ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১৬

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১৬
Suraiya Aayat

ঘুম আসছে না কোনরকম। আমার মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘কে ওনার মায়াবতী? ‘
পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম সানা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমার চোখে ঘুম নেই আর সে দিব্যি ঘুমাচ্ছে সেটা দেখেও আমার বিরক্ত লাগছে। রাত একটা বাজে প্রায়। এ বাসার সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছে। আচ্ছা আরিশ ভাইয়া কি এখনো জেগে আছেন? জেগে জেগে কি ওনার প্রেয়শীর সাথে কথা বলেছেন? নাকি পড়াশোনা করেছেন এখনো? ‘

কথাটা ভেবে উঠে পড়লাম আমি, নাহ আর ঘুম আসবে না আজ। এ বাসার ছাদটা আমার কাছে খুব অপরিচিত না হলেও কিন্তু বেশ অপরিচিত। তাই এতো রাতে ছাদে যাওয়ার সাহস দেখাবো না। কোন কিছু না ভেবে ফুপির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, দরজায় টোকা দেওয়ার আগ অবধি ভাবতে থাকলাম যে এতো রাতে ফুপিকে ডাকা উচিত হবে কি। কিন্তু আমার যে ঘুম আসছেনা!
যেই ভাবা সেই কাজ। দরজায় টোকা মারতে মারতে একটু হাক ছাড়লাম।
‘ফুপি একটু দরজাটা খোলো! ‘

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি দুই বার ডাকা মাত্রই ফুপি দরজা খুলে দাঁড়ালেন। আমাকে এই মুহূর্তে দেখে যেন অবাক হলো না, ফুপির চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে যে তিনি এতোখন জেগে ছিলেন। আমাকে দেখে আমার হাত ধরে কোনরকম কোন প্রশ্ন না করে ঘরের ভিতরে টেনে দরজা বন্ধ করে প্রশ্ন করলেন,
‘ কি রে মা ঘুম আসেছেনা?’
যেখানে ফুপির অবাক হওয়ার কথা সেখানে আমি অবাক হলাম। মাথা নাড়িয়ে জানালাম যে না।

ফুপা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। ফুপার বয়সী লোকেরা নাক ডেকে ঘুমান কিন্তু ফুপার সে স্বভাব নেই। আমার হাত ধরে ফুপি বিছানায় বসলেন আর আমাকে বললেন তার কোলে মাথা রাখতে। আমি আর দেরি না করে ফুপির কোলে মাথা রাখলাম। ফুপি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমরা দুজনেই চুপ। হঠাৎ আমি নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে উঠলাম,
‘ফুপি তুমি এতোখন জেগে ছিলে তাইনা? ‘
ফুপি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন ‘হ্যাঁ। ‘
টেবিলের ওপর থাকা আরিশ ভাইয়ার ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমি বললাম,

‘আচ্ছা আরিশ ভাইয়া তোমার সাথে তার মনের সব কথা শেয়ার করে তাইনা? ‘
ফুপি মৌন সুরে জবাব দিলেন, ‘হমম। ‘
‘উনি হাতিরঝিল থেকে ফিরে তোমাকে এসে কিছু বলেছে? ‘
‘হ্যাঁ বলেছে তো। ‘
আমি এবার ফুপির দিকে তাকালাম, তার চোখে চোখ রেখে বললাম,
‘জানো তো উনি কাওকে ভীষন ভালোবাসেন। আমি ওনার চোখে সে ভালোবাসা দেখেছি। ‘
ফুপি হাসতে হাসতে বললেন,
‘আরিশ ঠিকই বলে, তুই সেই ছোট্ট আরুটাই আছিস। কবে যে বড়ো হবি আর কবে তে সব বুঝবি। ‘

আমি মুখ গোমরা করে বললাম,
‘ ফুপি তুমিও? ‘
ফুপির বলা কথাতে আমি দমে গেলাম।
‘আরিশ যাকে ভালোবাসে সে একদম মায়াবতী। ‘
ফুপির মুখেও সে মেয়ের প্রশংসা শুনে আমার মোটেই ভালো লাগলো না, বিধায় বলে উঠলাম।

‘ঘুম পাচ্ছে আমার। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও আর নো মোর ওয়ার্ডস। ‘
কথাটা বলতেই ফুপি হাসলেন। আমি একটু রাগ দেখিয়ে বললাম,
‘তোমরা মা ছেলে দুজনেই ফাজিল। ‘
আমার এমন কথা শুনে ফুপি বেশ উচ্ছাসের সাথে হেসে বললেন,
‘ রাগ হচ্ছে? ‘
আমি ধমকের শুরে বললাম,
‘ বললাম না যে নো মোর ওয়ার্ডস, মানে আর কোন কথা না মানে না। ‘

দুই দিন অনায়াসেই সারাদিন ঘুমিয়ে কাটালাম। আরিশ ভাইয়ার ধমক খাওয়ার ভয় নেই এই কদিনে কারন উনিও কিছু বলবেন না এখন আর, এক্সাম শেষ। সকাল আটটা কি নয়টা বাজে হয়তো। এই কদিন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অপরাধে আম্মু আমাকে নাস্তা দেয় না। তাই না পেরে রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের জন্য কফি আর ব্রেডটা নিজেই রেডি করে নিতে হয়। আজকে ক্ষিধে পেয়েছে বেশ তাই কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতেই দেখলাম যে আম্মু কার সাথে যেন গল্প করছেন। উপর থেকে একটু ভালোমতো উঁকি মারতেই দেখলাম যে মামা আর মামী বসে আছেন। আম্মুর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যে কোন কিছু নিয়ে একটা কথা কাটাকাটি চলছে। তবে মামা আর মামীকে দেখে আমি খুশি হয়ে গেলাম। এক নিমেষেই দৌড়ে ছুটে গেলাম। আমাকে অমন ভাবে ছুটতে দেখে মামা বলে উঠলেন,

‘আরে আরু আস্তে নাম পড়ে যাবি। ‘
মামার কথার তোয়াক্কা করলাম না আমি, গিয়ে মামীকে জড়িয়ে ধরতেই মামী আমার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিলেন। আমি আসাতে আম্মু আর মামার কথার মাঝে যেন একটা অল্প সময়ের বিরতি ঘটলো। আমাকে দেখে মামু বলে উঠলেন,
‘ আরু মা তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, নাহলে দেরি হয়ে যাবে। ‘
আমি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলাম,
‘কেন কেন কেন? ‘
আম্মু মুখ গোমরা করে বললেন,
‘তোর নানা ভাই যেতে বলেছে। ‘
আমি আম্মু কে উদ্দেশ্যে করে বললাম,

‘কিন্তু আমি তো এখন যাবো না ভাবছিলাম। আমি তো মেডিকেল এর এক্সাম টা শেষ হওয়ার পর যাবো ভেবেছিলাম। আরিশ ভাইয়া তো কালকে কোচিং এ এডমিশনের জন্য নিয়ে যাবেন বললেন। আমি এখন কি করে যাবো? ‘
মামা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন,
‘তুই তো তোর নানাভাইকে চিনিস। সে যা বলে তা করা বাধ্যতামূলক। তাই না করিস না মা। এক দুদিনেরই তো ব্যাপার। ‘
আমার মন সাই দিচ্ছে না। আমি আম্মুর দিকে ব্যাথিত দৃষ্টিতে তাকাতেই আম্মু বলে উঠলেন,

‘আমি আরিশের সাথে কথা বলে নেবও। তুই গিয়ে রেডি হ। ‘
আমি দুমনা মন করে উঠে এলাম। যাওয়ার ইচ্ছে নেই তবুও যেতেই হবে ভেবে কেমন কেমন জানি লাগছে। আমি সেখান থেকে উঠে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেও যেন আমার পা চলছে না। আমি ধীমে ধীমে নিজের রুমে এসে দরজা লক করে কিছুখন বিছানার ওপর বসে রইলাম। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম প্রায় 25 টা মতো মিসড কল, আরিশ ভাইয়া দিয়েছেন। আমার বুকের ভিতর কেঁপে উঠলো। বাঁচতে চাইলে এক্ষুনি কল করতে হবে। ওনার কাছে ফোন ধরাতেই উনি এক চান্সের রিসিভ করলেন, আমার বুকের ভিতর ধুকধুক করছে।
উনি ফোন রিসিভ করতেই ধমক দিলেন,

‘কতোবার ফোন করেছি ডু ইউ নো? মন আর ফোন দুটোই কি মহাকাশে রেখে আসো নাকি স্টুপিড। ‘
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
‘আমি তো নাস্তা করতে নীচে গেছিলাম। গিয়ে দেখি মামা আর মামী এসেছে তাই ওখানে গেছিলাম। এসে দেখলাম আপনার কল। ‘
উনি কঠিন স্বরে বললেন,
‘তারা কেন এসেছে হঠাৎ? ‘
‘ তারা আসবে না? তারা তো আমাদের নিজেরই লোক। ‘
উনি রেগেমেগে বললেন,
‘নিশ্চয়ই ওই জল্লাদ নানাভাই পাঠিয়েছে। ‘

আমি ওনার কথা শুনতে পেলাম। ওনার কথা শুনতে পেয়ে বললাম,
‘ আপনি এসব বলছেন কেন? নানা ভাই ই পাঠিয়েছে। দুদিনের জন্যই তো থাকবো। তারপর তো চলেই আসবো। ‘
কথাটা শুনে উনি রেগে গিয়ে বললেন,
‘তোমার নানাভাইকে বলবে তোমার বিদেশ ভ্রমন শেষ হলে মেডিকেল এর জন্য কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিতে। আর সরকারি তে চান্স না পেলে আবার বিদেশ পাঠাতে, তোমার নানার তো টাকার অভাব নেই। ‘
আমি ওনার কথা শুনে নরম ভাবে বললাম,
‘ দু দিনের ব্যাপার। তারপর তো চলেই আসবো। আর আমার নানাভাইকে বিনা এতোগুলো কথা শোনালেন কেন? ‘

‘ আমার সব জানা আছে। তোমার আম্মু আর বাবা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন, সেটা মানতে তোমার নানাভাইয়ের দশ বছর সময় লেগেছে। তাই সে এখন চাই তার পছন্দ মতো ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হোক। আলহামদুলিল্লাহ তার ইচ্ছা পূরন হোক। যদি গিয়ে কোন ঝামেলায় পড়েছো তো তোমার খবর আছে আমার কাছে। ‘
ওনার কথা শুনে হাসি পেলো। যেন আমি গেলেই নানা ভাই আমাকে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন আর এমনটা যে উনি আমাকে হারানোর ভয় পাচ্ছেন। আমি হি হি করে হেসে বললাম,
‘চিন্তা নেই অতো সহজে হারিয়ে যাচ্ছি না। ‘
কথাটা শুনতেই উনি ফোনটা কেটে দিলেন। আমি বোকা বনে গেলাম। ওনার রাগ ভাঙাতে দ্বিতীয়বার কল দিতে গেলেই উনি আর ধরলেন না। আমি রেগে গিয়ে বললাম,

‘ ব্যাটা সব রাগ খালি আমার ওপরেই দেখায়। বেয়াদপ ছ্যামড়া। ‘
কথাটা বলে ব্যাগ গোছাতে লাগলাম।
গোছাগাছ শেষ করে রেডি হওয়ার শেষ পর্যায়ে গিয়ে মামা আর মামীর ডাক শুনতে পেলাম আমি। আমি ব্যাগটা নিয়ে নীচে নামতেই মামা আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললেন,
‘চল এখন। আপু আসছি, সাবধানে থেকো। আর আমি আরুকে পৌছে দিয়ে যাবো।

আম্মু কোন কথা বলছে না, মুখ গোমরা করে আছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে যে অনেক কিছু হয়ে গেছে তা বুঝতে পারলাম কিন্তু কোন কুল কিনারা করে উঠতে পারলাম না যে কি হয়েছে কারন এরা আমার সামনে একটা বিন্দু মাত্র উচ্চারন করছে না। হাটতে হাটতে গেট এর কাছে এলাম। মামা ব্যাগটা গাড়িতে রাখতে গেলেন। মামী আম্মুর হাত ধরে বললেন,
‘ চিন্তা করো না ভাবী, আমি আছি তো। ‘

আমি মামীর মুখের দিকে তাকালাম। অনেক কিছু বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু ব্যার্থ হচ্ছি বারবার। আমি আম্মুকে বাই বলে গাড়িতে উঠতেই তাদের কথোপকথনের কিছু অংশ আমার কানে গেল। আম্মু কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললেন,
‘ আমি চাই না এরকম করে জোর জবরদস্তি করে বাবা আমার মেয়ের বিয়ে যার তার সাথে দিয়ে দিক। শুধুমাত্র নিজের জেদ পূরন করতে বাবা আরুর সাথে এমনটা করলে আমি নিজেই তোদের আছে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসবো বলে রাখলাম।

আমার মেয়েকে তোর ওপর দায়িত্ব দিয়েছি তেমন দায়িত্ব সহকারে দিয়ে যাবি আমার কাছে। বাবা ওকে একপলক চোখে দেখার অযুহাতে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে তো বিষয়টা ভালো হবে না। আরুর বাবা আরুর বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন তার বন্ধুর ছেলের সাথে। তাতে আমার অমত থাকলেও আমি কিছু বলতে পারিনি কিন্তু সবসময় আমি চুপ করে থাকবো না। ‘

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১৫

আম্মুর এমন কথা শুনে আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। এই মুহূর্তে আরিশ ভাইয়ার বলা কথা গুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। ওনার মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে যেতে নিবো তার আগেই মামী এসে আমার পাশে বসে পড়লেন, গাড়ি ছেড়ে দিল আমি কিছু করতে পারলাম না।

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১৭