তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৮

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৮
Lutful Mehijabin (লেখা)

— আচ্ছা মেহের একটা কথা বলতো। সত্যি করে বলবি কিন্তু। স্যার কি রাতে তোর সঙ্গে ঘুমান?
দিশানির এহেন প্রশ্নে বিব্রত বোধ করলো মেহের। লজ্জায় মেয়েটার গাল যুগলে রক্তিম ধারণ করে উঠেছে ইতিমধ্যে! প্রায় মিনিট খানিক পার হয়ে গিয়েছে দিশানি এখনো প্রত্যুত্তরে অপেক্ষায় মেহেরের মুখশ্রীতে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে তিতাস বিরক্তের চরমে পৌঁছে গিয়েছে। তৎক্ষণাৎ সেবিরক্তের চোখ মুখ কুঁচকে দিশানির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— ওই মেয়ে চুপ থাক। তোদের এই মেয়েলি প্যাঁচাল আমার সামনে করবি না। দূর হ এইখান থেকে।
তিতাসের কথা শুনে দিশানের মুখশ্রী প্যংশুটে বর্ণ ধারণ করে উঠলো নিমিষেই। অতঃপর তিতাসের নিকটবর্তী এসে চিৎকার করে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— তোর সমস্যা হলে তুই কান বন্ধ করে রাখ। আমাকে কিছু বলবি না। একবারে মেরে ফেলবো তোকে।
দিশানির কথার প্রেক্ষিতে তিতাস ক্রোধের সহিত বলে উঠলো,
— ফাল্তু পোলাপান!

তিতাসের কথাই অত্যধিক চোটে গেলো দিশানি। এরপর আরম্ভ হয়ে গেলো নিত্যদিনের ন্যায় তাদের বিখ্যাত তর্ক বিতর্ক। বিষয়টা পরিলক্ষিত করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মেহের। আজ ভীষণ আনন্দিত তার হৃদয়মন। খানিক পূর্বে দিশানির প্রশ্নে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তিতাসের উপকার পেয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। বর্তমানে তিতাস এবং দিশানির ঝড়গা দেখে হাসি চেপে রাখতে ব্যর্থ হলো মেহের। তার প্রাণচ্ছল হাসির ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলছে! কতোদিন পরে মন খুলে হাসছে সে!

অন্যদিকে কেউ যে আড়াল থেকে তার পুচকিকে হাসি দেখছে তা মেহেরের অজানা! দরজার সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্র। বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হাসতে দেখে তার হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠেছে। মেহের হাস্যরত অবস্থায় দেখে তার বুকের ভেতর হিম শীতল হাওয়া বইছে। পরম শান্তিতে মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে রেখেছে সমুদ্র।
মেহেরকে হাসতে দেখে তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। ইশ,তার পুচকিটাও খিলখিলিয়ে হাসতে জানে! এতো দিনে সমুদ্রের অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটলো। লোকে বলে স্বামীর প্রতিচ্ছবি স্ত্রীর মাঝের স্পষ্ট ফুটে উঠে। কথাটা চিরন্তন সত্য।

স্বামী যেমন চরিত্রের অধিকারী হবে স্ত্রী ঠিক একই চরিত্রের অধিকারী হবে। তা ভালো হোক বা মন্দ। সমুদ্রের প্রতিচ্ছবি যেন মেহেরের মধ্যে স্পষ্ট! সমুদ্র কখনো মেহেরকে তার সমবয়সী মেয়েদের মতো মন খুলে হাসতে দেখে নি। সমুদ্রের ধারণা মেহের প্রাণচাঞ্চল্য নয় বরং গম্ভীর প্রকৃতির। একদমই হাসতে জানে না। কিন্তু সমুদ্রকে ভুল প্রমাণিত দিলো মেহের। তার খিলখিল হাসি যেন একদম সমুদ্রের বুকে গিয়ে বিঁধছে।

তিতাস এবং দিশানি ঝগড়া করতে এতোটাই বিভোর যে মেহেরের হাসি তাদের পরিলক্ষিত হলো না। কিন্তু আচমকা স্তব্ধ হয়ে পড়লো তিতাস। দিশানি তার মতো বকবক করতে ব্যস্ত। একটা সময়ে তিতাস নানান অঙ্গভঙ্গি করে দিশানিকে থামতে বলো। কিন্তু দিশিনি চুপ হবার মেয়ে না। তিতাসের নিরবতা দেখে হাল্কা হেসে বলে উঠলো,
— ওই চুপ করে আছিস কেন? জানিস আমার সাথে তুই তর্কে জিততে পারবি না। তাহলে কেন শুধু শুধু আমার মুড খারাপ করতে আসিস?

দিশানির কথার শুনে শুকনো ঢোক গিললো তিতাস। খানিক পূর্বে সমুদ্রের উপস্থিতি টের পেয়েছে সে। এমনত অবস্থায় ভীষণ ভয় পাচ্ছে সে। অতঃপর পরিবেশের প্রেক্ষিতে তিতাস ভদ্রতার সহিত সমুদ্রকে বলে উঠলো,
–স্যার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।

হঠাৎ সমুদ্র নামটা মেহেরের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই মেহেরের হাসি উধাও হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে দরজার দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো সে। তৎক্ষণাৎ দিশানিও থতমত খেয়ে গেলো। মুহূর্তেই তার মুখশ্রীতে চিন্তার প্রাদুর্ভাব ঘটলো। মাথা নিচু করে চোখ বুজে প্রতিনিয়ত বিরবির করে দোয়া পড়তে লাগলো।‌

আকস্মিক তিতাসের ডাকে বিরক্তি ভাঁজ দেখা দিলো সমুদ্রের মুখশ্রীতে। তিতাসের প্রতি অতিরিক্ত বিরক্ত সে! ফলে তার মুখ হতে বিরক্তির ‘চ’ শব্দ নির্গত হলো আপনি আপনি। বিরক্তি হাওয়াটাই স্বাভাবিক। আজ তিতাসের জন্য তার পুচকিটা হাসি বন্ধ করে ফেলছে। অতঃপর সমুদ্র নিজের ধাতস্থ রাখার প্রয়াসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন তার নিজকে নিয়ন্ত্রণ রাখা বড্ড প্রয়োজন। তাই চোখ জোড়া এক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ করে নিজকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে প্রয়াস চালালো সমুদ্র। লহমায় সে দ্রুত প্যান্টের পকেটে দু হাত হাত গুজে সোফায় উপর এসে আয়েশ করে বসলো। অতঃপর দিশানি এবং তিতাসকে বসতে বলে মেহেরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— গো পুচকি। দেখো, টেবিলে উপর খাবারের প্যাকেট রাখা আছে। যাও গিয়ে খাবার সার্ভ করো। একটু পর আমরা আসছি।
সমুদ্রের আদেশ পেয়ে এক মুহুর্তের জন্যও অপেক্ষা করলো না । মাথা নিচু করে রুম হতে প্রস্থান করলো। যাওয়া পূর্বে তিতাস এবং দিশানির দিকে একপল তাকিয়ে পা জোড়া ধাবিত করলো। বরাবরের ন্যায় সমুদ্রের কথা শুনে তার হৃদয় গহীন অশান্ত হয়ে উঠেছে। বারংবার তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনি তুলছে দিশিনির বলা অদ্ভুত বাক্যে! এতে করে বেশ দ্বিধা,সংকোচ,সংশোয় আবির্ভাব ঘটেছে তার অন্তরালে। দিশানিকে কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না মেহের।

সোফার উপর বসে আকস্মিক সমুদ্র দিশানিকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠলো,
— দিশানি, কাম হেয়ার।
তৎক্ষণাৎ দিশানি চমকে উঠলো। তিতাস বসে পড়েছে ঠিকই কিন্তু দিশানি এখন অবধি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে। দিশানির পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সমুদ্র বলে উঠলো,
–আজব তো! আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছো কেন?
সমুদ্রের প্রত্যুত্তরে দিশানি ঝটপট জবাব দিলো,
— সরি স্যার।

দিশিনির কথা শুনে তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করলো সমুদ্র। অতঃপর হেঁয়ালি না করে বলল,
— তোমার আম্মু তোমাকে বাসায় ড্রফ করে দিয়ে আসতে বলেছে। তোমার নানু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই তোমাকে যেতে হবে।
সমুদ্রের কথা শুনে নিমিষেই দিশানির মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,

— ঠিক আছে চলুন স্যার।
— তিতাস তুমি কি থাকবে?
সমুদ্রের কথার প্রত্যুত্তরে তিতাস বলল,
— স্যার আজ নাহয় আমি ও আসি।

অন্যদিকে ভীষণ চিন্তা গ্রস্থ হয়ে পরেছে রাফু। তার চিন্তার যেন শেষ। এবার খুব করে প্লান করেছিল জারাকে ফাঁসিয়ে ইয়াদকে পুনরায় ছটফট করে দেখবে। সেই অনুযায়ী পারভেজকে দিয়ে ইয়াদকে মারার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারভেজ আটক হওয়াতে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সে! ভয় করছে তার যদি পারভেজ ভুল বশত সত্যিটা ইয়াদকে বলে দেই।

তাহলে তো জারা সবকিছু জেনে যাবে। সেও তার বর্ষণের খোঁজ পাবে। বর্ষণ আর ইয়াদ যে একই ব্যক্তি বিষয়টা বিয়ের পরেও ইয়াদ গোপন করেছে জারার কাছে থেকে। হয়তোবা জারা যদি জানতে পারে ইয়াদই তার অতীতের প্রেমিক বর্ষণ তাহলে সে কোনদিনই ইয়াদকে ক্ষমা করতে পারবোনা। কারন ইয়াদ একজন স্পষ্ট মিথ্যাবাদী। ইয়াদের উচিত ছিলো জারাকে খুলে বলা। কিন্তু সে বলে নি।

পারভেজ সত্যি বলে দিলে ইয়াদ ঠিকি বুঝে যাবে তিন বছর পূর্বে যে ম্যাসেজ গুলো তাকে জারা পাঠিয়েছিল , সেগুলো যে জারা নয় বরং রাফু টাইপিং করেছিল তাও ইয়াদ স্পষ্ট বুঝে যাবে! এই চিন্তায় রাফু পাগলপ্রায়। জারা আর ইয়াদ সত্যটা জানতে পারলে নিজেদেরকে মধ্যে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা দূর করতে উঠে পড়ে লাগবে।

জারা কিছু করুক আর না করুক ইয়াদ নিজের চোখের জল বিসর্জন দিয়ে হলেও জারার মনে ফির জায়গা করে নিবে। তাছাড়া ইয়াদ রাফুর শাস্তির ব্যবস্থা করবে নিশ্চিত। বিষয়টা খানিকক্ষণ যাবত ভাবছে রাফু। আর বিরবির করে নিজে নিজেকে বলছে,
— পজেটিভ ভাব রাফু। কিছু হবে না তোর। পারভেজ মরে গেলেও কিছু স্বীকার করবে না। কারন ওর দুর্বলতা আমার কাছে। কিছু হবে না। নো টেনশন রাফু।

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই আটটা। মাত্র পড়ার সমাপ্তি ঘটিয়ে ড্রইং রুমে খাবার সার্ভ করতে ব্যস্ত মেহের। সমুদ্র কেয়ারে বসে কারো সঙ্গে দরকারি বিষয়ে আলোচনা করছে। দিশানিরা বিদায় দিয়ে সেই দুপুর বেলা লান্স করে। মেহেরের মনটা ভীষণ বিষাদময় হয়ে রয়েছে। একে তো দিশানিরা চলে গিয়েছে দ্বিতীয়ত বিকেলে সাফাত স্যার এসেছিল। স্যারের অঙ্গভঙ্গি তার নিকট অত্যধিক বিরক্তিকর লেগেছে। অবশ্য আজও বেলকনিতে বসে লেপটপ নিয়ে কাজ করছিলো সমুদ্র। এতে করে মেহের নিজেকে ঠিক রাখতে সক্ষম হয়েছে।

খাবার প্লেটে দিকে দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে বসে রয়েছে সমুদ্র। খানিক পূর্বে মেহেরের খাবার খেয়ে হাত পরিস্কার করে বসে রয়েছে। কিন্তু সমুদ্র খাবার না খেয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে। খাবার মুখে নিতে নারাজ সমুদ্র। তার মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব স্পষ্ট। সে ভেবে চলছে, মেহেরের কি বোধগম্য হচ্ছে না তার মনের অবস্থা! সে তো অভিমান করে রয়েছে। তা কেন মেহের আন্দাজ করতে সক্ষম হচ্ছে না।
একপর্যায়ে প্লেট থেকে চোখ সরিয়ে মেহেরের দিকে দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো সমুদ্র। অতঃপর ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৭

— পুচকি, আমি খাবো না।
মেহের সমুদ্রের কথা শুনে থতমত হয়ে পড়লো। পরিস্থিতি মেহেরের বোধগম্য হওয়ার পূর্বে আচমকা কলিং বেল ধ্বনি পেয়ে সমুদ্র চেয়ার থেকে উঠে মেইন ড্রোরের দিকে ধাবিত হলো। যে ব্যক্তি কলিং বেল বাজিয়েছে তার উপর ভীষণ বিরক্ত হলো। লোকটার জন্য সে মেহেরের সঙ্গে একটুও অভিমান করতে পারলো না।
তৎক্ষণাৎ ড্রোর খুলে দিলো সমুদ্র। অপর প্রান্তে শোয়াইব খানকে দৃশ্যমান হতেই পুলকিত হয়ে উঠলো তার হৃদয় গহীন।

তুমি নামক অনুভূতি পর্ব ৪৯