তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৮

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৮
Lutful Mehijabin (লেখা)

ড্রইং রুমে সোফার উপর বসে রয়েছে ইয়াদ। তার পাশে এক কানে ইয়ার ফোন গুঁজে বসে রয়েছে রাফু। তার দৃষ্টি মোবাইল ফোনে আবদ্ধ। মুখশ্রীতে একরাশ উজ্জ্বলতা বিদ্যমান। সে মনোযোগ সহকারে ফোন স্কোল করছে আর খানিকক্ষণ পর পর ধরণী কাঁপিয়ে অট্টসরে হেসে উঠছে। রাফুর এমন উদ্ভট অবস্থা দেখে স্বল্প বিরক্ত হচ্ছে ইয়াদ। পরিশেষে অসীম বিরক্তি নিয়ে ড্রইং রুম প্রস্থান করতে বাধ্য হলো ইয়াদ। চোয়াল শক্ত করে দ্রুত পদে নিজের রুমের দিকে ধাবিত হলো।

অন্যদিকে রান্নাঘরে প্রায় পাঁচেক খাবারের আইটেম রান্না করতে ব্যস্ত জারা। তার নিকটবর্তী হুইলচেয়ারে বসে রয়েছেন ইসরাত বেগম। তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে আনন্দের জোয়ার। মুচকি মুচকি হেসে নিজের ছেলের বউয়ের কাজ কর্ম পর্যবেক্ষণ করছেন সে। জারা খানিক পর পর ইসরাত বেগমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নানান ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। আর ইসরাত বেগম মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে ইশারাতে জারার কথার প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ জারার অন্তরাল বেশ পুলকিত।সকাল থেকে ইয়াদের ব্যবহার নিত্যদিনের চেয়ে একদম ভিন্ন রকম লাগছে তার নিকট। ইয়াদ তার সঙ্গে মার্জিত ব্যবহার করছে। ইয়াদের কন্ঠ স্বরে প্রতিদিনের ন্যায় কঠোরতা, তিক্ততার দেখা মেলেনি। নরম গলায় তার সঙ্গে কথা কথা বলেছে। ইয়াদের নিকট হতে এমন ব্যবহার সবসময়ই সে কাম্য করতো। আজ এমন ব্যবহার পেয়ে বড্ড আনন্দে জারার হৃদয় গহীন বারংবার নেচে উঠছে। মুহূর্তে হাজারো স্বপ্ন সাজাতে আরম্ভ করেছে তার অন্তরাল। লোকটা বুঝি তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছ! ইয়াদকে নিয়ে চিন্তা ভাবনায় মত্ত থাকার ফলে কয়েক বার হাতে ছ্যাক ও খেয়েছে সে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় একটু ব্যথা অনুভব হয়নি তার শরীরে।

লহমায় ইয়াদের আওয়াজ কর্ণপাত হতেই পুনরায় হাতে গরম খুনতির ছ্যাকা খেলা সে। সঙ্গে সঙ্গে ইসরাত বেগম হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। মুখ দিয়ে অস্কুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন সে। জারা হাতের ব্যথা উপেক্ষা করে দ্রুত ইসরাত বেগমের নিকটবর্তী এলো। শাশুড়ি মায়ের দু হাতের বাহু আগলে ধরে বলে উঠল,
–আম্মু ঠিক আছ তো তুমি।
তৎক্ষণাৎ ইসরাত বেগম খানিকটা শান্ত হয়ে হুইলচেয়ারে বসে পড়লেন। ভর্ৎসনা মাখা দৃষ্টিতে জারার মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলেন।

জারার তার শাশুড়ি মায়ের ক্রোধের কারণ বুঝতে পেরে নিম্ন কন্ঠে বলে উঠল,
–সরি আম্মু আমি আর অন্যমনস্ক থাকব না। আর দেখ আম্মু আমি তো ব্যথা পাইনি।

ইসরাত বেগম জারা হাত নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। পুনরায় ইয়াদের আওয়াজ ভেসে উঠল তাদের কর্ণপাতে। মুহূর্তেই জারার মুখশ্রী লজ্জায় লালাভ বর্ণ ধারণ করে উঠল। তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ইসরাত বেগমের রাগ হাওয়াতে ভেসে গেল। জারার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুচকি হেসে উঠলেন সে। তৎক্ষণাৎ চোখের ইশারাতে জারাকে ইয়াদের কাছে যাবার অনুমতি দিলেন। শাশুড়ি মায়ের অনুমতি পেয়ে জারা মুখশ্রীতে লজ্জা আবির্ভাব গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠল। অনুমতি পেয়ে অবশেষে জারা ধীর পায়ে রান্নাঘর প্রস্থান করল। নতজানু হয়ে খানিকটা জড়তা নিয়ে ইয়াদের রুমের সামনে উপস্থিত হলো। ঠোঁট যুগল জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে নিম্ন স্বরে বলে উঠল,

–আমাকে ডেকেছেন।
জারার কন্ঠস্বর পেয়ে কোলের উপর অবস্থিত লেপটপ হতে দৃষ্টি সরিয়ে একপলক জারার দিকে তাকাল ইয়াদ। কন্ঠস্বরে গম্ভীরতা রেখে বলে উঠল,
–কাম হেয়ার।

ইয়াদের কন্ঠ স্বর কর্ণপাত হতেই জারার শান্ত হৃদয়ে অস্থিরতার আবির্ভাব ঘটল। অস্বস্তি, অশান্ততা নিয়ে ইয়াদের নিকটবর্তী হাজির হলো সে। নতজানু হয়ে ভদ্রতার সহিত ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইলো।
লেপটপের দিকে দৃষ্টিপাত রেখে ইয়াদ শান্ত স্বরে বলে উঠল,
–রেডি হও কুইক। আর রান্না করতে হবে না। আজ নাহয় রেস্টুরেন্ট থেকে লান্চের জন্য খাবার নিয়ে আসব। তুমি যাও গিয়ে শাড়ি চেন্জ করে এসো।

ইয়াদের বলা বাক্যগুলো শুনে জারার মন গহীন আনন্দিত হয়ে উঠল। ফ্লোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইয়াদের মুখশ্রী তাকাল। ইশ! কতোই মায়াবী মুখশ্রী। লোকটা কতোই না সুন্দর দেখতে। জারা খানিকক্ষণ স্তম্ভিত দৃষ্টিতে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নির্লজ্জেল মতো ইয়াদের চোখ যুগলে দিকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ধূসর রঙের মনি! ছেলেদের যে ধূসর রঙের মনিতেও এতোটা সুন্দর লাগে তা জারার নিকট অজানা ছিল। মূহুর্তেই ইয়াদ জারাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,

–আমার দিকে তাকিয়ে না দেখে যাও দ্রুত গিয়ে রেডি হও। আমাকে দেখার অনেক সময় পাবে। কিন্তু এখন শপিং এ লেট করে গেলে দুপুরের খাবার খেতে সময় পাবে না। সো গো।
জারার চমকে উঠল। নিমিষেই লজ্জায় তার গাল যুগল রক্তিম বর্ণ করে উঠল। লজ্জা রাঙা মুখশ্রীতে দ্রুত পদে সে ইয়াদের রুম ত্যাগ করল। লহমায় তার হৃদয় স্পন্দন তীব্র হতে তীব্রতরে ছুটতে আরম্ভ করে দিলো।

কী আওয়াজ রে বাবা! লোকটা এতো সুন্দর কন্ঠস্বরে যে কথা বলতে পারে তা জারার নিকট বিষ্মকর। বর্তমানে জারার অবুঝ হৃদয়মন ইয়াদকে ঘিরে হাজার স্বপ্ন এঁকে বসেছে। সে ভাবছে, তাহলে কী অপেক্ষা প্রহরের সমাপ্ত হতে চলেছে! খুব শীঘ্রই তার স্বপ্ন কী পূরণ হবে! তার আর্মি পুরুষকে নিয়ে সে নতুন সূচনা নিয়ে বাঁচতে আরম্ভ করবে? আর্মি পুরুষ আর তার স্বপ্নে এসে হাজির না হয়ে বাস্তবে তার সঙ্গে একত্রে বসে শত শত গল্পের বই পড়ে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা অতিবাহিত করবে!

ইশ কতোই সুন্দর না হবে তাদের ভবিষ্যত! জারার এই ধরনের চিন্তা ভাবনাকেই বোধহয় বলা হয় মেয়েদের আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। তারা এতোটাই বোকা যে নিজ অদৃষ্টের কথা চিন্তা না করেই তার স্বপ্ন পুরুষে ঘিরে হাজারো ঘন্টার পর অতিবাহিত করে। প্রতিটি মেয়ের ন্যায় জারাও নিজের আর্মি পুরুষকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে ফেলছে। ইয়াদের কাছে থেকে সামান্য ভালো ব্যবহার পেয়েই তার হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠেছে।

এতটুকু ভালোবাসাই তার নিকট যথেষ্ট। এই হচ্ছে মেয়েদের স্বভাব। তারা অল্পতেই খুশি। সামান্য ভালোবাসা পেলেই নিজ ভালোবাসার বন্যা ঘটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু জারা একটি বারের জন্যও চিন্তা করল না, ইয়াদের এমন ব্যবহারের পিছনে নিশ্চয়ই কোন কোন কারণ থাকতে পারে? বিষয়টা জারার মস্তিষ্কে একটি বারের জন্যও আগমন ঘটাল না। সে পজিটিভ ভেবেই আনন্দে ভেসে উঠল।

ঘরির কাটাতে রাত আটটা ছুঁইছুঁই। উষ্ণ চাদর গায়ে জড়িয়ে বাংলা বইয়ে মুখ গুঁজে গল্প পড়ছে মেহের। কিছুতেই গল্পে মনোযোগ দিতে পারছে না সে। বারংবার ব্যর্থ হচ্ছে। কাল রাতের ঘটনা তার মস্তিষ্ক হতে বিদায় নিচ্ছে না। কালকের ভয়ঙ্কর রাত, চিনে জোঁকের ন্যায় মস্তিষ্ক আষ্টেপৃষ্টে জায়গা দখল করে রয়েছে। রাত যত গভীর হচ্ছে ততোই তার হৃদয়মনে অজানা ভয়ের আবির্ভাব ঘটছে।

বারংবার তার মস্তিষ্ক বলে উঠছে, কাল রাতের সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি কী আজও আসবে? কথাটা ভাবতেই মেহেরের সারা শরীর শিউরে উঠছে। ভয় হচ্ছে খুব। আজ বাসায় সমুদ্র আছে। তাই একটু হলেও চিন্তা মুক্ত সে। কিন্তু বারবার তার চোখ যুগলে ভেসে উঠছে বিউটি খালার মুখশ্রী। বারংবার কর্ণপাত হচ্ছে খালার ভয়ঙ্কর কন্ঠস্বর।খালাকে একদমই সুবিধাজনক মনে হয়নি তার নিকট। কেমন করে তার দিকে তাকিয়ে ছিল! খালার ওপর সন্দেহ, সংশয় দ্বিধা কাজ করছে তার অন্তরে। তার মনে হচ্ছে খালা নিশ্চয়ই কোন না কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে।

সব ঘটনা মিলিয়ে ঝড় রাত্রির উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় ঝড় বইছে তার মনে। সে বারংবার কামনা করছে অজ্ঞাত ব্যক্তিটা যেন সমুদ্রের কোন ক্ষতি না করে দেয়। সে যে সমুদ্রের কোন বিপদ সহ্য করতে পারবে না। অজ্ঞাত লোকটা তার হাজারো ক্ষতি করুন না কেন এতে তার কোন আক্ষেপ নেই। সে সার্থহীন মানুষের মতো শুধু প্রার্থনা করছে সমুদ্রের যেন কোন ক্ষতি না হয়। এতেই যেন সে খুশি।

ড্রইং রুমে বসে রয়েছে জারা। তার নিকটবর্তী বসে আছে রাফু। খানিক পূর্বে ইয়াদ ইসরাত বেগমকে শোবার ঘরে দিতে গিয়েছে। আজ বাইরে থেকে তারা লান্চ এবং ডিনার করে এসেছে। জারা আজ ভীষণ খুশি। তার ভাগ্য খুলে গিয়েছে। ইয়াদ তাকে অনেক গুলো ড্রেস কিনে দিয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা তাকে অনেক গুলো গল্পের বই কিনে দিয়েছে ইয়াদ। এই ধরণীর বুকে এর চেয়ে বেশি খুশীর সংবাদ তার নিকট অন্য কিছু হতে পারে না। বই তো নয় ইয়াদ যেন তাকে একরাশ আনন্দ কিনে দিয়েছে। তাই জারা মনে মনে প্লান করছে সে আজ উষ্ণ কম্বল গায়ে জড়িয়ে বসে বসে গল্প পড়েই রাত্রি অতিবাহিত করে দিবে।

ইসরাত বেগমকে রুমে দিয়ে এসে ইয়াদ নিজের রুমে না গিয়ে পুনরায় ড্রইং রমে আগমন করেছে। এসেই সোফার উপর অবস্থিত রাফুর নিকটবর্তী দাঁড়িয়েছে। প্রায় মিনিট পাঁচেক চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে, লহমায় ইয়াদ একপলক জারার দিকে দৃষ্টি ফেলে অতঃপর রাফুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,

–রাফু তোর রুমে যা। ঘুমিয়ে পর।
রাফু ইয়াদের কথা শুনে ফোন হতে দৃষ্টি সরিয়ে ভ্রূ কুঁচকে ইয়াদের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। অতঃপর সন্দেহ দৃষ্টিতে বলে উঠল,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৭

–ব্যাপার কী! আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস কেন?
রাফুর কথার প্রত্যুত্তর ইয়াদ ধমক স্বরে বলে উঠল,
–যাবি, নাকি অন্য ব্যবস্থা করব?

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৯