তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৪

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৪
Lutful Mehijabin (লেখা)

পরিশেষে কম্পমান আঙুলের স্পর্শে বর্ষণের নম্বরে কল দিলো সে। তার হাত পা প্রচন্ড কাঁপছে। বক্ষ পিঞ্জরের হৃদয় স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটতে! তার মনে হচ্ছে একটু পরেই নিঃশ্বাস আটকে মারা যাবে সে। অবশেষে কানের নিকটবর্তী ফোন নিলো। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে ঠিক করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে রিনিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন রিসিভ করল কেউ। তৎক্ষণাৎ জারা ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে অস্ফুটে স্বরে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো,
–হ্যা,,লো,,,

ওপার হতে কারো কন্ঠস্বর আভাস পেলো না জারা। তার হাত পা ব্যাপকভাবে কাঁপছে! শরীর শীতল হয়ে এসেছে। শরীর স্বাভাবিক রাখার প্রয়াসে ওষ্ঠ জোড়া দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো সে। কিন্তু তাতেও কম্পন থামার নাম গন্ধ নেই। প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক নিরবতা পালন করলো ফোনের দু পাশে থাকা দু জন ব্যক্তি। একপর্যায়ে জারা অনুভব করতে পারল তার বর্ষণের ত্যাগ কৃত নিশ্বাস। দু জন মানবীর নিশ্বাশ ভারী হয়ে এসেছে! হঠাৎ ফোনের ওপাশ ওপাশ থেকে ভারী কন্ঠে উত্তর এলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— কেমন আছেন মিসেস ইয়াদ?
প্রচন্ড ঝাঁজালো কন্ঠস্বর। যে কন্ঠস্বর হতে নির্গত প্রতিটি বাক্যে মিশে রয়েছে একরাশ ঘৃণা। জারার উপর প্রচন্ড ঘৃণা জমে রয়েছে ব্যক্তিটার হৃদয় গহীনে। বাক্যটা জারার কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র, গাল ভাসিয়ে দু ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে বিসর্জন হলো। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ হতে ফির বর্ষণ বলে উঠলো,

–আপনি তো ভালোই আছেন। থাকবেন না কেন, আপনার পুরোনো প্রেমিক যে আপনার কাছে ফিরে এসেছে। থার্ড ক্লাস গ্যাল! লজ্জা করে একসঙ্গে তিনজন ছেলের জীবন নিয়ে খেলতে?

অতিরিক্ত ক্রোধের সহিত কতগুলো অনর্গল বললো বর্ষণ। মুহূর্তেই জারা অবাকের চরমে পৌঁছে গেলো। বিশ্বাস হচ্ছে না, বর্ষণের বলা কথাগুলো। জীবনে তার বড্ড অভিপ্রায় ছিলো একবার হলেও বর্ষণের কন্ঠস্বর কর্ণপাত করার। আজ প্রায় তিন বছরের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। সে আজ প্রথম বারের মতো বর্ষণের কন্ঠস্বর শুনলো। এতে তো তার আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু সে আনন্দিত নয় বরং বড্ড ব্যথিত!

লোকটা যে তার সঙ্গে উপেক্ষা কৃত কন্ঠে কথা বলছে। শুধু উপেক্ষা নয় তার উপর মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে। যেখানে জারা নিজে অভিযোগ প্রদান করবে সেখানে তার উল্টোটা দৃশ্যমান হচ্ছে। জারা চালেও এর প্রতিবাদ করতে সক্ষম হচ্ছে না। তার গলা আটকে এসেছে। শত চেষ্টা করেও মুখশ্রী হতে একটি বাক্য ও নির্গত করতে পারছে না। শুধু মাত্র তার চোখের জল বাধাহীন অবাধ্য হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কয়েক মিনিটের মাঝেই জারার চোখ যুগল জলে ভর্তি হয়ে উঠেছে। ঝাপসা হয়ে এসেছে তার দৃষ্টি শক্তি। অতঃপর বর্ষণের বলতে লাগল,

–জানো জেবু, আমার না ঘৃণা হয় নিজের উপর। দুনিয়ারতে কী মেয়ের অভাব ছিলো। আল্লাহ কেন তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ সৃষ্টি করলো? কেন তোমার মতো ছলনা ময় নারীর প্রেমে পড়ালো? কেন আমার জীবনেও প্রেম কলঙ্কের গোটা গোটা দাগ তৈরি করে দিলো? তুমি একজন বিশ্বাস ঘাতক।

জানো,আমার অন্তরালে বারংবার বলে তুমি একজন খুনি। খুনির তো শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু আমি কীভাবে তোমার শাস্তির ব্যবস্থা করবো, বলো তো? যে মেয়েটা আমার হৃদয় ধারাল ছুড়ি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করেছে আমার হৃদয়ের পুরোটা জায়গা জুড়ে। তাকে আমি কী করে শাস্তি দেবো! আমি যে নিরুপায়।

এই ধরনীর বুকে এমন কোন বিচার প্রতি নেই যে কিনা তার শাস্তির ব্যাবস্থা করে দিবে। কেউ নেই। সবাই আমাকে মিথ্যেবাদী বলবে। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না।

কথাগুলো একবারে বলেই জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো বর্ষণ। তার নিঃশ্বাসের পরিমাণ মাত্রার অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। খানিক স্তব্ধতা পালন করলো তারা। জারা চোখ বুজে কান্না করছে অবিরাম! কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। বর্তমানে বাক প্রতিবন্ধী তালিকায় নাম লিখিয়েছে সে। অবশেষে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বর্ষণ ঘৃণা ভরা কন্ঠে পুরনায় বলতে লাগলো,

— এই মেয়ে কোন কথা বলছো না কেন? তোমার কাছে আমার জবাব চাই। আমার প্রশ্নের উত্তর দেও। তুমি আমাকে ঠকিয়েছো মেনে নিলাম। নিজ প্রেমিককে ধোঁকা দিয়েছো তাও মেনে নিলাম। কিন্তু তাই বলে ইয়াদের ঘাড়ে চাপলে কেন? ও কী করেছিল? বেচারা তো নিরপরাধ। ওকে কেন বিয়ে করলে? কেন ওর সারাটা জীবন ধ্বংস করে দিলে? আনসার মি,,,, হেই স্টুপিড গ্যাল আনসার মি?

আর সহ্য করতে পারলো না জারা। তার উদ্দেশ্যে ছিলো সে হাজারো কৈফিয়ত চাইবে, বর্ষণের নামক ব্যক্তির নিকট। কিন্তু এ বর্ষণ তো তাকেই বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করলো! তাহলে কী তার অতীতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল? লহমায় জারার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা ধপাস করে আছড়ে পড়লো মেঝেতে। একপায়ে ফোন ধরার শক্তি হারিয়ে বসলো। মুহূর্তেই দিশেহারা হয়ে মেঝেতে বসে পড়লো সে। পরিশেষে চোখ মেলে অনুভূতিহীন নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেঝেতে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমের এক কোণে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন শোয়াইব খান। চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছেন তিনি। অসম্ভব হয়ে উঠেছে তার অন্তরাল! পুরোনো অতীত যেন স্পষ্ট ভেসে উঠছে তার চোখের পাতায়। মেহেরকে দেখার পর থেকে তার রাতে নিদ্রা হারাম হয়ে গেছে।

মেহেরকে দেখার পর থেকেই তার অন্তরে ভীষণ অদ্ভুত অনুভূতির জাগ্রত হয়েছে। অচেনা একটা মেয়েকে একটিবার দেখেই অদৃশ্য মায়ায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে সে। তার মনে হচ্ছে আবার যদি মেয়েটাকে দেখতে পেতো সে! তার আফসোস হচ্ছে বারবার। ইশ, যদি মেয়েটার সঙ্গে সেদিন সে কথা বলতে পারতো। কেন কর্ণপাত না সেদিন মেয়েটার কন্ঠস্বর। কেন সেদিন তোতা পাখিটার সঙ্গে কিছুটা সময় পার করলো না?

তিনি আনমনে মেহেরকে তোতো পাখির নামে ভূষিত করেছেন। কেন করছেন তাও তার নিকট অজানা। মেয়েটার চেহারার সঙ্গে তার খুব কাছের মানুষের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। প্রায় বছর ষোলোক পূর্বে যে নারীর সঙ্গে ছলনায় মত্ত ছিল সে। যাকে দিশেহারা করে, একা ফেলে চলে এসেছেন তিনি। সে অবলা নারীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে মেহেরের মুখশ্রী! এ যেন তার স্ত্রী কল্পনার অবিকল রূপ।

এতে করে নিজের উপর অত্যধিক বিরক্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। তার মনে আবার মায়া দয়া উদয় হলো কবে? সে তো নির্দয় ,কঠোর মনের ব্যক্তি। তার হৃদয় যে বিন্দু পরিমাণে ও মায়া দয়া ছিলো না। তাহলে কেন মেহেরকে দেখে দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। বিশ্বাস ঘাতকদের ও বুঝি আত্মগ্লানি হয়!

চেয়ার থেকে লহমায় উঠে দাঁড়ালেন শোয়াইব খান। তৎক্ষণাৎ দ্রুত জানালার সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে সারা ঘর আলোকিত করে তুললেন। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে না উঠে ,অবশেষে পুরনো অতীত ঘাটাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। টেবিলের গোপন ড্রয়ার থেকে ডায়রি বের করলেন। মেহেরের সম্পন্ন তথ্য কালেক্ট করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। আজ যে করেই হোক মেহেরের সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ না করে শান্ত হবেন না তিনি। সে উদ্দেশ্যে ফোনটা হাতে নিয়ে কাউকে কল করলেন।

অবসন্ন বিকেল। ঘড়ির কাঁটাতে ছুঁই ছুঁই পাঁচটা। সাফাত স্যার বিদায় নিয়েছেন খানিকক্ষণ পূর্বে। সমুদ্র এখন অবধি বেলকনিতে অবস্থান করছে। এতোক্ষণ কাজে ব্যস্ত ছিলো সে। কিন্তু বর্তমানে মেহেরকে কর্মে ব্যস্ত করে প্রকৃতি বিশাল করতে মেতে উঠেছে সে। স্যার প্রস্হান করার সঙ্গে সঙ্গেই মেহের কে কফি তৈরি করতে নিয়োজিত করেছে সমুদ্র। এর পিছনে অবশ্য তার একটা উদ্ভুদ উদ্দেশ্যে রয়েছে। সে চাই কফি দেবার জন্যে অবশ্যই বেলকনিতে আসতে বাধ্য। এতে করে কিছুটা মুহূর্তে একসাথে অতিবাহিত করতে পারবে। ভেবেই মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মাথা নিচু করে বেলকনিতে প্রবেশ করলো মেহের। সমুদ্রের নিকটবর্তী হলেই যে তার বড্ড ভয় হয়। অযথাই একরাশ অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরে। ভীতি গ্রস্ত মুখশ্রী নিয়ে সমুদ্র সামনে কফির মগটা ধরলো মেহের। তৎক্ষণাৎ মেহেরের হাত থেকে কফির মগটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো সমুদ্র। এক চুমুক দিয়ে অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
— আই হোপ তোমার নিউ টিচার বেশ ভালোই পড়ান। তারপরেও পড়া না বুঝলে অবশ্যই আমাকে ইনফর করবে। অন্ডারস্টান্ড!

সমুদ্রের বলা বাক্যের প্রত্ত্যতুরে মেহের দ্রুত বলে উঠলো,
— আচ্ছা। আমি তাহলে এখন আসি।
বলেই এক পা স্বল্প প্রসারিত করলো মেহের। কিন্তু পা যুগল ধাবিত করার পূর্বে সমুদ্র শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
— কোথাও যাওয়া হবে না আপনার। আপনি এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আমি না বলা পর্যন্ত এক আপনার পা যেন না নড়ে। ইটস মাই ওডার।

তৎক্ষণাৎ থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মেহের। সমুদ্র কেন বুঝে না তার শুধু মাত্র আপনি বলে সম্বোধন মেহেরকে অস্থির করে তুলে। মেহেরের হৃদয় স্পন্দন দ্বিগুণ করে তুলে! অদ্ভুত রহস্যময় অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরে। শুধু মাত্র সমুদ্রের বলা একটি মাত্র শব্দে! তাও কেন যে সমুদ্র বারংবার তাকে বিভ্রান্তে ফেলে।
কফির মগটা পাশ্ববর্তী রেখে মেহেরের মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করলো সমুদ্র। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কুল পুচকি। আমি কী বাগ না ভাল্লুক!

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৩

সমুদ্রের উত্তরে মেহের ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে নিম্ন কন্ঠে মিনমিন করে বলে উঠলো,
— না না। আমি ঠিক আছি তো।
মেহেরের উত্তর পেয়ে সমুদ্র হঠাৎ বলে উঠলো,
–তাই? ওকে, নাও আই নিড প্রুভ। সো ওড়নাটা খুলো তো!কুইক,,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৫