তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪১

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪১
Lutful Mehijabin (লেখা)

— ওপেন দা ডোর।
সমুদ্রের কথা শুনে মেহের থতমত হয়ে পড়ে। অহনা এসে নিশ্চিত তাকে খারাপ ভাববে। তাই মেহের নিম্ন কন্ঠে সমুদ্রকে বলে উঠে,
–আপু কী ভাববে?
মেহেরের বলা বাক্যটা সমুদ্রের কর্ণপাত হতেই তার মুখ হাতে বিরক্তির ‘চ’ শব্দ নির্গত হয়। অতঃপর সমুদ্র পুনরায় বলে উঠে,

–পুচকি, তোমাকে না আমি বেশি ভাবতে নিষেধ করেছি। নাও গো,,
তৎক্ষণাৎ মেহেরের ধীরগতিতে পা জোড়া সংকুচিত করলো।‌সীমান্ত পর্যন্ত ওড়না দ্বারা আবৃত করে দরজার কিছুটা নিকটবর্তী এসে তড়িৎ বেগে খুলে দিলো। অহনার মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে মাথা নিচু করে ফ্লোরের উপর দৃঢ় দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিছানার উপর সমুদ্রের অবস্থান মোটেও প্রত্যাশা করেনি অহনা। সমুদ্রকে আয়েশ ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে তার কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের রেখা দেখা দিলো। ফলে মুখশ্রীতে পাংশুটে ভাবের উপস্থিত রেখে,শান্ত ভঙ্গিমায় সোফার উপর গিয়ে বসলো। প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক সমুদ্রের দিকে তিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠলো,
–ওই শয়তান তুই এখানে কি করছিস? আমি বলেছি না আন্টি আসার আগ পর্যন্ত তুই মেহেরের সামনে আসবি না! তাহলে কেন এলি?

অহনার কথাগুলো কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। তার মুখে বিরক্তির ভাবটা স্পষ্ট! অতঃপর মোবাইল ফোন হতে দৃষ্টিতাত সরিয়ে অহনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। স্বল্প গম্ভীর গলায় অহনার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
— জাস্ট সাট আপ! আই নো আমি সাংঘাতিক অন্যায় করেছি। বাট এখন আমি অনুতপ্ত। সো স্টপ ইউয়ার মাউথ।
সমুদ্রের বলা বাক্যের প্রত্ত্যতুরে এক গাল হাসি উপহার দিলো অহনা। অহনাকে আকস্মিক হাসতে দেখে মেহের থতমত হয়ে উঠলো। খানিক ক্ষণ প্রাণ খুলে হাসলো সে। কষ্ট করে হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,

— যাই হোক। তুই এই রুমে এলি কী করে?
অহনার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো সমুদ্র। কন্ঠস্বর রাগের আবির্ভাব বজায় রেখে কর্কশ গলায় বলল,
— হাও ফানি! এতো অদ্ভুত ডিজাইন করে তোদের বাড়ি করতে কে বলেছিল? আই আম সিউর তোদের বাড়িটা করতে গিয়ে আর্কিটেকচারের মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল! বাই দা ওয়ে, তুই এই রুমে মেহেরকে থাকতে দিয়েছিস কেন? এই রুমে ইজিলি প্রবেশ করা যায়। তাও তুই ওকে এখানে রেখেছিস?

সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে অহনা তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করলো মেহেরের মুখশ্রীতে। ফির মুচকি হেসে বলল,
–এসেছিস ভালো কথা। তাই বলে চোরের মতো বেলকনি ঝাঁপিয়ে। আমাকে বলতি আমি ড্রোর খুলে দিতাম। আর আমাদের বাড়িতে অনেক গুলো রুম আছে। তুই চাইলে অন্য রুমে থাকতে পারতি।‌‌ মাঝরাতে মেয়েটার ঘুম ভেঙে তুই একদমই ঠিক করিস নি।

অহনার কথাগুলো শুনে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল সমুদ্র। নিজ মাথার সিল্কি চুলগুলোতে আলতো স্পর্শ করে বলে উঠলো,
–বেশি কথা বলবি না। তোর কথা বলার ধরন আমার কাছে মোটেও সুবিধাজনক লাগছে না। আর একধাপ ও বাড়াবি না। তোর সামনে মেহের রয়েছে এটা ভেবে কথা বলবি। ইডিয়েট! মেহের কাম উইথ মি। তোমার স্কুল আছে। চলো।
বলেই রুম থেকে প্রস্থান করতে পা বাড়াল সমুদ্র। কিন্তু তার যাওয়ার পূর্বে অহনা বিরক্তির কন্ঠে বলে উঠলো,

–আরে কোথায় যাচ্ছিস তোরা। আমি বুঝিনা তোর এতো রাগ কেন? আমার তো মনে উইথ আউট মি তোকে দেখে সবাই ভয় পাই। ইনফ্যক্ট তোর পুচকিও। এতো রাগ ভালো না সমুদ্র। তুই এখনো মুখ ই ধুস নি। তাও আমি তোকে যেতে নিষেধ করব না। তুই যা।

সমুদ্র পা জোড়া থামিয়ে অহনার মুখশ্রীতে দৃষ্টি ফেললো। প্যান্টের দু পকেটে হাত রেখে বলে উঠলো,
— গাড়ি নিয়ে এসেছি। সো বাসায় গিয়ে সব করতে পারব। আমি থাকবো না তোর মতো স্টুপিডের বাসায়।
সমুদ্রের কথা শুনে অহনার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠলো। তৎক্ষণাৎ দ্রুত নিকটবর্তী মেহেরের হাত জোড়া আগলে ধরে বলল,

–তোকে যেতে নিষেধ করেছে কে! তুই যা। কিন্তু মেহেরকে নিতে পারবি না। দেখ দু দিন ও হয়নি। আমি ব্যস্ত ছিলাম তাই ওকে সময় দিতে পারি নি। সো তুই কাঁদলে ও আমি মেহেরকে যেতে দিবো না।
অহনার কন্ঠস্বর হতে নির্গত শেষোক্ত বাক্যটা কর্ণপাত হতেই সমুদ্র মেহের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। তার চোখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। এমন করুণ দৃষ্টি দেখে মেহেরের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। শুকনো ঢোক গিলল সে। অবশেষে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে অহনার উদ্দেশ্যে বলল,

–আপু আমার অনেক পড়া বাকি আছে। বাসায় যেতে হবে। স্কুল ও আছে। আজ বরং আসি। তুমি ভালো থেকো। পড়া একটু চাপিয়ে তারপর নাহয় আয়ানকে দেখতে আসব। তখন কমপক্ষে এক মাস থেকে যাব।
মেহেরের কথা শুনে অহনার মন খারাপ হয়ে গেল। পরক্ষণেই মুচকি হেসে মেহেরের কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বলল,

–গুড গ্যাল। পড়ালেখা মনোযোগ দিয়ে করো। আর এতো ভয় পেও না।‌ এখন তুমি বড়ো হয়েছে। এতো ভয় পেলে কি চলে! এ রণক্ষেত্রে এতো ভয় পেলে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া ভীষণ মুসকিল। ভালো থেকো।‌ না খেয়ে তোমাদের যেতে দিবো ভাবলে কি করে!এখন ড্রইং রুমএ যাও তো প্রিন্সেস, দেখো ওখানে বুয়া রয়েছে। তোমার নিরব ভাইয়া সেই সাত সকালে অফিসে চলে গিয়েছে। ড্রইং রুমে আয়ানকে ওর দাদু খাইয়ে দিচ্ছে। আই থিংক তুমি ফজরের সালাত আদায় করেছো। সো তোমার মুখ ধোয়ার প্রয়োজন নেই। সমুদ্র তো ফ্রেশ হয় নি। তাই ফ্রেশ হয়ে আসবে। তুমি যাও, আমি আসছি।
অহনা কথা শুনে মেহের কন্ঠস্বর হতে ‘হুম’ শব্দটি নির্গত করে ভদ্র মেয়ের ন্যায় ড্রইং রুমের জন্য ধাবিত হলো।

সমুদ্রের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অহনা। সমুদ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সোফায় উপর বসে ফোন স্কোল করছে। লহমায় অহনা সমুদ্রকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
— ওই তোর ভাবভঙ্গি আমার কাছে ঠিক লাগছে না। নিজেকে সাবধানে রাখিস। তুই মেহেরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিস। তা আমি জানি। সো কন্ট্রোল!

অহনার প্রত্ত্যতুরে সমুদ্র গম্ভীর গলায় বলল,
–দেখ খেজুরে আলাপ বাদ দে। কি বলবি বল?
লহমায় অহনার মুখশ্রীতে একরাশ ঘন কালো মেঘের দেখে দিলো। মন খারাপ করে ভৎসনা স্বরে,
–তুই এটা একদম ঠিক করিস নি। কালকে নিরবের কাছে থেকে শুনলাম তুই বর্তমানে যে কেসটা হেন্ডল করছিস সেটা নাকি ছয় বছর পুরনো কেস। এই কেসটাকে যে যে অফিসার স্লভ করতে গিয়েছে তারা সবাই নাকি মারা গিয়েছেন। তাহলে কেন জেনে শুনে তুই কেসটা হেন্ডেল করছিস?

অহনার কথাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সমুদ্র। অহনা ফির বলতে লাগলো,
— তুই কী জানিস এখন তোর লাইফ কতোটা রিক্সে আছে? যেকোনো সময় তোকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হতে পারে। সব কিছু জেনে শুনেই তুই বাচ্চাটার মন নিয়ে খেলা করছিস কেন?

তোর কি একবার মনে হয় না, তোর পুচকির মনেও বসন্তের আগমন ঘটে। একবার ভেবেছিস তোর অনুপস্থিতিতে এই বাচ্চা মেয়েটা কি পরিস্থিতির স্বীকার হবে? তোর নিঃশ্বাস যেদিন এই ধরণীর বাতাসে আর পাওয়া যাবে না সেদিন ওই মুহূর্ত হতে মেয়েটার কী হবে তুই কি ভেবেছিস? সেদিন থেকে তোর পুচকির জীবনে কাল বৈশাখী ঝড় শুরু হবে। প্রথমত বাল্য বিবাহ দ্বিতীয় স্বামী হীনা অর্থাৎ বিধবা মেয়ের সঙ্গে সমাজ কেমন আচরণ করবে তা তো তুই জানিসই!

আমাদের সমাজটা যে ভীষণ মারাত্মক। এখানে মানসিকভাবে সুস্থ থেকে জীবন যাপন করতে গেলে সঙ্গি হীনা বাঁচা যায় না। সমাজ সেই বিধবা মেয়েকে জীবন্ত লাশে পরিণত করে তুলে। তুই কি চাস তোর পুচকিকে তিলে তিলে শেষ করতে?
অহনার বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের অন্তরালের ঝড় হওয়া বইতে লাগলো। বুকের বা পাশে হাত দিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল সে। মুহূর্তেই অসহায় কন্ঠে বলল,

–এরকম কথা বলিস না অহনা। আমি যে আমার কলিজাকে আঘাত দিয়ে বাঁচতে পারব না। আমার পুচকিকে ছাড়া আমি মরতে চাই না। আমি চাই আমার শরীরের চামড়া কুঁচকে যাওয়া পর্যন্ত ওর সঙ্গে বাঁচতে। আমার প্রার্থনা পুচকি যেন আমাকে আরো অনেক গুলো পুচকি উপহার দেয়। আমি সেদিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই।
কথাগুলো বলেই মাথার চুল গুলো মুঠো বন্ধি করে, অহনার সামনে থেকে প্রস্থান করল সমুদ্র।

ঘড়ির কাঁটাতে ছুঁই ছুঁই একটা। খানিক পূর্বে অহনার বাসা থেকে তারা বাসায় এসেছে। মিনিট পাঁচেক পূর্বে সমুদ্র খাবার কিনতে বাইরে গিয়েছে। থেট সহকারে মেহেরকে দুপুরের রান্না করতে নিষেধ করে দিয়েছে সমুদ্র। এখনো অবধি সকিনা বেগমদের আগমন ঘটে নি। অবশ্য মেহের তাদের কথা জানেও না। কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পেরেছে সমুদ্রের অহনার বাসা থেকে আসার পর থেকেই কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪০

সমুদ্রের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মেহের রান্না ঘরে পা রেখেছে। সমুদ্রের চিন্তায় মগ্ন থেকে মুচকি হেসে কাজে ব্যস্ত ছিলো সে। হঠাৎ তার কর্ণপাত হলো কলিং বেলের ধ্বনি। সমুদ্র চলে এসেছে ভেবে দ্রুত গিয়ে ড্রোর খুলে দিলো সে। তৎক্ষণাৎ ওয়েস্ট পোশাক পরিহিত মেয়ে খোপ করে মেহেরকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা কান্না মাখা কন্ঠে বলতে লাগলো,
— সমুদ্র কোথায়? আই নিড সমুদ্র,,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪২