তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৮

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৮
Lutful Mehijabin (লেখা)

অহনা আপু আমাকে ক্লাস রুমে বসিয়ে দিয়ে চলে গেছেন। পিছের একটা বেন্চে বসে আছি। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না। আমি বিষন্ন মনে নতুন বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছি। খানিক বাদেই ক্লাসে টিচার প্রবেশ করতে সবাই উঠে দাঁড়াল। আমিও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম সামনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আমি স্তম্ভিত হয়ে উঠলাম। ক্লাস চিটারের স্থানে উনাকে দেখে আমি বিহ্বল হয়ে পড়লাম!

সমুদ্র নামক লোকটাকে শিক্ষক হিসেবে দেখে আমি অবাকের পরিশেষে চলে গেলাম। ফলে আমার অধর এবং ওষ্ঠ কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল। ভেবেছিলাম অন্তত পক্ষে স্কুলে যতক্ষণ থাকব ততক্ষণ ওনার থেকে দূরে থাকব। ওনার অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখশ্রী দর্শন থেকে বেঁচে যাব। কিন্তু তা আর হলো না, সে আমার নতুন স্কুলের শিক্ষক। ইনফ্যাক্ট আমার নিজের শিক্ষক। তারমানে এখন থেকে সে আমার পড়া জিজ্ঞেস করবে? আজ থেকে তাকে শিক্ষক হিসেবে স্থান দিতে হবে আমার অন্তরালে! হয়তো একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি তার দিকে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। খেয়াল করি নি যে ক্লাসের সবাই বসে পড়েছে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ক্লাসের সবাই খিলখিল করে হেসে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে আমি তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নতজানু হয়ে বসে পড়লাম। ক্লাসের ছাত্র ছাত্রী গুলো তখনও হাসতে লাগল। স্কুল প্রথম দিনে আমাকে এমন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হবে তা আমি কল্পনা করি নি। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে শক্ত হয়ে বসে রইলাম। অতঃপর আমার কর্ণপাত হলো উনার শক্ত গলার ধমক। মূহুর্তে তিনি সব স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

–সাইলেন্ট!
ওনার কন্ঠে ‘সাইলেন্ট’ নামক একটা শব্দ শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। নিরব হয়ে গেল ক্লাস রুম। অতঃপর তিনি ভারী গলায় বলে উঠলেন,
–আজকে তোমাদের ক্লাস টিচার গনেষ স্যার আসেনি। তাই তার প্রক্সি ক্লাস আমি নিচ্ছি । সো তোমাদের মুখ থেকে যেন টু শব্দ না শুনি। আন্ডারস্ট্যান্ড?
সঙ্গে সঙ্গে সবাই বলে উঠলো,

–ইয়েস স্যার।
মেহেরকে দেখার পর থেকে সমুদ্রের মস্তিষ্কে বারংবার ঘুরপাক খাচ্ছে, মেহের আমার স্টুডেন্ট! ওই বাচ্চার সাথে সে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে ? ওই পুঁচকি তার স্ত্রী! বিষয়টা সমুদ্র একদমি গ্রহণ করতে পারছে না। বিষয়টা প্রতিনিয়ত তার সম্মানে আঘাত প্রাপ্ত করে তুলেছে।
সমুদ্র চিন্তা ভাবনার মধ্যেই আদিবা নামের একটা মেয়ে উঠে দাঁড়াল। সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে মিটমিট করে বলে উঠলো,

–স্যার আমি একটা কথা বলি?
সমুদ্র আদিবার কথার প্রত্যুত্তর বলল,
–ইয়েস বলো।
–স্যার, আমাদের একটা পরীক্ষা নিন। যেহেতু আজকে গনেষ স্যার আসে নি।
সমুদ্র আদিবার কথা শুনে পরাপর দুটো নিশ্বাস ত্যাগ করে বলে উঠলো,

–ওকে। আমি তোমাদের টেস্ট নিব। কয়েকটা অংক বোর্ডে লিখে দিব। সেগুলো করে দিবে।
সমুদ্রের প্রত্যুত্তর শুনে আদিবার মুখশ্রী কালো হয়ে উঠেছে। সে ভেবেছিল হয়তো সমুদ্র বলবে, ‘থাক আজকে পড়তে হবে না’। বরং সমুদ্র তাকে ভালো বলবে। কিন্তু তা তো হলো না, বরং বিপরীতটা হলো।
আদিবার মতো ক্লাসে সব স্টুডেন্টদের মুখশ্রীতে ভয়ের আবির্ভাব ঘটেছে। ম্যাথ না পারলে হয়তো সমুদ্র তাদের অবস্থা খারাপ করে দিবে।

গনিত বইয়ের উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে ভয়গ্রস্ত হৃদয় নিয়ে বসে আছি। একটা অংক ও পারি না। রিভাইসের অভাবে সব অংক ভুলে গিয়েছি। সব পারি কিন্তু কোন নিয়ম ধরা দিচ্ছে না আমার মস্তিষ্কে। তাও কলম চলিয়ে উল্টে পাল্টে নিয়মে সল্ভ করতে শুরু করলাম।

সমুদ্র বোর্ডে অংক উঠানো সমাপ্ত করে চিন্তা মত্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবছে, নিশ্চয়ই মেহের অংক করতে পারবে না। কারণ মেয়েটা মেধাবী ছাত্রী নয়। তার ধারণা যে মেয়েকে তার পরিবার বাল্যবিবাহ দিয়ে দেয়, সেই মেয়ে অবশ্যই মেধাহীন স্টুডেন্ট। বিষয়টা যাচাই করতেই সমুদ্র আকস্মিক সবাইকে অংক করতে দিয়েছে।

ঘড়ির কাটার দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে দেখলাম চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গিয়েছে। এখনও আমি অংক স্লভ করতে ব্যর্থ। এরমধ্যে পাঁচ জন অংক সল্ভ করে তাকে দেখিয়েছে। অবশেষে আমি আর চেষ্টা করলাম না। ভাবলাম খানিকক্ষণ পরেই তো ক্লাসের সমাপ্ত ঘটবে। তাই আর করলাম না। খাতা রেখে নতজানু হয়ে বসে রইলাম।

আমার ধারণা ছিল, সে হয়তো আমার খাতা দেখতে চাইবেন না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল করে দিলেন উনি। চেয়ার হতে উঠে এসে আমার নিকট দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার সামনে অবস্থিত খাতাটা টান দিয়ে নিয়ে দেখতে আরম্ভ করে দিলেন। ওনার এহেন কন্ডে আমি বিব্রত হয়ে পড়লাম। একপলক পুরো ক্লাস পর্যবেক্ষণ করে পুনরায় নতজানু হয়ে রইলাম।
মেহেরের খাতার ভুল অংক দেখে, কিঞ্চিৎ পরিমাণ অহংকারের আবির্ভাব ঘটলো সমুদ্রের হৃদয় গহীনে। মেহেরকে একপ্রকার উপেক্ষিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

–তুমি বোধহয় নিউ স্টুডেন্ট! নাম কী তোমার?
উনার প্রশ্ন শুনে আমি থতমত হয়ে উঠলাম। খানিকক্ষণ স্তম্ভিত থেকে অস্কুটস্বরে বলে উঠলাম,
–মেহের ।
আমার নাম জানেন না তিনি আজব! একরাশ বিরক্তিতে ভরে উঠেছে আমার অন্তরালে। লোকটা আসলেই অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

সমুদ্র এক মূহুর্তের জন্যে ও দাঁড়াল না। বেরিয়ে গেল ক্লাস রুম থেকে।
উনি যাবার পর পুরো ক্লাস রুম পূর্বের ন্যায় কোলাহল পূর্ণ রুপ ধারণ করল। আর আমি বিষণ্ণ হৃদয় নিয়ে বসে রইলাম বেন্চের এক কণে। ভালো লাগছে না। ক্লাসের কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না। বোধহয় তারা আমাকে গ্রহণ করতে পারছে না।

রোদের মিষ্টি আলো জানালার কাঁচ ভেদ করে জারার ঘুমন্ত মুখশ্রীতে ছোঁয়া দিয়ে চলছে অনবরত। ফলে একপর্যায়ে ব্যাঘাত ঘটলো জারার অতিরিক্ত আরামময় নিদ্রার। নেত্র পল্লব পিটপিট করে মেলে সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল দেয়াল ঘড়ির দিকে। ঘড়িতে ছুঁই ছুঁই বারোটা। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে! গ্রীষ্মকাল হলে হয়তো এই মিষ্টি রোদ ও তিক্ত লাগতো এই ধরণীর প্রতিটি মানুষের নিকট।

কিছু মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ছুটে চলতো তাদের প্রয়োজন মিটাতে অর্থ উপার্জন করতে। গ্রামের কৃষকরা কড়া রোদের অত্যাচার হতে মুক্তি পেতে এবং ভালো ফসল ফলাতে চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করতো বর্ষা মৌসুমের। কিছু কিছু মানুষের জন্য এই গ্রীষ্মকাল আনন্দময়ী আবার অনেকের জন্যই ভয়ানক।কিন্তু এখন শীতের মৌসুম। এই দিনে রোদের কড়া তাপ আনন্দ বয়ে আনে প্রতিটি মানুষের নিকট। কথাগুলো কিছুক্ষন ভেবে জারা লাফ দিয়ে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। দ্রুত চলে গেল ওয়াশরুমে।

টিফিন দিয়েছে খানিক পূর্বে। সকালে ওটস খেয়ে এখন অনেক খিদে পেয়েছে। ক্লাস হতে অনেকেই বাসায় লান্চ করতে গিয়েছে আবার অনেকেই ক্লাসে খাচ্ছে। আমি অসহায়ের মতো বসে আছি আর প্রত্যেকের খাওয়া দেখছি। একপর্যায়ে আমি আর ক্লাসে থাকলাম না। ক্লাস থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ালাম।
ঠিক তখনই আমার সমবয়সী একটা ছেলে এসে আমার উদ্দেশ্য বলল,

–হাই, আমি তিতাস। তোমার সাথেই পড়ি। তোমার নাম কি?
তিতাসের কথার প্রত্যুত্তরে আমি বললাম,
–আমি মেহের।
তিতাস নিজের ডান হাত এগিয়ে দিল আমার দিকে। মিষ্টি হেসে দিয়ে বলল,

— আমি তোর বন্ধু হতে আগ্রহী। তোর ভাইয়ের মতো বন্ধু হতে চাই। তুই অনেক শান্ত ভদ্র মেয়ে তাই তোকে আমার ভালো লেগেছে। তোর মতো একটা বুনু চাই আমার। তুই রাজী তো?
তিতাসের বলা প্রতিটি বাক্য আমার হৃদয়ে শীতল হাওয়া বইয়ে নিতে সক্ষম হলো। অন্তর ভরে উঠলো ওর মুখ হতে ‘ভাই’ নামাক পৃথিবীর একমাত্র ভরসা যোগ্য আবাসস্থলের কথা শুনে। এক দেখাতেই কেউ ভাই হতে পারে?
আমার কোন ভাই নেই তাই প্রস্তাবটা আমার নিকট আকাশের চাঁদ হাতে পাবার ন্যায়। আমার চোখের কোণে অশ্রু এসে ঠাই নিল। অশ্রুভরা নয়নে বললাম,

–হ্যাঁ আমারা এখন থেকে বন্ধু। ঠিক আছে ভাইয়া।
তিতাস আমার দিকে চোখ যুগল ছোট্ট ছোট্ট করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
–ভাইয়া বলিস না। নাম ধরে ডাকিস। আর আমাকে কিন্তু তুই সম্বন্ধন করতে হবে । জানিস মেহের আমার না কোন বোন নেই। এখন থেকে তুই আমার বোন।
–ঠিক আছে।

তিতাসের সাথে কথা বলতে বলতে আমি খাওয়ার কথা ভুলেই গেলাম। টিফিনের সময়ের সমাপ্ত ঘটলো। চলে এলাম ভিন্ন ক্লাসে। কারণ তিতাস কমার্সের ছাএ আর আমি সাইন্সের। তাই সকালের ক্লাসগুলো আমারা একসাথে করতে পারব। কিন্তু টিফিনের পর থেকে আলাদা ক্লাস করতে হবে। বিষয়টা ভেবেই আমার মনটা খারাপ হয়ে উঠলো। তিতাসের সাথে অনেক কথা হয়েছে। নিজের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্যও ওকে বলে দিয়েছি। কিন্তু সমুদ্র নামক লোকটার কথা একটিবারের জন্যেও বলি নি। বলি নি আমি বিবাহিত। শুধু বলেছি এখানে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকি।

স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সবকিছুই আমার নিকট অচেনা। আশেপাশের রাস্তার ওলি গলি আমার কাছে ভয়ঙ্কর লাগছে। সব ছাত্র ছাত্রীরা যে যার মতো চলে যাচ্ছে। আমি অপেক্ষা করছি সমুদ্র নামক মানুষটার জন্য। যে মানুষটা আমি দুপুরে খেয়েছি কিনা একটু খোঁজ নিল না সে মানুষটা এখন আমাকে নিতে আসবে এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। তাও নিচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম রাস্তার এক কোণে।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৭

এমন সময় হঠাৎ আমার কর্ণপাত হলো কোন এক অচেনা পুরুষের ভারী কন্ঠ। লোকটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–মেডাম আমার সাথে চলেন।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৯