তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৬

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৬
Lutful Mehijabin (লেখা)

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই বরোটা। ক্ষুদ্র পরিসরের বদ্ধ একটা রুমের ভেতর থেকে কারো নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে চোখ যেন ধোঁয়াশা হয়ে উঠেছে! স্বল্প ভাঁপসা পচা দুর্গন্ধ রুমটার চারদেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে। হবেই বা না কেন!

এই ছোট রুমটাতে তিন দিন যাবত একটা ছেলেকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ছেলেটা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় ঝিমুচ্ছে। এই কয়ে কদিনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন তাকে কাহিল। প্রতি ক্ষনে ক্ষনে সে মৃত্যুর সংস্পর্শে গিয়ে ও বেঁচে আছে সে। কঠোর নির্যাতন তাকে মৃত্যুর সম্মুখীন করালেও মুখ দিয়ে একটি বাক্য ও নির্গত করছে না। ব্যথায় আর্তনাদ তুলছে কিন্তু তার মুখ টু শব্দ বের করতে নারাজ!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ দরজা চাপানোর মৃদু আওয়াজে কেঁপে উঠলো ছেলাটি। এখন তাকে পুনরায় আবার নির্যাতন সহ্য করতে হবে। এতো গুলো দিন রিমান্ডে থেকে ও মুখ দিয়ে টু শব্দ ও নির্গত করে নি ছেলেটি। কারো পায়ের আওয়াজ ক্রমশ ছেলেটার হৃদয় স্পন্দন বৃদ্ধি করে তুলছে। আচমকা ডিম লাইটের আলোতে পুরো রুম খানিক আলোকিত হয়ে উঠলো।

ছেলেটি পুনরায় চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। তিনদিন যাবত অন্ধকার অবস্থান করে তার চোখ যেন ঘোলাটে হয়ে এসেছে। চোখ মেলে তাকাতে প্রয়াস চালালো সে। কিন্তু চোখ যেন তার ব্যাথায় টনটন করছে। অনুভব হচ্ছে কোন আঠালো বস্তু তার চোখে আষ্টেপিষ্টে জায়গা করে নিয়েছে। মুহুর্তেই ছেলেটা স্বল্প কেঁপে উঠলো। কলিজা কাঁপানো কন্ঠস্বর ভেসে উঠলো তার কুর্ণকুরে,

— মিস্টার পারভেজ, এখনো সমাই আছে আপনি জবাব বন্ধি দিন। সত্যিটা বলুন। আপনি কেন আমাকে খুন করতে চান?
গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনেও ছেলেটার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ভয় পেয়েও সে একরাশ শাহস বজায় রাখার কর্মে ব্যস্ত! ভয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে সে।

প্রায় মিনিট পাঁচেক ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করলো ইয়াদ। একজন আর্মি অফিসার হওয়ার সুবাদে রিমান্ডে কোন দায়িত্ব না থাকা সত্ত্বেও ছেলেটার জবানবন্দী নিতে সে এসেছে! এখানে অবশ্যই তার স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু ছেলেটার কোন হেলদোল না দেখে ক্রোধ চেপে বসেছে ইয়াদের মস্তিষ্কে। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ রাখার প্রয়াস চালালো সে। হঠাৎ পাশে থেকে লাঠি নিয়ে ছেলেটার চোয়াল স্পর্শ করে দাঁত দাঁত চেপে বলে উঠলো,

–এই কুত্তা, তুই নিজে মরলে মরবি তাই বলে আমার জেবুকে কেন ফাঁসাতে চায়ছিস?আই নো তোর প্রাক্তন প্রেমিকা ছিলো জেবু। তোরা দু জন মিলে আমাকে ঠকিয়েছিস। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না আমার জেবু তোর অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। সত্যি বল তোর পিছনে কার হাত রয়েছে?

ইয়াদের প্রত্যুত্তরে ভয়ঙ্কর পৈশাচিক হাসি হেসে উঠলো পারভেজ। তার গায়ে শক্তি অভাব। এতোটা নির্যাতন সহ্য করেও মুখ দিয়ে টু শব্দ বের করছে না পারভেজ। ইয়াদের সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে উঠেছে। মুহুর্তেই সে লাঠি দিয়ে ইচ্ছে মতো সজোরে আঘাত করতে আরম্ভ করলো পারভেজ কে। ইয়াদের হুংকার যেন রুম জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলছে। সে চিৎকার করে বলছে,

–কুত্তা। তুই আমার জীবনে প্রবেশ করেছিস কেন? কেন আমার জেবুকে তুই কেড়ে নিয়েছিস। ভালোবাসার নামে তোরা দু জন আমাকে ঠকিয়েছিস। কান খুলে শুনে রাখ জেবু শুধু মাত্র বর্ষণের। হ্যাঁ আমি ঘৃণা করি আমার জেবুকে। খুব ঘৃণা করি যে ঘৃণার কোন অন্ত নেই। যা বিশাল ওই আকাশের সঙ্গে তুলনা করলেও অপরাধ হবে। কিন্তু তাই বলে আমি জেবুর কোন ক্ষতি সহ্য করতে পারব না। ওকে কোনদিনই ভালোবাসাতে পারব না ঠিকই কিন্তু ওকে কষ্ট দেবার একমাত্র অধিকার আমার।

সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হচ্ছে মেহের মুখশ্রীতে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। বেলা যে অনেক হয়েছে তা তার অজানা। ইতিমধ্যে ঘুমে মধ্যে প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করছে সে। সমুদ্রের কন্ঠস্বর মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছানোর ফলে তার নিদ্রা হাল্ক হয়ে এসেছে।

চোখ জোড়া বন্ধ রাখার প্রয়াস চালিয়েও ব্যর্থ হলো সে। একপর্যায়ে ধরফরিয়ে উঠে বসে পড়লো সে। তৎক্ষণাৎ তার লক্ষ্য হলো সমুদ্র তাকে ডাকছে। প্রায় মিনিট খানিক লাগলো তার ঘুমের রেশ কাটতে। অতঃপর দেয়াল ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত ফেলল সে। ঘড়ির কাঁটা গোটা গোটা নয় নামক সংখ্যায় এসে থেমেছে। ঘুম থেকে জাগ্রত হতে ব্যাপক দেরি হয়ে গিয়েছে মেহেরের।

অবশ্য দেরি হওয়া স্বাভাবিক। সারা রাত সমুদ্রের অপেক্ষায় ঘুমতে পারে নি মেহের। অবশেষে ফজরের সালাত আদায় করে সকালের দিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সে। বর্তমানে সমুদ্র সম্পর্কে নানান চিন্তার আবির্ভাব ঘটেছে তার হৃদয় মনে। লোকটা প্রায়ই প্রতিদিন রাতে বেলা কোথায় যায় তাকে ফেলে? তার মস্তিষ্কেও নেগেটিভ মন্তব্যের উদ্ভাবন ঘটেছে! অযথা মনের মাঝে সমুদ্রকে হারানোর সুপ্ত ভয় জাগ্রত হয়েছে।

সে তো চাই সমুদ্রকে ভয় না পেতে। কিন্তু পূর্বের তুলনায় সমুদ্রকে দেখে ব্যাপক ভয় পাই সে। কিছুদিন যাবত সমুদ্রের দুর্বলতা বুঝেও চুপচাপ রয়েছে সে। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে কোনদিনই সমুদ্রের নির্ঝর হাসির দেখতে পাই নি সে। লোকটা এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানব! মানুষ এতোটা গম্ভীর হয় কীভাবে তা তার নিকট অজানা। মেহেরে অন্তরালে শুধু মাত্র সমুদ্রের গম্ভীর মুখশ্রীর দৃশ্য ভেসে উঠে।

লোকটা কি কখনোই মিষ্টি করে কথা বলতে পারে না। মেহেরের বড্ড অভিপ্রায় জেগেছে সমুদ্রের খিলখিলিয়ে হাসি দেখবে সে। কিন্তু লোকটা যে হাসির নামই নেই না। মেহের ভাবে সে যদি একবার বলে সমুদ্রকে হাসতে। বিষয়টা বোধহয় বোকামি বৈকি অন্য কিছু নয়। আবার উল্টো বকা খাবার আশংকা রয়েছে! সমুদ্র মেহেরকে গভীর চিন্তায় মত্ত দেখে বিরক্ত হয়ে উঠলো। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

— বাহ্ পুচকি দেখি এক দিনে বড়ো হয়ে গিয়েছে! আমার বকা তার মানে কাজে এসেছে।
সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই মেহের থতমত খেয়ে গেলো। বাক্যের গুলো দ্বারা সমুদ্র কি বুঝিয়েছে তা বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো মেহেরের। মুহুর্তেই মেহের লজ্জায় লজ্জিত হয়ে উঠলো। রাতে সে চুল গুলো না বেঁধেয় ঘুমিয়েছিল। ফলে চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার। তার উপর মাথায় ঘোমটা দেয় নি সে‌। তৎক্ষণাৎ মাথায় ঘোমটা দেবার উদ্দেশ্যে চুল গুলো বেঁধে নিলো সে। কিন্তু ঘোমটা দেওয়া পূর্বে সমুদ্র ভারী কন্ঠে বলে উঠলো,

— বলেছি না আমার সামনে আমি যেভাবে বলল ঠিক সেই ভাবেই থাকতে হবে তোমাকে। আমার সামনে যে ওড়নাটা দিয়ে তুমি মাথায় কাপড় দিবে। আমি ঠিক সেই ওড়নাটা ছুড়ে ফেলে দিবো। সো নিশ্চয়ই তুমি তোমার ওড়না হারাতে চাও না। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড। নাও গো টু বাত। স্কুলের জন্য তৈরি হও।

সমুদ্রের কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। চশমাটা মুঠোয় করে রেখেছে সে। চোখে দেওয়ার সাহস হচ্ছে না। কারন চশমা পড়লেই সমুদ্রকে স্পষ্ট দেখতে পারবে সে। কিন্তু এখন সে সমুদ্রকে দেখতে চাই না।
মেহেরের অবস্থা পরিলক্ষিত করেই শুকনো ঢোক গিললো সমুদ্র। মেহেরের সদ্য ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে উঠা মুখশ্রী তার হৃদয়ে অশান্ততার আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।

সামান্য পিচ্চির ঘুম মাখা মুখশ্রী তার হৃদয় স্পন্দন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে! অদ্ভুত হলেও বিষয়টা চিরন্তন সত্য। সমুদ্র মতো একজন সাহসী সিআইডি অফিসার এখন অস্থির হয়ে উঠেছে ক্ষণে ক্ষণে। মাঝে মাঝে নিজের উপর বড্ড হাসি পাই তার। পৃথিবীতে কতো মানুষ। অথচ পুচকিকে ছেড়ে সে বাঁচার কথা ভাবলেই তার বুকটা ব্যথা করে উঠে। স্বল্প ব্যথা নয় বরং ব্যাপক ব্যথা। নিজেকে একজন নিষ্ঠুর ব্যক্তি ভাবে সমুদ্র ।

কারন সে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। তারচেয়ে বড়ো কথা এই ধরনীর বুকে সে ব্যতীত তার পুচকিটার আর কেউ নেই। এই পরিস্থিতিতে জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভাবলেই তার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠে। সত্যিই তো তার পুচকিটা তাকে হীনা ভীষণ অসহায়। প্রায় মিনিট পাঁচেক মেহের তীর্যক চাহনিতে পর্যবেক্ষণ করলো সমুদ্র। দিন দিন মেহের নামক অনুভূতিতে অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পড়ছে সমুদ্র!পরিশেষে নিজেকে ধাতস্থ রাখার প্রয়াসে রুম থেকে প্রস্থান করাটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করলো সে। সেই অনুযায়ী পা জোড়া ধাবিত করলো। যাওয়ার পূর্বে মেহেরকে উদ্দেশ্যে করে বলল,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৫

— তোমার জন্যে আমি ওয়েট করছি। তাড়াতাড়ি রেডি হও। আর হ্যাঁ রান্না ঘরের আশেপাশে ও তোমাকে যেন ঘেঁসতে না দেখি। আর হ্যাঁ,,,,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৭