তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৫

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৫
Lutful Mehijabin (লেখা)

সমুদ্র ক্লাসে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম তার দৃষ্টি পড়ল মেহেরের উপর। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর রাগে গিরগির করে উঠল। আকস্মিক দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের স্বরে চিৎকার করে বলে উঠল,
–মেহের, তিতাস, দিশানি স্টান্ড আপ! পুরো ক্লাস তোমরা তিনজন কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।

মেহের, তিতাস, দিশানি সমুদ্রের কথামতোন দাঁড়িয়ে পড়ল। সমুদ্রের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, ভেবেই মেহেরের গাল দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করে উঠল। কেন সমুদ্র তাকে কান ধরে দাঁড়াতে বলল তা মেহেরের ছোট মস্তিষ্কে বোধগম্য হলো না। মেহের বিব্রত মাখা মুখশ্রী নিয়ে নতজানু হয়ে রইল। সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি দেবার মতো সাহস তার হৃদয়মনে হয়ে উঠল না। তৎক্ষণাৎ মেহেরের কর্ণপাত হলো সমুদ্রের আওয়াজ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–এইটা যে ক্লাস রুম তা কী তোমরা ভুলে গিয়েছ! এখানে কী তোমরা পড়তে এসেছ নাকি আড্ডা দিতে এসেছ, স্টুপিড্স?
সমুদ্র বলা কথাগুলো কর্ণপাত হতেই মেহেরের ভ্রূ যুগল কুঁচকে এলো। সে তো কথা বলেনি। তাহলে কেন বিনা অপরাধে সমুদ্র তাকে শাস্তি দিচ্ছে! দিশানি, মেহের চুপচাপ জড়তা নিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কোন কথা মুখ দিয়ে নির্গত করে নি তারা দুজন। শুধু মাত্র তিতাস সমুদ্রকে ‘সরি’ বলেছে। পরিশেষে সমুদ্র তাদেরকে শাস্তিরত অবস্থায় রেখে ক্লাস নিতে আরম্ভ করল।

সমুদ্রের ক্লাস সমাপ্ত হয়েছে খানিক পূর্বে। পুরো ক্লাস সে গম্ভীর মুখ করে ছিল। মেহেরকে দেখে এমন ভাব করেছিল যে সে মেহেরকে চিনেই না। বিষয়টা মেহেরের মনকে বিষণ্ণ করে তুলেছে। বর্তমানে শাস্তি হতে মুক্তি পেয়ে চুপচাপ বসে আছে সে। ক্লান্তি ফুটে উঠেছে দিশানির মুখশ্রীতে। কিন্তু তিতাসের কোন পরিবর্তন হয় নি। সে বইয়ের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে নিশ্চিন্তে বসে আছে। তাদের মধ্যে পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে দিশানি ক্লান্তি মাখা সুরে বলে উঠল,

–মেহের রে আমার পা আজকে শেষ। খারাপ স্যার কোথাকার। দেখিস এই স্যারের কপালে বউ যুটবে না।
দিশানির বিরক্ত মাখা কথা কর্ণপাত হতে মেহেরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। খানিকের জন্য পুলকিত হয়ে উঠল তার অন্তরাল। মুচকি হেসে উঠল সে। পুনরায় দিশানি হাল্কা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–না না বউ কেন যুটবে না। সরি ভুল হয়ে গেছে, দোয়া করি স্যারের কপালে যেন একটা শাতচুন্নি বউ যুটে। যে একটা একটা করে স্যারের চুল ছিঁড়বে। কবুল কবুল তিনবার কুবল। আর হ্যাঁ আল্লাহ গো স্যারের বউ যেন কালো কিচকিচে হয়। একটা কুৎসিত বউ যেন তার কপালে যুটে।
দিশানির সম্পূর্ণ কথা শুনে তিতাস অট্টসরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলতে লাগল,

–ওই স্যারের বউ তোর কী করছে? স্যারের বউকে নিয়ে তোর এত মাথাব্যাথা কেন, হুম? স্যারের বউকে যে এতক্ষণ আজেবাজে কথা বললি। ঠিক এমন করে স্যারের বউয়ের সামনে বলতে পারবি তো!
দিশানি এবং তিতাসের কথোপকথন শুনে মেহের স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। তার ঠোঁট যুগল আপনা আপনি কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে উঠল। একরাশ বিব্রতা, দ্বিধা, সংশয়ের উদ্ভাবন ঘটল তার হৃদয় গহীনে। বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। ওয়াশরুমে যাওয়া উদ্দেশ্য বেন্চ হতে বের হওয়ার জন্য ধাবিত হলো। মুহূর্তে আচমকা দিশানি মেহেরের হাত খপ্প ধরে বলে উঠল,

–মেহের তোর হাতে বেন্ডেজ করা কেন? কি হয়েছে তোর হাতে?
মেহের তৎক্ষণাৎ হাতের দিকে একপলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, দিশানির মুখশ্রীতে চোখ যুগল আবদ্ধ করে নিম্ন সুরে বলে উঠল,
–কিছু হয়। সামান্য ছুরির আঘাতে হাত কেটে গেছে।

দিশানি ভ্রূ যুগল কুঁচকে মেহেরের দিকে তাকাল। মেহেরের কথা তিতাসের কর্ণপাত হতেই, সে শক্ত দৃষ্টিপাত নিবন্ধ করল মেহেরের চোখ যুগলে। স্বল্প রাগী কন্ঠস্বরে বলে উঠল,
–এই মেয়ে তুই নিজের খেয়াল রাখতে পারিস না? আশ্চর্য ! কী এমন কর্ম করতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিস?

তিতাসের শাসন মাখা বাক্যগুলো শুনে মেহেরের নয়নে অশ্রু এসে আশ্রয় নিল। তার হৃদয়ে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি বইয়ে গেল। কোনদিনও এভাবে এতোটা আদর, অধিকার কেউ তার উপর দেখাই নি। একেই বুঝি ভাইয়ের আদায় মাখা তিক্ত শাসন বলে! এই পরিস্থিতিতে মেহের নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি মনে করছে। কে বলছে তার ভাই নেই। তিতাসের ন্যায় ভাই পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। সে তিতাসের কাছ হতে হাত কাটার আসল ঘটনা এড়িয়ে গেল। বলল না সত্যি কথা। কারণ বললে তো তারা জেনে যেত সমুদ্র তার স্বামী।

ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য মেহের ক্লাস রুম হতে প্রস্থান করার উদ্দেশ্যে ধীর পদে ধাবিত হলো। দিশানি আর তিতাস মেহেরকে রেখে কিছুক্ষণ পূর্বে ক্লাস থেকে বের হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার তাই হাফ ক্লাস। তাই মেহের এখন ওয়াশরুম যাবে তারপর সমুদ্রের অপেক্ষায় ক্লাসের ভেতর বসে থাকবে। মুহূর্তে দিশানির উল্টো পাল্টে বাক্যগুলো তার মনে হলো। তখন খানিকটা বিরক্ত হলেও এখন কথাগুলো মনে পড়তেই প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে তার। মুচকি মুচকি হেসে নতজানু হয়ে ধীর পায়ে হাটতে লাগল সে। হঠাৎ হাতে হাল্কা টান অনুভব করতেই তার পা যুগল থেমে গেল। নত দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত ফেলল সে। আদিবা নামের মেয়েটা মেহেরের হাত ধরে বলে উঠল,

–এই মেয়ে আমার কলমটা উঠিয়ে দেও।
মেহের উন্মুক্ত নয়নে পর্যবেক্ষণ করল আদিবাকে। পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্লাস রুম হতে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহের কিছুটা বিরক্ত হলেও আদিবার কথামতো কলমটা উঠিয়ে দিল। অতঃপর আদিবা সহ তার কয়েকজন ক্লাসমেট অট্টসরে হেসে উঠল। মেয়েটাকে দিয়ে তাদের হুকুম পালন করাতে পেরে তারা খুব খুশি। এককথাই মেহেরকে উপেক্ষা করার জন্যই তারা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। সবকিছু বুঝেও অবুঝের ন্যায় মেহের মুচকি হেসে, বই ভর্তি ব্যাগ হাতে নিয়ে ক্লাসরুম হতে বেরিয়ে এলো।

পড়ন্ত বিকেল। চারপাশে সূর্যের লালভ আলোক‌চ্ছটা কিরণ দিচ্ছে। পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। আকাশ পানে দৃষ্টি মেললেই, আল্লাহ সৃষ্টি প্রকৃতির সিন্ধতায় মন গহীন তৃপ্ত হয়ে উঠবে। প্রকৃতির যেন জাঁমজমক রুপে সেঁজে উঠেছে। আহা! কতোই না সুন্দর এই প্রকৃতির সুমধুর সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যেল প্রেমে পড়েতে যে কোন মানুষ বাধ্য। গাড়ির জানালা দিয়ে দৃষ্টি ভেদ করে স্বচ্ছ আকাশের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে মেহের।

কিন্তু আজ ভিন্ন দিনগুলোর মতো প্রকৃতির প্রতি প্রেম সৃষ্টি হচ্ছে না। এই সুন্দর প্রকৃতিকেও তার বিরক্ত লাগছে। সবকিছু তার নিকট বিষাদময় লাগছে। তার সামনে সমুদ্র বসে মনোযোগ সহকারে গাড়ি ড্রাইভ করছে। মেজাজ তার অতিরিক্ত তিক্ত। মেহেরের উপর প্রচন্ড খেপে আছে সে। সমুদ্রের ক্রোধের কারণ মেহেরের নিকট অজানা। কোন এক কারণে সমুদ্র দাঁত দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে ড্রাইভ করছে।

এতে অত্যধিক বিরক্তি আষ্টেপৃষ্টে ধরে রয়েছে মেহেরের অন্তরালে। স্কুল ছুটির পর একটিবারের জন্যই মেহের সমুদ্রের আওয়াজ শুনতে পাইনি। মূহুর্তেই এপার্টমেন্টের সামনে এসে গাড়ি থামাল সমুদ্র। মেহেরকে না নিয়েই সে গটগট করে লিফ্টে উঠে পড়ল। আজ সত্যিই সমুদ্রের আচরণ অস্বাভাবিক লাগলে মেহেরের নিকট। সমুদ্রের খিটখিটে মেজাজের ধমক আজকে তার কপালে যুটেনি। সমুদ্রের এমন অদ্ভুত ব্যবহার তাকে প্রচন্ড রূপে ব্যথিত করে তুলছে। সমুদ্রে কেন বুঝে না, ছোট মেয়েটির হৃদয় যে মেঘের ন্যায় বিষাদ জমে অগুনিত।

বাসায় এসেই মেহের ওয়াশরুমে ঢুকেছে। প্রায় আধ ঘণ্টা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে সে। তিনদিন হলো তার শরীরের জলের ছিটে ফোটা ও পড়ে না। মাত্র শাওয়ার নিয়ে ফ্যান হাল্কা স্ফিডে অন করে টাওয়ায় দিয়ে চুল মুছতে আরম্ভ করল মেহের। এই শীতেও তার উষ্ণ পোশাক পড়ে নি সে। শুধু মাত্র হোয়াইট রংয়ের থ্রি পিস পড়ে রয়েছে। শীতল বাতাসে তার অবাধ্য আগলা চুল গুলো ইচ্ছেমতো উড়ছে। শীতল পরিবেশ হওয়ার ফলে খানিক পর পর কেঁপে উঠছে সে।

মেহেরের উপর শতাধিক ক্রোধ নিয়ে, মেহেরের রুমে যাওয়া জন্য দ্রুত পায়ে হেঁটে চলছে সমুদ্র। অত্যধিক রাগ হচ্ছে তার। মেয়েটার সাহস হয় কী করে, ছেলেদের গায়ে পড়ে ঢলাঢলি করার? বিষয়টা না চাইতেই সমুদ্রের মস্তিষ্কে চেপে বসেছে। সে চাইতেও নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ। অবশেষে ফ্রেশ হয়ে এসেই মেহেরকে ইচ্ছা মতো বকা দেওয়া প্রস্তুতি নিয়েছে সে।

তৎক্ষণাৎ মেহের রুমে এসে উপস্থিত হলো সমুদ্র। অগ্নি দৃষ্টি তার। ক্রোধের বশে তার নয়ন যুগল হতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ইতিমধ্যেই রাগে মোবাইল ফোন সজোরে ফেলে দিয়েছে সে। এতো রাগ হয়তো তার এই জীবনে হয়ছে কি সন্দেহ ! রুমে ঢুকেই সর্বপ্রথম সমুদ্রের দৃষ্টিপাত পড়ল মেহেরের উপর। সাদা ড্রেস পরিহিত অবস্থায় মেয়েটা পিছন ফিরে চুল আচড়াতে ব্যস্ত।

এই প্রথম মেহেরকে মাথায় ঘোমটা দেওয়া ব্যতীত অবস্থায় দেখল সমুদ্র। মেয়েটা তাকে দেখলেই অতি দ্রুত ওড়না টেনে ঘোমটা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর আগেও একবার মেহেরকে আগলা চুলে দেখেছিল সে। কিন্তু সেদিন ভালো মতো লক্ষ্য করে নি। মেহের যে এতো পুঁচকি হওয়ার সত্বেও অতিরিক্ত বড় চুল বিদ্যমান তা সমুদ্রের নিকট অত্যধিক বিষ্ময়কর লাগছে!

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৪

সমুদ্র অগ্নি দৃষ্টিতে খানিকটা সময় মনোযোগ সহকারে মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আকস্মিক সমুদ্রের অচন্চল চোখ যুলগ স্থির হয়ে পড়ল মেহেরের ওড়নার ফাঁকের অনাবৃত শুভ্র স্বচ্ছ গলার উপর। মেয়েটা এলোমেলো করে ওড়না পড়ে রয়েছে! মুহূর্তেই সমুদ্রের বুকের ভেতর খানিকটা ধ্বক করে উঠল,,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৬