তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১০

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১০
Lutful Mehijabin (লেখা)

ঠিক রান্নাঘরের সামনে এসেই সমুদ্রের পা থেমে গেল। তার দৃষ্টি পড়ল সাদা ফ্লোরে বসে থাকা সাদা রঙের জামা পরিহিত মেহেরের উপর। কিছুটা এগিয়ে যেতে সমুদ্র পায়ের তলায় স্বল্প ভিজে অনুভব করল। স্তম্ভিত দৃষ্টিপাত দিয়ে তাকিয়ে রইল মেহেরের উপর। মুহূর্তের জন্য থমকে গেল তার হৃদয় স্পন্দন। তার পূর্ণ দৃষ্টিপাত গিয়ে পড়ল মেহেরের পিঠ ভর্তি কালো বর্ণের ভেজা একরাশি চুলের উপর। পিঠ ভাসিয়ে চুলগুলো মেঝে পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কি একটা অন্ধকার রহস্যের আড়ালে মেহের নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে!

সমুদ্রের উপস্থিতি টের পেয়ে খানিকটা বিহ্বল হয়ে পড়ল মেহের। ওড়না টেনে পিঠ ঢেকে রাখা চুলগুলো আবৃত করে নিল। লজ্জা এসে জুড়ে বসেছে তার গাল যুগলে। ফলে স্বল্প লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে তার গাল যুগল। সীমান্ত পর্যন্ত ঘোমটা টেনে প্লেটটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আড় চোখে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল সমুদ্রের মায়াবী মুখশ্রীতে। সমুদ্র অচঞ্চল নয়নে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। মেহের চেষ্টা করেও সমুদ্রের দৃঢ় চোখে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করতে ব্যর্থ হলো। ঠোঁট যুগল কিঞ্চিৎ সংকুচিত করে লজ্জামাখা কন্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–আসলে আমার প্রচন্ড খিদে পেয়েছিল। তাই আপনার অনুমতি না নিয়ে খেয়ে নিয়েছি।
মেহেরের বলা ছোট বাক্যটা সমুদ্রের শান্ত হৃদয়ে অশান্ততা আবির্ভাব ঘটাতে সক্ষম হলো। মিনিট পাঁচেক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল মেহের লজ্জা রাঙা মুখশ্রীতে। অতঃপর তার পাষাণভার অন্তর পুনরায় কঠোর রূপ ধারণ করল। খনিকের আন্তগ্লানি ত্যাগ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

— একটুও কী অপেক্ষা করতে পারলে না। ইডিয়েট!
বলেই হাতে থাকা বিরিয়ানির প্যাকেট টেবিলে উপর ফেলে দ্রুত পায়ে ড্রইং রুম প্রস্থান করল সমুদ্র। কিছুই বুঝে উঠতে পারল না মেহের। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল সমুদ্রের চলমান পায়ের দিকে। সজল হয়ে উঠল তার চোখ। সে পলকহীন নয়নে ডুব দিল গভীর চিন্তায়। মেহের ভেবে পাচ্ছে না, যার চোখে মুখে যার উপচে পড়া স্নেহ, তার ব্যবহার এমন রূঢ়!

বিষণ্ণ হৃদয় নিয়ে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা অতিবাহিত করছে জারা। খানিক পূর্বে এশারের সালাত আদায় করে, অশান্ত মন নিয়ে ড্রইং রুমে বসে রয়েছে। দৃষ্টি তার টিভির স্কিনে নিবদ্ধ। মুখশ্রীতে একরাশ বিরক্তি বিদ্যমান। ইয়াদের প্রকান্ড আড়ম্বর পূর্ণ এপার্টমেন্টটা জারার নিকট বিষাদময় লাগছে। নিজেকে বন্দি খাঁচার প্রাণী মনে হচ্ছে। চব্বিশ ঘন্টার অবরুদ্ধ নিষ্ক্রিয়তায় হাঁফিয়ে উঠেছে সে। কোন কিছু ভালো লাগছে না। লাগবেই বা কী করে, কাব্যপ্রেমিকা যে কাব্যহীনা। কাব্য প্রেম বুঝি এমনই হয়!

কাব্য ছাড়া হৃদয় গহীন শূন্য শূন্য লাগে। ইয়াদের উপর অত্যধিক রেগে রয়েছে জারা। ইয়াদ নামক পাষাণভার লোকটা তার থেকে তার প্রেমিক অর্থাৎ বই কেড়ে নিয়েছে। বাসা থেকে একটা বই ও আনতে দেয়নি। সারাটাদিন ঘুমিয়ে পাড় করেছে সে। এখন চাইতেও নিদ্রা তার চোখে ধরা দিচ্ছে না। ভয় জেঁকে বসে মন গহীনে। কোথায় গিয়েছে ইয়াদ? পুরোটা দিন একটা বারের জন্যেও ইয়াদের মুখ দর্শন মিলে নি। বড্ড অস্থিরতা কাজ করছে তার অন্তরালে। তৎক্ষণাৎ তার চোখ যুগলের দৃষ্টি পড়ল রান্নাঘরের দিকে। অবশেষে নিজের বিক্ষিপ্ত মনকে ব্যস্ত রাখার গরজে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো জারা।

সিরাত তার স্বামী রাহাতের পা যুগল জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কাঁদছে। রাহাতের চোখে মুখে ক্রোধের আগুন জ্বলছে। সে আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পালিত মেয়ে মেহেরকে সবকিছু খুলে বলবে। সে আর মেহের নামক ঝামেলাতে জড়াতে চাই না। চাই না মেহেরের অপূর্ব সৌন্দর্যের খেসারত দিতে। সে আজ কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেহেরকে সব ঘটনা বলে দিবে। এবং আজ হতে মেহেরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটাবে। কিন্তু মেহেরের পালিত মা সিরাত চাই না মেহের চিরন্তন সত্যিটা জানুক। সে চাই না মেহেরকে নিজ কোল থেকে হারাতে। তাই সিরাত হাউমাউ করে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে স্বামীর পায়ে।

–ওগো, তুমি এমন সিদ্ধান্ত নিও না। কেন বুঝো না মেয়েটা এখনো অনেক ছোট। সইতে পারবে না। আমি তো তোমার কথা গ্রহণ করেই, মেহেরকে সমুদ্রের সঙ্গে গেঁথে দিয়েছি। ও আর কোনদিনই তোমার এই বাড়িতে আসবে না। আমি যে আমার বোনকে কথা দিয়েছে। কখনও দুলাভাইকে জানতে দিব না যে তার কোন সন্তান আছে। আমি যে আমার বোনটার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে চাই।
রাহাত সিরাতের কথার প্রত্যুত্তরে কর্কশ গলায় বলল,

–তোমার কথা চুলোই যাক। পনেরোটা বছর ওই অলক্ষি মেয়েকে আগলে রেখেছি। নিজের রক্ত নয় জেনেও বুকে পাথর চেপে বাবার মতো ভালোবাসা দেওয়া চেষ্টা করছি। কী না করেছি ওই মেয়ের জন্য। আর আজ ওর জন্যই আমাকে চাকরি হারিয়ে পথে বসতে হয়েছে। বাপের মতো সুন্দর হয়েছে মেয়ে। কালি মেখে থাকতে পারতো না। বাইরে এতো ঢং ঢং করার জন্যই আজ আমার কপাল খারাপ। ওর বাপ রে বলতে হবে যেন মেয়ের এতো দিনের যাবতীয় খরচ আমাকে মিটিয়ে দেয়।

সিরাত এবার চিৎকার করে বলে উঠলো,
–এতোটা নিচু মন মানসিকতা অধিকারী তুমি? ছিঃ, এতোদিনে আমি তোমাকে চিনতে পারি নি রাহাত।
রাহাত আরো চটে গেল সিরাতের উপর। ধাক্কা মেরে ফেলে দিল সিরাতকে।

–আমি আমার পাওনাটা চাই। আজ যদি রাফির সঙ্গে মেহেরের বিয়ে দিতাম তাহলে এই দিনটা আমকে দেখতে হতো না। তোমার জন্য আজ আমাকে নিজের শহর ছেড়ে অন্য শহরে পালিয়ে বেরাতে হচ্ছে। তোমার পাকামির জন্য। তুমি চাল চেলে সমুদ্রের সঙ্গে মেহেরের বিয়েটা দিয়ে দিলে। সেদিন আমি বুঝতে পারি নি সিদ্ধান্তটা কতোটা ভুল ছিল। রাফি মেহেরের বিয়ের খবর পেয়ে খেপে গেছে।

সিরাত রাহাতের সামনে থেকে উঠে দাঁড়াল। চোখের পানি টুকু মুছে তেজী কন্ঠে বলে উঠলো,
–ওয়াও রাহাত, তুমি আমার মেয়েকে এক গুন্ডার হাতে তুলে দিয়ে চাইছিলে? আচ্ছা বাদ দিলাম যে রাফি গুন্ডা, মাস্তান। কিন্তু রাফি তো বিবাহিত।

–বিবাহিত হয়েছে তো কী হয়েছে? রাফি তো নিজের বউকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। এখন তো ওর বউ নেই।
সিরাত আর কোন কথা বলতে পারল না। স্বামীর কথাই স্তব্ধ হয়ে পড়েছে সে। বুকের বা পাশটা কেমন যেন চিনচিন ব্যথা করছে। বিশ বছরের সংসারে এই প্রথম রাহাত তাকে ব্যথা দিল। অনুভব হলো বিশ বছরের ভালোবাসা এই প্রথম তার হৃদয়ে অদৃশ্য ছুড়ির আঘাতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। যে ছুড়ির দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না। কিন্তু আঘাতটা ধারাল ছুড়ির চাইতে কোন অংশেই কম নয়। যা শুধু মাত্র অন্তরে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে ক্ষমতা রাখে। সিরাতের নিশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। রাহাতের এমন কথাগুলো ঝড় উঠিয়ে তুলেছে তার অন্তরালে।

রান্নাঘরে খাবার রাঁধতে ব্যস্ত জারা। লহমায় তার কর্ণপাত হলো কলিংবেলের মৃদু শব্দ। হাল্কা কেঁপে উঠল সে। হৃদয়ে ভয় নামক অনুভূতির উৎপত্তি ঘটল। তার ছোট মস্তিষ্কে নানান সংশয় দেখা দিল। তৎক্ষণাৎ বারংবার কলিং বেলের ভয়ঙ্কর ধ্বনি বেজে উঠল। মূহুর্তে তার হৃদয় স্পন্দন ধুপ ধুপ আওয়াজের ঢোল পিটাতে আরম্ভ করল। শরীরের অনবৃত অংশটুকু আঁচলের আবরণে আবৃত কর নিল। ভীতগ্রস্ত শরীর নিয়ে ধীর পায়ে মেইন ড্রোরের নিকটবর্তী এসে দাঁড়াল। ঠোঁট যুগল কিঞ্চিৎ কামড়ে ধরে দ্রুত দরজা খুলে দিল।

ইয়াদ ঘরের ভিতরে ঢুকে, জারাকে এক প্রকার উপেক্ষা করে দ্রুত পায়ে জারার ঘরের দিকে ধাবিত হলো। ইয়াদের ফ্যাকাসে মুখশ্রী দেখে জারা বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। না চাইতেও ধীর গতিতে এগিয়ে গেল তার রুমের ড্রোরের সামনে।

ইয়াদ জারার উপস্থিতি তোয়াক্কা করল না।পরণের অফ ওয়াইট রঙের শার্টের বোতাম গুলো খুলতে লাগল। তৎক্ষণাৎ জারা লজ্জায় নতজানু হয়ে পড়ল। ইয়াদ শার্টলেস! জারা কখনো এমন পরিস্থিতির স্বীকার হবে তা সে কল্পনাও করতে পারে নি। মুহূর্তে জারার অবাধ্য দৃষ্টি পড়ল ইয়াদারে গায়ের উপর। তার দৃষ্টিপান স্তব্ধতা ধারণ করল। লজ্জায় লাল হওয়া গাল দুটো নিমিশেই ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করল।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৯

ইয়াদের উদাম পিঠের দিকে চোখ পড়তেই শিউরে উঠল সে। সমস্ত পিঠ জুড়ে কালচে বর্ণ ধারণ করে আছে। বোধহয় কেউ সজোরে আঘাত করছে। অতঃপর জারার মন গহীন পূর্বের ন্যায় বলে উঠল, ইয়াদ একজন সাইলেন্ট কিলার। ইয়াদ নিজের বাহুর আঘাতগুলো ড্রেসিং করতে ব্যস্ত। ক্ষতগুলো খুব গভীর হওয়াতে ইয়াদের মুখশ্রী নীলাভ বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। তার মুখশ্রীতে ব্যথাতুর ভাবটা স্পষ্ট। ইয়াদ জারার উপস্থিতিতে কিছুটা বিরক্ত হলো। ভ্রু যুগল কুঁচকে ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,
–আমি আজকে তোমার,,,,,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১১