তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৮

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৮
জেনিফা চৌধুরী

অন্ধকার রুমের এক কোনায় তানিশার গ*লা চে*পে ধরে আছে শাকিল। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তানিশা। ‘ওর’ দ’ম ব’ন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। চোখ গুলো মার্বেল আকৃতির হয়ে আছে। মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ঠোঁট গুলো তীব্র গতিতে কাঁপছে। শাকিল রক্তিম চোখে তাকিয়ে তানিশার দিকে।

এই মুহূর্তে তাকে বড্ড হিং’স্র দেখাচ্ছে। তানিশার মনে হচ্ছে ‘ও’ মা**রা যাচ্ছে। এই বুঝি দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা উড়াল দিলো। নিজের পরকিয়া আড়াল করার জন্য কতশত কাহিনী। হায়! কত কী দেখতে হবে? কে জানে? তানিশার শরীরের শক্তি ক্রমশ কমে আসছে। তা বুঝতে পেরে শাকিল বিশ্রি প্রয়োগ করল। গর্জন করে বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোরে পছন্দ হইছিলো তাই বিয়া করছিলাম। তোরে আমি তোর বাপের থেইকা কিন্না আনছি। তোর মতো দুই টাকার মাইয়ার মুখে এত বড় বড় কথা মানায় না। কোন সাহসে তুই আমার উপর খবরদারি করতে আহোস? আরেকবার এমন ভুল করলে তোরে সোজা মা*ই*রা* ফে*লুম। মনে রাহিস।”

বলে তানিশাকে ছিটকে ফেলে দিলো। হনহন করে রুমের থেকে বেরিয়ে গেলো। নিচে পড়ে তানিশা গ*লা কা*টা মু*রগীর মতো কিছুক্ষণ ছ*টফ*ট করলো যন্ত্রনায়। কান্না গুলো সব গ*লার মধ্যে আটকে আছে। মনে হলো, ব্যাথায় জীবন বেরিয়ে যাবে এক্ষুনি। চিৎকার করে কান্না করে উঠল তানিশা।

কিছুসময় পর দুই হাতে মুখে আঁচল গুঁজে কান্না নিবারণের চেষ্টা করতে লাগল। মস্তিকের মধ্যে কিছু শব্দ জানান দিলো। এই শহরে মেয়েদের শব্দ করে কান্না বারণ। অভিযোগ করা বারণ। ম*রে যাও। তবুও টুঁশব্দ করো না। তুমি মেয়ে তোমার জন্ম হয়েছে শুধু স্যাক্রিফাইস করার জন্য।

তোমার মুখে এত কথা মানায় না। তুমি কেন প্রতিবাদ করতে যাবে? তুমি তো মুখে আঙ্গুল দিয়ে থাকবে। কথাগুলো ভেবেই তানিশার দ’ম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। বুক ফে*টে কান্না আসছে। কী ভয়ংকর পরিস্থিতি! এই যন্ত্রণা যে সহ্য করা যায় না। তানিশার বোবা কান্নায় দেয়াল গুলোর বুক ভারী হয়ে আসতে লাগল। চারপাশের বাতাসে বিদঘুটে কান্নার আওয়াজ ভাসতে লাগল। কিছুসময় পর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে তানিশা বলে উঠল,

“তোমরা ভালো আছো তো মা? আমি কিন্তু অনেক ভালো আছি। আমার ভালো থাকার লেইগাই তো এতসব কিছু। তোমরাও ভালো থাইকো। আমি সবসময় দোয়া করুম। তোমরা অনেক ভালো থাইকো।”

মাগরিবের নামাজ পড়ে সবে মাত্র বিছানায় বসেছে বেলী। নামাজের পর মনের মধ্যে যেই প্রশান্তি অনুভব হয় তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। কখনো খুব বেশি মন খারাপ হলে, অশান্তি লাগলে। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লে সব অশান্তি, মন খারাপ নিমিশেই কে*টে যায়।

সকালে আমিনের কথাগুলো আজ সারাদিন বেলীর মাথায় গেঁথে ছিলো। নামাজ পড়ার পর এখন কিছুটা শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে, বুকের উপর থেকে ভারী বোঝাটা নেমে গেছে। হুট করে ফোনটা বেজে উঠতেই বেলী হকচকালো। ফোন স্ক্রিনে তানিশার নামটা দেখেই মুখে হাসির রেখা টেনে সাথে সাথে রিসিভ করল। হাস্যজ্বল কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছিস পে*ত্নী?”
তানিশা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর নিচু স্বরে বলল,
“আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছোস?”

তানিশার কন্ঠস্বর আজ আবারো বেলীকে ভাবতে বাধ্য করছে। সত্যিই, কী তানিশা ভালো আছে? মনের প্রশ্নটাকে আজ আর প্রশ্রয় দিলো না। হয়তো বেলী একটু বেশি ভাবছে? একটু হেসে উত্তর দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ! আমি ভালো আছি। তোকে আজ একটা কথা বলতে ফোন দিয়েছিলাম সকালে। কিন্তু, তুই রিসিভ করলি না। কেন রে?”

তানিশা পূর্বের ন্যায় শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“কাজে ব্যস্ত ছিলাম রে। এখন বল কী বলবি?”
বেলী বোধহয় একটু লজ্জা পেলো? নিজের বিয়ের কথা নিজের মুখে বলতে লজ্জা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বেলীকে চুপ থাকতে দেখে, ওপাশ থেকে তানিশা একটু জোরেই বলে উঠল,

“কিরে চুপ কইরা আছোস কেন? ভূ*তে ধরছে না-কি?”
বেলী একটু মুচকি হেসে জবাব দিলো,
“এক মাস পর আমার বিয়ে…।”

কথাটা বলে থেমে গেলো বেলী। চোখ দুটো অনায়াসে বন্ধ করে নিলো। হয়তো প্রশান্তির সুখ অনুভব করছে? বুকের মধ্যে বইছে শান্তির ঢেউ। ফোনের ওপাশ থেকে তানিশা চিৎকার করে বলে উঠল,
“কিহ! সত্যি? আমার বিশ্বাস হইতাছে না! কী খুশির খবর দিলি রে বেলু? আমার তো এহন নাচতে মন চাইতাছে।”
তানিশার চিৎকারে বেলীর কান ফে*টে যাওয়ার উপক্রম। মেয়েটা মাঝে মাঝে এত জোরে চ্যাঁচিয়ে উঠে যে, কবে যেন কার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়? ধমকে বলে উঠল,

“এত জোরে কেউ চিৎকার করে? আর একটু হলে আমার…।”
তানিশা বেলীর মুখের কথা কেড়ে নিলো। সাথে সাথে খোস আমেজে উত্তর দিলো,
“অন্য কেউ না দিলেও, আমি দেই। বুঝলি? এহন কবে বিয়ে হেইডা কও, সোনা। আই ওয়েটিং!”

এহেন কথায় বেলী হাসলো। প্রফুল্ল মনে সবটা বলতে লাগল। দুজন মিলে বকবক শুরু করে দিলো, মুহুর্তেই। তানিশাও নিজের কষ্টটা কিছু সময়ের জন্য ভুলে গেলো। বুকের ভেতর হাজারটা কষ্ট চে*পে রেখে কী করে হাসা যায়? তা তানিশাকে দেখে শিখা উচিত। সবাই নিজের কষ্টটা প্রকাশ করে না। কেউ কেউ ছেড়ে দেয় উপর ওয়ালার হাতে। হয়তো তিনি এই কষ্টের বিনিময়ে উত্তম কিছু দিবেন। অপেক্ষা শুধু সময়ের। উপর ওয়ালা কী কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়? নাহ! অবশ্যই, হাত ভর্তি করে দেন। হয়তো ইহকালে, নয়তো পরকালে।

“তুই কিন্তু আমার বিয়ের সাতদিন আগে আসবি।”
কথার মাঝে হঠাৎ বেলীর এই কথায় তানিশা থমকে যেতে বাধ্য হলো। চিন্তায় পড়ে গেলো মুহূর্তেই। এই ইচ্ছেটা যে পূরণ হবে না তা, তানিশা খুব ভালো করে জানে। বেলীকে বলতে গিয়েও থেমে গেলো। হাস্যজ্বল স্বরে বলে উঠল,
“আরে তোর বিয়া আর আমি যামু না। এইডা জীবনে হইব না। তোর বিয়াতে গিয়ে আমি কব্জি ডুবাইয়া খামু।”

বেলী শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর মিছিমিছি রাগী স্বরে বলল,
“আমি তোরে খেতে দিব না। তোকে আমার বিয়েতে আনব থালা বাসন ধোয়ার জন্য। কাজের বেটি জরিনা হয়ে সব কাজ করবি।”
তানিশা এবার হুংকার ছেড়ে উঠল। চ্যাঁচিয়ে বলল,

“ঝা*ড়ু খুইলা মা**রু**ম বেলুরুটি। কত্ত বড় সাহস আমারে কয় কাজের বেটি জরিনা? আমি হইলাম নায়িকা জ্যাটরিনা।”
‘জ্যাটরিনা’ শব্দটা বোধহয় বেলী আজ ফাস্ট শুনল? ‘জ্যাটরিনা’ বলে কী আদৌও কোনো নায়িকা আছে? জানা নেই তো? অবাক স্বরেই জিজ্ঞেস করল,
“এই জ্যাটরিনা আবার কোন দেশের নায়িকা?”
তানিশা বেশ ভাব নিয়ে উত্তর দিলো,

“আরে ক্যাটরিনা কইলে আবার মাইনসে কইতো অশ্লীল। তাই আমি ক্যাটরিনার বিপরীত শব্দ কইলাম। বুঝোস না গা*ধী?”
কথাটা শুনে বেলী নিজেই নিজের কপাল চা*পড়ানো শুরু করল। কী দিয়ে কী শব্দ বানায় মেয়েটা? এইসব উদ্ভট শব্দ কই পায়? মানুষ শুনলে নির্ঘাত পা**গল বলব। তানিশাকে কিছু বলতে যাবে। তখনি তানিশা হা হা করে হেসে দিলো। বেলীও নিজের হাসিটা দমিয়ে রাখতে পারলো না। তানিশার সাথে তাল মিলিয়ে উচ্চস্বরে হেসে দিলো। বেলীর ডাক পড়তেই ফোন রাখার জন্য প্রস্তুত হলো। ব্যস্ত গলায় বলল,

“এখন রাখছি, তানু। পরে মেসেঞ্জারে নক করব। মা ডাকছে।”
তানিশা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। বেলী ফোনটাকে কান থেকে নামিয়েও কা*টল না৷ আবার কানে দিয়ে বলে উঠল,
“কিরে? কিছু বললি না যে?”

তানিশা সময় নিলো বোধহয়? অল্প একটু খানি সময়ের ব্যবধানে হুট করে একটা অবিশ্বাস বাক্য বলে উঠল। এই বাক্যটা এই মুহূর্তে বেলী আশা করেনি। বুকটা কেঁপে উঠল খানিকটা। ভয়েরা এসে গ্রাস করল সর্বাঙ্গ। তানিশা বলল,
“আচ্ছা দোস্ত? মৃ**ত্যু অনেক কঠিন তাইনা?”
বেলী প্রতি উত্তর করতে পারল না। জোরে চ্যাঁচিয়ে বলতে লাগল,

“থা*ব*ড়া*ইয়া তোর দাঁ*ত ফে*লে দিব। এইসব কী বলিস? বেশি পাকনামি শিখে গেছিস? একবার তোর সামনে আইসা নেই। তোর পাকনামি আমি বের করতাছি। তুই আমারে আর কোনোদিন ফোন দিবি না। তোর সাথে আমার কোনো কথা নাই। কত দিন তোরে বারণ করছি, এইসব বলবি না। তবুও বলে যাস। আমার কথার কোনো দাম নেই তাইনা? ঠিকি তো দাম থাকবেই কেন? আমি কে?”

বেলী এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে থামল। রাগে ওর মাথা ফে*টে যাচ্ছে। সেই সাথে ভয়ে হাত-পা অটোমেটিক কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। এই কথাটা হঠাৎ কেন বলল, মেয়েটা? বেলীকে ভয়ংকর রাগতে দেখে তানিশা চুপসে গেলো। চুপসানো কন্ঠস্বরে বলল,
“স্যরি! স্যরি! রাইগা যাইতাছোস কেন? আমি কী কইছি, আমি ম**ই**রা যামু? আমি শুধু জিগাইছি?”
বেলী আবার চ্যাঁচালো। বলল,

“কেন? তুই জানস না? মৃ**ত্যু কঠিন না-কি সহজ? মৃ**ত্যু কঠিন এইটা দুনিয়ার সবাই জানে। তুইও জানস। তবুও কেন জিগাইলি? ফাজলামি করস?”
তানিশা কিছু শান্ত থাকল। নিজেও জানেনা হঠাৎ কেন এমন একটা প্রশ্ন করল? এখন নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছে। শুধু শুধু মেয়েটার মন খারাপ করে দিলো। মেয়েটা কত খুশি ছিলো? ধুর! বেলীকে শান্ত করার জন্য বলল,

“আচ্ছা আর কমু না। স্যরি! আর সবাইরে একদিন তো ম**র**তেই হইব। রাগিস না, প্লিজ। ”
বেলী দাঁতে দাঁত চে*পে কটমট করে উত্তর দিলো,
“যা। তুই ম**ই**রা যা। আমারে চল্লিশার দাওয়াত দিস। বিরিয়ানি রান্না করতে বলিস। কব্জি ডুবাইয়া খাইয়া আসব। রাখি।”

বলে ফোন কে*টে দিলো। সুইচ অফ করে দিলো। রাগে পুরো শরীর জ্ব*ল*ছে। শীতল রক্ত গুলো বোধহয় গরম হয়ে গেছে? জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে বলে উঠল,
“ইয়া আল্লাহ! তুমি আমার সব প্রিয়জনদের ভালো রেখো।”
তারপর বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কিন্তু মাথার মধ্যে তানিশার কথাটা চক্রাকারে ঘুরতে লাগল।

ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে মাত্র দরজা খুলতেই, নীলাভ্রকে হঠাৎ দেখে বেলী ভয় পেয়ে গেলো। বেলীকে ভয় পেতে দেখে নীলাভ্র হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
“কী ব্যাপার? আজকাল মেয়েরা নিজের স্বামীকে দেখেও কী ভয় পায়?”
বেলী রাগান্বিত চেহারায় তাকালো নীলাভ্রর দিকে। বলে উঠল,
“খাম্বার মতো এমন করে দাঁড়িয়ে থাকলে। সবাই ভয় পাবে।”

হুট করে চোখ গেলো নীলাভ্রর হাতে থাকা কাগজটার দিকে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটা টেস্টের রিপোর্ট? কিন্তু কার কী হলো আবার? সাথে সাথে প্রশ্ন করল,
“এটা কিসের রিপোর্ট? দেখি? আর আপনার কী হয়েছে?”
বলে সেদিকে হাত বাড়াতেই নীলাভ্র সরিয়ে নিলো। নীলাভ্রর মুখ দেখে মনে হলো, একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে বোধহয়? কিন্তু কেন? বেলী কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল,

“কী হলো? দেখতে দিলেন না কেন? কী হয়েছে আপনার?”
নীলাভ্র আমতা আমতা করল। উত্তর দিলো,
“আরে এটা আমার নয়। এটা আমার বন্ধু, রিয়াদের।”
বেলী হাঁফ ছাড়ল। এক মিনিটের জন্য মনে হয়েছিলো এটা নীলাভ্রর। শান্ত স্বরেই বলল,
“রিয়াদ ভাইয়ার কী হয়েছে?”

নীলাভ্রর চুপ করে গেলো৷ উত্তর দিলো না। প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“তোকে একটা কথা বলার জন্য এসেছিলাম।”
“কী কথা?”
বেলী সাথে সাথে পাল্টা প্রশ্ন করল। নীলাভ্র বলল,

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৭

“আমি পনেরো দিনের জন্য একটু চট্রগ্রাম যাব। আমার একটা কাজ পড়ে গেছে। আজকেই যেতে হবে। তাই তোকে বলার জন্য এসেছিলাম।”
বেলী একটু ভড়কালো। হঠাৎ, চট্রগ্রাম! কিন্তু কেন? কী এমন কাজ? নীলাভ্রর মুখ দেখে কেন মনে হচ্ছে, যে মিথ্যা বলছে? এটা কী বেলীর মনের ভুল? না-কি সত্যিই নীলাভ্র কিছু লুকাচ্ছে?

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৯