তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩০

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩০
Lutful Mehijabin (লেখা)

–আমি যে রাতে এসেছি এ কথা অহনাকে বলবে না। আর হ্যাঁ রাতের বলা কথাগুলো মস্তিষ্ক থেকে ডিলিট করে ফেল। কোন কিছু নিয়ে বেশি ভাবতে যেও না। টেক কেয়ার। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করো। পুচকি পুচকির মতো থাকবে। আন্ডারস্টান্ড?

কথাগুলো বলেই কিছু একটা ভেবে পা জোড়া থামিয়ে ফেলল সমুদ্র। পিছন ঘুরে মেহেরের দিকে এগিয়ে এলো সমুদ্র। যাওয়া পূর্বে হুট করে মেহেরের নিকটবর্তী চলে এলো। অতঃপর মেহেরের আঘাত প্রাপ্ত গাল স্পর্শ করে কাতার কন্ঠ বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–আই এম সরি পুচকি।
বাক্যটা বলেই দ্রুত রুম থেকে বেলকনিতে প্রস্থান করল সমুদ্র। ফির একপলক মেহের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেলল। মেয়েটা তার হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে রয়েছে। মেহেরের এমন পরিস্থিতি দেখে সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে স্বল্প হাসির রেখা ফুটে উঠল। তৎক্ষণাৎ তার কর্ণকুহরে পৌঁছাল অহনার কন্ঠস্বর। সে আর এক মুহূর্তেও দেরি করল না। রুমটার বেলকনি ফাঁকা এবং উন্মুক্ত হওয়ার সুবাদে সমুদ্রের নিচে নামতে কোন অসুবিধা হলো না। দেয়ালে হতে মাটি স্পর্শকৃত পাইপ বেয়ে নিচে নেমে পড়ল সে।

বারংবার অহনার আওয়াজ পেয়ে চোখ জোড়া উন্মুক্ত করল মেহের। সমুদ্রের সরি বলার ভঙ্গিমা দৃশ্যমান হতেই, চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল সে। তার সাহস হয়নি সমুদ্রের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করার। সমুদ্রের কন্ঠস্বর হতে নির্গত ‘সরি’ শব্দটা মেহেরের শান্ত হৃদয়ে অশান্ততার আবির্ভাব ঘটিয়েছে। মস্তিষ্ক খানিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে সমুদ্রের চলে যাওয়া তার বোধগম্য হয় নি। প্রায় মিনিট পাঁচেক স্তম্ভিত হয়ে ছিল মেহের। লহমায় ক্রমাগত অহনার কন্ঠস্বর পেয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। আশেপাশে সমুদ্রের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। অবশেষে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে, ইতস্তত সহিত বলে উঠল,

–আসলে আপু আমি ওয়াশরুমে ছিলাম তো।
মেহেরের কথা শুনে অহনা ভ্রূ যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে ফেলল। মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে হেসে দিয়ে বলল,
–আরে অস্থির হচ্ছ কেন? আমি কী তোমাকে কিছু বলেছি!

বলেই রুমের ভেতরে প্রবেশ করল অহনা। এতে করে স্বল্প ভয় পেল মেহের। বারংবার তার মনে হলো, রাতের অনাকাঙ্খিত ভাবে সমুদ্র আগমনের কথা হয়তো ধরে ফেলবে সে। কিন্তু তার চিন্তা ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিলো অহনা। বিছানার উপর একটা প্যাকেট রেখে চটজলদি মেহেরের হাত ধরে তার কাছে নিয়ে এলো। অতঃপর মেহেরের গালে স্পর্শ করে বলে উঠল,

–তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে এসো তো।
অহনার কথা শুনে অবাক হয়ে উঠল মেহের। এই শীতল পরিবেশে তাকে শাওয়ার নিতে হবে! মুহূর্তেই তার মুখশ্রী পাংশুটে বর্ণ ধারণ করে উঠল। স্বল্প মন খারাপ করে অহনাকে বলল,
–এতো সকালে শাওয়ার নিতে হবে! কেন আপু?
মেহেরের কথার প্রত্যুত্তরে অহনা বলে উঠল,

–ওহহ তোমাকে তো বলাই হয় নি আজকে বাসায় ছোট একটা পার্টি আয়োজন করা হয়েছে। তাই ফ্রেশ হয়ে এসো।
অনুষ্ঠানের ব্যাপারে শুনে খানিকটা বিরক্ত হয়ে পড়ল মেহের। বরাবরই অনুষ্ঠান তার একদমই অপছন্দের। কারণ সাধারণ অনুষ্ঠানের পরিবেশ কোলাহল পূর্ণ। ছোট বেলা হতেই চিৎকার চেঁচামেচি, গান বাজনা পছন্দ নয় মেহেরের। কিন্তু মেহেরের বিরক্তির কারণটা আন্দাজ করতে ব্যর্থ হলো অহনা। সে ভাবল মেহেরের বুঝি সমুদ্রের কথা মনে পড়ছে। তাই অহনা সান্তানা স্বরে বলে উঠল,

–ওই শয়তানটার কথা মনে পড়েছে?
মেহের তার দৃঢ় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল অহনার মুখে। প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক পর তার বোধগম্য হলো শয়তান বলতে সমুদ্রকে বুঝিয়েছে অহনা। মুহূর্তেই লজ্জয় মেহেরের গাল যুগল রক্তিম বর্ণ ধারণ করে উঠল। তার কর্ণপাত হতে লাগলো সমুদ্রের বলা প্রতিটি কথা। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে অহনার কথার জবাবে বলে উঠল,

–না আপু।
অহনা কিছু বুঝে উঠতে পারল না। মেহেরের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে উঠল,
–ও তোমাকে থাপ্পড় মেরেছে দেখে তুমি লজ্জা পাচ্ছ? একটা কথা মনে রেখে মেহের, সমুদ্র তোমার যোগ্য নয়। তাই ওকে ভুলে যাও।

অহনার বলা বাক্যগুলো শুনে নিমিষেই মেহেরের মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। তাকে ছাড়া আদৌ থাকা সম্ভব!
–লেট হয়ে যাচ্ছে মেহের। নিরব তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। কাল অনেক রাত করে বাসায় ফিরেছে তাই আর তোমার সঙ্গে দেখা করাই নি। আমি যাচ্ছি অনেক কাজ আছে। একটু পর তোমাকে নিতে আসব।

কথাগুলো বলে এক মূহুর্তও দেরি করল না অহনা। মেহের অপলক দৃষ্টিতে অহনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। আর ভাবতে লাগল সমুদ্রের কথা। সমুদ্র তাকে যাবার আগে রাতের ঘটনা চিন্তা করতে নিষেধ করে দিয়েছে। কিন্তু মেহের শত চেষ্টা করেও রাতের ঘটনা মস্তিষ্ক থেকে ডিলিট করতে পারছে না। কথাই আছে না নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের অদম্য আগ্রহ প্রকাশ পায়। ঠিক তেমনি মেহের অবাধ্য মস্তিষ্ক সমুদ্র কথা না চাইতেও ভেবে চলছে।

মোবাইল ফোনের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে অশ্রু বিসর্জন করে চলছে সিরাত বেগম। আজ তার মেহেরের কথা বড্ড মনে পড়ছে। তাই তো মেয়েটার ছবির দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে মেহেরকে এক পলক দেখার। সিরাত বেগম তীর্থের কাকের ন্যায় মেহেরের মুখশ্রী দর্শনের অপেক্ষায় রয়েছে। মেয়েটার জন্য তার হৃদয় আশঙ্কায় কাতর হয়ে উঠেছে। একটা বিশেষ কারনে অত্যধিক ভয় হচ্ছে তার। কারণ আজ তার স্বামী তার বারণ শুনে নি। মেহেরের সম্পর্কে সব তথ্যই রাফিকে বলে দিয়েছে। অবশ্য এতে করে রাফি তাদেরকে আর পর্যবেক্ষণ করছে না।

মেহেরের বিয়ের খবর পেয়ে মারাত্মক খেপে গিয়েছে রাফি। এখন হয়তো রাফির হাত থেকে তার মেয়েটার নিস্তার নেই। বিষয়টা যতবার সে ভাবছে ঠিক ততোবার তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠছে। যদি রাফি সমুদ্রের কোন ক্ষতি করে দেয়? সিরাত বেগম মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে, রাফি মেহেরের কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু সমুদ্র ছেলেটার কী হবে? রাফির ব্যাপারে সমুদ্রেকে জানাতে যেয়েও জানাতে পারি নি। কারণ তার স্বামী স্পষ্ট নিষেধ করে দিয়েছে মেহেরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সিরাত বেগম। কী করবে সে? একদিকে স্বামীর নিষেধ অন্যদিকে মেয়েটার জীবন? তাই কোন উপায় না পেয়ে চোখের জল ফেলছেন তিনি।

বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে রয়েছে জারা। বিষণ্ণতা তাকে আষ্টেপিষ্টে ঘিরে রেখেছে। আজ বই প্রেমিকা বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিষাদগ্রস্ত হৃদয় গহীন নিয়ে সে ভেবে চলছে তার বিষাক্ত অতীত। সবকিছু তো ঠিকই ছিল। তাহলে কেন বিষাদময় অতীত তার জীবনের আগমন ঘটাল। সে তো চেয়েছিল অতীত ভুলে ইয়াদের সঙ্গে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতো।

মুহূর্তেই জারার কর্ণপাত হলো তার মোবাইলের স্বল্প আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয় গহীন ধবক করে উঠল। তৎক্ষণাৎ একপলক ফোনের স্কিনে দৃষ্টিপাত ফেলল সে। অস্থির হয়ে উঠল তার হৃদয় গহীন। তৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল সে। বারংবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল বর্ষণ নামের গোটা গোটা অক্ষর। পরক্ষণেই তার চোখের কোণে হতে কয়েক ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে গাল বেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।

দাঁত দাঁত চেপে কান্না নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস চালাল সে। একপর্যায়ে ব্যর্থ হলো। লহমায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল জারা। অতঃপর কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

–আমি তো আপনাকে ভুলে ভালোই ছিলাম। তাহলে কেন আবার আমার জীবনে ফিরে আসলেন আপনি? এখন থেকে যে আমি আপনার জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আপনি কেনই বা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন? বলুন না, কেন? আমি তো চেয়েছিলাম আপনার জীবনে প্রবেশ করতে। চেয়েছিলাম তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনকে ঘিরে বাঁচাতে। আপনি কথা দিয়েছিলেন, কোনদিনও আমাকে ছেড়ে যাবেন না।

মনে আছে আপনার আপনি আমার সঙ্গে একদিন কথা না বললে অস্থির হয়ে যেতেন। সেই আপনিই দুটো বছর আমার সঙ্গে কথা না বলে কাটিয়ে দিলেন। আমার তো মনে হয় আপনি আমাকে কখনোই ভালোবাসেন নি। ভালোবাসালে কখনোই এই যে অতিক্রান্ত দুই বছর চার মাসে একবার হলেও খোঁজ নিতেন আপনার জেবুর কথা।

আপনি জানেন একটা সময় আপনার জেবু আপনাকে ভেবেই প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা আতিবাহিত করতো? কিন্তু এখন আমি আপনাকে ভুলে গিয়েছি। জেবু ভুলে গিয়েছে তার বর্ষণকে। বর্তমান আপনার জেবু আর আপনার নেই। আমি ঘৃণা করি আপনাকে। আই হেইট ইউ বর্ষণ।

কথাগুলো বলতে বলতে একপর্যায়ে জেরে কেঁদে উঠল জারা। সে আর পারছে সহ্য করতে। ইয়াদের জন্য তার অন্তরাল অস্থির হয়ে উঠেছে। একদিকে পুরনো প্রেম বর্ষণ অন্যদিকে তার স্বামী ইয়াদ। চাইলে বর্ষণকে মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিতে পারছে না।

সোফার উপর মন মরা হয়ে বসে রয়েছে মেহের। পরেনে তার অফ হোয়াইট লং ড্রেস এবং একই রঙের স্কার্ফ ওড়ানা। কৃত্রিম কোন সাজ দেইনি মুখশ্রীতে। অথচ বেশ মাধুর্যপূর্ণ লাগছে তাকে। তার কোলে নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে আয়ান। পুরো রুম ভর্তি মানুষ দিয়ে ভরপুর। এতে ভারি ইতস্তত বোধ হচ্ছে। সবার আড়ালে অবস্থান করলেও অত্যধিক অস্তিত্ব হচ্ছে তার। এমন কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ অভ্যস্ত নয় সে। অবশ্য তার কিছুটা দূরে অবস্থান করছে সমুদ্র।

মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব স্পষ্ট! মেহেরকে দেখেও না চেনার ভাব করে রয়েছে সমুদ্র। অহনার স্বামী নিরব সমুদ্রকে বিশেষ ভাবে নিমন্ত্রণ করেছে। শুধু সমুদ্র নয় তার সঙ্গে আকাশ এবং তাদের পুরো টিম উপস্থিত হয়েছে। শুধু মাত্র শোয়াইব খান বাদে। সমুদ্রের উপস্থিতিত একরাশ রাগের আবির্ভাব ঘটেছে অহনার অন্তরাল। নিরবের জন্য এখনো অবধি সমুদ্রের কিছু বলতে পারে নি সে। সমুদ্রের উপস্থিতিতে অত্যধিক পুলকিত হয়ে উঠেছে মেহেরের হৃদয় গহীন। পরক্ষণেই মেহেরের দৃশ্যমান হলো আদিবার উপস্থিতি। ওয়েস্টান পোশাক পড়ে অর্ধ বয়স্ক লোকের সঙ্গে এসেছে। হয়তো এখনো পর্যন্ত আদিবা মেহেরকে লক্ষ্য করে নি।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৯

আয়ানকে নিয়ে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে ছিল মেহের। খানিক বাদে বাদে সমুদ্রের দিকে আর চোখে লক্ষ্য করেছিল সে। এমন পরিস্থিতি হঠাৎ মেহেরের দৃশ্যমান হলো তিতাস কে। মুহূর্তেই ড্রইং রুম প্রস্থান করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩১