশা নয়টার সময় ডাইনিং টেবিলে এসে বললো, “আমার নাশতা কই?”
তাহেরা বেগম মুখ ফুলিয়ে বসে রইলেন।নিতু রান্নাঘর থেকে বললো,”নিজের নাশতা নিজে বানিয়ে নাও।নিজের হাত পায়ের যত্ন নিজে যেভাবে নাও,ভুলে যেও না অন্যের ও হাত পা আছে।সে ও তার এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন। কাজ করলে যদি তোমার ত্বকের ক্ষতি হয়,তো আমার ও হয়।আমি তো আর নিজের ক্ষতি করে তোমার জন্য খাবার বানাতে পারি না।”
দিশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো তাহেরা বেগমের দিকে।তাহেরা বেগম নিজেও থম মেরে বসে আছেন।

সকালে সবাই ভাত খেতে বসলো আজ।মাংস খেতে গিয়ে তাহেরা বেগম চমকে গেলেন। দাঁতের নিচে সব আস্ত মশলা এসে পড়ছে।সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে জিরা পেস্ট হয় নি।মাংসের স্বাদ কেমন বাজে লাগছে।
তামিম ডাল আর ভাজা মাছ দিয়ে খেয়ে উঠলো। নিতু খেলো না।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে অফিসের জন্য বের হলো তামিমের সাথে।

তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর পর্ব ১৫

তাহেরা বেগমের রাগে পুরো শরীর জ্বলছে। কি করবেন কিছু মাথায় আসছে না তার।রাগে ক্ষোভে নিজের চুল নিজে টানতে লাগলেন।কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না।কেননা আজ মাসের ২৯ তারিখ। ১ তারিখে তামিম বেতন পায়। সেই হিসেবে নিতুও ১ তারিখে বেতন পাবে।তামিমের বেতনের ৫০ হাজার টাকা আর নিতুর ২৫ হাজার টাকার স্বপ্নে তাহেরা বেগম আপাতত নিজের রাগ সামলে নিলেন।

তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর পর্ব ১৭

2 COMMENTS

Comments are closed.