তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৮

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৮
Lutful Mehijabin (লেখা)

ঘরির কাটাতে ছুঁই ছুঁই বারোটা। মধ্যরাতে মেহেরের অনুভব হচ্ছে কেউ তার মুখের উপর ঝুকে আছে। লোকটার ঘনঘন ত্যাগকৃত উষ্ণ নিশ্বাশ মেহেরের মুখশ্রীতে আষ্টেপিষ্টে উপচে পড়ছে। ফলে পুরনো ঘটনার ভয়ঙ্কর অনুভূতি তাকে চেপে ধরেছে। অতিরিক্ত ভয়ে জেগে থাকা সত্ত্বেও চোখ জোড়া উন্মুক্ত করার সাহস হচ্ছে না তার। ঠিক তখনি আচমকা মেহেরের মুখ লোকটা জোরে চেপে ধরল।

ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে কিন্তু লোকটার বলিষ্ঠ হাতের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠল না। হঠাৎ লোকটার উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে মেহেরের শরীর শিউর উঠল। খানিকের জন্য তার অনুভব হলো লোকটা সমুদ্র। পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের হাসির উৎপত্তি ঘটল তার অন্তরালে। সত্যিই কি সমুদ্র এসেছে? বিষয়টা কি আদৌ সম্ভব! মেহের চিন্তা করল হয়তো সমুদ্র কে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার ফলে সমুদ্রের মিথ্যে উপস্থিতি অনুভব হচ্ছে তার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মুহূর্তেই তার মনে হলো সমুদ্রের মিথ্যা উপস্থিতি তার অপ্রমত্ত ছলনা বৈকি অন্য কিছুই নয়। তৎক্ষণাৎ মেহের তার গালে খসখসে কোন কিছুর ছোঁয়া পেল। জ্বলে উঠল তার আঘাত প্রাপ্ত গাল। মেহেরের মস্তিষ্ক বলে উঠল লোকটার হাত অমসৃণ কিছু দিয়ে পট্টি বাঁধা অর্থাৎ ব্যান্ডেজ করা বিধায় সে স্বল্প ব্যথা পাচ্ছে। অবশেষে ভয়ের আবিষ্কার ঘটল তার হৃদয় গহীনে। তাহলে কি সত্যিই কেউ তার রুমে এসেছে? নাকি হ্যালুসিনেশন এর স্বীকার হয়েছে সে! আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এতো কিছু হওয়ার পরেই মেহেরের অস্বস্তি হচ্ছে না। তার অন্তরাল বারংবার বলে উঠছে, সমুদ্র এসেছে! কিন্তু তার মস্তিষ্ক বড্ড অবাধ্য। সমুদ্রের উপস্থিতি মানতে নারাজ।

এভাবে নিরবতা সহিত মিনিট পাঁচেক পার হয়ে গেল। মেহেরের মস্তিষ্ক বলে উঠল, হয়তো সেদিন রাতের সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির আগমন ঘটেছে। অথচ তার মন কিছুতেই মানতে চাইল না। চোখ জোড়া বন্ধ রেখে নিস্তবদ্ধতা বজায় রেখে অনুভব করতে লাগল লোকটার হাতের সযত্নে ছোঁয়া। সহৃদয়ের লোকটা তার হাত বারংবার মেহেরের গালে ছোঁয়াচ্ছে। এমন অবস্থায় মেহেরের অদম্য আগ্রহ জাগল চোখ জোড়া উন্মুক্ত করে লোকটার মুখ দর্শন করতে। খানিকটা সময় অতিবাহিত হতেই, মেহেরের হৃদয় অস্বাভাবিক অনুভুতির স্বীকার হলো। হঠাৎ অনুভব হলো তার মুখশ্রী উষ্ণ জলে ভিজে উঠছে। একপর্যায়ে মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছল লোকটার ব্যথাতুর মৃদু আওয়াজ। লোকটা মেহেরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলছে,

–আই এম সরি, পুচকি। তোমার যে এতো ব্যথা লাগবে আমি বুঝতে পারি নি। বিশ্বাস করো তখন আমার মাথা একদমই ঠিক ছিলো না।

লোকটার গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে মেহেরের চমকে উঠছে। স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে সে। তারমানে এতক্ষণ তার মন যা বলছিল তাই কী সত্যি! অর্থাৎ বর্তমানে তার নিকটবর্তী সমুদ্র অবস্থান করছে? সত্যিই কী সে এমন অদ্ভুত মুহূর্তের স্বীকার হয়েছে? মেহেরের বড্ড ইচ্ছে জাগল, সমুদ্রকে দেখার। কিন্তু অভিমান যেন ঝেঁকে বসল তার অন্তরে। ইচ্ছে করেই মেহের চোখ জোড়া খুলল না সে। চুপচাপ সমুদ্রের পরিস্থিতি আন্দাজ করার প্রয়াস চালাল। লহমায় ফির সমুদ্রের ভাঙা কন্ঠে বলতে লাগল,

–তুমি কী আমাকে ক্ষমা করবে না? বিশ্বাস কর পুচকি, সেই বিকেল থেকে আমার বুকটা ছটফট করছিল তোমাকে একটিবারের জন্য দেখতে। সত্যিই বলছি আজ তোমাকে না দেখলে আমি মরে যেতাম। জান পুচকি, আমার না এখন অনেক শান্তি লাগছে। তোমাকে দেখে আমার অশান্ত হৃদয় অবশেষে শান্ত হয়েছে।

সমুদ্রের মুখ হতে অনুভূতি সম্পূর্ণ বাক্যগুলো বিশ্বাস করতে ব্যর্থ হচ্ছে মেহের। এত অনুভূতি সম্পূর্ণ বাক্য কী আদৌও কোন প্রেমিক পুরুষ বলতে পারে? লহমায় নাক টেনে ফির সমুদ্র বলে উঠল,

–এই পুচকি বলো না কী আছে তোমার? কিচ্ছু নেই! কিন্তু আমি যে প্রতিনিয়ত আসক্ত হয়ে পড়ছি তোমাতে। তুমি কী জান, তুমি হীনা আমি কতোটা অসহায়? এতক্ষণ উন্মাদ পাগলের ন্যায় কাতার হয়ে উঠেছিলাম তোমার কাছে আসার জন্য। তোমাকে না দেখা অবধি ধীরে ধীরে আমার নিশ্বাশ বন্ধ হয়ে আসছিল। হয়তো এখন তোমার কাছে না আসলে সকালে আমাকে এই ধরণীর বুকে খুঁজে পাওয়া যেত কি সন্দেহ!

কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল সমুদ্র। সেকেন্ড পাঁচেক নিরব থেকে পুনরায় মেহেরের কানের কাছে তার মুখটা নিয়ে এলো। মেহেরের আন্দাজ করতে পারল সমুদ্র কাঁদছে। সত্যিই সমুদ্র কাঁদছে! ইচ্ছে মতো অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। বিষয়টা লক্ষ্যে করে খানিকটা সময় স্তব্ধ হয়ে পড়ল মেহের! সমুদ্রের চোখের জল তার হৃদয় ব্যথিত করে তুলল। সমুদ্রের পরিস্থিতি দেখে ইতিমধ্যেই মেহেরের অভিমানের জমে থাকা পাহাড় ভেঙে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

একরাশ নাম না জানা অনুভূতির আবির্ভাব ঘটেছে মেহেরের হৃদয়মনে। অস্থির হয়ে পড়েছে তার অন্তরালে। মেহের আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারল না। পিটপিট করে চোখ জোড়া খুলে ফেলল। তৎক্ষণাৎ তার বেলকনির হতে নির্গত মৃদু উজ্জ্বল আলোতে সমুদ্রকে স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো। মুহূর্তেই তার সারা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বইয়ে গেল। লহমায় সমুদ্র মেহেরের কানের নিকট হতে মুখ সরিয়ে আনল। অতঃপর কিঞ্চিৎ ঝুকে দৃঢ় দৃষ্টিপাত ফেলল মেহেরের মুখশ্রীতে।

হঠাৎ মেহেরের কর্ণপাত হলো সমুদ্রের ফুঁপানোর আওয়াজ। সমুদ্রের ফুঁপিয়ে কাঁদছে! সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে মেহেরের মুখশ্রীতে পড়ল। নিমিষেই ভিজিয়ে দিল মেহেরের গলা। কেঁপে উঠল মেহেরের! সমুদ্রের এতোটাই কাঁদছে যে মেহেরের মুখশ্রীতে ভিজে উঠেছে। মেহের সমুদ্রকে কান্নারত অবস্থায় সহ্য করতে পারছে না। বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। পরিশেষে দিশেহারা হয়ে উঠল মেহেরের। অতঃপর সমুদ্রের ঘন ঘন নিশ্বাশ ত্যাগ করতে লাগল এবং বলে উঠল,

–এই পুচকি, চোখ খুলেছ কেন, হুম? তোমার কোন অধিকার নেই আমার এই কান্নারত মুখশ্রী দেখার। কারণ তুমি বড্ড পচা। এতটুকু পুচকি হয়েও তুমি আমাকে নিয়ন্ত্রন করছ। তুমি কী জান, আজ কত বছর পর আমর চোখে অশ্রু এসেছে! সো চুপচাপ চোখ বুজে থাকো।

সমুদ্রের আদেশ পেয়েও চোখ বন্ধ করল না মেহের। অবাধ্যের মতো ঝাপসা আলোতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সমুদ্রের মুখশ্রীতে। সমুদ্র মেহেরের অবস্থা দেখে নিজের হাত দিয়ে বন্ধ করে দিলো মেহেরের চোখ জোড়া। পরক্ষণেই সমুদ্র তার চোখ যুগল বন্ধ করে লম্বা, স্নিগ্ধ বাতাস টেনে নিয়ে, পুনরায় কান্নারত কন্ঠে বলল,

–পুচকি, আমি জানি না প্রেম, ভালোবাসা কি? আদৌ কি পৃথিবীর বুকে ভালোবাসা নামক সম্পর্ক বলতে কিছু আছে কি সন্দেহ হয় আমার। আমি বিশ্বাস করি ‘ভালোবাসা’একটা অক্ষর ছাড়া অন্য কিছুই নয়। বিশ্বাস কর প্রেম, ভালোবাসার কোন মূল্য নেই আমার কাছে। কারণ হয়তো একটাই আমি কোন প্রেমিক পুরুষ নই। কিন্তু আমি যে ক্ষণে ক্ষণে একটা বাজে অনুভূতিতে গ্রাস হয়ে যাচ্ছি। সেই অনুভূতিটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।

আমার কাছে মাদক আসক্তির চেয়েও অধিক মারাত্মক। অনুভূতিটাতে তুমি যদি আক্রান্ত হতে তাহলে নিশ্চিত আমার পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারতে।আজ অনুভূতিটা আমাকে হারে হারে অনুভব করিয়েছে যে তুমি হীনা আমি কতোটা অসহায়। আমার শুধু মাত্র তোমাকে প্রয়োজন। এই মুহূর্তে তোমার যেমন এই শীতল পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে উষ্ণতার প্রয়োজন। আমারও ঠিকই অন্তরের অদ্ভুত অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে শুধু মাত্র তোমাকে প্রয়োজন। এই অনুভূতির নাম কি তুমি জানো? জান না। আমার যে শুধু মাত্র অনলি ওন তোমাকে প্রয়োজন। বিকস আমি যে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অনুভূতি তুমি নামক অনুভূতিতে আক্রান্ত।

কথাগুলো মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে খুশী ব্যক্তি মনে হলো তার। একরাশ আনন্দের আবির্ভাব ঘটল তার অন্তরালে। অত্যধিক পুলকিত হয়ে উঠেছে তার হৃদয়। পরক্ষণেই তার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ বিসর্জন হয়ে গালে এসে আশ্রয় নিলো। মুহূর্তেই মিশ্রিত হয়ে পড়ল সমুদ্রের অনুভুতি যুক্ত জলে সঙ্গে। সমুদ্রের এতোটা সময়ের বিসর্জিত চোখের বর্ষণ মেহেরের মুখ হতে শুকনোর পূর্বে ফির সমুদ্র গুমরে কেঁদে উঠল। লহমায় ফির ভিজিয়ে দিল মেহেরের মুখশ্রী। অতঃপর ফিসফিস করে অস্কুটস্বরে বলতে লাগল,

–সরি পুচকি। আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমি আর কোনদিনই তোমাকে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট পেতে দিব না। আমি জানি আমার পুচকি সেই ছোট্ট বেলা থেকে কষ্ট পেয়ে আসছে। প্লিজ ফারগিভ মি।
বলেই সমুদ্রের চোখের বর্ষণের প্রখরতা বাড়িয়ে দিল। অবিরাম বর্ষণে ভিজিয়ে দিল মেহেরের মুখশ্রী। পরিশেষে মেহের বাধ্য হয়ে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে কম্পমান কান্নারত নিম্ন কন্ঠ বলে উঠল,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৭

–আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না প্লিজ। আপনি আমার কাছে সম্মানিয় ব্যক্তি। তাই প্লিজ এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদবেন না। আমার খুবই অসুবিধে হচ্ছে না। আপনি দয়া করে এই শীতে এভাবে বসে না থেকে শুয়ে পড়ুন। আপনি বললে আমি ছোফায় যেয়ে ঘুমচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।
মেহেরের কথাগুলো কর্ণপাত হতেই সমুদ্র,,,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২৯