তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৯

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৯
Lutful Mehijabin (লেখা)

বলেই সমুদ্রের চোখের বর্ষণের প্রখরতা বাড়িয়ে দিল। অবিরাম বর্ষণে ভিজিয়ে দিল মেহেরের মুখশ্রী। পরিশেষে মেহের বাধ্য হয়ে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে কান্নারত নিম্ন কন্ঠ বলে উঠল,

–আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না প্লিজ। আপনি আমার কাছে সম্মানিয় ব্যক্তি। তাই প্লিজ এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদবেন না। আমার খুবই অসুবিধে হচ্ছে না। আপনি দয়া করে এই শীতে এভাবে বসে না থেকে শুয়ে পড়ুন। আপনি বললে আমি ছোফায় যেয়ে ঘুমচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহেরের বলা কথাগুলো কর্ণপাত হতেই ক্রোধের বসে সমুদ্র তার ব্যান্ডেজ কৃত হাতটা বিছানার নিকটবর্তী ট্রি টেবিলের উপর সজরে মুষ্ট্যাঘাত করল। মুহূর্তেই ব্যথায় মলিন হয়ে উঠল তার মুখশ্রী। বিষয়টা মেহের বুঝতে পেরেও কিছু বলার সাহস পেল না। এখনো অবাকের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারি নি সে।

সমুদ্রের এক দিনের আকস্মিক পরিবর্তন তাকে অবাক হতে অবাকতর করে তুলেছে। স্বল্প অবাক নয় সীমাহীন অবাক তাকে আষ্টেপিষ্টে ঘিরে ফেলেছে। সমুদ্রের আচমকা বদল তার নিকট স্বপ্নের মতো লাগছে। মৃদু আলোতে মেহের তার ডাগর ডাগর চোখ দুটোর দৃষ্টি পাত নিক্ষেপ করে রয়েছে সমুদ্রের মুখশ্রীতে। সমুদ্রের এই অদ্ভুত রুপটা তার হৃদয়ে অস্তিত্ব, অস্থিরতা, অশান্ততার আগমন ঘটিয়েছে। হঠাৎ ব্যথাতুর হাতটা চাদরে আড়াল করে নিল সমুদ্র। অতঃপর দ্বিধা, সংকোচ, লজ্জা হীনা মেহেরকে আবৃত করা উষ্ণ চাদরটা নিজের গায়ে জড়িয়ে এক কোণে শুয়ে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ জোড়া বন্ধ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,

–ঘুমিয়ে পড় পুচকি। ওই ছোট মস্তিষ্কের উপর চাপ দিও না প্লিজ। আমার কথাগুলো বোধগম্য করার বয়স এখনো তোমার হয় নি। সো চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়।
মেহের কি করবে বুঝতে পারল না। এক কথায় দিশেহারা হয়ে পড়ল সে। পনেরো বছরের সমাপ্তি ঘটিয়ে ষোলো বছরের পা দেওয়া বাচ্চা মেয়েটা তার জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করে আসছে ক্রমাগত।

মেয়েটার মস্তিষ্কের বয়স খুব একটা বেশি না হলেও, তার আচার ব্যবহারে শিশু সুলভ আচরণ বহি: প্রকাশ পায় না। সবসময়ই প্রাপ্ত বয়স মহিলাদের ন্যায় জ্ঞান, বুদ্ধি – কৌশল প্রতিফলিত হয় তার মধ্যে। যে কেউ তার ব্যবহারে মুগ্ধ হতে বাধ্য। প্রতিটি কাজ সে বুদ্ধিমত্তা এবং নিপুণতার সঙ্গে সম্পূর্ণ করে। কিন্তু এই মুহূর্তে মেহেরের মস্তিষ্কের কর্ম ক্ষমতা খানিকটা লোপ পেয়েছে। সমুদ্রের বলা একটি বাক্যেও তার মস্তিষ্ক বুঁজে উঠতে পারছে না।

সমুদ্রের চোখের অশ্রু তাকে ব্যথিত করে তুলছে। তার মুখ হতে নির্গত প্রতিটি কথা চিন্তিত করে তুলছে মেহরকে। সমুদ্র তার কাছে ক্ষমা চাইছে, বিষয়টা পরিস্কার মেহেরের নিকট। এতটুকুতেই মেহেরের হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু পরক্ষণে সমুদ্রের বলা কিছু কথা তাকে চিন্তা গ্রস্ত করে তুলেছে। সে বিষণ্ণ হৃদয় নিয়ে ভেবে চলছে, সমুদ্র কেন বলল সে প্রেম, ভালোবাসার সম্পর্কে বিশ্বাসী নয়?

কেন বলল মেহেরকে শুধু মাত্র অনুভূতি নিবারণের জন্য প্রয়োজন? সত্যিই কি এই ধরণীর বুকে তুমি নামক অনুভূতি বলতে কিছু আছে? নাকি শুধু মাত্র সমুদ্র তার প্রয়োজন থেকে কথাগুলো বলল। সমুদ্র তার কৃত কর্মে অনুতপ্ত। তাই হয়তো অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু সে যে বলল, তার মেহেরকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তা আদৌ কি সম্ভব! মেহেরের ভাবনার সাগরে ব্যাঘাত ঘটাল সমুদ্র। হঠাৎ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,

–চোখ বন্ধ কর পুচকি। অযথা তুমি অনুভূতিটার কথা ভেবে চলছে। আমার কথা তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো! বেশি চিন্তা কর না তুমি যেদিন এই অনুভূতিটা উপলব্ধি করতে পারবে ঠিক সেদিন আমার কথা বিশ্বাস করতে পারবে। আই প্রে, খুব শীঘ্রই আমার পুচকিটা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে অনুভূতিটাতে আক্রান্ত হয়। ইশ! নিশ্চিত সেদিন পুচকিটা আমাকে নিষ্ঠুর বলবে।

সমুদ্রের বাগযন্ত হতে নির্গত বাক্যগুলো শুনে শুকনো ঢোক গিলল মেহের। শেষোক্ত বাক্যটার মেহেরের হৃদয়ে উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় অশান্ত এবং অসংযত করে তুলেছে। তার বক্ষ পিন্জরের হৃদয় স্পন্দন তৎক্ষণাৎ তড়িৎ বেগে ছুটতে আরম্ভ করল। বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতির উৎপত্তি ঘটল। বড়ই অদ্ভুত অনুভূতি! অবশেষে মেহের লজ্জয় চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল। একরাশ সংশয়, সংকোচ, দ্বিধা দেখা দিয়েছে তার অন্তরালে! সমুদ্র তার অতি নিকটবর্তী অবস্থা করছে! সমুদ্র এতোটাই কাছে যে মেহেরের ইতস্তত বোধ হচ্ছে। মুহূর্তেই সমুদ্র মলিন কন্ঠে বলল,

–ঘুমিয়ে পড়। এভাবে রাত জেগে থেকো না। আমি ঘুমোব তো। তুমি জেগে থাকলে আমি ঘুমাতে পারব না। তাই প্লিজ আমাকে ঘুমাতে দেও। আমি অনেক ক্লান্ত।
মেহের খানিকটা চমকে উঠল সমুদ্রের কথা শুনে। লোকটা তো তার বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে আছে! তাহলে কিভাবে বুঝতে পারল যে সে চোখ জোড়া উন্মুক্ত করে তার ভাবনায় ডুবে রয়েছে? সঙ্গে সঙ্গে ফির চোখ যুগল খিচে বন্ধ করে নিলো সে। বারংবার তার কর্ণপাত হতে লাগল সমুদ্র বলাগুলো। সে না ঘুমালে নাকি সমুদ্রও শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না।

এলামের কর্কশ ধ্বনি কর্ণপাত হতেই আরামের ঘুম ভেঙে গেল জারার । তৎক্ষণাৎ চোখ জোড়া উন্মুক্ত করে উঠে বসল সে। তার দৃশ্যমান হলো পাশে ইয়াদ নেই। কালকে সারাদিন বাসায় অনুপস্থিত ছিল ইয়াদ। বেশ রাত করে বাড়ি ফিরেছে। পুরো রুম পর্যবেক্ষণ করে কোথাও ইয়াদের দেখা মিলল না। মুহূর্তেই জারা বিছানা থেকে উঠে পড়ল। নিজ ওয়াশরুম, ড্রাইং রুম এবং শাশুড়ি মায়ের রুমে ইয়াদকে খুঁজতে লাগল। আজ তার বড্ড অভিপ্রায় জাগছে ইয়াদের মুখশ্রী দর্শন করতে। কারণটা হয়তো ইয়াদের বলা একটা বাক্য।

ইয়াদ কালকেও জারাকে স্মরণ করে দিয়েছিল, উপহারের কথা। আজ সকালের প্রথম প্রহরেই নাকি জারা তার উপহার পেয়ে যাবে। বলেছিল ঘুম থেকে উঠে উপহারটা পেয়ে জারা অসীম আনন্দে ভেসে উঠবে। কিন্তু সকাল হওয়া সত্বেও ইয়াদের দেখা মিলল না। তাহলে কী সে উপহারটাও পাবে না? বিষয়টা ভেবে নিজের অজান্তেই ব্যথিত হয়ে উঠল সে। এত সকালে ইয়াদ কোথায় গিয়েছে? অবশেষে জারার চোখ পড়ল ইয়াদের ব্যবহৃত বালিশের উপর।

দৃশ্যমান হলো হলুদ রঙের খাম! জারা দ্রুত বালিশের উপর থেকে খামটা হাতে নিলো। তার হৃদয় স্পন্দন অযথাই স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কী ওই হলদে রঙের খামেই জারার উপহার রয়েছে? অতঃপর জারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিঠিটা খুলে ফেলল। হাত পা অত্যধিক কাঁপছে। সামান্য একটা চিঠিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করার পূর্বেই শরীর অতিরিক্ত হারে কাঁপতে আরম্ভ করছে! দাঁত দিয়ে নিজ অধর চেপে ধরল জারা। একরাশ ভয়ের আবির্ভাব ঘটেছে তার অন্তরালে! পরিশেষে চিঠিটাতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল। সর্বপ্রথম বাক্য পড়েই চমকে উঠল সে। চিঠিটা ইয়াদ লিখছে,

–এই যে জারা, তোমাকে বলেছিলাম না তোমার জন্যে উপহার অপেক্ষা করছে। আশা করি তুমি তোমার উপহার পেয়ে গিয়েছ। ওহহ তোমাকে তো বলাই হলো না কী উপহার! শোন আমি কাল সকালের ফ্লাইটে ঢাকা যাচ্ছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি চার পাঁচ মাস পরে ফিরব।
বাক্যগুলো পড়তেই জারার চোখ যুগল হতে অঝরে দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে বিসর্জন হতে আরম্ভ করল। গুমরে কেঁদে উঠল সে। এই ভয়ঙ্কর উপহারের জন্যই ইয়াদ তাকে এ ঘরে দুদিন থাকতে বলেছিল! জারার অবাকের সহিত পুনরায় চিঠিটাতে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল।

–জান আমি কেন তোমার থেকে দূরে চলে এলাম? থাক কথাটা এখন বলতে চাচ্ছি না। সময় হলে ঠিকই বলব। শুধু একটা কথাই তোমাকে আমি ঘৃণা করি। প্রচন্ড ঘৃণা করি। আমি তো চেয়েছিলাম সবটা নতুন করে গড়তে। চেয়েছিলাম পুরোনো সব হিসেব নিকেসের সমাপ্তি ঘটিয়ে নব্য সূচনা করতে। কিন্তু তুমি তো নিজেই চাও না নব্য সূচনা হোক। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম দূরে চলে যাব তোমার থেকে অনেক দূরে। কারণ তোমার কাছে থাকলে আমি যে দহনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাব। পারব না তোমাকে অন্য কার সঙ্গে সহ্য করতে। এবার তুমি খুশী তো?

ইয়াদের চিঠিটার সমাপ্তি ঘটিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাশ ত্যাগ করতে লাগল জারা। প্রচন্ড বমি পাচ্ছে তার। তৎক্ষণাৎ চোখের পানি মুছতে মুছতে ওয়াশরুমের দিকে ধাবিত হলো সে। হঠাৎ তার অস্থির লাগছে। অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে। কী করব সে? অতীত ফিরে যাবে নাকি নতুন অনুভূতি ঘিরে বাঁচাতে আরম্ভ করবে ?

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল মেহের। দরজায় টকটক আওয়াজ মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই ধরফরিয়ে চোখ জোড়া উন্মুক্ত করল সে। গা হতে উষ্ণ চাদর সরিয়ে ফেলল। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল সমুদ্রের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে। সমুদ্রকে ঘুম থেকে জাগ্রত করার ইচ্ছে হলো না তার। কিন্তু পরিশেষে উপায় না পেয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠল,
–এই যে শুনছেন, অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। অহনা আপু এসেছে। আমি কী দরজা খুলে দিব?

অহনা নামটা কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের ঘুম ভেঙে গেল। দ্রুত উঠে বসল সে। একপলক হাত ঘরির দিকে দৃষ্টি ফেলল সে। মুহূর্তেই তার মুখ হতে বিরক্তি’ চ ‘শব্দটা বেরিয়ে এলো। মাথার চুল মুঠো বন্ধি করে বিছানা থেকে নেমে পড়ল সে। লহমায় মেহেরের নিদ্রা মাখা মাধুর্যপূর্ণ মুখে দৃষ্টি আকর্ষন করল সে। সেকেন্ড পাঁচেক মেহেরের মুখশ্রীতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অতঃপর পা যুগল ধাবিত করল বেলকনির উদ্দেশ্য। কিছুটা পথ অতিক্রম করে, মেহেরের উদ্দেশ্য বলল,

–আমি যে রাতে এসেছি এ কথা অহনাকে বলবে না। আর হ্যাঁ রাতের বলা কথাগুলো মস্তিষ্ক থেকে ডিলিট করে ফেল। কোন কিছু নিয়ে বেশি ভাবতে যেও না। টেক কেয়ার। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করো। পুচকি পুচকির মতো থাকবে। আন্ডারস্টান্ড?

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৮

কথাগুলো বলেই কিছু একটা ভেবে পা জোড়া থামিয়ে ফেলল সমুদ্র। পিছন ঘুরে মেহেরের দিকে এগিয়ে এলো সমুদ্র। যাওয়া পূর্বে হুট করে মেহেরের নিকটবর্তী চলে এলো।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩০