তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১২

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১২
Lutful Mehijabin (লেখা)

ম্যাথ বইয়ের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পিছনের একটা বেন্চে বসে আছে মেহের। বিষণ্ণ হৃদয় নিয়ে চিন্তা করে চলছে সমুদ্রের কথা। বারংবার তার মনে হচ্ছে সকালে রান্না তৈরি করার জন্য নিশ্চয়ই সমুদ্র তাকে কাছে পেলে ইচ্ছে মতো বকবে। তার ধারণা সমুদ্র হয়তো তার তৈরি করা রুটি, ভাজি খাবে না। বিষণ্ণ মন নিয়ে এমন হাজারো কথায় চিন্তায় ব্যস্ত সে। এখনো সে তার প্রাণ প্রিয় বন্ধু তিতাসের দেখা পাই নি। ক্লাসের বাকি সব স্টুডেন্টরা তাকে এক প্রকার উপেক্ষা করে চলছে। সবাই তার সঙ্গে জ্ঞাত হতে নারাজ। এতে মেহেরের অন্তরাল বড্ড ব্যথিত।

খানিক বাদেই ক্লাসে স্যার প্রবেশ করল। লহমায় একটা মেয়ে হতদন্ত হয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে উপস্থিত হলো মেহেরের শ্রেনী কক্ষের সম্মুখে। কিছুটা দেরি হওয়াতে স্যারের বকুনি খেতে হলো মেয়েটাকে। অতঃপর নতজানু হয়ে ক্লাসের প্রবেশ করল সে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো মেহেরের বেন্চের নিকটবর্তী। মেহেরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুচকি হেসে মেহেরের গা ঘেঁষে বসে পড়ল। নেত্র যুগল বন্ধ করে পর পর দুটো ক্লান্তি মাখা নিশ্বাস ত্যাগ করে, মেহেরের উদ্দেশ্য বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–হাই, আমি দিশানি। বিজ্ঞানের স্টুডেন্ট। তোমার নাম কী?
নিমিষেই মেহেরের বিষণ্ণ মনটা পুলকিত হয়ে উঠল। খুশীর জয়ার বয়ে গেল অন্তরালে। অবশেষে তার অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটল! তার কপালেও নতুন বন্ধু জুটল। একরাশ আনন্দ আবির্ভাব ঘটল মেহের মুখশ্রীতে। চমৎকার অনুভূতিটা দিশানির নিকট প্রকাশ করল না সে। অনুভূতি মনের ভেতর চেপে রেখে মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠল,
–আমি মেহের আমি সাইন্সের ছাত্রী।
–তুমি কী নতুন এসেছ?
–হ্যাঁ।

দিশানি মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলে উঠল,
–তুমি এতো চুপচাপ, নিরব আর এতো শান্ত কেন?
দিশানির প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে শুধু মাত্র মুচকি হেসে বাক্যটার সমাপ্তি ঘটাল। পুনরায় দিশানি কিছু বলতে ঠোঁট যুগল সংকুচিত করল, তৎক্ষণাৎ ক্লাস টিচার প্রেজন্টটেশন শুরু করল। দিশানি কথা বলতে ব্যস্ত থাকার ফলে তার একটু লেইট হলো প্রেজন্ট দিতে। ফলে দ্বিতীয়বার স্যারের ভর্ৎসনার সম্মুখ হতে হলো তাকে। তাও মেয়েটা তার বকবকানি ইতি টানল না। ইচ্ছে মতো কথা বলতে থাকল মেহেরের সঙ্গে।

–মেহের, আমারা তো এখন থেকে ফেন্ড। তাই এখন থেকে তুই বলে সম্বোধন করব। ঠিক আছে?
দিশানির কথাই মনে মনে হেসে উঠল মেহের। মস্তিষ্ক বলে উঠল তিতাসের কথা। দুজনই একই ভাবে প্রশ্ন করেছে তাকে! ইশ, তার ভাইটা আজকে স্কুলে আসেনি। মেহের নিম্ন কন্ঠে ফিসফিস করে বলে উঠল,
–তুই তো একদমই তিতাসের মতো কথা বলিস।

তিতাসের কথা শুনে ভ্রূ যুগল কুঁচকে উঠল দিশানির। খানিকটা নিশ্চুপ হয়ে উঠল সে। স্বপ্ন অভিমান স্বরে বলে উঠল,
— আজকে আসেনি শয়তানটা। দেখিস মেহের, কালকে ওর কী হাল করি। বাজে ছেলে কোথাকার।
মেহের এবার স্বল্প শব্দ করে হেসে উঠল। কিন্তু তার নিম্ন কন্ঠের হাসি ক্লাস টিচারের কর্ণপাত হতে সক্ষম হলো না। শুধু মাত্র দিশানির কর্ণপাত হলো। মেহেরের হাসি দেখে দিশানির গাল যুগল বেলুনের ন্যায় ফুলে উঠল। অন্য দিকে মুখ করে বলে উঠল,

–হাসিস কেন? কথা বলব না তোর সাথে। হুম!
মেহের হাসি নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসে টিচারের দিকে লক্ষ্য করল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাসি মাখ মুখ থতমত হয়ে উঠল। ভীত মুখশ্রীতে খাতার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দিশানিকে ফিসফিস করে বলে উঠল,
–দিশু, স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কথা বলিস না।
দিশানিও সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে পড়ার দিকে মনোযোগ দিলো।

তিন ঘণ্টা বাদে মেহেরের ক্লাসের সমাপ্তি ঘটে টিফিনের ঘন্টা পড়ল। বর্তমানে মেহেরের হৃদ গহীন ভীষণ পুলকিত। কারনটা খুবই স্বল্প। আজকে সে দিশানির মতোন বন্ধু পেয়েছে। দিশানির সঙ্গে পরিচয় হয়ে, সমুদ্র নামক পাষাণভার হৃদয়ের ব্যক্তিটার কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে ছিল।

মিনিট পাঁচেক পূর্বে দিশানি বিদায় নিয়ে টিফিন খেতে বাসায় চলে গিয়েছে। অতঃপর মেহের ওয়াশরুমের যাবার উদ্দেশ্যে ক্লাস রুম হতে প্রস্থান করল। মেহের কালকের ন্যায় আজকেও অনাহারে থাকার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছি। তার মন গহীন বারংবার বলে উঠছে তাকে এখন হতে প্রতিটা দিন টিফিনের না খেয়ে থাকতে হবে। সো বিষণ্ণ মন নিয়ে থাকলে চলবে না। এটাই তার জীবনের অদৃষ্টের পরিহাস!

সমুদ্রের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো সে। নতজানু হয়ে ক্লাস রুমে দিকে ধাবিত হলো। ঠিক তৎক্ষণাৎ তার হাত ধরে কেউ টান দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল। সঙ্গে সঙ্গে মেহের অস্থির হয়ে উঠল। তার চকচকে মুখশ্রী মেঘময় আকাশের ন্যায় কালো হয়ে উঠল। সামনের দিকে লক্ষ্য না করেই হাত ছাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠল সে। মুহূর্তেই তার কর্ণপাত হলো সমুদ্রের ঝাঁঝাল গলার ভয়ঙ্কর ধ্বনি,

–হেই স্টুপিড ! কই মাছের মতো নড়াচড়া করছ কেন? কোথায় চোখ রেখে হাঁট হুম? এখুনি তো ড্রেনে পা পড়ে যেতে।
লহমায় মেহেরের শান্ত হৃদয় অশান্ত, অস্থির হয়ে উঠল। সমুদ্রের আকস্মিক উপস্থিতি তাকে বিহ্বল করে তুলেছে। বিষয়টা বিশ্বাস করতে ব্যর্থ সে। অতঃপর মেহের নিচের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। সত্যি সত্যি ছোট একটা ড্রেনের গর্ত তার পায়ের সান্নিধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা দূরে সরে যায় সে। মনে মনে নিজেকে শ খানিক গালি দিয়ে সমুদ্রের উদ্দেশ্য অস্কুটস্বরে বলে উঠল,

–থ্যাংইউ। আসলে আমি খেয়াল করি নি। আচ্ছা আমি তাহলে ক্লাস রুমে যাই।
বলেই হাঁটতে আরম্ভ করল মেহের। পুনরায় সে তার হাতে খানিকটা টান অনুভব করে থমকে দাঁড়ায়ি পড়ল। তৎক্ষণাৎ তার হৃদয় গহীনে শুরু হলো ঝড় হাওয়া। বক্ষ পিন্জরের হৃদয় স্পন্দন ঢোল পিটাতে মত্ত হয়ে উঠল। ভীত গ্রস্ত হয়ে উঠল তার অবাধ্য অন্তরাল! মূহুর্তে তার কর্ণে ভেসে উঠল সমুদ্রের ভর্ৎসনা মাখা কন্ঠেস্বর,

–আমি কী তোমাকে যেতে বলেছি স্টুপিড!
মেহের সাথে সাথে স্বল্প কেঁপে উঠল। মনে পড়ে গেল সকালের ঘটনা। নিশ্চয়ই সমুদ্রের অনুমতি ব্যতীত তার কিচেনে প্রবেশ করার তিরস্কার তাকে এখন ভোগ করতে হবে! অবশেষে সমুদ্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে মেহের ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ সংকুচিত করে বলল,

–আমি যাই। ক্লাসে,,,
মেহের কথা উপেক্ষিত করে সমুদ্র শক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
–জাস্ট সাট আপ! কাম উইথ মি।
বলেই সমুদ্র মেহেরের হাত ছেড়ে, নিজ গতিতে হাঁটতে আরম্ভ করে দিল। মেহের দিশেহারার ন্যায় বাধ্য হয়ে সমুদ্রের পিছু পিছু যেতে লাগল। আর ভীতগ্রস্ত মন নিয়ে হাজার উদ্ভট চিন্তায় মেতে উঠল। নিশ্চয়ই সমুদ্র সকালের কর্মের শাস্তি দিবে তাকে!

ফাঁকা একটা টিচারস রুমের সামনে পা যুগল স্থির করল সমুদ্র। অন্য অন্য রুম গুলো টিচার দিয়ে ভরপুর। তাই ফাঁকা একটা ক্লাস রুমে মেহেরকে নিয়ে এসেছে সে। অতঃপর মেহেরকে ভেতরে ডেকে চেয়ার বসতে বলল। মেহের কিছুক্ষণ এদিক সেদিক লক্ষ্য করে চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো নতজানু হয়ে বসে পড়ল। অতিরিক্ত ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে।
সমুদ্র টেবিলের ড্রয়ার হতে বিরিয়ানির প্যাকেট মেহেরের সামনে রেখে দিয়ে তিক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
–নাও ফিনিস ইট!

সমুদ্রের কথা শুনে মেহের স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল সমুদ্রের দৃঢ় নয়নে। সঙ্গে সঙ্গে মেহের স্বল্প ভয় পেয়ে উঠল। অত্যধিক রক্তিম বর্ণ ধারণ করে রয়েছে সমুদ্রের নেত্র যুগল। লোকটা কী রাতে ঘুমোন নি! মেহের দৃষ্টি সরিয়ে নতজানু হয়ে বসে রইল। পুনরায় সমুদ্র ক্রোধ মাখা কন্ঠে বলে উঠল,

–খাচ্ছ না কেন? দেখ, কাল রাতে খাও নি। এখন ঢং বাদ দিয়ে খাওয়া স্টাট কর। পুরোটা ফিনিস করবে।
মেহের ভয় পেয়ে ঘপাঘপ খেতে আরম্ভ করে দিল। দ্রুত খাওয়া শেষ করে প্রস্থান করল সমুদ্রের সান্নিধান হতে। সমুদ্রের অনুমতি ব্যতীত, পানি না খেয়েই নিজ ক্লাস রুমের দিকে ধাবিত হলো। যাওয়া পূর্বে কাঁপতে কাঁপতে অস্কুটস্বরে বলল,

–এখুনি টিফিন টাইম শেষ হয়ে যাবে। আমি ক্লাসে গেলাম। ভুল থাকলে দয়া করে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সরি।
মেহেরের আজব কথাবার্তা শুনে থতমত মুখ করে, মেহেরের যাওয়া পানে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সমুদ্র। মুহূর্তেই তার মোবাইল ফোন বিকট শব্দে বেজে উঠল। কল রিসিভ করতেই সমুদ্রের মুখশ্রীতে কিঞ্চিৎ চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল। ক্রোধে টগবগ করে উঠল তার শরীরের শিরা উপশিরা। ফোনের ওপর পাশে থাকা ব্যক্তির প্রত্যুত্তরে ছোট করে বলে উঠল,

–আমি এখুনি আসছি।
খানিকক্ষণ পূর্বে মেহেরের ক্লাসের সমাপ্তি ঘটছে। সকালে ন্যায় তার মন এখন অত্যধিক বিষণ্ণ হয়ে রয়েছে। কারন টিফিন শেষে দিশানি আর স্কুলে আসে নি। এমনকি সমুদ্রর ও নিজের ক্লাস নেয় নি। তাছাড়া আদিবা নামের মেয়েটা তার দলবল সহ মেহেরকে জব্দ করার প্রয়াস চালিয়েছে। ফলে ভীষণ ভাবে মন খারাপ তার। মনের এই বাজে পরিস্থিতিতে তার মস্তিষ্ক ভেবে চলছে সমুদ্রের নামক প্রাণীর কথা। কঠিন ভাবে সে সমুদ্র নামক মানুষটির চিন্তায় মত্ত হয়ে উঠছে।

এমন অবস্থায় স্বল্প বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে। এখনো রিক্সা ওয়ালা কাকা আসেনি। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করছে সে। পরিশেষে নিরুপায়ে বুকের ভেতর একরাশ সাহস যুগিয়ে নিজ গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সামনে দিকে ধাবিত হলো সে। ঠিক তখনই হঠাৎ একদল কালো মুখোশ পরিহিত ছেলে তার নিকটবর্তী হাজির হলো। মেহের ছেলে গুলোর পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে দৌড়াতে আরম্ভ করে দিল।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১১

ভয়ে তার মুখশ্রীতে কালো বর্ণ ধারণ করছে। দৌড়াতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। ভয়ে হাত পা অসাড় হয়ে উঠছে। শরীর নুইয়ে পড়তে চাইছে মাটিতে। মেহের অস্থির মাখা দেহ নিজে নিজেকে রক্ষা করতে পাগলের ন্যায় ছুটে চলছে। ছেলেগুলো মেহেরের পায়ের সাথে তালেতাল মিলিয়ে ছুটতে লাগল। একপর্যায়ে ঘিরে ফেলল মেহেরকে। লহমায় একটা ছেলে ধারাল ছুড়ি নিক্ষেপ করল মেহেরের নিকট।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৩