তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৭

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৭
Lutful Mehijabin (লেখা)

ঘরির কাটাতে রাত দুটো ছুঁইছুঁই। উষ্ণ চাদর গায়ে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেহের। মধ্যরাত পর্যন্ত সে জেগেছিল সমুদ্রের উপেক্ষয়। সমুদ্র বলেছিল সে রাতে ফিরবে কিন্তু সে ফিরেনি। অবশেষে কিছুক্ষণ পূর্বে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। হঠাৎ ঘুমের মাঝে অস্বস্তি অনুভব হলো তার। স্বল্প নড়েচড়ে উঠল সে। গলায় কারো উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠল সে। তার অনুভব হলো কেউ তাকে গভীর দৃষ্টিপাতে পর্যবেক্ষণ করছে।

কারো চাহনি এতোটাই গভীর যে মেহের ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা সত্ত্বেও অনুভব করতে পারছে। হঠাৎ অজ্ঞ ব্যক্তিটা পুনরায় মেহেরের গলার ক্ষত স্থানে হাল্কা করে ছুঁয়ে দিল। মেহের লাগাতার চেষ্টা করল চোখ উন্মুক্ত করে লোকটাকে দেখার জন্য। কিন্তু ঘুম তাকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরল। একপর্যায়ে সুযোগ বুঝে মেহের লোকটার হাত ধরে ধাক্কা দিল। অজানা ব্যক্তিটা তাল সামলে না পেরে ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অবশেষে বিকট আওয়াজ কর্ণপাত হতেই মেহেরের চোখ যুগল আপনা আপনি উন্মুক্ত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে বসল। আবছা অন্ধকারে ব্যক্তিটাকে দেখার প্রয়াস চালাল। তাড়াতাড়ি উঠে রুমে লাইট জ্বালিয়ে দেখল রুম একদম খালি। কোন জন মানবের সন্ধান মিলল না। কেউ নেই। কেউ বলবে এখানে একটু আগে কেউ এসেছিল! এতো শীতল পরিবেশে মেহের তবুও মেহের ঘেমে একাকার। ভয়ে মেহেরের শরীর থরথর করে কাঁপছে।

এটা কী স্বপ্ন ছিল নাকি হ্যালুয়েশন? কোনটি নয় বরং বাস্তব। কেউ তাকে ছুঁয়ে ছিল। মেহের আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। সে তো সব দরজা জানালা আটকে ঘুমিয়েছিল। তাহলে! সমুদ্র তো এখনো বাসায় ফিরে নি? ব্যক্তিটা কোথায় গেল? তারা ফ্রোথ ফ্লোরে থাকে। এতো উঁচু এপার্টমেন্ট নিশ্চয়ই কোন জ্ঞানী ব্যক্তি লাফ দিয়ে পালাবার মতো ভুল কর্ম করবে না!

মেহের ভালো করে খেয়াল করল তার রুমের সবকয়টা জানালা দরজা বন্ধ। তাহলে কী কোন ভৌতিক ঘটনা! কোন অশরীরী আত্না কি তার রুমে প্রবেশ করেছিল। হাজারো আজেবাজে চিন্তা মেহেরের ছোট্ট মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে লাগল। খানিকটা মূহুর্ত্য বাদেই তার কর্ণপাত হতে লাগল ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি। মেহের উষ্ণ চাদর গায়ে থেকে ফেলে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্য ওয়াশরুমে দিকে ধাবিত হলো। তার এই অস্থির হৃদয় শীতল করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সালাত। কনকনে শীতল ঠান্ডা পানি দিয়ে ওযু করে সে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ মেহের রুম থেকে বের হয়নি। রাতের ঘটনা এমন ভাবে তার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে যে সে চাইলেও মুক্তি পেতে পারছে না। সমুদ্র হয়তো এখনো আসেনি। হয়তো আসতেও পারে! যদিও রাতে ফিরেও থাকে নিশ্চিত তার খোঁজ নিতে আসবে না। রুমের সবগুলো লাইট অন করে মেহের চুপচাপ বসে আছে। সমুদ্রের অপেক্ষায় রাত্রি বেলা গলা দিয়ে খাবার নামে নি।

ফলে এখন প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু রান্নাঘরে যাবার মতোন সাহস তার মন গহীনে জুটছে না। সে নিরুপায় হয়ে বিছানার উপর আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তৎক্ষণাৎ তার কর্ণপাত হলে কেউ তার রুমের দরজা ধাক্কাছে। পূর্বে ন্যায় তার হৃদয় ভয়ে শুকিয়ে আসছে। বারংবার তার মনে হচ্ছে রাত্রি বেলার সেই অচেনা ব্যক্তি আবার এসেছে! আওয়াজ যেন আর ও বাড়তে লাগল। একপর্যায়ে মেহের একরাশ সাহস জুটিয়ে দরজার দিকে ধাবিত হলো। অবশেষে খুলে দিল দরজা। চোখের সামনে আকাশের হাসি মাখা মুখশ্রী দেখে হৃদয় স্পন্দন ধ্বক করে উঠলো। সে মুহূর্তের তার মনে সংশয় হানা দিল। তাহলে কী রাতের সেই ব্যক্তি কী আকাশ?

মেহেরের আতঙ্কিত মুখশ্রী লক্ষ্য করে আকাশের ভ্রূ যুগল কুঁচকে এলো। মুখশ্রীতে সচেতন ভাবটা স্পষ্ট করে বলল,
–কী হয়েছে মেহের? তুমি ঠিক আছো তো?
মেহের আকাশের কথার প্রত্যুত্তরের নিশ্চুপ হয়ে রইল। আকাশ পুনরায় বলে উঠল,
–কোন কিছু দেখে ভয় পেয়েছে?
আকাশের বলা বাক্যটা শুনে মেহেরের সন্দেহ আর দৃঢ় হয়ে উঠল। নিজেকে ধাতস্ত রেখে নিম্ন কন্ঠে বলে উঠল,
–না।

–ওহ সরি। আমিই হয়তো ভুল বুঝেছি। চলো আমার সঙ্গে।
মেহের খানিকটা জড়তা মাখা কন্ঠস্বরের বলল,
–কোথায়?
–ড্রইং রুমে ।
বলেই আকাশ দরজার সামনে থেকে প্রস্থান করল। মেহের পরাপর দুটো গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করে ধীর পায়ে ড্রইং রুমে ধাবিত হলো।

ড্রইং রুমে উপস্থিত হতেই মেহের চোখ যুগল তৃপ্ত হয়ে উঠল। পুলকিত হয়ে উঠল তার হৃদয় গহীন। কারণ তার সামনে আয়েশ ভঙ্গিতে সোফার উপর বসে রয়েছে সমুদ্র । তার নিকটবর্তী দাঁড়িয়ে আছে একজন অর্ধ বয়স্ক মহিলা। মেহের মহিলার দিকে একপলক তাকিয়ে ফির সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করল। ইশ! লোকটা মুখশ্রী পণ্ডর ভাব স্পষ্ট। চুল গুলো এলোমেলো অবস্থায় সীমান্ত পর্যন্ত যায়গা করে নিয়েছে।

আকস্মিক মেহেরের দৃষ্টি পড়ল সমুদ্রের হাতের উপর। ভালো ভাবে খেয়াল করে দেখল, সাদা কাপড়ে বেন্ডিজ করা। বেন্ডিজের উপরের ছোঁপ ছোঁপ লাল রক্তের দাগ। লাল রঙের রক্তের বেন্ডিজের সাদা কাপড়ের নাজেহাল অবস্থা। সমুদ্রের হাতের দিকে তাকিয়ে মেহের চোখ যুগল সজল হয়ে এলো। কতোই না ব্যথা পেয়েছে লোকটা। মুখশ্রীতে ব্যথাতুর ভাবটা স্পষ্ট! সমুদ্র ক্ষত দেখে মেহেরের নিকট অনুভব হচ্ছে, ব্যথা যেন সমুদ্র নয় বরং সে পেয়েছে। মিনিট পাঁচেক নিরবতা পালন করল সবাই। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে সমুদ্রের পাশে থাকা মহিলাটা বলে উঠল,

–স্যার, এডা ক্যারা?
সমুদ্র দৃঢ় দৃষ্টিপাত মেহের উপর নিক্ষেপ করল। একপলক আকাশের মুখশ্রীতে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
–কেউ না। আমার কেউ হয় না।
সমুদ্রের বলা প্রত্যুত্তরের মেহেরের বুক কেঁপে উঠল। আচমকা ধারাল তীরের ন্যায় তার হৃদয়ের বিঁধল। বাজে ভাবে ক্ষত বিক্ষিত করে তুলল তার অন্তরাল! কান্না এসে দলা পাকিয়ে তার গলায় আটকে রইলো। অথচ অশ্রু মাখা নয়নে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে অস্কুটস্বরে বলে উঠল,

–আপনার হাতে কী হয়েছে।
সমুদ্র মেহেরের কথার প্রত্যুত্তরে গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
–কিছুই হয় নি । কিছু যদি হয়েও থাকে তাহলে তোমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করি না।
মেহের নিশ্চুপ করে সমুদ্রের অপমান সহ্য করে গেল। মুখ দিয়ে টু শব্দ ও নির্গত করল না । সমুদ্র কথা শুনে আকাশ ধরণী কাঁপিয়ে অট্টসরে হেসে উঠল। কপাল কুঁচকে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,

–ভালোই তো পারিস সমুদ্র!
সমুদ্রের আকাশের কথার কোন গুরুত্ব দিল না। অতঃপর মেহেরকে উদ্দেশ্য করে ঠোঁট যুগল সংকুচিত করে মৃদু স্বরে বলে উঠল,
–এনি হলো বিউটি খালা। আজকে থেকে বাসার সব কাজ উনি করবেন। তোমাকে আর কিছু করতে হবে।

লহমায় মেহের বিউটি খালার দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। মহিলার চাহনি তার দিকে নিবন্ধ ছিল। আকস্মিক বিউটি খালার ভয়ঙ্কর চাহনি দেখে মেহের ভয় পেয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল রাতের অস্বাভাবিক ঘটনা। মেহের তো সমুদ্রকে বলতেই পারল না রাতের কথা । সে তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সমুদ্রকে জানাবে রাতের ঘটনা। মন খুলে ব্যক্ত করবে তার ভয়ঙ্কর অনুভূতির কথা। সমুদ্রকে প্রাণ খুলে বলতে চেয়েছিল তার ভয়ঙ্কর বিক্ষিপ্ত মনে কথা। কিন্তু সমুদ্র কেন বোঝে না, মেঘের ন্যায় তার অন্তরে বিষাদ জমে অগুনিত। লহমায় মেহেরের কর্ণপাত হলো বিউটি খালার কন্ঠস্বর,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৬

–স্যার কী কী করতে হবে বলেন? আমার অন্য বাড়িতে ও কাজ আছে।
বিউটি খালার ভয়ঙ্কর কর্কশ আওয়াজ! কিছুটা ভারী পুরুষ নালী কন্ঠের ন্যায়। মেহের মনে হলো বিউটি খালা কোন মহিলা নন বরং পুরুষ মানুষ। সে হাল্কা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল। নতজানু দৃষ্টি সরিয়ে একপলক খালার দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি বেশিক্ষণ খালার মুখশ্রীতে আবদ্ধ থাকতে পারল না। খানিকটা ভয় পেয়ে সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৮