তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৯

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৯ 
জেনিফা চৌধুরী

ডিভোর্সী একটা মেয়ের একা বেঁচে থাকার লড়াই কেউ জানেনা। কেউ বুঝে না। সমাজের মানুষ পাশে থাকার বদলে, আরো বেশি নিচে নামিয়ে দেয়। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে কথার আঘাতে লা*শ বানিয়ে দেয়। কী সুন্দর সমাজ! তাইনা?

উত্তপ্ত গরমে ফুটপাতের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে বেলী। মাথার মধ্যে জমাট বেঁধে আছে দুশ্চিন্তা। চোখ দুটো প্রাণহীন। মনে হয় এ চোখে প্রাণ নেই? পড়নের ধূসর শাড়িটা ভিজে একাকার অবস্থা। জীবনটা কী অদ্ভুত! এই ভালো তো এই খারাপ। ভালোবাসার মানুষটার থেকে ধোকা বেঁচে থাকার সুপ্ত ইচ্ছাটাকেও মে**রে ফেলে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেলী আজ সব হারিয়ে নিঃশ্ব। আনমনে হাঁটছে। দুনিয়ার কোনোদিকে ল। পেছন থেকে কেউ হঠাৎ বেলী বলে ডেকে উঠল। পা জোড়া থেমে গেলো। পেছনে ফিরে তাকাল। পরিচিত মানুষটাকে দেখে ঠোঁটে কোনে হাসি ফুটল। বলে উঠল,
“রাকিব তুই?”

রাকিব এগিয়ে এলো বেলীর দিকে। মুখে হাসি নেই। পাশে এসে দাঁড়াল নিশ্চুপে। কিছু বলতে চাচ্ছে বোধহয়? কিন্তু পারছে না। বেলী তা বুঝতে পেরে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“কিরে? তুই এখানে কেন? তুই না গ্রামে গিয়েছিলি? কবে আসলি?”

রাকিব অপ্রস্তুত ভাবে হাসলো। মুখে লেগে আছে বিষন্নতা। কীভাবে কথা শুরু করবে। বুঝতে পারছে না। রাকিবের অবস্থা বুঝতে পেরে বেলী হাঁটা শুরু করল। রাকিবও বেলীর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলা শুরু করল,
“নীলাভ্র ভাই কোথায় বেলী?”

বেলী থামলো না। রাকিব ভেবেছিলো বেলী প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে রিয়েক্ট করবে। কিন্তু না! এমন কিছু বেলী করল না। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,
“জানিনা।”
রাকিব থমকালো। হকচকালো। চক্ষু জোড়া থেকে বিস্ময়ের ঘোর কা*টল না। এত স্বাভাবিক! কিন্তু কী করে? এতকিছুর পর কী করে এত স্বাভাবিক বেলী? রাকিব পুনরায় প্রশ্ন করল,

“জানিনা মানে? নীলাভ্র ভাই নিখোঁজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। আর তুই বলছিস জানিনা?”
বেলী আগের ন্যায় উত্তর দিলো,
“যে সত্যিকারের নিখোঁজ হয় তাকে খুঁজে বের করা যায়। আর যে ইচ্ছেকৃতভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। তাকে কী করে খুঁজে বের করব বল?”

রাকিব চুপ থাকল। কিছু সময়ের ব্যবধানে হাফ ছেড়ে উত্তর দিলো,
“তোকে তো বলে গেছে। তাহলে ইচ্ছেকৃত ভাবে লুকিয়ে থাকা হলো, কী করে?”
বেলী আপনমনে হাঁটতে লাগল। উত্তর দিলো না। উত্তর দিতে মন চাইছে না। রাকিব হাল ছাড়ল না। প্রশ্ন করল,

“সবটা খুলে বল, বেলী। কী হয়েছিলো?”
বেলী শাড়ির আঁচলটা টেনে মাথায় দিলো। মুখের ঘাম গুলো হাত দিয়েই মুছে নিলো। শান্ত, স্বাভাবিক কন্ঠে বলতে লাগল,

“হুট করে এক সপ্তাহ আগে ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় নীলাভ্র বাড়িতে এসে হাজির হয়। বলল, কী একটা কাজে চট্রগ্রাম যেতে হবে। পনেরো দিনের জন্য যাবে। কিন্তু কী কাজ তা বলেনি। সেদিনই সে চট্রগ্রাম চলে গেছে। আমাকে বা পরিবারের কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজনবোধ করেনি।

চট্রগ্রাম চলে গিয়ে সবাইকে ফোন করে জানিয়েছে। যেদিন চলে গেছে তারপরের দিন থেকে তার ফোন অফ। হাজার চেষ্টা করেও তার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে তার বন্ধুর কন্ট্রাক্ট নাম্বার জোগাড় করেছিলাম। ফোন করে জেনে ছিলাম, সে কাজে বেশ ব্যস্ত। কারোর সাথে এক মিনিট কথা বলার টাইম নেই। আমার সাথেও না। আমাদের সবার থেকে তার কাজটা অনেক বড়। এখন তুই বল? যে নিজ থেকে যোগাযোগ রাখতে চায়না। সে কী নিখোঁজ?”

রাকিব থেমে গেলো। বেলী মুচকি হাসল। এই হাসির মাঝে কোনো প্রাণ নেই। শুধু আছে তাচ্ছিল্য। অভিমান, অভিযোগ। বুকভরা অভিযোগ নিয়েও মুখে হাসি রেখে চলার নামেই জীবন। বেলী তাচ্ছিল্যের কণ্ঠে বলে উঠল,

“থেমে গেলি কেন? আসলে কী জানিস? আমার ভাগ্যটা হয়তো এমনি। কারোর ভালোবাসা বেশিদিন আমার কপালে লেখা নেই। হয়তো আমার ব্যর্থতা? তবুও সব কিছু মিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী!”

রাকিব আর উত্তর দিতে পারল না। তবে মুখে দেখে মনে হচ্ছে কঠিন ভাবনায় ব্যস্ত? বাসার কাছে আসতেই বেলী বলে উঠল,
“আসছি। তুই বাসায় যা।”
বলে গেটের দিকে পা বাড়াতেই, রাকিব পেছন থেকে ডেকে উঠল। দৃঢ় কণ্ঠে স্বরে বলল,

“বেলী, তুই নীলাভ্র ভাইকে ভুল বুঝছিস। নীলাভ্র ভাই তোকে সত্যিই ভালোবাসে। হয়তো সে কোনো সমস্যায় আছে বা সত্যিই কাজে ব্যস্ত?”
বেলী হাসল। উত্তর না দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। রাকিবের কেন যেন সবটা এলোমেলো লাগছে। একটা ছেলে অন্য একটা ছেলের চোখের দিকে তাকালে সত্যি মিথ্যা সহজেই বুঝতে পারে। নিজে নিজেই বলে উঠল,

“এইসব কিছুর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে? কিন্তু কী কারণ? আমি খুঁজে বের করব।”

বেলী রুমে ঢুকেই দরজাটা আটকে দিলো। দরজা ঘেষে বসে পড়ল মেঝেতে। হাটুর ভাঁজে মুখ লুকাল। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বলে উঠল,

“কেনো দূরে গেলেন নীলাভ্র ভাই? প্লিজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেই মানুষটা তার বেলীপ্রিয়াকে ছাড়া একদিন থাকতে পারত না। আজ সেই মানুষটা এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ। আমি একা বাঁচতে পারছি না, নীলাভ্র ভাই। প্লিজ ফিরে আসুন। ”

কান্নায় ভেঙে পড়ল। তখনি শুনতে পেলো। দরজার ওপাশ থেকে কেউ অনবরত ডেকে চলেছে। একটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারল। এটা সীমার গলা। তাড়াহুড়ো করে চোখের জলটুকু মুছে নিলো। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে দরজা খুলল। সীমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল,

“বড় মামী,, তুমি? কিছু কী হয়েছে?”
সীমা ভয়ংকর চাহনী দিলো বেলীর দিকে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বেলীর গালে সপাটে থা*প্পড় মে*রে বসল। চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,

“আমার ছেলেটাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে শান্তি হয়েছে তোর। এইজন্যই আমি তোকে সহ্য করতে পারিনি। এইজন্যই আমার ছেলেটাকে বার বার বারণ করেছিলাম। যে মেয়ে প্রথম স্বামী ডিভোর্স দিয়ে আসতে পারে। সেই মেয়ে কত ভালো? আমি খুব ভালো করে জানি। কিন্তু আমার বোকা ছেলেটা বুঝে নাই। তাই আজ ওর এই অবস্থা।”

বেলী গালে হাত দিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। এই সাতদিনে বেলীকে এমন নানা বিশ্রি কথা শুনতে হয়েছে। আশেপাশের মানুষ অব্দি কথা শুনাতে বাদ দেয়নি। বেলী নিজেকে সামলে নিলো মুহূর্তেই। প্রতিবাদ না করলে এই সমাজে বাঁচা যাবে না। রুঁখে দাঁড়াতেই হবে। চোখের পানি গুলো মুছে নিয়ে জোরেই বলে উঠল,

“মামী! কোন অধিকারে আপনি আমাকে এতগুলো কথা শুনাচ্ছেন?”
সীমা এবার আগের থেকেও দ্বিগুণ চ্যাঁচিয়ে উঠল। দ্বিতীয় দফায় থা**প্পড় মা**রার জন্য হাত উঠাতেই বেলী ধরে ফেলল। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে বলে উঠল,
“আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার আপনার নেই, মামী।”

বলে হাতটা এক প্রকার ছিটকে ফেলে দিলো। সীমা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। বেলী বুঝতে পেরেও চুপ করে রইল। শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আমাদের সদর দরজাটা খোলা। আপনি এখন আসতে পারেন মামী।”

বলে সীমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। নিজে নিজেই বলে উঠল,
“আমি আপনাকে খুঁজে বের করব। আমার থেকে আপনি কী লুকাচ্ছেন? আমার সব প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতে হবে। আপনার জন্য আমি আর কারোর কথা শুনতে পারব না।”

ফজরের আযান কানে যেতেই বেলী উঠে পড়ল। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজ পড়ে নিলো। শাড়িটা পাল্টে একটা থ্রি-পিস পড়ে নিলো। তারপর বোরকা পড়ে, নিকাবের আড়ালে মুখ ঢেকে নিলো। ব্যাগটা কাল রাতেই গুছিয়ে রেখেছিলো। ফোনটা হাতে নিয়ে রাকিবকে কল করল। রাকিব রিসিভ করতেই এপাশ থেকে বেলী বেলী উঠল,

“আমি বের হচ্ছি। তুই সোজা বাস স্টেশন চলে যা।”
বলে রেখে দিলো। রুম থেকে বের হতেই রিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসি মুখে বলল,
“আসছি মা।”

রিতা কিছু বলল না। মেয়ের এই ডিসিশনে সে কিছুতেই খুশি না। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলছে না। বেলী নিজের মায়ের মনের ভাষা বুঝতে পারল। কিন্তু কিছু বলল না। নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে পা রাখতেই শুনতে পেলো,
“সাবধানে যাবি।”

পেছনে না ফিরেই হাসল। মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে কিছুটা সাহস বেড়ে গেলো। বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। গেটের সামনে এসে একটা রিকশা ডেকে নিলো। রিকশায় উঠার জন্য পা বাড়াতেই কেউ পেছন থেকে হাতটা টেনে ধরল।

আচমকা এহেন কান্ডে ভয় পেয়ে গেলো বেলী। হকচকিয়ে পেছনে তাকাতেই শরীরটা জমে গেলো। শীতল রক্ত বইতে শুরু করল সর্বাঙ্গে। হাতের ব্যাগটা তৎক্ষনাৎ নিচে পড়ে গেলো। আঁখি জোড়ায় অশ্রুরা এসে ভীড় করল। ঠিক দেখছে তো? না-কি ভুল? এটা কী স্বপ্ন? না-কি সত্যি? মানুষটা তাহলে কী ফিরে এসেছে?

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৮

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। রি-চেক দিতে পারিনি। অনেক ভুল আছে দয়া করে দেখিয়ে দিবেন। আর হ্যাঁ, কাল ১১/১২টার দিকে একটা পর্ব পাবেন। (ইন শা আল্লাহ)। যদি সবাই সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করেন তাহলে কাল দুই পর্ব।]

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৯ শেষ অংশ