তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ১৭

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ১৭
জেনিফা চৌধুরী

নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে লাল টুকটকে শাড়ি পড়ে বিয়ের আসরে বসতে হয়েছে তানিশার। চোখ, মুখ ফুলে আছে কিছুটা, চোখে পানি টইটুম্বুর, ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। তানিশার মনে হচ্ছে ওর বুকের ভেতরটা ফে’টে যাচ্ছে। বুকের ভেতর জমানো হাহাকার, আর্তনাদ গুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ কিন্তু পারছে না। বিয়ে শুরু হওয়া মাত্রই তানিশা আর চুপ থাকতে পারলো না, চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

“ও আব্বা, আমি তোমার পায়ে পড়ি। আমারে বিয়া দিও না। আমি এই বিয়া করুম না।”
যারা উপস্থিত ছিলো, সবাই অবাকের শেষ সীমানায়। পাশ থেকে একজন বয়স্ক মহিলা হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো,
“এই মাইয়ায়, কি কইতাছে শাকিল?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমার পোলায় তোমার বাপরে কতগুলান টাকা দিছে। হেই খবর কি তোমার আছে? বিয়া না কইরা যাইবা কই? বিয়া না করলে, তোমার বাপরে কও আমাগো টাকা আমাগো দিয়া দিতে। তোমারে ঘরের বউ করনের সখ নাই আমার। তোমার থেইকা ভালা মাইয়া আমার পোলারর লেইগা খুইজা আনতাম। কিন্তু আমার পোলায় তোমারে ছাড়া নাকি চক্ষে দেহেনা।”

কথাটা শুনে শাকিল ওর মাকে কিছুটা ধমকালো। ওর মা শান্ত হলো। তানিশার বাবা রতন মেয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো, বললো,
“তোরে না কইছি, বেশি কথা কইবিনা। আমরা যা করতাছি তোর ভালোর লেইগা। কাজি সাহেব আপনি বিয়া পড়াইনা শুরু কইরা দেন। ”

তানিশার মা এসে তানিশার পাশে বসলো, তানিশা একাধারে কেঁদেই যাচ্ছে। ওর মায়ের চোখেও পানি। নিয়তিটা যে বড্ড খা’রাপ, বাজে। নিয়তির উপর কারোর হাত থাকেনা। উপরওয়ালা ভাগ্যে যে লিখে দেয়, দিনশেষে তাই হয়। বুকের মধ্যে পা’হাড় সমান কষ্ট নিয়ে কবুল বললো তানিশা।

মনে হচ্ছে ও এক্ষুনি মা*রা যাচ্ছে। হয়তো পৃথিবীতে ওর দিন শেষ হয়ে আসছে। সবাই এত নিষ্ঠুর কেনো? যারা গরিব ওদের কি ভালোবাসা অধিকার নেই, যদি ভালোবাসার অধিকার থাকে তাহলে কেনো দিন শেষে সামান্য কয়েকটা কাগজের নোটের কাছে হে’রে যেতে হয়। আজ তানিশাকেও টাকার কাছে বি’ক্রি হয়ে যেতে হলো। বিয়েটা সম্পূর্ণ হলো। তানিশা নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কাঁদছে না৷ কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে হয়তো।

বিকেলের সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে গেছে।আবহাওয়াটা সুন্দর। শীতল বাতাস বইছে চারদিকে। বেলী ছাদের এক কোণে চুপিসারে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা চুলগুলো বাতাসের সাথে সমানতালে উড়ছে৷ মনটা আজ অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি খারাপ। আজ এই বাড়ি ছেড়ে, নীলাভ্রকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। নীলাভ্রর ছায়া ছেড়ে কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছেনা।

কিন্তু ওর মা যে শুনবেনা। তানিশাকে বারবার ফোন করার পরও কোনো খোঁজ পায়নি। দুশ্চিন্তায় মস্তিষ্ক ভরপুর। হঠাৎ করে বাহুতে কারোর উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই বেলীর ধ্যান ভাঙলো, পাশফিরে তাকালো, কাঙ্কিত ব্যাক্তিকে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটলো। মানুষটা মুচকি হেসে, ওর পাশে দাঁড়ালো। একহাত দিয়ে আগলে নিলো, ‘বেলীপ্রিয়াকে’। বেলী মিষ্টি স্বরে প্রশ্ন করলো,

“আসতে দেরি করলেন যে?”
নীলাভ্রর দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। বেলী প্রশ্ন করতেই সাথে সাথে উত্তর দিলো,
“তোদের ব্যাগ গুলো গাড়িতে তুলে দিয়ে আসলাম।”

ছেলেটার কন্ঠস্বর শান্ত। কথাটা শুনে বেলীর বুক ধক করে উঠলো। নীলাভ্রর মুখপানে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, কিছুসময়। এত শান্ত লাগছে কেনো? কষ্ট হচ্ছেনা? তার বেলীপ্রিয়া আজ তার ছায়াতল থেকে চলে যাবে। তবুও কষ্ট হচ্ছেনা। নাকি প্রকাশ করছে না। বললো,

“কখন বের হবে?”
নীলাভ্র এবারও বেলীর দিকে তাকালো না। বললো,
“হয়তো কয়েক মিনিটের মধ্যে।”
বেলী নীলাভ্রর মুখশ্রী থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
“আজ তানিশা গ্রামে চলে গেছে।”

এবার নীলাভ্র বেলীর দিকে তাকালো। অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,
“হঠাৎ গ্রামে কেনো?”
বেলী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, সব খুলে বললো নীলাভ্রকে। সবটা শুনে নীলাভ্র একটু জোরেই বললো,
“কি বলছিস? তানিশা কি বো’কা? ও কেনো গেলো?”

“জানিনা আমি। নীলাভ্র ভাই, কিছু করেন প্লিজ। আজ সারাদিন ধরে আমি ওর ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছি, কিন্তু রিসিভ হচ্ছেনা। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। ওর যদি বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে রাকিব ভে’ঙে যাবে। ওরা দুজনেই জীবন্ত লা*শ হয়ে যাবে। রাকিবের মা অসুস্থ, তাই ও এইসব কিছু জানেনা। যদি জানতে পারে তাহলে, কি হবে ভাবতে পারছেন? কিছু করেন প্লিজ।”
বেলী কথাগুলো বলতে বলতে কান্না করে দিলো। নীলাভ্র কি করবে বুঝতে পারছেনা। বেলীকে শান্ত করার জন্য বেলীর দুই গালে রেখে শান্ত স্বরে শুধালো,

“বেলীপ্রিয়া, কান্না থামা। তুই জানিস না, তোর কান্না আমার সহ্য হয়না। তবুও কাঁদছিস। কিছু হবেনা তানিশার। আমি ওর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলব। এখন তুই কান্না থামা।”
বেলীর কান্না থামলোনা। মনটা খুব ছটফট করছে। যত খারাপ চিন্তা, ভাবনা মাথায় আসছে। ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো। নীলাভ্র বেলীর অশ্রু ফোটা গুলো পরম যত্নে মুছিয়ে দিতে দিতে, বলে উঠলো,

“বাবুই, কান্না থামানা। প্লিজ, কান্না থামা বেলীপ্রিয়া। কাঁদতে বারন করেছি আমি। এবার কিন্তু বকা খাবি। কান্না থামা। ”
বেলীর কি হলো, কে জানে? হুট করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। নীলাভ্র বুঝতে পারলোনা। বেলীর কি হলো? বেলী নিশ্চুপে নীলাভ্রর বুকে মুখ গুঁজে আছে। নীলাভ্র কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও, পরক্ষণেই বেলীকে আকঁড়ে ধরলো। বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, বললো,

“বেলীপ্রিয়া।”
“হু” একদম ছোট শব্দে বেলী সাড়া দিয়ে উঠলো। নীলাভ্র প্রশ্ন করলো,
“চলে যাবি তাই কষ্ট হচ্ছে বুঝি?”

“আপনি কি করে বুঝলেন?” চট করে বেলী জিজ্ঞেস করে ফেললো। নীলাভ্র বেলীর মাথায় থুঁতনি ঠেঁকিয়ে বললো,
“বো’কা মেয়ে, তুই কি দূরে চলে যাচ্ছিস নাকি? আমাদের প্রতিদিন দেখা হবে, কথাও হবে। তাহলে, মন খারাপ করছিস কেনো?”

বেলী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। নীলাভ্রর বুকের ধুকপুকানির শব্দ ওর কানে বাজছে। নীলাভ্রকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বললো,
“আমার ভয় হচ্ছে নীলাভ্র ভাই।”
“কিসের ভয়? আমি আছি তো। আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই বেলীপ্রিয়া।”

নীলাভ্রর এমন বাক্য শুনে বেলী হাসলো। নীলাভ্র নাকক প্রেমিক পুরুষ যেই নারীর কপালে সে সত্যিই ভাগ্যবতী। বললো,
“আপনার ছায়াতলে আমি সারাজীবন থাকতে চাই নীলাভ্র ভাই।”
নীলাভ্র মিষ্টি স্বরে শুধালো,

“বেলী ফুলের স্নিগ্ধ তুই। যার হাসিতে আমার সব কষ্ট ধুয়ে, মুছে যায়। যার অদ্ভুত সুন্দর চোখের চাহনীতে, আমি আমার প্রশান্তি দেখতে পাই। তুই আমার প্রশান্তি।”
বেলী নীলাভ্রর বুক থেকে মাথা উঠালো। নীলাভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। বললো,
“তুমি নামক প্রশান্তি”

বেলীর কথাশুনে নীলাভ্রর ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। বললো,
“তুমি বললি কেনো?”
নীলাভ্রর কথা শুনে বেলী ভ্যাবাচেকা খেলো। এই ছেলেটা এত আনরোমান্টিক কেনো? রোমান্টিক একটা মুহূর্তকে, এক নিমিশেই শেষ করে দেয়। বেলী কপাল চা’পড়াতে, চা’পড়াতে বললো,

“ইয়া মাবুদ! এ তুমি কার পাল্লায় ফেললে আমাকে। এই ছেলেকে সামান্য তুমি বললেও সমস্যা। এই আপনি এত আনরোমান্টিক কেনো? কই, আমি তুমি বলেছি বলে, খুশিতে না-গিন ডান্স শুরু করবেন, তা না করে প্রশ্নের বন্যা বসিয়ে দেয়।”
নীলাভ্র মুখ বাঁকিয়ে বললো,

“তোর মুখে আপনি শুনতে অদ্ভুত শান্তি লাগে। অদ্ভুত সুন্দর তোর কন্ঠস্বর। নে’শালো, ঘা’য়েল করার মতো।”
কথাটা শুনে বেলী একটু লজ্জা পেলো। এর মধ্যেই মেরিনা আর ইশু ছাদে উঠে, ওদের দুজনকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠে,
“ও মাগো টুরু লাভ!”

ওদের চিৎকারে বেলী আর নীলাভ্র দুজনেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো। বেলী ভয় পেয়ে বুকে থুথু দিতে দিতে বললো,
“এভাবে কেউ চিৎকার করে ফা’জিল। ভয় পেয়ে গেছিলাম তো।”
ওরা দুজনেই এগিয়ে আসলো। ইশু বেলীর কাঁধে হালকা করে থা-প্পড় মে*রে বললো,
“তলে তলে টেম্পু চালাও। আমরা বললেই হ’রতাল।”

মেরিনা ওর স্বরে স্বরে মিলিয়ে, নীলাভ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ভাইয়্যুকে দেখলে তো সবাই বলবে ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা। এদিকে সে বেলীপ্রিয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। সব কপাল বুঝলি ইশু, আজ তুই আর আমি সিঙ্গেল বলে, কেউ আমাদের বলেনা ‘তোর কন্ঠস্বর অদ্ভুত সুন্দর’।”
কথাটা শেষ হতেই নীলাভ্র দুইহাতে ইশু আর মেরিনার কান ধরে ধমকানোর স্বরে বলে উঠলো,

“বেশি পাকামো হচ্ছে। আর প্রথমত, আমি ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানিনা এটা ঠিক। মাছ হচ্ছে, খাওয়ার জিনিস উল্টে খেলাম নাকি সোজা খেলাম তাতে তোদের কি?”

বেলী ওর কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো। ইশু আর মেরিনা দুজনেই লাফিয়ে বলতে লাগলো,
“ভাইয়্যু কান ছাড়ো। ব্যাথা পাচ্ছি তো। সত্যিটা সবারেই গায়ে লাগে। এখন কান ছাড়ো, নয়তো ফুপ্পিকে সব বলে দিব।”
নীলাভ্র ওদের কান ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো,

“আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।”
নীলাভ্র কথাটা বলতে দেরি ইশু আর মেরিনার দৌড় দিতে দেরি হলোনা। ওদের আর কে পায়? এক দৌড়ে সোজা সিড়ির দিকে। ওরা যেতেই বেলী আর নীলাভ্র একসাথে শব্দ করে হেসে উঠলো। এর মধ্যেই আবার শুনতে পেলো,

“হাসলে কিন্তু তোমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে বেলীপ্রিয়া।”
কথাটা শুনেই বেলী আর নীলাভ্র দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো, ইশু আর মেরিনা দুজনে উঁকি মে*রে চেয়ে আছে। ওদের দেখেই নীলাভ্র বলে উঠলো,
“তবে রে।”

এবার নীলাভ্র বোনদের পিছু পিছু দৌড়ে গেলো। আর বেলী দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো। কিছুক্ষণ একা একা হেসে হঠাৎ থেমে গেলো। মনে পড়লো, এক্ষুনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। ওদের সবাইকে ছেড়ে একা থাকতে হবে। মনটা নিমিশেই পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ খারাপ হয়ে গেলো। ধীর পায়ে নিচে নেমে আসলো।

বেলী আর সীমা দুজনেই সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিলো। ইশু আর মেরিনা বেলীকে কিছুতেই একা ছাড়বেনা, দেখে ওরা দুজন ও বেলীদের বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। নীলাভ্রর আগেই গাড়িতে গিয়ে বসে আছে। আজ সীমা অনেকটাই চুপচাপ। বেলী সবার কাছথেকে বিদায় নিয়ে সীমার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। হাসি মুখে বললো,
“আসছি বড় মামি। ভালো থেকো।”

বেলীর কথাটা শেষ করতেই, সীমা আদুরে হাত বাড়িয়ে দিলো। বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“ভালো থাকিস মা। পারলে তোর এই খারাপ মামীটাকে ক্ষমা করে দিস। অনেক অন্যায় করে ফেলেছি তোর সাথে। ক্ষমা করিস আমাকে।”

বলে রুমের দিকে পা বাড়ালো। আর বেলীসহ উপস্থিত সবাই ‘হা’ হয়ে আছে। বেলী স্পষ্ট খেয়াল করেছে সীমার চোখে পানি। সেই পুরনো মামীকে দেখতে পেলো আজ। সেই আদুরে হাত, আদুরে কন্ঠ, মায়ের মতো ছায়া। খুশিতে চোখে পানি টলমল করে উঠলো। অনেকদিন পর সবকিছু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। সুন্দর হয়ে উঠছে জীবন।

ঘড়ির কাটায় রাত ৯টা বেজে ৮ মিনিট। তানিশা অনেকক্ষণ যাবৎ শাকিলের রুমে একা বসে আছে। কাঁদছে না মেয়েটা। সেই তখনের পর শান্ত হয়ে গেছে পুরোটা। এখন ওর চোখে তাকালে যেকেউ বুঝে যাবে ওর দেহে প্রান নেই। নিষ্প্রাণ সে চোখের চাহনী। মোবাইলটা আসার সময় দিয়ে দিয়েছিলো ওর মা।

কিন্তু কাউকে ফোন দেওয়ার সাহস নেই ওর। কি বলবে? কি জবাব দিবে রাকিবকে? বলবে, সব ভেঙে গেছে, সব স্বপ্ন ছাঁই হয়ে গেছে, কয়লা গেছে। কোন মুখে বলবে ‘আমার বিয়ে হয়ে গেছে’। রুমে কেউ নেই। সবাই বাইরে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ আগেও রুম ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছিলো। সবাই নতুন বউ দেখার জন্য ভীড় জমিয়েছিলো।

এখন তানিশা একা। সম্পূর্ণ একা। ওর কেউ নেই। সত্যিই তো ওর কেউ নেই। এর মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠলো। অনেকক্ষণ যাবৎ বেজে যাচ্ছিলো। ফোন স্কীনে ‘রাকিব্বার বাচ্চা’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। তানিশা ধরার সাহস পাচ্ছেনা। এবার মনকে শক্ত করলো। কাঁপা-কাঁপি হাতে ফোনটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে রাকিব একনাগাড়ে বলতে শুরু করলো,

“কিরে, কূ’টনী বুড়ি ফোন ধরছিলি না কেনো? আজ তোর কোনো খবর নাই। আমি তো ভাবলাম, বিরিয়ানির দাওয়াত না দিয়াই, তুই মই*রা টইরা গেলি। দোস্ত আর যাই করিস বিরিয়ানির দাওয়াত না দিয়ে ম*রিস না প্লিজ। তোর চল্লিশায় একদম কব্জি ডুবিয়ে বিরিয়ামি খামু। আহা! এক্ষুনি জিভে পানি আইয়া পড়ছে।”

রাকিবের কথাগুলো শুনে তানিশার চিৎকার করে উঠতে মন চাইলো। কিন্তু পারলোনা। শুধু শান্ত স্বরে বললো,
“আমার বিয়া হইয়া গেছে রাকিব।”
ওপাশ থেকে রাকিব হাহা করে হেসে উঠলো। পরক্ষণেই কান্না কান্না গলায় বললো,

“দোস্ত, তুই আমার লগে বেঈমানী করতে পারলি। পারলি তুই? আমারে দাওয়াত না দিয়া বিয়া কইরা লাইসোস। তুই কিপ্টা জানতাম, কিন্তু এত কিপ্টা তা জানতাম না। আমি তোরে আগেই কইয়া রাখছিলাম, তোর বিয়ার সাতদিন আগের থেইকা না খাইয়া থাকুম। আর তুই আমারে দাওয়াত না দিয়া বিয়া কইরা, এহন আমার কাছে কইতে আইছোস। তোর তো কচু গাছেফ লগে ঝুইলা পড়া উচিত।”

তানিশা এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“আমি মজা করতাছিনা রাকিব। আমার সত্যি বিয়া হইয়া গেছে। ”
এবার রাকিব হয়তো একটু সিরিয়াস হলো। শান্ত স্বরে বললো,
“দেখ তানিশা, একদম মজা করবিনা। কি হয়েছে আমাকে বল? বাসার থেকে আন্টি, আংকেল আবার চা’প দিচ্ছে তোকে? বল কি হয়েছে?”

তানিশা এবার কেঁদে উঠলো। হুহু করে কান্না যাকে বলে। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমার সত্যি বিয়া হইয়া গেছে রাকিব। বিশ্বাস কর, আমি আর তোর নাই। আমি অন্য একজনের হইয়া গেছি। আম্মা-আব্বা আমারে বিয়া দিয়া দিছে।”
রাকিব এবার ধমকের স্বরে চেঁচিয়ে বললো,

“তানিশা, কি হয়েছে আমাকে বল। আবোলতাবোল বকছিস কেনো? বিয়ে হয়ে গেছে মানে! বিয়ে হয়ে গেছে মানে কি? হ্যাঁ! বিয়ে কি ছেলে খেলা নাকি। বললি আর হয়ে গেলো। তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমার কি হবে?”
তানিশা নিজেকে পুনরায় কান্না করতে করতে বললো,

“আমারে তুই মাফ করিস না প্লিজ। আমি তোরে ঠকাইছি। আমারে টাকার কাছে বেইচা দিছে আমার বাপ-মা। আমি তাগো কাছে অনেক সস্তা ছিলাম রে বিশ্বাস কর, তাই তারা আমারে অনেক অল্প দামেই বেইচা দিছে। তুই মাফ করিস না আমারে৷ আমার মতো মাইয়ারে কেউ ভালোবাসেনা, তুইও বাসিস না। ”

ওপাশ থেকে বিকট শব্দ ভেসে আসলো। ফোনটা কে’টে গেলো। হয়তো রাকিব ফোনটাকে ছুড়ে ফেলেছে। আর তানিশা পাগলের মতো কান্না করতে লাগলো। জীবন কি সুন্দর! কেউ বিচ্ছেদের দুঃখে কাঁদছে আর কেউ প্রেয়সীকে বুকে আগলে ভালোবাসার গল্প শুনাচ্ছে। চারদিকে কত মানুষ, কত রুপ। তানিশা কান্না করতে করতে অস্পৃশ্য স্বরে বলছে,

“আমি কেন গরিব হইলাম আল্লাহ? তুমি তো যা করো ভালোর জন্য, তাইলে আমার কেন কষ্ট হইতাছে? আমি কেন সুখী হতে পারতাছিনা। আমার কষ্টটা একটু কমাইয়া দাও আল্লাহ! তুমি ছাড়া যে আমার কেউ নাই । আমি আর সহ্য করতে পারতাছিনা।

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ১৬

আমারে তুমি লইয়া যাও, তোমার কাছে। এই যন্ত্রণার থেইকা মুক্তি দাও আমারে। আচ্ছা আমার জীবনডা তো অন্যরকম হইলেও পারতো? কেন এমন হইলো জীবনডা?”
আজ একটা মেয়ে সর্বস্ব হারিয়ে কাঁদছে। জীবন কখন কোন দিকে মোড় নেয় কেউ বলতে পারেনা।এর শেষ কোথায়?

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ১৮