তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৩
Lutful Mehijabin (লেখা)

এদিকে খাওয়া শেষ করে, এলোমেলো করে শাড়ি পেঁচিয়ে দু হাতের মুঠো ভর্তি চুড়ি পড়ে বসে আছি। চিন্তা করছি উনার কথা। আমার চিন্তার মধ্যেই উনি ভেতরে প্রবেশ করলেন। ভয় পেয়ে আমি এলোমেলো শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সাথে সাথেই আমার অন্যমনস্ক থাকার জন্য অঘটন ঘটে গেল।

আমার হাত অতিরিক্ত সরু হওয়ার ফলে হাতভর্তি থাকা চুড়ি গুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। স্বর্ণের চুড়ি ব্যতীত টুকটুক করে কাঁচের রেশমি চুড়ি গুলো ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উনার চলমান পা যুগল থেমে গেল। মূহুর্তেই আমি দৃষ্টি নামিয়ে নতজানু হয়ে রইলাম। তার পরিস্থিতি দেখে মনে হলো তিনি হয়তো এখন আমার উপর রেগে যাবেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফ্লোরে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভাবে ভেঙে থাকা চুড়ি গুলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সমুদ্র। আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনাতে সে স্তম্ভিত। বিরক্তে তার ভ্রু যুগল কুঁচকে গেছে। তৎক্ষণাৎ মেহেরের দিকে শক্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
–যে মেয়ের হাত সামান্য চুড়ি সামলাতে পারে না। সে মেয়ে কীভাবে কারো সংসার সামলাবে?

তার কথাগুলো কর্ণধার হতেই আমার মন গহীনে অসীম ভয়ের আবির্ভাব ঘটলো। তার বলা তিক্ত কথাগুলো আমার গায়ে ধুনুকের তীরের ন্যায় বিঁধলো। দুচোখ দিয়ে দুফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপ টপ করে ঝরে পড়লো। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা আমার দিকে মনোযোগ না দিয়ে সে তার নিজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।

ছাদে ওপর মায়ের সামনে বসে রয়েছে ইয়াদ। ইয়াদের মা ইসরাত বেগম হুইল চেয়ারে বসে তার হাতে অবস্থিত খাতাতে কলম দিয়ে কিছু লিখতে ব্যস্ত।
–মা, আমাদের আজই চট্টগ্রামে যেতে হবে। খুব দরকার। তোমার চিন্তার কিছু নেই। আমি জারার বাড়ির লোকদের বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছি। একটু পরেই বেরিয়ে পড়বো আমারা। জাস্ট পনেরো দিনের জন্য।
ইয়াদের কথার প্রেক্ষিতে ইসরাত বেগম চিন্তা ভরা নয়নে তার দিকে তাকিয়ে, হাতে থাকা খাতাটা ইয়াদের নিকট এগিয়ে দিলেন।

–সমুদ্র বলেছে ও নাকি আজকে ঢাকা চলে যাবে। কিন্তু মেহেরকে সঙ্গে নিবে না। আমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে। ছেলেটাকে নিয়ে আমার বড্ড চিন্তা হয়। আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী ও মেহেরকে বিয়ে করেছে ঠিকি কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। বল তো কী করব? কী করলে ও মেহেরকে সঙ্গে নিতে রাজি হবে?

লেখাগুলো পড়ে ইয়াদ পরাপর দুটো তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে ইসরাত বেগমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
–তুমি তো জানোই ভাইয়া মেয়েদের একদম সহ্য করতে পারে না। চিন্তা করো না একটু সময় লাগবে দ্যান সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমি,,
ইয়াদের কথা বলার মাঝেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। সে কথা থামিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতেই লক্ষ্য করলো মেহেরের মা ফোন দিয়েছে। সাথে সাথে দ্রুত ফোন রিসিভ করে মায়ের সামনে থেকে আড়ালে চলে এলো।

অস্থিরতা নিয়ে সারা ঘর জুড়ে পায়চারি করছে জারা। ভয়ে তার অবস্থা নাজেহাল। শীতের সকাল হওয়া সত্ত্বেও তার ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম স্পষ্ট। রিভালবারের দৃশ্য বার বার ভেসে উঠছে তার চোখে। হৃদ গহীন থেকে পিষে গেছে সে। প্রতিনিয়ত তার মনে হচ্ছে ইয়াদ খুব বড় ধরনের একজন গুন্ডা নয়তোবা মাফিয়া হবে নিশ্চিত! জারার ভাবতেই কান্না পাচ্ছে যে শেষে তার বিয়ে এমন লোকের সাথে হলো? তৎক্ষণাৎ তার মনে হলো যে করেই হোক ইয়াদের সাথে চট্টগ্রামে যাওয়া আটকাতে হবে। নিশ্চয়ই চট্টগ্রামে ইয়াদের কোন গ্যং আছে। এসব চিন্তা নিয়ে সে ঘর জুড়ে হাঁটতে হাঁটতে বিরবির করে বলছে,

–আল্লাহ! লোকটা কী চট্টগ্রামে নিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে? নাকি বন্ধী করে রাখবে? তারমানে আব্বু আম্মু আমাকে গুন্ডার সাথে বিয়ে দিল? দূর, কী যে করি?

জারা আপুর পাশে বসে আছি। অনেকক্ষণ পরে আপুকে দেখতে পেয়ে মনের ভেতরে এক আলাদা প্রশান্তির হাওয়া বইছে। আপুর দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করতেই বুঝতে পেরেছি সে কোন না কোন চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে। প্রচন্ড অস্থির লাগছে তাকে। প্রায় মিনিট পাঁচেক দুজনের মাঝে নিরবতা বিরাজমান।

আমি কথা বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। ওই খারাপ লোকটার কথা ভেবে আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। যে লোক এত বাজে ব্যবহার করে তার সঙ্গে বসবাস করা অসম্ভব। একটু আগে জিজু এসে আমাকে রেডি হতে বলে গেছে। আমাকে আজই নাকি ওই লোকটার সাথে ঢাকায় যেতে হবে। আম্মুর মুখটা মনে পড়তেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

কিন্তু আফসোস জারা আপুকেও আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কথা ব্যক্ত করতে পারলাম না। বলতে পারলাম না আমার কষ্টের কথা। চোখের জল নাকের জল এক করে ফেললাম। কালকে অনেক খুশি ছিলাম আপুর সাথে থাকব ভেবে। কিন্তু এখন জানতে পারলাম আমাকে ওই খারাপ মানুষটার সঙ্গে ঢাকায় যেতে হবে। হাজার চেষ্টা করেও কান্না আটকে রাখতে পারলাম না। কান্না করতে করতে বললাম,

–আপু আমি তোমার সাথে থাকব,,
জারা কী বলে কেঁদে আকুল হওয়া মেয়েটাকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারলো না। রিভালবার সম্পর্কিত কথাটা মেহেরকে বলতে চেয়েও বলল না। সে নিজেও মেহেরের সঙ্গে কান্নায় মত্ত হয়ে উঠলো। কান্নারত অবস্থায় বলল,
–পাগলী কাঁদছিস কেন? খুব তাড়াতাড়ি আমার আর তোর দেখা হবে। কোন চিন্তা করবি না তুই। কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিবি। আমি তোর সাথে প্রতিদিন কথা বলবো।

–কিন্তু আপু আমি যাব না। ওই লোকের সাথে থাকব না। লোকটা অনেক খারাপ।
মেহেরের কথার মধ্যেই ইসরাত বেগম আর ইয়াদ এসে হাজির হলো। ইসরাত বেগম মেহেরের চোখের পানি মুছে দিয়ে খাতাটা এগিয়ে দিল।

খাতার লেখা দেখে আমার কান্না আকাশে ভেসে গেল। মূহুর্তেই চোখে মুখে রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। নিজেকে বড় মানুষ মনে হতে লাগলো। আমি খাতা থেকে দৃষ্টি সরাতে পারলাম না।
–মেহের মা, আমার ছেলে কিন্তু খারাপ না। একটু বদমেজাজি হলেও ওর মনটা ভীষণ ভালো। মাত্র এক মাসের জন্য ঢাকায় যাচ্ছ। তারপর থেকে তুমি আমার কাছে থাকবে। তখন সমুদ্র আমার পায়ে পড়লেও আমি তোমাকে ওর কাছে দিব না। শুধু কয়টা দিন, প্লিজ কান্না করো না সোনা।

শাশুড়ি আম্মুর কথা ভেবে আমি ওনার সাথে ঢাকায় যেতে রাজি হলাম। এত মিষ্টি হাসি যার। যে আমাকে এতটা ভালোবাসে তার কথা আমি ফেলতে পারলাম না। ওই লোকের সঙ্গে যাওয়া জন্য আপুর আর আম্মু থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জিজুর সাথে।

মেহেরকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে এসেছে ইয়াদ। রাগে তার হা পা কাঁপছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে সমুদ্রের উপর। একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে সমুদ্র এতটা বাজে ব্যবহার করে ভেবেই গা জ্বলে উঠছে ইয়াদের। সমুদ্র যেমন ব্যবহার করছে মনে হচ্ছে মেহের নিজ ইচ্ছেই ওর গলায় ঝুলে পড়েছে। একবার ও বুঝতে চাইছে না মেয়েটার মনের অবস্থা। আজ শুধু মাত্র সমুদ্র বড় ভাই বলে সে কিছু বলতে পারে নি। প্রচন্ড রাগ নিয়ে সে ঘরে এসে বলকণিতে চলে গেল।

মেহেরকে বিদায় দিয়ে জারা ওয়াশরুম গেছিল শাওয়ার নিতে। ইসরাত বেগমের মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে তার মস্তিষ্ক থেকে ইয়াদের রিভলবারের কথা বেরিয়ে গেছে। সেই সকলে ইয়াদ তাকে পাঁচ মিনিটে রেডি হওয়ার জন্য হুকুম দিয়ে গেছে ঠিকি কিন্তু সমুদ্রের জন্য তাদের চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া হয়নি।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাল্কা কোঁকরানো সিল্কি আঁচড়ে নিচ্ছে সে। তৎক্ষণাৎ তার কর্ণধারে ভেসে উঠলো বেলকণি থেকে নির্গত ইয়াদের কন্ঠে ভয়ঙ্কর কথা। ইয়াদ কারো সাথে দাঁতে দাঁত চেপে হুমকি সুরে বলছে,
–শয়তান টাকে যেখান থেকে পারিস ধরে আনবি। ওর সাহস তো কম না ও সাহিল হোসাইন ইয়াদের জিনিসে হাত বাড়িয়েছে। ওকে আমি ছাড়ব না। আমি আসছি।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ২

কথাগুলো শুনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জরে আক্রান্ত রোগীদের মতো কাঁপছে জারা। তৎক্ষণাৎ ভয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সে শাড়ির আঁচলে টান অনুভব করল। তার মনে হলো ইয়াদ তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে আছে!
জারা অস্কুটস্বরে বলল,
–ছু,, ছাড়ুন!

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪