তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৪

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৪
Lutful Mehijabin (লেখা)

বিছানার উপর আধশোয়া হয়ে শুয়ে রয়েছে মেহের। মুখশ্রীতে ব্যথাতুর ভাবটা স্পষ্ট। সে তার ডাগর ডাগর চোখে পলক হারিয়েছে। তার দৃঢ় দৃষ্টিপাত সামনে অবস্থিত স্বচ্ছ দেয়ালে। পলকহীন নয়নে সে ভেবে চলছে তখনকার ভয়ঙ্কর ঘটনা। চোখ বন্ধ করলে তার কর্ণপাত হচ্ছে ছেলেগুলোর হুমকি দেওয়া বাক্যগুলো। সমুদ্রের যদি কোন অঘটন হয় তাহলে সে কি নিয়ে বাঁচবে। প্রকান্ড সমুদ্রের বুকে অসীম জলের কণাগুলোর ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতম কণার ন্যায় সুখ প্রত্যাশা করেছিল তার ছোট হৃদয় গহীন।

যেদিন হতে সে সমুদ্র নামক পাষণ লোকটির সঙ্গে মায়ার বাঁধনে গেঁথে গিয়েছিল, সেদিন থেকে সে তার হৃদয়মনে হাজারো বাসনা এঁকেছিল সমুদ্রকে ঘিরে। শেওলার ওপর পানির ফোঁটার ন্যায় ক্ষণিকের জীবনে সে সমুদ্রকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। অভিপ্রায় করেছিল সমুদ্র নামাক মানুষটার নামের নিজের পনেরো বছরের জীবনটা উৎসর্গ করে দিবে। কিন্তু সমুদ্রের বুকে যে সহস্রাব্দের নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান। যা মেহেরকে অনুক্ষণ ক্ষত-বিক্ষত করে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সমুদ্রের এতো দিনের আচার আচরণ তার হৃদয় যতটুকু ক্ষত বিক্ষত করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা আজ সমুদ্রের বলা একটা বাক্য করতে সক্ষম হয়েছে। তার বারংবার কর্ণপাত হচ্ছে, সমুদ্র তাকে আর নিজের কাছে আশ্রয় দিতে চাইছে না। চাইছে না তার সঙ্গে মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে থাকতে। সমুদ্র কঠোর ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মেহেরকে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিবে। আকাশের সঙ্গে কথাগুলো বলার মুহূর্তে ঠিকই সে শুনেছে চরম তিক্ত বাক্যগুলো।

কথাটা কর্ণপাত হতেই তার দু চোখ সজল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তার চোখ গহীনে অবস্থিত দুর্বোধ্য রহস্য ধরণীর বুকে বিসর্জন হয়নি! কোথাও যেন আটকে ছিল। সমুদ্র কী তাকে কখনোই গ্রহণ করতে পারবে না? মেহের পারছে না তার হৃদয়ের রক্ত ক্ষণের কথা ব্যক্ত করতে। বারংবার সে ব্যর্থ হচ্ছে, চিৎকার করে কেঁদে বুকটা হাল্কা করতে। প্রতিবারের ন্যায় আজও সে বুকে পাথর চেপে সবটা সহ্য করে যাচ্ছে।

লহমায় সমুদ্র হাতে বৃত্তাকার বাটি নিয়ে ধীর পদে মেহেরের রুমে ধাবিত হলো। সে একপলক মেহেরের ব্যথায় মলিন হওয়ার মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তার কেয়ার লেস হওয়ার কর্মে নিজের ওপর ক্ষোভ ও ধিক্কার জানাল সে। যতোই হোক বর্তমানে মেহের তার অধীনে। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল কাল হতে সে মেহেরের খেয়াল রাখবে। কিঞ্চিৎ সংকোচ, দ্বিধা নিয়ে সে আস্তে করে মেহেরের বিছানার পাশে বসল। শতাধিক ইতস্তত বোধ হচ্ছে তার। সমুদ্রের যে কোনদিন কোন মেয়ের জন্য খাবার তৈরি করে খাওয়াতে আনবে বিষয়টা অকল্পনীয়!

সমুদ্র কিছুটা হলেও মেহেরের নিঃশব্দের কান্না আন্দাজ করতে পেরেছে। কিন্তু বিষয়টা উপেক্ষা করে শান্ত ও নিম্ন সুরে বলে উঠল,
–আর ইউ ওকে পুঁচকি?

সমুদ্রের কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই মেহের নড়েচড়ে বসল। গায়ে অবস্থিত ওড়না মাথার সীমান্ত পর্যন্ত টেনে নিল। গায়ে থাকা উষ্ণ চাদরটার আড়ালে নিজেকে আবৃত করে নিল। নতজানু হয়ে একপলক বাটির দিকে লক্ষ্য করল সে। বাটি ভর্তি সুপ দেখে তার নাক মুখ কুঁচকে এলো। নিম্ন কন্ঠে অস্কুটস্বরে বলল,

–আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। বমি পাচ্ছে। খাব না।
মেহেরের কথা শুনে সমুদ্রের চোখে মুখে বিরক্তের আবির্ভাব ঘটল। কিন্তু নিজেকে ধাতস্থ রেখে বলল,
–কোন কথা নয়। জলদি ফিনিস কর।
মেহের পুরণায় বলে উঠল,

–না খেলে হয় না। আমি খাব না। আপনি খান।
সমুদ্র এবার ফোন হতে দৃষ্টি সরিয়ে তিক্ত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল মেহেরের পানে। তৎক্ষণাৎ তার বুকটা ছ্যাত করে উঠল। এবার একটু কন্ঠে কঠোরতা এনে বলল,
–ফিনিস ইট ফার্স্ট । খাবে নাকি আমি অন্য ব্যবস্থা করব?
মেহের চমকে উঠল। একবার সমুদ্রকে আড়চোখে লক্ষ্য করে বলল,
–খাচ্ছি তো।

সুপের বাটিটা সামনে নিয়ে নাক মুখ কুঁচকে খেতে আরম্ভ করে দিল মেহের। সমুদ্র মেহেরের পরিস্থিতি দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ল। কিছু না বলে খানিকক্ষণ নিরবতা পালন করল সে। অতঃপর মেহেরের খাবার ফিনিস হওয়ার পর, সমুদ্র নিজের ফোনে উপর দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে বলে উঠল,

–তোমার বাবার নাম্বার বল। আমি আজই তোমার বাবাকে কল করতে চাই।
সমুদ্রের অনাদৃত বাক্যগুলো শুনে মেহেরের বুকটা ছ্যাত করে উঠল। খুব শীঘ্রই কী তাকে সমুদ্র নামক আশ্রয় হতে বিদায় নিতে হবে! অশ্রু স্নিগ্ধ নয়নে বুকে চাপা কষ্ট রেখে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
–আমার তো বাবার নাম্বর মুখস্থ নেই। জিজুর কাছে আছে বোধহয়।
সমুদ্র কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচলো। কেমন মেয়ে, নিজের বাবার নাম্বারটাই অজানা, আশ্চর্য! মেহেরের প্রত্যুত্তরে শুনে সমুদ্র নিম্ন সুরে বলল,

–ওকে।
মেহেরের কথার ছোট্ট প্রত্যুত্তর করে, লহমায় সমুদ্র মেহেরের ক্ষত হাতটা আস্তে টান দিয়ে নিজের হাতের উপর রাখল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিখুঁত ভাবে দেখতে লাগল মেহেরের ক্ষত। আজ হতে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মেহেরের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব ভালো আচরণ করবে। এই দু তিন দিন মেহেরকে আগলে রাখবে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব মেহেরকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিবে।

হঠাৎ সমুদ্রের হাতের ছোঁয়া পেয়ে বিব্রত বোধ করছে মেহের। খানিক সংশয় হচ্ছে হৃদ গহীনে। সমুদ্র মেহেরের কুসুম কোমল হাত ধরে মনে মনে ভাবছে, এই হাত বোধহয় তুলো দিয়ে তৈরি। এতো নরম কোন মানুষের হাত হতে পারে তা সমুদ্রের নিকট অজানা! তৎক্ষণাৎ মেহেরের হাতের ক্ষত এর দিকে মনোযোগ নিক্ষেপ করতেই সমুদ্রের অন্তরালে কোন এক অজানা অনুভূতি জেগে উঠল। মুহূর্তে সে দ্রুত পায়ে মেহেরের কক্ষ হতে প্রস্থান করল। গড়গড় করে দ্রুত পদে রুমে এসে শব্দ করে দরজা ধাক্কা মারল। কপালে আলত করে দু আঙুল চেপে ধরে বিরবির করে বলে উঠল,
–সিয়াম তুই আজ একদমই ঠিক করিস নি। আমি তোকে এবার ছাড়াব না।

নিজের অসহায় আঙুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে জারা। আজ তার হৃদ গহীন বড্ড পুলকিত। ইয়াদ তার হাতে খেয়েছে। মূলত তাকে শাস্তি দেবার প্রয়াসে ইয়াদ তাকে খাইয়ে দিতে বলেছিল। বারংবার সেই সুমধুর দৃশ্য কল্পনা করতেই জারার মনটা খুশিতে নেচে উঠছে। তার দৃষ্টি পড়ছে ইয়াদের দেওয়া উপহারে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আপনাআপনি লজ্জায় রঞ্জিত হয়ে উঠছে তার গাল যুগল।

চোখ ভেসে ওঠছে একরাশ লাজুকতা। তার আঙুল যেন দ্বিগুণ সৌন্দর্য ধারণ করেছে। ব্যথা পেয়েছে খানিক কিন্ত বারংবার সে প্রার্থনা করছে, এই দাগ যেন বিদায় না নেয় তার আঙুল হতে। যতোই হোক এই দাগ যে তার সর্বপ্রথম অনুভূতির সাক্ষী। লোকটা যদি তাকে ব্যথা দিয়ে আনন্দ পাই। তাহলে সে ইয়াদের সুখের কামনায় এই রকম হাজার ব্যথা পেতে রাজি।
ইয়াদকে নিয়ে হাজার এইরকম বাসনা দেখতে দেখতে জারা ঘুমের দেশে পারি দিল।

শীতের রাত্রি। পুরো শহরের প্রায়ই সব জন মানব নিজ শরীর উষ্ণ চাদরে ঢেকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। কিন্তু এই গভীর রাত হওয়া সত্ত্বেও ঘুমের চিটে ফোটাও নেই ইয়াদের চোখে মুখে। নিদ্রা যেন তার হাতে ধরা দিতে লজ্জা পাচ্ছে। এই শীতল পরিবেশে ইয়াদ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি বিলাশ করতে ব্যস্ত। তার ধারণা রাতের নৈসগিক পরিবেশ যেমন দৃষ্টিনন্দন, চিত্তাকর্ষক তেমনি উপভােগ্য।

কিন্তু আজ প্রকৃতির ইন্দ্রজাল তাকে মুগ্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তার হৃদয় পড়ে রয়েছে জারা নামক প্রাণীটির উপর। বারংবার সে কেন জারাতে গিয়ে আটকে পড়ে? জারা তো অপরাধী! সে তো তার হৃদয়ে কঠিন ভাবে ব্যথা দিয়েছে। দিয়েছে বললে ভুল হবে এখনো দিচ্ছে। ইয়াদ কোনদিনও জারাকে ক্ষমা করতে পারবে না। ইয়াদ এবার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে জারাকে শাস্তি দেবে। হ্যাঁ প্রচুর শাস্তি দেবে। ভেবেই ইয়াদের বুক ব্যথিত হয়ে উঠল। চোখের কণে পানি এসে আশ্রয় নিল। ইয়াদ সজল চোখে বলতে লাগল,
–আই হেইট ইউ। তোমাকে তো অনেক শাস্তি পেতে হবে মিসেস ইয়াদ।

নিত্যদিনের মতোন আজও মেহের সকালে উঠেছে। সালাত আদায় করে পড়তেও বসেছিল সে। আজ সকালে সে সমুদ্রের মুখ দর্শন পেয়েছে। কোন কথা বলেনি তার সঙ্গে। কিন্তু ব্রেকফাস্ট আজকে সমুদ্র বাইরে থেকে নিয়ে এসেছে। মেহেরকে খাইয়ে সে নিজ দায়িত্বে আজ মেহেরকে স্কুলে নিয়ে এসেছে এবং তারই গাড়িতে করে। আজ মেহেরকে মাস্ক পড়তে বলেনি। সে প্রথম ভেবেছিল মেহেরকে আর স্কুলে নিবে না।

পরিশেষে তার মস্তিষ্ক বলে উঠে, মেহেরকে বাসায় একা রেখে যাওয়াটা বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই সে মেহেরকে স্কুলে নিয়ে এসেছে।

বর্তমানে মেহের তিতাস এবং দিশানি একই বেন্চে বসে খেজুরে আলাপে মত্ত হয়ে রয়েছে। মেহেরকে মাঝখানে বসিয়ে তারা দু জন দু কণে বসে আছে। দুজনের কথাবার্তায় একে অপরের প্রতি অভিযোগ, অভিমান বিদ্যমান। মেহের তাদের ছোট ছোট ঝগড়া দেখে হাসিতে ভেঙে পড়েছে। এই মূহুর্তে মেহের নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। দিশানি খানিকক্ষণ পরপর গাল ফুলিয়ে বলছে,

–দেখ মেহের তিতাসের সাপোর্ট নিবি না। ওর সঙ্গে আমি কথা বলব না।
মেহের দিশেহারা মতোন বসে তাদের বক্তব্য শুনছে। লহমায় ক্লাসে সমুদ্র প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই চুপ হয়ে গেল। দিশানি মেহেরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

–মেহের স্যারকে দেখছিস উনি অনেক রাগী। জানিস আমাদের ক্লাসের আদিবা আছে না। স্যারকে অনেক পছন্দ করে। স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নানান রূপে স্যারকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে ।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৩

দিশানির কথা কর্ণপাত হতেই মেহেরের বুকের মাঝে ব্যথা করে উঠল। দিশানির কথাই বোকার ন্যায় হেসে উঠল।
সমুদ্র ক্লাসে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম তার দৃষ্টি পড়ল মেহেরের উপর। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর গিরগির করে উঠল। আকস্মিক দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের স্বরে চিৎকার করে বলে উঠল,
–মেহের, তিতাস, দিশানি স্টান্ড আপ! পুরো ক্লাস তোমারা তিনজন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৫