তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৯

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৯
Lutful Mehijabin (লেখা)

এমন সময় হঠাৎ আমার কর্ণপাত হলো কোন এক অচেনা পুরুষের ভারী কন্ঠ। লোকটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–মেডাম আমার সাথে চলেন।

আমি নত দৃষ্টি উঠিয়ে লোকটাকে খেয়াল করলাম।অর্ধ বয়স্ক লোক। নেভি ব্লু রঙের শার্ট এবং লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় লোকটা এক গাল হেসে গলায় থাকা গামছা দিয়ে খানিক পর পর মুখ মুছছে। সে দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে রয়েছে। এই শীতের মৌসুমে লোকটার লটাটে কিঞ্চিৎ ঘাম স্পষ্ট! লোকটা আবার ও বলে উঠলো,
–মেডাম, আমার সাথে চলেন। সামনে আমার রিক্সা খাড়া কইরা আসছি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লোকটার কথাই এবার আমি বুঝতে পারলাম আমাকে ওনার রিক্সায় উঠতে আমন্ত্রণ করছে। কিন্তু আমি কী করব কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পারছি না। যদিও রিক্সায় উঠি একে তো বাসা চিনতে পারব না। তাছাড়া একটা পায়সাও তো নেই আমার কাছে।

–ও মেডাম, চিন্তা করইরেন না। আমারে সমুদ্র স্যারে পাইয়ছে। চলেন সামনে রিক্সা।
‘সমুদ্র’ নামটা আমার কর্ণপাত হতেই স্বল্প অভিমান জমল আমার অন্তরালে! কেন হলো অভিমান? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে হানা দিলেও এর উওর আমার কাছে নেই। উনি কে হন আমার যে তার উপর অভিমানের ভান্ডার নিয়ে বসে থাকব! আমার অভিমান হওয়ার কারন যাচাই করার পূর্বে চাচা আবারও ডেকে উঠলেন,

–চলেন ম্যাডাম। দেরি হইয়া যাইতেছে।
ব্যথিত হৃদয় নিয়ে রিক্সাওয়ালা চাচার রিক্সায় উঠে বসলাম। রিক্সা চলতে আরম্ভ করল। সঙ্গে সঙ্গে শীতল হাওয়া আষ্টেপিষ্টে আমাকে ছুঁয়ে দিতে লাগল। শো শো করে শীতল হাওয়া এসে আমার গাল যুগল ঠান্ডা করতে মেতে উঠেল। ইশ, কতই না সুন্দর এই প্রকৃতি! দুপুরের কড়া রোদ ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। পুরো শহর জুড়ে অঢেল বিল্ডিং এ ভরপুর।

উঁচু উঁচু বিল্ডিং গুলো যেন আকাশ ছোঁয়ার প্রায়েস চালাচ্ছে। ভালোই লাগছে দেখতে! মাথাটা কিঞ্চিৎ আকাশের পানে মেললেই দেখা মিলছে এপার্টমেন্ট গুলোর বেলকণি। বেলকণিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে। কতো কতো রংবে রঙের পোশাক। হাজারো মানুষ তাদের নিত্যদিনের পরিহিত জামা কাপড় বেলকণিতে তাড় টানিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। আমি মুচকি মুচকি হেসে জামা কাপড় দেখে চলছি।

খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে অনুভব করছি বাতাসের শীতলতা। রিক্সা নিজ গতিতে চলছে। আমি উপভোগ করেছি প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য। আশেপাশে শত শত গাড়ি তাল মিলিয়ে ছুটে চলছে রাস্তাতে। গাড়ির হনের সঙ্গে চিৎকার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে একদল কুঁচকুঁচে কালো দাঁড়কাক। কা কা করে ডেকে নিজের অস্তিত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে আমাদের। আহা!

কতোই না প্রশান্তি ময় এই প্রকৃতি। পরিবেশটা কোলাহল পূর্ণ হলেও আমার নিকট ভালোই লাগছে। চশমা ছাড়া দু চোখে এই বিশাল প্রকৃতির সান্নিধ্যে দেখতে বড্ড অভিপ্রায় জাগছে। তাই বোকার মতো চোখ হতে চশমা খুলে হাতে নিলাম। তৎক্ষণাৎ সবকিছু যেন দু চোখে ঝাপসা হয়ে উঠলো! দূর, অযথা মিথ্যা প্রচেষ্টা করে কোন লাভ আছে? বোকার মতো কর্ম করে মনটা মূহুর্তেই ভালো হয়ে উঠলো। হাল্কা হেসে পুনরায় চশমাটা পড়ে ব্যস্ত শহর দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এই যেন প্রকৃতির ভিন্ন এক রুপ।

বারংবার সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি আমাকে মুগ্ধ করে তুলে। নিজের দুঃখ কষ্ট হাওয়াতে উড়ে যায়। শুধু একটা কথাই আমার কর্ণপাত হয়ে আমাকে গ্রাস করে ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন।’
প্রকৃতি বিলাশ করতে করতে কখন যে এপার্টমেন্টের সামনে চলে এলাম টেরই পাইনি। চাচা আমার উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন,

–মেডাম নামেন, চইলা আইছি। ওহন থাইকা আমি আপনারে স্কুলে লইয়া যামু আর লইয়া আহুম। সমুদ্র স্যারে আমারে এই কাম দিচ্ছে। জানেন ম্যাডাম স্যারের মনডা খুব ভালা। আল্লাহ তার ভালা করুক।
আমি চাচার কথার প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসি দিয়ে ভেতরে চলে এলাম। অতিদ্রুত লিফটে উঠে পড়লাম। লিফটে আমার পাশে একজন বয়স্ক মহিলা উঠলেন।

আমার দিকে আড় চোখে বারংবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু কোন কথা বললেন না আমার সঙ্গে। চতুর্থ ফ্লোর এসে লিফট থেমে গেল। আমি নেমে পড়লাম। তার ফ্লাটের সামনে এসে অভিমান মাখা দুটো নিশ্বাস ত্যাগ করলাম। ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইলাম ফ্লাটের ড্রোরের উপর। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। সারাদিন স্কুলে ক্লাস করে শরীরে একরাশ ক্লান্তি এসে ভর করেছে। তৃষ্ণা পেয়েছে প্রচুর। কিন্তু আমি নিরুপায়। ড্রোর খুলে ভিতরে ঢুকার মতো আমার সামর্থ নেই। কারন আমার কাছে ড্রোরের চাবি নেই। সমুদ্র নামক লোকটা এতোটাই ভালো মানুষ যে আমাকে বাসায় আনতে রিক্সা পাঠিয়ে দিয়েছেন ঠিকি কিন্তু ড্রোরের লক খুলার জন্য আমাকে চাবি দেন নি। কি করব, বুঝতে পারলাম না। ক্লান্তি মাখা শরীর নিয়ে বসে পড়লাম ড্রোরের পাশে। মাথা ঠেকিয়ে দিলাম দেয়ালে।

মাগরিবের আযান দিয়েছে খানিক পূর্বে। সমুদ্র চিন্তামত্ত মস্তিষ্ক নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে। দুশ্চিন্তায় তার ললাট কিঞ্চিৎ কুঁচকে রয়েছে। সে এতোটাই চিন্তা মত্ত যে সে ভুলেই গিয়েছে, মেহের নামক কোন প্রাণীর কথা। তার এই দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ হলো তার বাসার গৃহকর্মী বিধবা সকিনা বেগম। সকিনা বেগমের খোঁজ নিতে তার আগের ভাড়া বাসায় এসেছিল সমুদ্র। কিন্তু সকিনা বেগমের কোন খোঁজ সে নিতে পারেনি। সে এটাও জানে না যে কোথায় সকিনা বেগমের গ্রামের বাড়ি। তাই সমুদ্র বলতেই পারছে না, কোথায় গিয়েছে সকিনা বেগম এবং তার মেয়ে। খোঁজ না পাওয়া যেন সমুদ্রের নিকট অসীম ব্যর্থতা পূর্ণ ।

এপার্টমেন্টের সামনে এসে পড়তেই সমুদ্র মন পড়ল, মেহেরের কথা। তৎক্ষণাৎ তার মুখ হতে বিরক্তির ‘চ’ শব্দটি বের হলো। দ্রুত সে গাড়ি পার্কিং করে লিফটে উঠলো।

লিফ্ট থেকে বেরিয়ে ফ্লাটের ড্রোরের সামনে এসেই সমুদ্রের চোখে পড়ল মেহেরের হেলে পড়া ঘুমন্ত দেহের উপর। পরপর দুটো স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। মেইন ড্রোরের লক খুলে এগিয়ে গেল মেহেরের নিকট।
অহনার কিনে দেওয়া নতুন বই ভর্তি ব্যাগটা জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেহের। চোখের চশমাটা চোখ হতে খানিকটা সরে গিয়েছে। মেহেরের মাথার চুলগুলো স্কার্ফ ভেদ করে এলোমেলো হয়ে রয়েছে। তার ফর্সা গাল যুগল ঠান্ডা হাওয়াতে লালাভ বর্ণ ধারণ করে রয়েছে।

সমুদ্র খানিকটা সময় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেহেরের মায়াভরা চেহারাতে। মনে মনে কিছুটা অনুতপ্ত হলো সে। সিদ্ধান্ত নিল মেহেরের শান্তির ঘুম না ভেঙে তাকে ঘরে নিয়ে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মস্তিষ্ক বলে উঠলো, অযথা মিথ্যে মায়া বারিয়ে কোন লাভ নেই।

মূহুর্তে সে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলল। মেহেরের উপর হতে দৃষ্টি সরিয়ে ঝাঁঝাল গলায় বলে উঠলো,
–এই পুঁচকি, ঘুমানোর কী জায়গায় পেলে না? উঠে পড়।
সমুদ্র নামক লোকটার ঝাঁঝাল আওয়াজ কর্ণপাত হতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। পিটপিট করে চোখ মেলে তার দিকে তাকালাম। চশমাটা ঠিক করে পড়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে উঠে দাঁড়ালাম। তাৎক্ষণিক ক্লান্তি মাখা শরীর নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।
মেহেরকে ডেকে সমুদ্র ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল। নিজের রুমে এসে সমুদ্র তার গায়ে থাকা কোট টা ছুড়ে ফেলল আর ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে।

মাত্র শাওয়ার সেরে বিছানার উপর বসলাম। ভেবেছিলাম শাওয়ার নিলে ক্লান্তির সমাপ্তি ঘটবে।কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ক্লান্তি যেন শরীরে গভীর ভাবে আক্রমণ করল। অতিরিক্ত শীতে আমার শরীর কাঁপতে আরম্ভ করল। দুপুরে না খাওয়ার জন্যে খিদে আরও বেড়ে গেল। অতিরিক্ত খিদের ফলে পেটের ভেতরে স্বল্প ব্যথা অনুভব হতে লাগল।

আমি আর থাকতে পারলাম না। ধীর পায়ে চলে এলাম ড্রইং রুমে। একপলক উনার ঘরের দিকে লক্ষ্য করলাম। কিন্তু উনাকে দেখতে পেলাম না। রান্না ঘরে এসে পর্যবেক্ষণ করতে দেখলাম, রাইসকুকারে গরম ভাতের বাষ্প বুদবুদ করছে। সঙ্গে সঙ্গে মুখে পানি চলে এলো। আর এক মূহুর্তও দেরি করলাম না। রাইসকুকার থেকে ভাত প্লেটে বেরে ফ্লোরে বসে হাত না ধুয়ে খেতে আরম্ভ করলাম। ভাতের কয়েকটা দানা মুখে পুড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ফ্রিজ থেকে কাঁচা মরিচ বের করে ধুয়ে নিলাম। লবণের কৌটো খুঁজে বের করে, স্বল্প লবণ হাতে নিয়ে দৌড়ে খাবার প্লেটটার সামনে এসে বসলাম। লবণ মরিচ এবং পানি দিয়ে ভাত ভালোভাবে মাখিয়ে পুনরায় তৃপ্তি সহকারে খেতে আরম্ভ করে দিলাম।

রাইসকুকারে ভাত বসিয়ে দিয়ে তরকারি কিনতে বাসা থেকে বেরিয়েছে সমুদ্র। সে আজকে দুপুরে লাঞ্চ করেনি। কিন্তু মেহেরের খাবার কথা তার মস্তিষ্ক হতে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাই সমুদ্র হোটেল থেকে তারকারি কিনতে এসে রেস্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানি কিনে এসেছে।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৮

মেন ড্রোরের লক খুলে ভিতরে প্রবেশ করল সমুদ্র। হাতে থাকা বিরিয়ানির প্যাকেট ধরে এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে।
ঠিক রান্নাঘরের সামনে এসেই তার পা থেমে গেল। তার দৃষ্টি পড়ল সাদা ফ্লোরে বসে থাকা সাদা রঙের জামা পরিহিত মেহেরের উপর। কিছুটা এগিয়ে যেতে সমুদ্র পায়ের তলায় ভিজে অনুভব করলাম। সে স্তম্ভিত দৃষ্টিপাত দিয়ে তাকিয়ে রইল মেহেরে,,,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১০