তুমি নামক প্রশান্তি গল্পের লিংক || জেনিফা চৌধুরী

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ১
জেনিফা চৌধুরী

ভার্সিটির অন্ধকার রুমে কোমরের খালি জায়গায় আচমকা কেউ জ’লন্ত সি’গারেট চেপে ধরতেই নিদারুণ যন্ত্রণায় আঁতকে উঠলো বেলি। পা জোড়া থমকে গেলো। এর মধ্যেই এক জোড়া পুরুষের শক্ত হাত বেলির মুখ চে’পে ধরলো। যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগলো। বদ্ধ আর্তনাদ করছে। কেউ শুনতে পারছে না।

সি’গারেটটা হয়তো বেলির কোমরের দিকে ভয়ঙ্কর ক্ষত সৃষ্টি করলো। সিগা’রেটটা ফেলে দিলো পুরুষটা। তৎক্ষণাৎ শাড়ির ভাঁজে হাত ঢুকিয়ে মৃদু চে’পে ধরলো বেলির কোমর। ওর শরীর অটোমেটিক ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করলো। হাতের স্পর্শটা কোমর ছুঁয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে লাগলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অন্ধকারের মাঝে অচেনা পুরুষের লোভা তুত দৃষ্টি বেলির চোখ এড়ালো না। অচেনা পুরুষটা যে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করছে তা খুব ভালো ভাবে বোঝা যাচ্ছে। গা ছিম ছিম লোলুপ স্পর্শটা এবার বেলির গা ঘেঁষে দাড়ালো। তীব্র যন্ত্রণায় মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না ওর। জ্বলে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ।

ঠোঁট চেপে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করলো। চোখ থেকে অশ্রুপাত হচ্ছে অবিরাম। শরীর কাঁপছে বেগতিক হারে। পেছন থেকে মানুষটা দুই হাত দিয়ে বেলির কোমরে জোরে চাপ দিয়ে উঠতেই বেলী শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মানুষটাকে দুই হাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো। মানুষটা ধাক্কা খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো হয়তো? কান্না মিশ্রিত স্বরে বেলি থমকে থমকে বললো,

“কে কে? কে এখানে?”
অন্ধকার নিস্তব্ধ রুমে নিশ্বাসের শব্দ ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছে বেলির কানে। অন্ধকারের পুরুষ মানুষটা এইবার বেলির একদম কাছে চলে আসলো। ভয় ও যন্ত্রণায় নিশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও নিশ্বাস নিতে পারছে না। আজ ভার্সিটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানে বান্ধবীদের আবদার রাখার জন্য শাড়ি পড়ে এসেছিলো।

অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার মাঝে সবাই যখন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত, তখন তানিশা বেলিকে নিয়ে ওয়াশরুমে আসে। তানিশাকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে ও চারদিকটা ঘুরে দেখছিলো। ঘুরতে ঘুরতে এই রুমের মধ্যে আসতেই হঠাৎ দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। আর অন্ধকারেই মাঝে এই বিশ্রী ঘটনা ঘটে। বেলি ভয়ে এক পা এক পা পিছিয়ে যাচ্ছে।

ঢোক গিলছে বারংবার। চিৎকার করার শক্তি পাচ্ছে না। চিৎকার করলেও হয়তো কেউ শুনবে না? কারন, বাইরে ফুল ভলিউমে গান বাজচ্ছে। তীব্র ঘামছে শরীর। থর থর করে কাপুঁনি হচ্ছে সর্বাঙ্গে। পিছিয়ে যাওয়ার সময় কিছুতে শাড়ি আটকে ধপ করে পড়ে যায় বেলি। পড়ে গিয়ে বেঞ্চের কোনায় কপালে তীব্র ব্যাথা পেলো।

মুহূর্তেই ওর মাথা ঘুরতে লাগলো। ব্যাথায় শব্দ করেই আঁতনাদ করে উঠলো। এই মুহুর্তে হয়তো দম আটকেই ম’রে যাবে ও। চোখ দুটো নিভু নিভু হয়ে আসচ্ছে। চারদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পারছে না । অসার হয়ে আসলো শরীরটা। কপালের ব্যাথা জায়গায় হাত রাখতেই হাতে তরল জাতীয় কিছু লেগেছে বলে টের পেলো।

বেলির বুঝতে দেরি হলো না কপালে হয়তো খানিক কে’টে গেছে। উঠে দাড়ানোর শক্তি নেই ওর। তখনি চুলের খোপা জোরালো ভাবে টান খেলো। ব্যাথার শরীর এই সামান্য ব্যাথাটুকু মারাত্নক বেদনা সৃষ্টি করলো। “আহঃ” করে মৃদু শব্দ করে উঠলো।

খোপায় টান পড়তেই বেলির দীর্ঘ ঘন কালো কেশ মাটিয়ে বিছিয়ে পড়লো। এক জোড়া শীতল হাত গলা চে’পে ধরলো। দম আটকে যেতেই কেশে উঠলো ও। কাশির শব্দ শুনে হাত জোড়া আলগা হয়ে এলো। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কেউ ভয়ংকর ধ্বনি সৃষ্টি করলো। বেলিয়ার কানে মানুষটার ঠোঁটের ছোঁয়া লাগছে। রাগ, ক্ষোভ আর তীব্র আকাঙ্ক্ষা মিশ্রিত কন্ঠস্বরে কেউ বললো,

“তোমার মেদহীন ফিগার নেশা ধরিয়ে দিয়েছে আমার। তোমাকে কাছে পাওয়ার নেশায় ডুবে যাচ্ছি আমি প্রতিনিয়ত। তাইতো বিছানায় পাওয়ার আশায় না থেকে এখানেই কাজটা সেরে ফেলতে চাচ্ছি।”

লোকটার বিশ্রী কথা শুনে ঘৃনা, রাগ, ক্ষোভে বেলির শরীর রি’রি করছে। চোখ থেকে অশ্রু লাগামহীন ভাবে পড়ছে। মনে মনে উপর ওয়ালার কাছে মুক্তি প্রাথর্না করছে। বেলি শাড়ির আঁচলটা শক্ত করে বুকে চে’পে ধরে কান্না করে উঠলো। ওর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দের সাক্ষী হলো ইট, পাথরের দেয়াল। কান্না জড়ানো কন্ঠে ফুঁপিয়ে বললো,

“দয়া করে আমাকে যেতে দিন প্লিজ।”
বেলির কথায় লোকটা হাসলো। শব্দ করেই হাসলো। হুট করে সরে গেলো বেলীর সামনে থেকে। লোকটা সরে গেছে বুঝতে পেরে বেলি দূর্বল শরীর নিয়ে উঠে দাড়ালো। সম্পূর্ণ আঁচল টেনে জড়িয়ে নিলো গায়ে। হঠাৎ করেই রুমে আগুনের ফুলকি দেখা গেলো। এটা লাইটারের আলো।

লাইটারের আলোয় বেলি স্পষ্ট দেখতে পেলো লোকটা অন্য দিকে মুখ করে আছে। লাইট জ্বালানোর কারনটা বুঝতে দেরি হলো না সি’গারেটে বিদঘুটে গন্ধে। তার মানে লোকটা দ্বিতীয়বারের জন্য সিগারেট জ্বালাচ্ছে। জঘন্য, বিদঘুটে গন্ধে চোখ মুখ কুচকে এলো। লাইটারের আলো নিভে যেতেই সম্পূর্ণ রুমটায় আধারে ছেয়ে গেলো পূর্নরায়।

লোকটা সামনে এগিয়ে এসে মুখের ধোয়া গুলো মুখের উপর ছাড়তেই বেলি কাশতে লাগলো। ছোট থেকেই আগুন, পানি, ধোয়া, অন্ধকার, ধূলাবালিতে ওর ফোবিয়া রয়েছে। বেলি জানে এই ধোয়া গুলো ওর মুখে গেলে এক মিনিটের জন্যও জেগে থাকতে পারবে না। হয়তো হাঁপানি উঠে যাবে।

নয়তো জ্ঞান হারাবে। অসহ্যকর, নিদারুণ, যন্ত্রণা ভুলে গেলো এক মুহূতের জন্য। আঁচল দিয়েই শক্ত করে মুখ চে’পে ধরলো। আঁচলটা উপরের দিকে উঠে যেতেই কোমরের দিকটা আবারো খালি হয়ে গেলো। সামনের মানুষটা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো নিশ্চয়ই।

দেরি না করে এক হাতে বেলীকে টেনে কাছে এনে, অন্য হাতে থাকা জ’লন্ত সি’গারেটটা দ্বিতীয় বারের মতো ওর পেটে চে’পে ধরলো। তীব্র যন্ত্রণায় বেলি দ্বিতীয় বারের মতো চিৎকার করে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড অতিক্রম হলো। লোকটা সিগারেটটা ফেলে দিলো। এত ক্ষনে ব্যাথায় বেলির শরীরের শিরা-উপশিরায় যন্ত্রণা ছড়িয়ে গেছে।

হাত পা নাড়ানোর মতো শক্তি নেই। কি দারুন যন্ত্রণা! কি জঘন্য অসরতা! শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি করছে লোকটার সাথে। কিন্তু পেরে উঠছে না। শক্তি দিয়ে লোকটার গলা চে’পে ধরার চেষ্টা করলো দুই হাতে। লোকটা এইবার এক হাতে শক্ত করে বেলির চুল টেনে ধরে ওর গালে থা’প্প’ড় মে’রে বসলো। লোকটা বিশ্রী, জঘন্য হাসি হেসে বেলীর মুখদ্বয়ের সম্মুখে এসে দাতে দাত চে’পে শাসানো গলায় বললো,

“কোনো রকম চালাকি বা জোর দেখানোর মতো ভুল চেষ্টা করো না। তাহলে, সেই ভুলের শাস্তিটাও ভয়ংকর হবে। তোমার মতো কয়েকজনকে সামলানোর জন্য আমি একাই যথেষ্ট ।”

এই কন্ঠ স্বরটা বেলির চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু কে? মনে করতে পারলো না। তীব্র ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে উঠলো শরীর। চোখ দুটো হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। এই কঠিন মূহূতে বেলি বুঝতে পারছে আজ ওকে রক্ষা করার মতো কেউ নেই? কেউ শুনতে পারছে না ওর আর্তনাদ? ঢুলে পড়ে গেলো নিচে। চোখ বন্ধ হওয়া অব্দি উপর ওয়ালার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলো। কয়েক সেকেন্ডেএ ব্যবধানে জ্ঞান হারালো । জ্ঞান হারানো বেলির মনে জানান দিচ্ছে আজ ওর সর্বনাশ হবে। বিশাল সর্বনাশ…।”

“বেলিপ্রিয়া চোখ খোল। দেখ তোর কিছু হয়নি। একবার চোখ খোল প্লিজ। আমি তোর কিছু হতে দিব না। কেনো ভয় পেলি তুই? বাবুই চোখটা খোল না একবার। আমার বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে হচ্ছে রে বেলিপ্রিয়া। একবার চোখ খোল।”
কথাগুলো কাতর কন্ঠে বলার চেষ্টা করলো নীলাভ্র। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না।

নিশ্চল চোখ জোড়া স্থির হয়ে আছে। গম্ভীর ছেলের মুখটায় বিষন্নতা বিরাজ করছে। মুখপানে লেগে রয়েছে আঁতঙ্ক। বুকের ভেতর দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এত কষ্ট কেনো হচ্ছে? কি আছে মেয়েটার মাঝে? ভাবলো কিছুক্ষন। উওর পেলো না। আবার কথা বলতে ও পারছে না। শব্দগুলো কেমন একটা এলোমেলোভাবে জট পাকাচ্ছে।

চোখের কোনে অশ্রু টলমল করছে। পলকহীনভাবে তাঁকিয়ে আছে জ্ঞানহীন বেলীর দিকে। চঞ্চল, হাসিখুশি মেয়েটা হঠাৎ করেই আজ শান্ত হয়ে পড়ে আছে। এটা সহ্য হচ্ছে না ওর। কষ্ট হচ্ছে ভীষন। কাঁদতে চাইছে। পারছে না। চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে বেলিকে। কিন্তু তাও পারছে না। হায় এ কি ভয়ংকর যন্ত্রণা?

এই দহন, যন্ত্রণার শেষ কোথায়? কি বিশ্রী যন্ত্রণা! বেলির মাথাটা ওর কোলে । ওদের ঘিরে রয়েছে কিছু মানুষ। তানিশা ভয়ে কান্না করছে আর বেলির মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। তানিশা জানে যে বেলির ছোট থেকেই অন্ধকারে ফোবিয়া। এভাবে ওর জ্ঞান ফিরবে না। তাই দেরি করলো না। কথা বলার জন্য সাহস জোগালো। কান্না গুলো গিলে নিলো। শান্ত কন্ঠে নীলাভ্রকে শুধালো,

“নীলাভ্র ভাইয়া ওর এভাবে জ্ঞান ফিরবে না। আপনি তো জানেন? প্লিজ দেরি না করে ওকে নিয়ে হসপিটালে চলুন।”
নীলাভ্র হুঁশে এলো। শান্ত নজরে তাকালো তানিশার দিকে। মাথা নাড়ালো। সময় নিলো না বেলিকে কোলে তুলে নিলো। গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ওর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে কিছু ইশারা করলো। ওর ইশারার মানে বুঝতে পেরে সব বন্ধুরা এক সাথে মাথা নাড়ালো। নীলাভ্র মনে মনে আওড়াতে লাগলো,

” আমার ক্যাম্পাসে এসে আমার বেলীফুলের দিকে নজর দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর সাহস যে দেখিয়েছে। সে ভাবতেও পারছে না ওর সাথে ঠিক কি হবে? একবার শুধু আমার ফুলকে সুস্থ হতে দে। তারপর তোর সাথে খেলাটা তো আমি খেলব।”

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২