তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৯ শেষ অংশ

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৯ শেষ অংশ
জেনিফা চৌধুরী

চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে কেঁপে উঠল বেলী। নীলাভ্রর চোখ জোড়া কোটরে ঢুকে গেছে। শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছে! মুখটা ফ্যাকাসে। ঠোঁটে কোনে আজ হাসি নেই। কী হয়েছে ছেলেটার?

ক্ষুধার্ত ব্যক্তি অনেকদিন পর খাবার পেলে যেমন করে হা/মলে পড়ে। তেমনি, প্রায় একসপ্তাহ পর প্রিয় মানুষটাকে দেখে বেলী তার বক্ষস্থলে হা/মলে প/ড়ল। নীলাভ্র ঠাঁই দাঁড়িয়ে। কোনো কথা বলার ভাষা বা শব্দ খুঁজে পেলো না। কোন ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করে বেলীকে নিজের অবস্থা বুঝাবে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেলী শব্দ করে কাঁদছে। নীলাভ্র এখনও দাঁড়িয়ে। নাহ! বেলীকে আকঁড়ে ধরতে গিয়েও পারল না। হাত বড্ড কাঁপছে! ভয় না-কি সাহসের অভাবে? ইশারায় রিকশাওয়ালাকে নীলাভ্র চলে যেতে বলল। শুনসান রাস্তায় হাতে গোনা কয়েকটা রিকশা চলছে।

সকালের মিষ্টি আবহাওয়ায় দুটি মানুষ প্রণয়ের দহনে জ্ব/লছে। বেলী ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেলো। এবার নীলাভ্রর টনক নড়ল। শক্ত করে বেলীকে আঁকড়ে ধরল। স্বান্তনার ভঙ্গিতে বলে উঠল,

“এত জোরে কেউ কান্না করে না-কি ব/লদ? সবাই কী ভাববে বল তো?”
বেলী এবার গর্জে উঠল। নীলাভ্রর শার্ট জোরে খা/মচে ধরল। বক্ষস্থল থেকে মাথা তুলে নীলাভ্রর চোখে চোখ রাখল। বেলীর চোখের দিকে তাকিয়ে নীলাভ্র তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিলো। এই চোখে তাকিয়ে থাকার সাহস নেই। বেলী সেদিকে তাকিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,

“চুপ! একদম চুপ! আমাকে যে যা খুশি ভাবুক। খারাপ ভাবলে আমি খারাপ। ভালো ভাবলে আমি ভালো। আমার খারাপ, ভালো নিয়ে আপনার চিন্তা করা লাগবেনা। কে আমি? কেন ভাববেন আমাকে নিয়ে?

যদি ভাবতেন তাহলে আমার থেকে দূরে যেতে পারতেন না। আপনার যখন ইচ্ছে হবে, আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন। যখন ইচ্ছে হবে, ফিরে আসবেন। কী পেয়েছেন আমাকে? আমি কি মানুষ না? না-কি আমাকে মানুষ বলে আপনি গণ্য করেন না?”

কথাগুলো বলতে বলতে বেলী কেঁদে দিলো। এই মুহূর্তে নীলাভ্রর নিজেকে খুব অসহায় লাগল। কতটা অসহায় হলে একটা মানুষ কিছু বলার থাকলেও চুপ থাকে? বেলীর চোখে পানি গুলো নীলাভ্রকে বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে!

নীলাভ্র কোনো উত্তর না দিয়ে বেলীকে বুকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত করে। মনে হচ্ছে, ছেড়ে দিলে এক্ষুনি পালিয়ে যাবে। বেলী ছোটাছুটি করতে লাগল। তবুও নীলাভ্র ছাড়ল না।

বরং, আরো শক্ত করে জড়িয়ে রাখল নিজের সাথে। এবার বেলী না পেরে, নীলাভ্রর বুকে কি/ল ঘু/ষি যা পারছে বসিয়ে দিচ্ছে। বেলীর কান্ড দেখে নীলাভ্র খানিকটা মুচকি হাসল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠ বলা শুরু করল,

“তুই তো জানিস, যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকে। তাদের কত কী সহ্য করতে হয়? সামনে নির্বাচন। তাই বিপক্ষ দলের মানুষেরা আমাকে ক্ষিপ্ত হয়ে খুঁজছে। হাতের কাছে পেলে আমাকে মে/রে ফেলতেও একবার ভাববে না।

যখন আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তখন আমার ফ্যামিলির উপর আক্রমণ করবে। আমার বড় দূর্বলতা তুই। তাই ওদের ফাস্ট টার্গেট তুই। আমি যদি তোর থেকে দূরে না থাকতাম। তাহলে এতদিনে তুই বা আমি দুজনের একজন মা/র্ডার হয়ে যেতাম।

তাই বাধ্য হয়ে তোর থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। আমি তোদের কাছে থাকলে তোকে বা আমার পরিবার কাউকে রক্ষা করতে পারতাম না। এই এক সপ্তাহ দিনরাত এক করে সমস্যার সমাধান করেছি। সব কয়েকটাকে হাজতে পাঠিয়েছি। এখন আমি আমার পরিবার সবাই বিপদমুক্ত। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু ঢাকাতেই ছিলাম। চট্রগ্রাম যাইনি।”

শেষ কথাটা শুনতেই বেলী বিস্ফোরিত চোখে তাকাল নীলাভ্রর দিকে। ওমনি নীলাভ্র চোখ মা/রল। তা দেখে বেলীর রাগ যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ঢাকা থেকেও মিথ্যা বলেছে। কী সাংঘাতিক! কোমড়ে হাত দিয়ে রাগান্বিত চোখে তাকাল নীলাভ্রর দিকে। দাঁ/তে দাঁ/ত চে/পে বলল,

“মিথ্যা কথা খুব ভালো শিখেছেন, তাইনা?”
নীলাভ্র মুচকি হাসল। শার্টের কলারটা ঠিক করতে করতে ভাব নিয়ে বলল,
“ইট’স মাই পাওয়ার! এই গুণটা সবার থাকেনা।”
ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলল কথাটা বলে। কথাটা বেলীর কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাতেই বেলীর কপাল কুঁচকে এলো। দাঁ/ত কটমট করতে করতে শুধাল,

“আপনি একটা জ/ঘন্যতম ব্যক্তি! মিথ্যা কথা বলে আবার জোর গলায় বলছেন? লজ্জা করছে না আপনার? নি/র্লজ্জ লোক একটা! ”

বলে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। বেলীর রাগ দেখে নীলাভ্র শব্দ করে হেসে উঠল। নীলাভ্রর হাসির শব্দ বেলীর কানে আসতেই রাগে কান গরম হয় গেলো। আঁখি জোড়া রাগে লাল বর্ণ ধারণ করল। পেছন ফিরে দেখল নীলাভ্র কোমড়ে হাত দিয়ে হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার উপক্রম।

হঠাৎ ঝিনঝিনিয়ে উঠল সর্বাঙ্গ। ছেলেটার মুখে হাসি কী সুন্দর মানায়! হাসলে পৃথিবীর কুৎসিত ব্যক্তিটাকেও মা/রাত্নক সুন্দর লাগে! ভালো লাগার ছোঁয়ায় সারা অঙ্গ পুলকিত হলো। চেয়ে রইল এক ধ্যানে।

হাস্যজ্বল মুখপানে তাকিয়ে নিজের সব কষ্ট, অভিযোগ, অভিমান ভুলে গেলো। মুছে গেলো হৃদয় থেকে। ভালোবাসার মানুষটা অন্যায় করলেও ঘৃণা করা যায় না। বড়োজোর ‘ঘৃণা করি’ কথাটা মুখে বলা যায়। কিন্তু, মন থেকে সত্যি সত্যি ঘৃণা করা যায় না।

মানুষটার আড়ালে বুকের ভেতর হাজারটা অভিযোগ জমিয়ে রাখা যায়। কিন্তু দিনশেষে মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে অভিযোগ গুলো প্রকাশ করা যায়না। কী এক অদ্ভুত অনুভূতি!

বেলীকে নিরলস চেয়ে থাকতে দেখে নীলাভ্র থমকালো। মা/দকতার মতো চাহনী মেয়েটার! দেখলেই নে/শা ধরে যাওয়ার মতো। রাগলে মেয়েটাকে আরো সুন্দর লাগে।

আর হাসলে তো বক্ষস্থল চিনচিন করে উঠে। হৃদযন্ত্রটা লাফানো শুরু করে। চারদিকে সব বিষাদ ভুলে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তৃপ্তি সহকারে। হুট করে কোথা থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ কানে আসতেই দুজনের চৈতন্য ফিরে এলো।

ধড়ফড়িয়ে উঠল দুজনেই৷ বেলী একটু লজ্জা পেলো বটে। বেলীর লজ্জানত মুখখানে দেখে নীলাভ্রর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধিরা এসে হা/না দিলো। উচ্চস্বরে অপকটচিত্তে বলে উঠল,

“তোমাকে দেখে আমার বুকের ভেতর ধুপধাপ করে, বেলীপ্রিয়া। তোমার প্রণয়ের দহনে আমি জ্ব/লে, পু/ড়ে ক’য়লা হয়ে যাচ্ছি। আমার বক্ষস্থলের এই জ্বা/লানি একমাত্র তুমি ছাড়া আর কারোর পক্ষা নিভানো সম্ভব না। তুমি আমার জ্বালাময়ী রানী।”

নীলাভ্র এহেন সব অদ্ভুত কথা শুনে বেলীর হাসি পেলেও দমিয়ে নিলো। কপট রাগ দেখিয়ে হাতের মোবাইলটা ছুঁ/ড়ে মা/রল নীলাভ্রর দিকে। নীলাভ্র কেস ধরে নিলো সাথে সাথে। বেলী সেদিকপানে তাকিয়ে মেকি হাসল। জোরেই বলল,
“আপনি এক কাজ করুন। সিনেমায় যোগদান করুন। ভালো উন্নতি করতে পারবেন। অভিনয়ে একদম সেরা! আর ডায়লগ তো মা/রহাবা!”

কথা টুকু শেষ করে। বিড়বিড় করে বলল,
“শা/লা এক নাম্বার পট্টিবা/জ!”
বলে বাসার দিকে পা বাড়াল। আর নীলাভ্র সেখানে দাঁড়িয়ে হাসিতে মত্ত হয়ে পড়ল।

বেলী বাসার ভেতরে ঢুকে যেতেই নীলাভ্রর মুখের হাসিটা গায়েব হয়ে গেলো। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হাহাকার শুরু হলো মুহূর্তেই। এতক্ষণ হাসি মুখে থাকলেও এবার নয়ন জোড়ায় অশ্রু এসে হা/মলে পড়ল। কী এক যন্ত্রণা! এই যন্ত্রণার শেষ কোথায়? কে জানে?

বেলীকে হারানোর ভয়টা মস্তিষ্কের মা/রাত্মক ভাবে ঘা/পটি মে/রে বসেছে। কিছুতেই দূর হচ্ছে না। এতদিন বেলীকে ছেড়ে থাকতে পারছিলো না। কিন্তু, ফিরে আসার কোনো রাস্তাও ছিলো না। সব সময় মন চাইলেই সব পাওয়া যায়না।

যদি মানুষ চাইলেই সব পেয়ে যেতো তাহলে কী আর পৃথিবীতে না পাওয়ার হাহাকার থাকত? আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে নয়ন জোড়া বন্ধ করে নিলো। সাথে সাথে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, চোখের কোন বেয়ে। তড়িঘড়ি করে মুছে নিলো। বুকের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যাথা টের পেলো। নিজে নিজেই বলে উঠল,

“তোকে ছেড়ে আর যাব না, বেলীপ্রিয়া। আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারিনা রে! আমার খুব কষ্ট হয়। আমি এতদিন ভালো ছিলাম না। কিন্তু ফিরতেও পারছিলাম না। এখন যখন একবার ফিরে এসেছি। তখন আর যাব না। প্রমিস। ভালোবাসি, বেলীপ্রিয়া। বড্ড বেশি ভালোবাসি তোকে!”

বলে বেলীর ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করল।

বেলী মুখ গুমরা করে সোফায় বসে আছে। রিতা অনেকক্ষণ যাবৎ একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। কিন্তু বেলী উত্তর দিচ্ছে না। এবার সে রেগে এক প্রকার ধমক দিয়েই জিজ্ঞেস করল,

“আমি কী বলছি? শুনতে পাচ্ছিস না তুই? ফিরে আসলি কেন? কী হয়েছে?”
বেলী বিরক্ত হয়ে কিছু কথা বলার জন্য মুখ খুলল। তখনি দরজার সামনে থেকে পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো।

“কারণ আমি ফিরে এসেছি তাই।”
নীলাভ্রর কণ্ঠ পেয়ে বেলীর কোনো ভাবাবেগ প্রকাশ পেলো না। কিন্তু রিতা অবাক চোখে সেদিকে তাকাল।

দরজার সামনে নীলাভ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আকাশ থেকে পড়ল যেন? তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নীলাভ্র শান্ত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল রিতার সামনে। হাসি মুখে রিতাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। প্রশ্ন করল,

“কেমন আছো, ফুপ্পি? শরীর ঠিক আছে তোমার?”
নীলাভ্রর প্রশ্নটা শেষ হতে দেরি। কিন্তু গা/লে থা/প্প/ড় পড়তে দেরি হলো না।

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৯ 

আচমকা এমন একটা কান্ড ঘটে যাওয়ায় বেলী বজ্রাহত চোখে তাকাল মায়ের দিকে। হকচকিয়ে উঠে, দাঁড়িয়ে পড়ল।
নীলাভ্র বো/কার মতো তাকিয়ে রইল শুধু…

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ৩০