তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৭

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৭
জেনিফা চৌধুরী

“তুই শেষ অব্দি বিবাহিত, ডিভোর্সি, চরিত্রহীন একটা মেয়েকে বিয়ে করছিস, নীল? ”
কথাটা ব্যঙ্গ করে বলল আমিন। পরক্ষণেই একটু হাসল। আমিনের কথাটা বেলীর কর্ণকুহরে যেতেই কেঁপে উঠল। অপমানে হাস্যজ্বল মুখটা চুপসে গেলো। কয়েক মিনিট স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে।

আঁখি জোড়া অশ্রুতে ভরপুর। নীলাভ্র ঠাঁই দাঁড়িয়ে। কালো সানগ্লাসের আড়ালে রক্তিম চোখ জোড়া ঢাকা পড়ে আছে। বেলীর নিষ্প্রাণ, নিশ্চল আঁখি জোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ল, কয়েক ফোঁটা অশ্রু। হুট করে নীলাভ্র চোখের সানগ্লাসটা খুলে ছু*ড়ে ফেলে দিলো। হিংস্র বা*ঘের মতো আমিনের কলার চে*পে ধরলো। তীব্র তেজপূর্ণ কণ্ঠস্বরে বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমার বউকে এইসব বলার অধিকার তোকে কে দিয়েছে? আমি দিয়েছি? দেইনি তো। তাহলে, তুই কোন মুখে এইসব বললি?”
নীলাভ্রর রাগ দেখে বেলী হকচকিয়ে গেলো। ভয়ে কম্পন হলো সর্বাঙ্গে। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলল না। নিজের বন্ধুর হবুর বউকে নিয়ে যে, এমন বাজে মন্তন্য করতে পারে। তার মানসিকতার কতটা নিচু তা এতক্ষণে খুব ভালো করে বুঝে গেছে বেলী। আমিন ভড়কে গিয়ে থতমত খেয়ে উঠল। আমতা আমতা করতে লাগল। কী বলবে? কী উত্তর দিবে? ভাবতে লাগল। ভেবে পেলো না। নীলাভ্র কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় চ্যাঁচিয়ে বলল,

“আমার ফুলকে চরিত্রহীন বলার সাহস তুই কোথায় পেলি, এন্সার মি?”
চারদিকটায় কিছু মানুষ সিনেমার শ্যুটিং দেখার মতো করে কৌতুহল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রেস্টুরেন্টের মাঝে এমন একটা পরিস্থিতি বেলীকে লজ্জায় ফেলছে বারংবার। সবাই কী ভাবছে? কে জানে? আমিন নীলাভ্রর থেকে কলার ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলতে লাগল,

“কী করছিস তুই? সবাই দেখছে। কী ভাবছে সবাই? এটা পাবলিক প্লেস। এখানে সিনক্রিয়েট করিস না, নীল।”
আমিনের কথা শুনেও নীলাভ্র ছাড়ল না। বরং পূর্বের ন্যায় বলে উঠল,
“সিনক্রিয়েট, আমি না। তুই করছিস। এক্ষুনি ক্ষমা চাইবি। বেলীপ্রিয়ার কাছে মাথা নত করে ক্ষমা চাইবি।”
বেলী এহেন পরিস্থিতিতে কী বলবে? ভেবে পাচ্ছে না। তবুও কোনো রকম শান্ত কণ্ঠে বলল,

“নীলাভ্র ভাই, সবাই দেখছে। আপনি প্লিজ উনাকে ছেড়ে দিন। ”
নীলাভ্র তবুও ছাড়ল না। আমিন অপমনে মুখটা কালো মেঘের ন্যায় করে রেখেছে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। চোখ দিয়ে স্পষ্ট রাগের বহিঃপ্রকাশ করছে। আমিনের দিকে তাকিয়ে নীলাভ্র, কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“তুই ক্ষমা চাইবি কি-না?”

আমিন বিশ্রি এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করছে। তাই সময় নিলো না। সুললিত স্বরে, অপরাধী ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“আমার ভুল হয়ে গেছে ভাবী। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি বুঝতে পারিনি। সামান্য একটা কথা নিয়ে এমন সিচুয়েশন হবে। আমি সত্যিই দুঃখিত। নীল, অজান্তে তোকেও কষ্ট দেওয়ার জন্য স্যরি।”

এবার আমিনের কলার থেকে নীলাভ্রর হাত আলগা হয়ে এলো। জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমিন আর এক মুহূর্ত দন্ডায়মান অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। অপমানিত মুখটা দেখানোর ইচ্ছা হলো না। শুধু বেলীর দিকে একবার রাগান্বিত চাহনী দিয়ে বেরিয়ে গেলো। নীলাভ্র সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল।

হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। বেলী এখন স্থির দাঁড়িয়ে। কাল বেলী আর নীলাভ্রর বিয়ের পাকা কথা হয়েছে। এক মাস পর বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। আজ ভার্সিটি শেষ করে নীলাভ্রর সাথে বেরিয়ে ছিলো। কিছু শপিং করে, খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে ঢুকে ছিলো। তখনি আমিনের সাথে দেখা। কথার এক পর্যায় বেলীকে নিজের হবু বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেই, আমিন উপরোক্ত কথা বলে উঠে।

“তোকে কী বসার জন্য নিমন্ত্রণ করতে হবে না-কি?”
হুট করে নীলাভ্রর রাগী স্বরের কথাটা কানে আসতেই বেলী ভড়কে উঠল। ঠোঁটে মেকি হাসি ঝুলিয়ে তৎক্ষনাৎ বসে পড়ল। নীলাভ্রর কাছ ঘেষে পাশের চেয়ারে বসল। নীলাভ্র খুব মন দিয়ে মেনু কার্ডটা দেখছে। চেহারা পানে এখনো রাগের আভা। ছেলেটা ইদানীং এত রেগে থাকে কেন? আগে তো এত রেগে থাকত না! তাহলে? ভেবে বেলী আনমনে জোরেই বলে উঠল,
“বিয়ের পানি গায়ে লাগলে সব ছেলেরা নাকি বা*ঘ থেকে বিড়া*ল হয়ে যায়৷ আর আমারটা বিড়া*ল থেকে বা*ঘ হয়ে যাচ্ছে। হায়, কপাল!”

বেলীর কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই নীলাভ্র ধমকে উঠল। দাঁতে দাঁত চে*পে বলল,
“ইদানীং দেখছি, তোর মুখটা বেশি চলছে। থা*প্পড় খাওয়ার সখ হয়েছে বুঝি?”

কথাটা জোরে বেরিয়ে আসবে মুখ দিয়ে, ভাবতেও পারেনি। নীলাভ্র কথাটা বলে ওয়েটার ডেকে খাবার অর্ডার দিলো। বেলী নিশ্চুপ হয়ে রইল। কিছুসময়, কিছুক্ষণ। মিনিটের মাথায় ওয়েটার খাবার নিয়ে হাজির হলো। নীলাভ্র বেশ শান্ত ভঙ্গিতে কোকাকোলা নিয়ে ঢকঢক করে গিলতে শুরু করল। এত ঠান্ডা! আর সে অনায়াসে কী সুন্দর গিলছে! এই মুহূর্ত দেখতে বেশ লাগছে নীলাভ্রকে। বেলী পিটপিট করে তাকালো সেদিকে। ঠোঁটে লম্বা একটা হাসি ঝুলিয়ে নিলো। বেশ শান্ত, মোলায়েম কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

“নীলাভ্র ভাই, একটা প্রশ্ন করি?”
বেলীর কথায় নীলাভ্র কপাল কুঁচকালো। চোখে, মুখে লাল আভা স্পষ্ট ভেসে উঠল। কুঁচকানো, গম্ভীর মুখটা আবারো রাগের ইঙ্গিত দিলো। বেলীর তা বুঝতে দেরি হলো না। কিছুক্ষণ বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকলো। থমথমে কণ্ঠে বলল,
“না। তুই কোনো প্রশ্ন করবি না।”

কথাটা শুনে বেলী ভড়কালো। চোখের পাতা ঝাপটালো। বদ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইল । ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করল। নাহ! বুঝতে পারলো না। অবাক স্বরে বলল,
“প্রশ্ন করব না! কিন্তু কেন?”

বেলীর এমন বো*কার মতো প্রশ্নে নীলাভ্রর রাগটা তীব্রতর হলো। কুঁচকানো মুখটা আরো কুঁচকে গেলো।।চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে ফেলল। এবার চোখ দুটো দৃশ্যমান হলো। লাল হয়ে আছে অল্পস্বল্প। দাঁতে দাঁত চে*পে নীলাভ্র গ্রাম্য ভাষায় শুধাল,
“দুইদিন পর তোর লগে আমার বিয়া। কিন্তু তুই আমারে ডাকস ভাই। বাহ! তা আমাগো পোলাপাইন হইলে তারা কী আমারে মামা ডাকব।”

নীলাভ্রর কথা শেষ হতেই বেলীর কাশি উঠে গেলো। সবে এক চুমুক কোকাকোলা মুখে দিয়েছিল। কিন্তু নীলাভ্রর এহেন কথায় ভড়কে গিয়ে নাকে, মুখে উঠে গেছে সবটা। এখন কাশতে কাশতে বেচারির রফাদফা। কিন্তু সেদিকে নীলাভ্রর ধ্যান নেই। সে বেশ ইনজয় করছে বেলীর এই অবস্থা। মুখে রয়েছে বিশ্ব জয়ের হাসি। চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। বেশ প্রফুল্ল মনে আওড়ালো,

“একদম ঠিক হয়েছে। উচিত শিক্ষা। আমাকে ভাই বলার শাস্তি। আর বলবি ভাই?”
কাশতে কাশতে বেচারির চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছে। তা দেখেও নীলাভ্র শান্ত। ছেলেটা কী নিষ্ঠুর! একটুও মায়া দয়া নেই বুঝি? বেলী ইচ্ছে করলে নীলাভ্রর ভ্যাটকানো চেহারাটায় কোকাকোলা গুলো ছু*ড়ে মা*রতে। নিজের অদম্য ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখল। কিছু সময়ের ব্যবধানের কাশির মাত্রা ধীরে ধীরে কমে এলো। বেলী স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

“আপনি কী নিষ্ঠুর! আমি এমন ভাবে কাশতে কাশতে ম*রে যাচ্ছি। আর আপনি চেয়ে চেয়ে দেখছেন? খারাপ লাগেনি? ভীষণ পঁচা আপনি।”
বলে মুখ ফোলাল। গালে দুই হাত দিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। নীলাভ্র হাসলো। মুচকি হাসি। চেহারায় দুষ্টুমি ভাবটা উদয় হলো। বেশ শান্ত স্বরে, গা ছাড়া ভাবে জবাব দিলো,
“তুই তো আমার কে যে, আমার খারাপ লাগবে? ”

বেলীর রাগ হলো না। নাহ! নীলাভ্রর উপর না। নিজের উপর। কেন সে বার বার নীলাভ্রকে ভাই বলে সম্মোধন করে ফেলে। নিজের গালে একটা জোরে চড় মা*রতে ইচ্ছে হলো। নিজের মাথাটাকে দেয়ালে ঠু*সা দিতে ইচ্ছে হলো। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাইল। কিন্তু একটাও ইচ্ছে বাস্তবে রুপ দিতে পারলো না। হায়! কী কষ্ট! এই কষ্টের শেষ নেই। নিজেকে শান্ত করল। বেশ হাস্যজ্বল চেহারা করে নীলাভ্রর হাত আঁকড়ে ধরল। চোখে চোখ রেখে বলে উঠল,

“আজ থেকে আর ভাই ডাকব না। সত্যি। ”
নীলাভ্রও সাথে সাথে ঢং করে প্রশ্ন করল,
“তাহলে কী ডাকবে সোনাপাখি?”
নীলাভ্রর ঢং এর কথা শুনে বেলীর গা জ্বলে গেলো। তবুও শান্ত থাকল। কিছুক্ষণ ভাবল, কী ডাকা যায়?অনেকক্ষণ ভাবার পর, হুট করে বলে উঠল,

“আপনাকে আমি নীলাভ্র বাবু, সোনা, ময়না, টিয়া ডাকব।”
বেলীর কথায় নীলাভ্রর মন চাইল কচু গাছের লগে ঝু*লে পড়তে। ঝাড়া মে*রে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠল,
“তুই এক কাজ কর এক কলসি পানিতে ডু*বে যা।”
বলে মুখের মধ্যে খাবার ভরতে লাগল। নীলাভ্রর খাওয়ার স্টাইল দেখে বেলী হাহা করে হেসে দিলো।

তানিশা বিছানায় মুখ গুঁজে কাঁদছে। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। অনেক ক্ষণ ধরে কান্না করার ফলে চোখ ফুলে উঠেছে। গালের মধ্যে থা*প্পড়ের দাগ স্পষ্ট। বিছানার চাদরটা আকঁড়ে ধরে আছে শক্ত করে। শাকিল তানিশার সামনে বসে বসে সিগারেটের ধোয়া উড়াছে। জোরে ধমক দিয়ে বলে উঠল,
“এখানে বসে বসে ন্যাকামি আর কতক্ষণ করবি? চোখের সামনে থেকে বেরিয়ে যা। খাবার নিয়ে আয় আমার জন্য।”

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৬

(অনেক দিন পর লিখছি। সব এলোমেলো হইছে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার মন মানসিকতা এখন ঠিক হয়নি। আমার আব্বু আগের থেকে একটু সুস্থ। আপনাদের দোয়ায় একটু আমার পরিবারকে রাখবেন। আমার আব্বু যেন তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। আসসালামু আলাইকুম।)

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ২৮