তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৪

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৪
Lutful Mehijabin (লেখা)

–জারা পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার রুমে এসো। আর হ্যাঁ আম্মু, আজকে জারা আমার সঙ্গে থাকবে। দেরি যেন না হয়!
ইয়াদের বলা বাক্যগুলো জারার কর্ণকুহরে পৌঁছান মাত্রই থতমত হয়ে পড়ল সে। ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠল জারার মুখশ্রীতে। কথাগুলো বলে এক মূহুর্তের জন্যও ড্রইং রুমে উপস্থিত থাকে নি ইয়াদ। সঙ্গে সঙ্গে নিজের রুমে যাবার উদ্দেশ্যে পা যুগল প্রসারিত করেছে ইয়াদ। ড্রইং রুম হতে ইয়াদ প্রস্থান করার পর, জারা একপলক রাফুর দিকে অসহায় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। অতঃপর মলিন কন্ঠে রাফু উদ্দেশ্য বলে উঠল,

–ভাইয়া আপনি যান গিয়ে শুয়ে পড়ুন।
রাফু কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। জারার কথার সম্মতি জানিয়ে অতঃপর রাফু ড্রইং রুম হতে প্রস্থান করল। তৎক্ষণাৎ জারা পরাপর দুটো লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে ইসরাত বেগমকে রুমে নিয়ে এলেন। শাশুড়ি মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, অপরাধীর ন্যায় নিজেও এক কোণে শুয়ে পড়ল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিষয়টা পরিলক্ষিত করে ইসরাত বেগম জারার উপর খানিকটা রেগে গেলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি আস্তে করে শুয়া থেকে উঠে বসলেন। নিজ মুখশ্রীতে একরাশ রাগের আবির্ভাব বজায় রেখে জারার দিকে মুখ ফিরে আধশোয়া হয়ে বসে পড়লেন। জারার মুখশ্রীতে কঠোর দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে, তাকে চোখের ইশারায় ইয়াদের রুমে যাওয়ার জন্য আদেশ করলেন। জারা শাশুড়ির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নিজেও উঠে বসল। অতঃপর নতজানু হয়ে ঠোঁট জোড়া হাল্কা সংকুচিত করে মিনমিন কন্ঠে বলে উঠল,

–আম্মু না গেলে হয় না। প্লিজ,,, ভয় পাই তো।
জারার কথার প্রেক্ষিতে নিশ্চুপ হয়ে রইলেন ইসরাত বেগম। তৎক্ষণাৎ খাটের ড্রয়ার থেকে খাতা কলম বের করে কিছু একটা লিখতে আরম্ভ করল তিনি। লিখা শেষ হলে জারার হাতে খাতাটা ধরিয়ে দিয়ে উল্টে দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লেন। জারা ইসরাত বেগমের ভাব ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারল তার শাশুড়ি আম্মু তার উপর খুব রেগে গিয়েছেন । এতে কিছুটা দুঃখ পেল সে। মুহূর্তে খাতাটার দিকে লক্ষ্য করে দেখতে লাগল কী লিখেছেন ইসরাত বেগম। জারা তার শাশুড়ি আম্মুর সম্পূর্ণ লেখনী মনোযোগ সহকারে পড়তে লাগল। লেখনীর অক্ষরে অক্ষরে স্পষ্ট ভর্ৎসনা ফুটে উঠেছে। ইসরাত বেগম ক্রোধের সহিত লিখেছেন,

–তুমি তোমার স্বামীকে দেখে ভয় পাচ্ছে কেন! তুমি কি এখনো অবধি বড় হও নি? আমার তো মনে হয় তোমার চেয়ে মেহের বেশী বুদ্ধিমান। দেখ আমি কোন কথা শুনতে চাই না। তুমি এখন চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো ইয়াদের রুমে যাবে এটা আমার অডার। তুমি যদি না যাও তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।

লেখাগুলো পড়ে তার মনটা ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে উঠল জারার। তার মুখশ্রী গভীর ভাবে মলিন হয়ে উঠল। শাশুড়ি মায়ের আদেশ পালন করতে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়ে পড়ল সে। কপালের সীমান্ত পর্যন্ত ঘোমটা টেনে আবৃত করে ইয়াদের রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা জোড়া ধাবিত করল। রুম থেকে বের হওয়ার পূর্বে জারা নিজ ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে নিম্ন কন্ঠে শাশুড়ি মায়ের উদ্দেশ্য বলল,

–ঠিক আছে যাচ্ছি। রেগ না প্লিজ।
জারার রুম থেকে প্রস্থান করার পর ইসরাত বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে রেখে নিশ্চিতে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললেন।

ভীতি গ্রাস্ত মুখশ্রী নিয়ে ইয়াদের রুমে প্রবেশ করল জারা। তার বক্ষ পিন্জরের হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটতে আরম্ভ করছে। বারংবার ইয়াদের নিকট উপস্থিত হলেই জারার হৃদয় স্পন্দন অবাধ্য হয়ে পড়ে! কেন যে সে এমন অস্থির অনুভূতিতে আক্রান্ত হয় তা তার নিকট অজানা। ইয়াদের রুমের ভেতর উপস্থিত হতেই জারার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।

পুরো রুমে জুড়ে অন্ধকার বিরাজমান। কিন্তু বেলকনি হতে নির্গত স্বল্প আলোতে রুমে প্রতিটি বস্তুই দৃশ্যমান। জারা দৃষ্টি মেলে রুম রুম পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কিন্তু রুমের মধ্যে কোন জন মানবের চিহ্ন পেল না। ইয়াদের দেখা না পেয়ে, প্রায় মিনিট পাঁচেক দিশেহারা হয়ে চুপ করে রইল। খানিকক্ষণ পর তার দৃষ্টি পড়ল বেলকনির দিকে। বেলকনির ইয়াদের উপস্থিতি দেখে থতমত হয়ে পড়ল সে। ইশ!

এতো শীতল পরিবেশেও লোকটা গায়ে শুধু মাত্র একটা টি শার্ট পড়ে রয়েছে। লোকটার শরীরে কী শীত লাগছে না? জারা আশ্চর্যের পাশাপাশি খানিকটা চিন্তিত হয়ে উঠল ইয়াদকে নিয়ে। বুকে একরাশ সাহস যুগিয়ে ধীর পায়ে বেলকনিতে উপস্থিত হলো। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল, ইয়াদ একজন আর্মি। তাই হয়তো তার দেহে শীত অনুভব হয় না। কথাটা জারার মস্তিষ্কে ভেসে উঠতেই তার ঠোঁটের কোণে স্বল্প হাসির রেখে ফুটে উঠল।

ইশ, কতোই না মাধুর্যপূর্ণ লাগছে তার আর্মি পুরুষকে! কিছুটা সময় অপলক দৃষ্টিতে ইয়াদের মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো জারা। বেলকনির আবছা আলোতে অত্যধিক মহোনীয় লাগছে ইয়াদকে। বেলকনির গ্রীল হাত জোড়া দিয়ে স্পর্শ করে রয়েছে ইয়াদ। তার দৃষ্টি নিবন্ধ রয়েছে রাত্রির অন্ধকার আকাশ পানে। নিস্তব্ধ রুপ ধারণ করেছে কোলাহল পূর্ণ ব্যস্ত শহরটা।

ইয়াদের বেলকনি থেকে আশেপাশে কয়েকটা উঁচু এপার্টমেন্টের বেলকনিতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক বাতির উজ্জ্বলতার আলো দৃষ্টিমান হচ্ছে। প্রকৃতি তার সিদ্ধ শীতল বাতাসে গ্রাস করে নিয়েছে অন্ধকার শহরটাতে। ইয়াদের এপার্টমেন্টটা মেইন রোড হতে খানিকটা ভিতরে তাই চলন্ত গাড়ির দেখা মিলছে না। শীতার্দ্র প্রবাহে চারপাশ বিন্দু বিন্দু শিশির ভেজা স্নিগ্ধ জলে হাল্কা ভিজে উঠেছে।

ঘন কুয়াশায় দুই হাত দূরের জিনিসও দেখা দুষ্কর। সবকিছু যেন কুয়াশার শুভ্র চাদরে ঢাকা পড়েছে। উষ্ণ চাদরে যখন সবাই আবৃত, ঠিক তখনই দুজন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিস্তবদ্ধতা বজায় রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জারার দৃঢ় দৃষ্টি এখনও অব্দি ইয়াদের মুখশ্রীতে নিবন্ধ। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ নিরবতা ভেঙে ফেলল ইয়াদ। আকাশের দিকে চোখ জোড়া আবদ্ধ রেখে গম্ভীর কন্ঠ বলে উঠল,

–জারা, আই নিড ইউয়ার টাইম।
আকস্মিক ইয়াদের মুখ হতে নির্গত ছোট বাক্যটা কর্ণপাত হতেই শিউরে উঠল জারা। আঁতকে উঠল সে। চরম বিষ্মম যেন তাকে চেপে ধরেছে। ইয়াদ যে তাকে এমন কোন কথা বলতে পারে বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারছে না সে। বিষ্ময়ে তার ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে পড়েছে। জারা স্তম্ভিত নয়নে তাকিয়ে রয়েছে ইয়াদের দিকে। বিষ্ময়ের ধকল কেটে উঠার পূর্বেই ইয়াদ আবার বলে উঠল,

–তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। কিন্তু উপহারটা পেতে হলে তোমাকে একটা শর্ত রাখতে হবে। রাজি তো?
ইয়াদের কথার প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ রইল জারা। ইয়াদ পুনরায় গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
–আচ্ছা তোমাকে শর্ত পূরণ করতে হবে না। শুধু মাত্র আমার আদেশ মনে করে কথাটা রাখবে তুমি। তুমি মনে কর না এই সাহিল হোসাইন ইয়াদ কাউকে অনুরোধ করবে! আমি এতোটাও নিচু নই।

ইয়াদের শর্তের কথা ভেবেই খানিক অস্থির হয়ে উঠল জারা। ইয়াদের বলা প্রথম বাক্য শুনে সে ভেবেছিল ইয়াদ হাজারটা শর্ত দিলেও সে মান্য করবে। এর বিনিময়ে কোন উপহার চাই না তার। ইয়াদ বললে সে প্রাণ উজার করে দিতেই রাজি। কিন্তু শেষোক্ত কথাটা শুনে তার মনে হয়েছে তার আর্মি পুরুষ তাকে একদমই সহ্য করতে পারে না। বিষয়টা তার অন্তারালে ঝড় তুলতে সক্ষম হয়েছে। বিষণ্ণ মন নিয়ে জারা ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে মিনমিন কন্ঠে বলল,
–কী করতে হবে বলুন।

জারার কথাটা শুনে আকাশ পানে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল ইয়াদ। চোয়াল শক্ত করে চোখ যুগল বুঁজে রইলো। সেকেন্ড পাঁচেক নিরবা পালন করে অতঃপর তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠল,
–না তোমাকে তেমন কিছুই করতে হবে না। শুধু মাত্র এই দুটো দিন তুমি আমার রুমে থাকবে।

এই যেন অনুরোধ নয় এক প্রকার ভর্ৎসনা। জারা বুঝতে পারল না লোকটা এমন আজব চরিত্রের কেন! সামান্য একটা বিষয় তাকে এভাবে বলল? জারা স্তব্ধ হয়ে ইয়াদের মুখ পানে তাকিয়ে রইল।
তার হৃদয় গহীন অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি হাজির হলো। যে লোকটা কিছুদিন আগেও তাকে রুমের আসে পাশে চাপতে দিন না আজ সেই তাকে রুমে থাকার কথা বলছে!

এভাবেই একরাশ অদ্ভুত অনুভূতি যুক্ত মুহূর্ত অতিক্রম করল জারা। তার মনটা আজ বড্ড আনন্দিত! খানিক বাদে ইয়াদ পকেট থেকে তার পকেটে হতে একটা পারসেল বের করল। অতঃপর প্যাকেটা জারার হাতে দিয়ে বলল,
–এটা নেও।

জারা মুখে আনন্দের ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে! স্বল্প পরিসরে ইতস্তত বোধ হচ্ছে তার। কিন্তু দ্বিধা, সংকোচ ঝেড়ে ফেলে আস্তে করে ইয়াদের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে নিলো। পারসেলটার আকার আকৃতি দেখে সে পরিষ্কার হলো এর মধ্যে নতুন কোন ফোন বিদ্যমান।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৩

পারসেলটা সে হাতে করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। সময় যেন তাদের দুজনের মনের মতোই চলছিল। কিন্তু মাঝখানে একটা বিপত্তি ঘটে গেল। আকস্মিক ইয়াদ ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে জারার মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলল। হঠাৎ করে ইয়াদ তার চোখ জোড়া বড় বড় করে মুখ দিয়ে অস্কুটস্বরে,,,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৫