তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১১

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১১
Lutful Mehijabin (লেখা)

ইয়াদ নিজের বাহুর আঘাগুলো ড্রেসিং করতে ব্যস্ত। ক্ষতগুলো খুব গভীর হওয়াতে ইয়াদের মুখশ্রী নীলাভ বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। তার মুখশ্রীতে ব্যথাতুর ভাবটা স্পষ্ট। ইয়াদ জারার উপস্থিতিতে কিছুটা বিরক্ত হলো। ভ্রু যুগল কুঁচকে ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,

–আমি আজকে তোমার এই রুমে থাকব। সো গেট আউট।
ইয়াদের শান্ত কন্ঠে কিছুটা কেঁপে উঠল জারা। তড়িৎ বেগে তার হৃদয় স্পন্দন ছুটে চলতে শুরু করলো। অজানা সংশয়ে মুখশ্রী নিমেষেই কালো বর্ণ ধারণ করে উঠল। বারংবার তার মনে হতে লাগলো ইয়াদ কোন না কোন ভয়ঙ্কর খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত। মূহুর্তেই সে পলকহীন দৃষ্টিতে ইয়াদের ক্ষত পিঠে চোখ জোড়া আবদ্ধ করলো। ক্ষতগুলো বিচ্ছিরি রুপ ধারণ করে আছে! তা দেখেই জারার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারল না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অবশেষে একরাশ সাহস যুগিয়ে ইয়াদের নিকট ধাবিত হলো। কান্না মাখা কম্পনিত কন্ঠস্বরে বলে উঠলো,
–আপনি নিশ্চয়ই সাইলেন্স কিলার? শেষে কিনা আমার এক গুন্ডার সাথে বিয়ে হলো! আমি আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাই। মুক্তি পেতে চাই আপনার বন্ধি খাঁচা থেকে। আমি পুলিশকে আপনার কথা জানিয়ে দিব।
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। ইয়াদ জারার আজব কথাবার্তা শুনে, হাত থেকে স্যাভলন মাখা তুলোটা ফেলে দিল। পিছন ফিরে অগ্নি দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল জারার চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সজল নয়নে। চোয়াল শক্ত করে ধাবিত হতে লাগলো জারার কম্পনিত শরীরের নিকট।

ইয়াদকে এগিয়ে আসতে দেখে জারা ভয়ে দুবার শুকনো ঢোক গিললো। ইয়াদ শার্টলেস! গায়ে কাপড়ের ছিঁটে ফোটাও নেই। যদিও টাউজার পরিহিত কিন্তু জারার নিকট অস্বস্তিকর লাগছে। লহমায় হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটেতে আরম্ভ করেছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় বক্ষ পিন্জর ফেঁটে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। অস্থির লাগছে খুব। ক্রমশ তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। অশ্রু এসে আশ্রয় নিয়েছে তার চোখের কোণে।

ঠোঁট যুগল অতিরিক্ত হারে কাঁপছে। অতঃপর সে নিজের কম্পমান ঠোঁট যুগল কামড়ে ধরে পিছনের দিকে ধাবিত হতে লাগল। অসহায় চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ইয়াদের ধূসর মনির নয়নে। কী ভয়ঙ্কর দৃষ্টিপাত! সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর শিউরে উঠলো। ইয়াদের অচঞ্চল চোখ যুগলে চেষ্টা করেও দৃষ্টি রাখতে পারল না অতিরিক্ত ভয় পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

তৎক্ষণাৎ ইয়াদ জারার নিকটবর্তী চলে এলো। এখনো তার দৃঢ় দৃষ্টি জারার মুখশ্রীতে। একপর্যায়ে জারা পিছুতে পিছুতে দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল। অবশেষে নিরুপায় হয়ে সজল চোখ যুগল বন্ধ করে ফেললো। তাকাবে না সে ভয়ঙ্কর মুখশ্রীতে! ইয়াদ যেন দৃষ্টি দিয়ে তাকে মেরে ফেলার ফন্দি এটেছে। জারা চোখ যুগল বন্ধ করে বিরবির করে দোয়া পড়ছে। প্রার্থনা করছে, ইয়াদ যেন তাকে মেরে না ফেলে।

অতিরিক্ত রাগে ইয়াদের ফর্সা মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। ধূসর রংয়ের মনি হতে ক্রোধের আগুন জ্বলেছে। জারার মুখে থেকে ডিভোর্সের কথা শুনে ইয়াদ তার সীমাহীন রাগ কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতো বড়ো সাহস মেয়েটার? তার মুখের উপর বলে ডিভোর্স দিয়ে দিবে? অত্যধিক রাগে হাত মুঠো করে, একবার সজোরে নিজের অধর অর্থাৎ নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে ধারাল দাঁতের আঘাত পেয়ে বাজে ভাবে কেঁটে গেল তার ঠোঁট। অথচ রাগ যেন কমল না বরং বেড়ে গেল। পরিশেষে ইয়াদ রাগ প্রয়াসে জারার চোখের দিকে হাত বাড়ল। টান দিয়ে চশমাটা জারার চোখ হতে খুলে ফললে। চশমাটা ভেঙে ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে কর্কশ গলায় বলে উঠলো,

–লুক এ্যাট মি, স্টুপিড!
জারা শরীরে কাঁপুনি শুরু হলো। চশমা হীনা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকল ইয়াদের রক্তিম বর্ণ ধারণকৃত মুখশ্রীতে। কান্না যেন দলা পাকিয়ে আসছে। তৎক্ষণাৎ ইয়াদ শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
— তোমার ব্যবহারে আমি বাকরুদ্ধ। আর ইউ স্টুপিড! তুমি এখনো জান না তোমার হাসবেন্ড কী কর্মে নিযুক্ত? বিয়ের আগেই তোমার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল যে তোমার স্বামী কী করে।
জারা কোন কথা না বলে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার ফ্লোরে নিবদ্ধ।

–ওহ আচ্ছা আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি তো আবার ভিনগ্রহবাসী। সারাদিন বইয়ের পাতায় ডুবে থাকো। তোমার তো সময়ের অভাব।
জারা ইয়াদের তিক্ত বাক্যগুলো আর সহ্য করতে পারল না। চোখ বেয়ে দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল ধরণীর বুকে।
জারার চোখের পানি লক্ষ্য করে কিছুটা চুপসে গেল ইয়াদ। জারার দেহ ঘেঁষে থাকা দেয়ালে নিজের সমস্ত শক্তি প্রায়োগে বারি দিয়ে শান্ত কন্ঠস্বরে ভর্ৎসনা করে বলল,

–তুমি অনেক বড় বড় কথা বলে ফেলেছে জারা। আমার পেশা নিয়ে নানান বাজে কথা বলেছ। আর একটা কথা বলে রাখি আমি কোন গুন্ডা বা মাস্তান না। আমি একজন আর্মি জেনারেল। সো আমাকে অনেক আঘাত সহ্য করতে হয়। এখন যে আঘাত গুলো দেখেই তোমার শরীর ঘৃণায় শিউরে উঠেছে। সেই আঘাত গুলোই আমার নিত্যদিনের সাথী।
কথাগুলো বলেই ইয়াদ থেমে গেল। জারা অবাকে শেষ সীমান্তে।

পুলকিত হয়ে উঠলো তার হৃদ গহীন। সে বিশ্বাস করতে পারছে না ইয়াদ তার স্বপ্নপুরুষ। জারার ছোট্ট বেলা থেকেই অভিপ্রায় ছিল আর্মি অফিসারকে বিয়ে করবে। অবশেষে কী সত্যিই সে তার আর্মিপুরুষকে পেয়েছে! খুশীতে জারার চোখ মুখে জোৎস্না মেঘ মুক্ত আকাশে ন্যায় চকচক করে উঠলো। অশ্রু যেন বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে হারিয়ে গেল তার চোখ যুগল হতে। ভয়হীন নয়নে সে দৃষ্টি মেলে দিল ইয়াদের মুখশ্রী। আজ যেন এই ভয়ঙ্কর মানুষটাকে তার নিকট অত্যধিক ভালো লাগছে। জারা তার ঘন নেত্রপলব বিশিষ্ট নয়নে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

ইয়াদ জারার দৃষ্টি উপেক্ষা করল। জারার নিকট হতে দূরে সরে গেলো। তৎক্ষণাৎ বিছানার উপর হতে রক্তের লাল রংয়ে রংন্জিত হাওয়া অফ হোয়াইট শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিল। বিছানায় কোণে বসে চোখ যুগল বন্ধ করে নিল। মাথার সিল্কি চুলগুলো মুঠো করে জারাকে বলে উঠলো,

–কী যেন বললে, আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। অনেক সাহস না তোমার? তোমার এই সাহস কীভাবে ভাঙতে হবে তা আমার জানা আছে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ, এই সাহিল হোসাইন ইয়াদ তোমার কি হাল করে। নাও গো। এক মিনিটের মধ্যে আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাবে।
নিমেষেই জারার পুলকিত হৃদয় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। ইয়াদের ক্ষতগুলো চোখের ভেসে উঠতেই চোখ সহজ হয়ে উঠল। বুকের র ভেতর বেদনায় দুমড়ে মুচড়ে উঠল। গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল সে। অস্থির, অশান্ত মনকে শান্ত করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

–আপনি তো অনেক ব্যথা পেয়েছেন! আমি আপনাকে একটু হেল্প করি। প্লিজ আজকে আমাকে এ ঘরে থাকতে দিন।
ইয়াদ জারার একটা কথাও গ্রহণ করল না। ধমকে ফের বলে উঠলো,
–আমার কোন সাহায্যের প্রয়োজন নেই। নাও গেট আউট, স্টুপিড! তুমি যাবে নাকি আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব?
জারা আর দাঁড়াল না। চুপচাপ নতজানু হয়ে অশ্রুধারা বিসর্জন দিতে দিতে প্রস্থান করল রুম থেকে।

ফজরের সুমধুর আজানের ধ্বনি কর্ণপাত হতেই মেহেরের ঘুম ভেঙে গেল। পিটপিট করে চোখ খুলে উঠে বসল সে। গা হতে উষ্ণ কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়ে পড়ল। মুচকি হেসে বেলকণিতে চলে এলো। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরের হীম শীতল হাওয়া ছুঁয়ে দিতে লাগল। ঠান্ডায় হাল্কা কাঁপুনি ধরল তার। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা আকাশের বুকে। এখনো সূর্যি মামার দেখা মিলেনি।

চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে আছে। ঘন কুয়াশায় দুই হাত দূরের জিনিসও দেখা দুষ্কর। সবকিছু যেন কুয়াশার শুভ্র চাদরে ঢাকা পড়েছে। মুহূর্তে মেহেরের কানে ভেসে উঠল আজানের ধ্বনি। প্রতিদিন সূর্যি মামার হাজির হাওয়ার পূর্বে দিনের প্রথম প্রহরের অন্ধকার ধরণী বিলাশ করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠেছে। এই লহমায় পুলকিত করে তুললো মেহেরের আন্তরাল। অতঃপর মেহের দ্রুত কনকনে ঠান্ডা পানি দিয়ে ওযু সেরে সালাত আদায় করে, টেবিলের উপর হতে হায়ার ম্যাথ বইটা নিয়ে বিছানার উষ্ণ চাদরের ভেতরে বসে পড়তে আরম্ভ করে দিল।

সকাল আটটা বাজে মেহেরের পড়ার মনোযোগ ঘুঁচল। ব্যাগের মধ্যে বই গুছিয়ে রেখে রান্না ঘরে চলে এলো। ঝটপট চা, রুটি এবং ডিম ভেজে নিল।
তৎক্ষণাৎ সমুদ্র জন্য টেবিলে খাবার বেড়ে রেখে নিজের খাওয়ার সমাপ্তি ঘটিয়ে ড্রইংরুমটা স্বল্প পরিষ্কার করে, নিজ রুমে প্রস্থান করল।

ঘড়িতে কাটা যখন ছুঁই ছুঁই সাড়ে নয়টা ঠিক তখনই সমুদ্র ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে গেল। সারারাত ঘুময়নি সে। কালকে দুপুরে এবং রাতে না খাওয়াতে এখন প্রচন্ড খিদে পেয়েছে তার। সকালে দেরি করে নিদ্রা ভেঙেছে তাই রান্নাটা করতে পারি নি। খাবার নিয়ে চিন্তা মত্ত অবস্থায় সমুদ্রের চোখ পড়ল স্কুল ড্রেস পরিহিত মেহেরের উপর। মেহের একরাশ সাহস যুগিয়ে নতজানু অবস্থায় নিম্ন স্বরে সমুদ্রের উদ্দেশ্য বলে উঠলো,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১০

–টেবলের উপর খাবার রাখা আছে। খেয়ে নিবেন প্লিজ। আমি আসছি, রিক্সা নিয়ে চাচা চলে এসেছে।
বলেই এক মুহূর্তের জন্যেও অপেক্ষা করল না মেহের দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। এক কথাই ভয় পেয়ে প্রস্হান করল। সমুদ্র মেহেরের এহেন কান্ডে হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। টেবিলের খাবারের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো,
–এই পুঁচকির এত গুণ!

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১২