তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৯

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৯
Lutful Mehijabin (লেখা)

–ব্যাপার কী! আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস কেন?
রাফুর কথার প্রত্যুত্তর ইয়াদ ধমক স্বরে বলে উঠল,
–যাবি, নাকি অন্য ব্যবস্থা করব?

রাফু খানিকটা ভয় পেয়ে সোফা হতে উঠে দাঁড়াল।ইয়াদের ভয়ঙ্কর রাগ সম্পর্কে সে ভালো করেই অবগত। তাই অযথা ঝামেলায় জড়াতে চাইছে না সে। লহমায় চোখ যুগল কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে সন্দেহ দৃষ্টিতে ইয়াদের মুখশ্রীতে তাকাল। কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বিরবির করে বলে উঠল,
–রাগিস কেন? যাচ্ছি তো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বাক্যটা বলেই রাফু ড্রইং রুম হতে প্রস্থান করল। রাফু চলে যেতেই ইয়াদ পরাপর দুটো স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, সোফার উপর অবস্থিত জারার মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। ঠোঁট যুগল স্বল্প সংকুচিত করে বলে উঠল,
— আমার সাথে ছাদে চলো।
ইয়াদের কথা কর্ণপাত হতেই জারা সোফা থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। চোখ জোড়া সংকুচিত করে অনুরোধ স্বরে মিনমিন করে বলে উঠল,

–আমি যাব না। শীত লাগে তো।
জারার প্রত্যুত্তর শুনে ইয়াদের হৃদয় গহীনে বিষণ্ণতার আবির্ভাব ঘটল। অভিমানের ভান্ডার যেন অভিমান নামক অনুভূতিতে অষ্টেপৃষ্টে ভরে উঠলো অন্তরালে। ইয়াদ তার অন্তরের অভিমান গুলো বহিঃপ্রকাশ করল না জারার কাছে। কেন জারা ছাদে যেতে চাইছে না, বিষয়টা সে একটি বারের জন্যও যাচাই করার প্রয়োজন বোধ মনে করল না। তার রাগ হচ্ছে প্রচুর। মুহূর্তে ক্রোধের বসে মাথা তপ্ত হয়ে উঠতে আরম্ভ করল। পরিশেষে মস্তিষ্ক শীতল করার প্রয়াসে প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক চোখ যুগল বন্ধ করে, স্নিগ্ধ হাওয়া নিশ্বাসের সহিত টেনে নিলো ইয়াদ। অতঃপর অসহায় বিপন্নের মতো জারার চোখ যুগলে দৃঢ় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে মৃদু স্বরে বলে উঠল,

–ওকে। তোমাকে যেতে হবে না। আমি রুমে যাচ্ছি। যাও গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।
তৎক্ষণাৎ ইয়াদ দ্রুত পদে পা যুগল সংকুচিত করে ড্রইং রুম প্রস্থান করল। জারা ফ্যালফ্যাল নয়নে ইয়াদের চলমান পদের দিকে তাকিয়ে রইল। দৃষ্টি তার অনুভুতিহীন নির্বাক! এই মুহূর্তে ইয়াদের চাউনি বারংবার তার মস্তিষ্কে ভেসে উঠছে। ক্রমশ ক্ষত বিক্ষিত করে তুলছে তার হৃদয় মনকে। নিজেকে একরাশ ঘৃণা ভরা ধিক্কার জানল সে।

ছিঃ লোকটা কতোটা অদম্য আগ্রহের তাকে সঙ্গে করে ছাদে নিতে চেয়েছিল রাত্রির স্নিগ্ধ প্রকৃতি বিলাস করবে বলে। হয়তো চেয়েছিল এই জোৎস্না ভরা শীতল রাত স্মরণীয় করে রাখতে। কিন্তু সে কি করল। ইয়াদের প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে তাকে কষ্ট দিয়ে মুখের উপর না বলে দিলো? অতঃপর সে অসীম বিরক্তিকর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল নিজের শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা পায়ের দিকে।

বিষণ্ণ মনে মুখ দিয়ে অস্কুটস্বরে বিরবির করে হাজার গালি দিল তার পায়ের পার্শ্ববর্তী এক কোণে অবস্থিত একটা অতিসুক্ষ্ম আলপিনকে। আজ তার নিকট এই ছোট্ট আলপিনটাকে জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হচ্ছে। এই পিনটার জন্যই তাকে ইয়াদের মুখের উপর না বলতে হয়েছে। কারণ অত্যন্ত অসময়ে এই পিনটা তার পায়ের তালুতে বাজে ভাবে ছিদ্র করে ফেলছে।

খানিক পূর্বে যখন ইয়াদ তার মাকে রুমে দিতে গিয়েছিল ঠিক তখন জারা সোফা থেকে উঠার জন্য পা বাড়াতেই আলপিনটা তার বাম পায়ের তালু ক্ষত করে তুলে। তাই সে বাধ্য হয়ে ইয়াদের সঙ্গে ছাদে যেতে রাজি হয় নি। বর্তমানে এই পিনটাকে তার কাছে বিষধর সাপের ন্যায় মারাত্নক মনে হচ্ছে। শুধু মাত্র এই পিনটার জন্যই সে ইয়াদকে না চাইতেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। জারা তপ্ত শ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল।

নিজ রুমে যাবার জন্য পা যুগল হাল্কা ধাবিত করতেই, ক্ষত পায়ে ব্যথা অনুভব করল। পায়ের ব্যথার অসহ্যনীযয় যন্ত্রণা! অবশেষে তার বোধগম্য হলো পিনটা তার পায়ে এতোটাই ক্ষত করছে যে প্রচুর রক্ত ঝরেছে তার রক্ত গ্রন্থি হতে। স্বচ্ছ, শুভ্র রঙের ফ্লোরে রক্তের লাল দাগ পরিষ্কার ভাবে স্পষ্ট। রক্তের দাগ দৃশ্যমান হতেই চিন্তিত হয়ে পড়ল সে। এখন যে তাকে এই দাগ মুছে তারপর রুমে যেতে হবে। নতুবা এই রক্তের দাগ সহজে পরিস্কার করা যাবে কি সন্দেহ। তার এই সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই।

পরে যদি রক্তিম বর্ণ ফ্লোর হতে না উঠে তাহলে তো তার শাশুড়ি আম্মু তাকে হাজরটা বকুনি শুনাবে। মহিলাটা এতোটাই খারাপ যে সামান্য ব্যথা পেলেই ইশারাতে হাজারটা বকুনি শুনাই তাকে। জারা স্মরণ করতে পারছে না যে শেষ কবে তার মাকে তাকে ব্যথা পাবার জন্য বকুনি দিয়েছিল। বিষয়টা ভেবেও জারা এই ঠান্ডার মধ্য ক্ষত পা নিয়ে ফ্লোর মুছতে ব্যর্থ হলো। অসহ্যনীযয় ব্যথার সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে এক পা উঁচু করে ধীরে ধীরে নিজের রুমে উদ্দেশ্য ধাবিত হলো।

দেয়াল ঘরির কাটাতে রাত একটা ছুঁইছুঁই। উষ্ণ চাদর গায়ে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেহের। আজ রাত্রি প্রায় বারোটা পর্যন্ত সে ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছিল। অবশেষে সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে সে। শত চেষ্টা করেও চোখ যুগল উন্মুক্ত রাখতে পারেনি। দরজার জানাল ভালো করে লক করে ঘুমিয়েছে। অজ্ঞাত ব্যক্তির ভয়ে মেহের ঘুমের মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সমুদ্র বাসায় আছে বিষয়টা খানিক স্বস্তির হলেও তার নিকট নিরাপত্তাহীন। কারণটা অজানা নয়। সমুদ্র থাকা আর না থাকা একই কথা। সে তো এ কয়েক দিনে একটি বারের জন্যও অকারণে মেহেরের রুমে উপস্থিত হয়নি। মেহের সমুদ্রের উপর ভরসা রেখে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে ঠিকি। সমুদ্রে যে তাকে আজও এই এত্ত বড়ো ফ্লাটে একা রেখে গিয়েছে তা তার নিকট অজানা।

একটা ভাঙা দোতলা বাড়িতে এক রুমে অবস্থান করছে সমুদ্র। রাত দুটো ছুঁইছুঁই। প্রায় মিনিট পাঁচেক বাদেই ঘরির কাটা রাত দুটোটে পা রাখবে। পরিবেশ কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা সত্ত্বেও বাড়ির ভেতরে অবস্থিত মানুষগুলো এই কনকনে শীত উপেক্ষা করে কোন এক বিষয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত ছিল। খানিক পূর্বে মিটিং শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রায় বিশ জন ব্যক্তি এই মিটিং সভাতে উপস্থিত ছিল। সবাই প্রস্থান করলেই কয়েকজন ব্যক্তি এখনো বাড়িটা ত্যাগ করেনি।

তার মধ্য সমুদ্র বিদ্যমান । বর্তমান একটা চেয়ারে নতজানু হয়ে বসে রয়েছে সমুদ্র। মিটিংটা মূলত তাকে কেন্দ্র করে হয়েছে। সমুদ্রহীনা এই আলোচনা সভা যেন অসম্পূর্ণ। তার নিকটবর্তী বসে রয়েছে এসিপি শোয়াইব খান। তার চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দ ভেসে উঠেছে। সমুদ্র তার কর্মে সাফল্যর পথে। তার জন্যই কেসটা খুব শীঘ্রই সফল ভাবে সমাপ্ত হতে চলেছে। তাই শোয়াইব খানের যেন খুশির শেষ নেই।

সে সমুদ্রকে আকাশের সঙ্গে যেতে দেয় নি। সবাই গাড়ি করে চলে গেলেই তিনি সমুদ্রকে বিদায় দেননি। তার নাকি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে সমুদ্রের সঙ্গে। স্যারের আদর্শ পেয়ে সমুদ্র ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাসায় ব্যাক করতে পারে নি। কিছুটা হলেও তার মেহেরের জন্য চিন্তা হচ্ছে। না চাইতেই সে বারংবার মেহেরকে নিয়ে ভাবনায় বিভোর থাকছে। বিষয়টা সমুদ্র কিছুতেই মস্তিষ্ক হতে বের করতে সফল হচ্ছে না। যতোই হোক মেহের তার একমাত্র দায়িত্ব। তার জন্য মেয়েটা যদি কোন বিপদের সম্মুখে পড়ে তাহলে সে তার মা ইসরাত বেগমের মুখশ্রীর সম্মুখীন হতে পারবে না। সমুদ্র যখন চিন্তায় বিভোর ঠিক তখনি এসিপি বলে উঠলেন,

–সমুদ্র হুয়াট আর ইউ থিংকিং?
এসিপির কথার প্রত্যুত্তরে সমুদ্র হাল্কা হেসে বলে উঠল,
–কিছু না স্যার। রাত তো অনেক হলো এখন আমি আসি?

ঘরির কাটাতে রাত দুটো বেজে পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। গভীর হতে গভীরতর ঘুমে আচ্ছন্ন মেহের। আজও তার ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক অনুভূতি হচ্ছে। অর্থাৎ কাল রাতের অজ্ঞাত ব্যক্তির আগমন ঘটছে। মেহেরের অস্বস্তি হচ্ছে খুব। ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ তার মুখশ্রীতে গভীর দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে রয়েছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়া সত্ত্বেও মেহের বিষয়টা আন্দাজ করতে সক্ষম। মেহের চেষ্টা করেও চোখ যুগল উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছ।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ১৮

অতঃপর আকস্মিক কোন একটা কাঁচের বস্তু ভেঙে বিটক আওয়াজ হওয়াতে মেহেরের অস্বস্তি মাখা নিদ্রা বিদায় নিল। তৎক্ষণাৎ চোখ যুগল উন্মুক্ত করে উঠে বসল সে। ভয়ে হাঁফিতে হাঁফিতে সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বুঝে উঠল অজ্ঞাত ব্যক্তি দ্রুত পদে বিদায় নিচ্ছে। মেহের ভয়ে শিউরে উঠল। লোকটার ছায়ার দিকে দৃষ্টি পরখ করতেই টের পেল ব্যক্তিটার আবছা অবয়ব। মুহূর্তেই আবছা ছায়া অন্ধকারে মিশে গেল। মেহের বুঝতে পারল লোকটা অতিরিক্ত খাটো।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২০