তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ১০

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ১০
জেনিফা চৌধুরী

ওয়াশরুমের পানির ট্যাপ ছেড়ে কাঁদছে বেলী। বুকের চাপা কষ্ট গুলো অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়ছে। মেয়েটা ভেতরে ভেতরে ম’রে গেছে। অতীতের চঞ্চল বেলী আজ শান্ত, নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আয়নার দিকে অশ্রু মাখা চেহারা নিয়ে তাকাতেই দেখলো, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, ঠোঁট গুলো তিরতির করে কাঁপছে। মনে পড়ে গেলো অতীতের সুন্দরতম এক স্মৃতি,
‘৬ বছর আগে’

সেদিন ছিলো নীলাভ্রর বোন ইশরাতের জন্মদিন। বাড়িতে কতশত আয়োজন। পুরো বাড়ি রঙিন লাইট দিয়ে ভরপুর। নীলাভ্র পড়েছে নীল রঙের পাঞ্জাবী। ছেলেটা বরাবরই পাঞ্জাবী পড়তে খুব ভালোবাসে। নীল রঙটা মানায় ভালো শ্যামবর্ণ শরীরে। ইশু, মেরিনা, আর বেলী পড়েছে কালো স্কার্ট। তিনজনেই মহা খুশিতে গানের তালে তালে নাচানাচি করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেলীর চুলগুলো কাঠি দিয়ে খোঁপা করা ছিলো। হালকা মেকাপে মেয়েটাকে দারুন লাগছে দেখতে। নীলাভ্র ব্যস্ততার মাঝেও আড় চোখে তার বেলীপ্রিয়াকে দেখতে ভুলছে না। খুব বিরক্ত লাগছে খোঁপা করা চুল দেখে। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। দেখলো সবাই কাজে ব্যস্ত। এই সুযোগে নীলাভ্র গিয়ে বেলীর পেছনে দাড়ালো।

খুব সযত্নে খোঁপা থেকে কাঠি বের করে নিলো। ওমনি চুল গুলো বিছিয়ে পড়লো সমস্ত পিঠ জুড়ে। চুল খুলে যেতেই বেলী থেমে গেলো। পেছনে ঘুরতেই নীলাভ্রর হাসোজ্জল মুখটা চোখে পড়লো। সবে নাইনে পড়ুয়া বেলী চোখে, মুখে তীব্র রাগ ফুটিয়ে বলে উঠলো,

“আপনি আমার চুলে হাত দিলেন কেনো?”
নীলাভ্র খামখেয়ালি ভাবে উত্তর দিলো,
“ভালো লাগছিলো না। এখন ভালো লাগছে।”
বেলী গাল ফুলালো। বললো,

“আপনি সব সময় কেনো এমন করেন নীলাভ্র ভাই?”
নীলাভ্র ভ্রু কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“কেমন করি?”
বেলী বাচ্চাদের মতো করে রাগ দেখিয়ে বললো,
“একদম ঢং করবেন না।”

নীলাভ্র হাসলো। বেলীর নাক টেনে বললো,
“রাগ করো কেনো বাবুই?”

বেলী আর রাগ দেখাতে পারলো না হেসে দিলো। তাল মিলিয়ে নীলাভ্র ও হেসে দিলো। হাসতে হাসতে মেরিন নাচতে নাচতে এসে বেলীর সাথে ধাক্কা খেলো, আচমকা মেরিনার পায়ের সাথে পা লেগে বেলী ধপাস করে পড়ে গেলো। সামনে বড় একটা মাটির ফুলদানি রাখা ছিলো।

পড়ে গিয়ে ফুলদানীর সাথে কপালে বাজে ভাবে ব্যাথা পেতেই, বেলী মৃদু শব্দে “আহঃ” করে উঠে। চোখের পলকে ঘটনাটা ঘটে যেতেই নীলাভ্র টের পেলো না কিছু। বেলী পড়ে যেতেই নীলাভ্র ‘বেলীপ্রিয়া’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। ছুটে গিয়ে আঁকড়ে ধরলো বেলীকে। হঠাৎ ঘটনায় সবাই ওদের দিকে তাঁকিয়ে।

হুড়মুড়িয়ে ছুটে এলো এদিকে। মেরিনা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। বেলীর কপালে খানিকটা কে’টে গেছে। পরিমানে খুবই সামান্য। এইটুকু দেখেই নীলাভ্রর জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। অস্থির হয়ে বলতে লাগলো,

“বেলীপ্রিয়া ব্যাথা পেয়েছিস? আর কোথায় লেগেছে? খুব ব্যাথা করছে বাবুই? কি করে পড়ে গেলি? কান্না করিস না প্লিজ। ”
নীলাভ্রর কথা শুনে বেলী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রিতা, আইরিন দুজনেই একসাথে প্রশ্ন করলো,

“পড়ে গেলি কি করে?”
বেলী ওদের দিকে তাকিয়ে ছোট করে উত্তর দিলো,
“বুঝতে পারিনি।”

বলতে বলতে উঠে দাড়ালো। রিতা নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে বেলীর কপালে লেগে থাকা র’ক্ত টুকু মুছে দিলো। কপালটা খানিক ফুলে উঠেছে। ফর্সা মুখে সামান্য আঁচড় টুকু মারাত্মক লাল হয়ে গেছে। আইরিন ছুটে গেলো বরফ আনতে। নীলাভ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে, মুখে বিরাজ করছে রাজ্যের অস্থিরতা। আইরিন বরফ এনে নীলাভ্রর হাতে দিয়ে বললো,

“নীল ত্যই একটু বরফটা লাগিয়ে দে বাবা। ওইদিকে রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। ”
বলে ছুটলো কিচেনের দিকে। রিতাও আইরিনের পিছু পিছু গেলো। ইশু আর মেরিনা দুজনে এবার এগিয়ে এলো বেলীর দিকে। মেরিনার ভয়ে কান্না করে দেওয়ার উপক্রম। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,

“আমি দেখিনি বেলী সত্যি। তোর অনেক ব্যাথা লেগেছে তাইনা রে?”
ইশু মেরিনার মাথায় গাট্টা মে’রে বলে উঠলো,
“তোর নজর কই থাকে অ’সভ্য? তোর জন্য এখন বেচারি ব্যাথা পেলো। ভাইয়া তুমি আমাকে বরফ টুকু দাও আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।”

নীলাভ্র ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে, বেলীর হাতটা চে’পে ধরে বলে উঠলো,
“তোদের লাগবে না। আমিই পারব।”
বলে বেলীকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। বেলী হাত মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বললো,
“নীলাভ্র ভাই, এত জোরে কেউ চে’পে ধরে ব্যাথা পাচ্ছি তো।”

এইবার নীলাভ্র ভয়ংকর চাহনী দিলো বেলীর দিকে। রাগে গর্জে উঠে বলে উঠলো,
“ঠিকঠাক ভাবে চলতে পারিস না। এত বড় মেয়ে, যেখানে-সেখানে পড়ে যায়। লজ্জা করেনা তোর?”
বেলী বুঝলো না। এখানে ওর দোষ কই? অবাক স্বরে বললো,
“আমার কি দোষ?”

নীলাভ্র বেলীকে খাটে বসিয়ে, নিজে ওর সামনে হাটু ভেঙে বসলো। কপালে বরফ ডলতে ডলতে বললো,
“তোর তো কোন দোষ নেই। সব দোষ অন্যদের। তুই ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানিস না। মাঝে মাঝে মন চায় তোর গালে সপাটে দুই-তিনটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দেই।”

নীলাভ্রর ধমকানো শুনে বেলী কান্না করে দিলো। এমনিতেই ব্যাথায় বেচারির জান বেরিয়ে যাচ্ছে। তার উপর ছেলেটা ওকে বকে যাচ্ছে। বেলীকে কান্না করতে দেখে নীলাভ্র ভ্যাবাচেকা খেলো। বললো,
“একি কান্না করছিস কেনো?”
বেলীর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। দুইহাত পানি মুছতে মুছতে উত্তর দিলো,
“ব্যাথা করছে।”

বলে ফুঁপিয়ে কান্না করে দিলো। নীলাভ্রর মুখটাও চুপসে গেলো। একমাত্র এই মেয়েটার কান্না ওর বুকে ক্ষত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই বেলীকে হাসানোর জন্য বললো,
“এই দেখ তোর চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। দেখতে একদম পে’ত্নী লাগছে। ওই যে শেওড়া গাছের পে’ত্নীটা আছেনা, ওর মতো লাগে। আজ থেকে তোর নাম শেওড়া গাছের পে’ত্নী। খুব ভালো নাম তাইনা? থাক আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। বোনের নাম ঠিক করা তো ভাইয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”

বলে ভাব নিয়ে কলার ঠিক করলো। বেলী আহাম্মকের মতো চেয়ে রইলো ওর দিকে। কিছুক্ষণ, কিছুসময়। তারপর রাগী স্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“আজকে শেওড়া গাছের পে’ত্নী আপনার ঘাড় মট’কাবে।”
বলে নীলাভ্রর দিকে হাত বাড়াতেই নীলাভ্র দৌড় দিতে দিতে বললো,
“আমাকে ছুঁতে পারলে তো।”

বেলীও থেমে থাকার পাত্রী নয়। রুমের থেকে একটা ছোট ফুলদানী হাতে নিয়ে নীলাভ্রর পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলো। দুজনে মিলে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আর সবাই ওদের খুনশুটি দেখে হাসচ্ছে। অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর নীলাভ্র হাঁপিয়ে উঠে শিড়িতে বসে পড়লো। এই সুযোগে বেলী ফুলদানীটা ছুড়ে মা’রার জন্য উঠাতেই, নীলাভ্র চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

“আল্লাহ গো! আমার বিয়ে হয়নি। এত তাড়াতাড়ি আমাকে মে’রে ফেললে, আমার বউটার কি হবে বলতো? ও তো বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যাবে।”
নীলাভ্রর কাঁদোকাঁদো চেহারাটা দেখে বেলী আর হাসি আটকে রাখতে পারলো না। শব্দে করে হেসে দিলো। এতক্ষণ পর বেলীর মুখে হাসি দেখে নীলাভ্রর চেহারায় তৃপ্তির হাসি ফুটলো। বেলী একনাগাড়ে হেসেই যাচ্ছে।
“তোরে কি জ্বি’নে ধরছে নাকি বইন? একলা একলা বাথরুমে ঢুইকা হাসতোস কেন?”

হঠাৎ করে চেনা কন্ঠ কানে আসতেই বেলীর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। এতক্ষণ অতীতে ডুবে ছিলো। খেয়ালেই ছিলো না। তড়িঘড়ি করে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে আসলো। বেলী বেরিয়ে আসতেই তানিশা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
“তোরে জ্বি’ন নাকি পি’শাচে ধরছিলো বইন?”

বেলী শান্ত স্বরেই বললো,
“আবোলতাবোল কথা ছাড়া তোর কি আর কোনো কাজ নাই? ”
তানিশা পাল্টা বলে উঠলো,
“জীবনে হুনছোস কোন মানুষ বাথরুমে ঢুইকা হাহা করে হাসে?”

বেলী ভ্যাবাচেকা খেলো। আমতা আমতা করে বললো,
“আমি হাসলাম কই? তুই ভুল শুনেছিস?”
তানিশা বেলীর মাথায় গাট্টা মে’রে বলে উঠলো,
“আমারে কি তোর বয়রা মনে হয়?”
বেলী হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিলো,
“মনে হয় না। তুই যে বয়রা আমি শিউর।”
কথাটা তানিশার পছন্দ হলো না। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

“থাকুম না তোর লগে। এত্ত বড় অপ’মান করলি।”
বলে মুখ গুমড়া করে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো। বেলী ওর রাগ দেখে, পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
“ওলে বাবুতা রাগ কলে না। প্লিজ…”
তানিশা মুখ ভেংচি কে’টে বললো,

“আইছে ঢং করতে। সামনের থেইকা সর কইতাছিস। তোর আলগা পিরিতের আমার দরকার নাই।”
বেলী তবুও ছাড়লো না। ক্যাম্পাসের এক কোনে এসে দুজনেই বসলো। তানিশার মুখ গুমড়া দেখে বেলী মুখ টিপে হাসলো। বললো,

“আজকে তোর মজনু কই রে?”
তানিশা গর্জে উঠে বলে উঠলো,
“ওই হা’লার নাতির কথা আমার সামনে কইবি না। ওই হা’লায় এক নাম্বার লু’চ্চা৷ রাস্তা ঘাটে যারে দেহে তারেই ওর ভাল্লাগে। ওর লগে আমার ব্রেকাপ।”
তানিশার কথা শুনে বেলী উচ্চস্বরে হেসে দিলো। তা দেখে তানিশা ধুম করে বেলীর পিঠে একটা কি’ল বসিয়ে দিলো। রাগান্বিত চোখ করে বললো,

“সর তো সামনের থাইকা। একদম ভ্যাটকাবি না। ”
বেলী হাসি থামানোর চেষ্টা করলো। পারলো না। এর মধ্যে রাকিব কোথা থেকে এসে হুড়মুড়িয়ে তানিশার পাশে বসে পড়লো। তা দেখে তানিশা লাফিয়ে উঠে বললো,
“রাকিব্বার বাচ্চা তুই আবার আইছোস। তোরে না কইছি তুই আমার সামনে আইবিনা।”
রাকিব ডোন্ট কেয়ার ভাবে উত্তর দিলো,

“তোরে না কইছি তুই রাকিব্বার বাচ্চা কইবি না। দিলে লাগে বইন, আমার মতো আবিয়াইত্তা পোলারে তুই বাচ্চার বাপ বানাইয়া দেস। তোর উপরে শুকনা ঠা’ডা পডব।”
তানিশা কি থেমে থাকার পাত্রী? বললো,
“জুতা ফিক্কা মা’রুম রাকিব্বা।”
রাকিব মুখ বাঁকালো। বললো,
“তোরে কি ডরাই আমি?”

তানিশা এইবার রেগে গিয়ে রাকিবের চুল ধরে টানতে লাগলো। রাকিব ও কম কিসে? দুজন দুজনের চুল ধরে টানা টানি করা আরম্ভ করে দিলো। আর বেলী হা হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এরা কি এখনো ছোট বাচ্চা? জোরে ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
“এই তোরা কি শুরু করলি? থামবি…”

বেলীর ধমক শুনে ওর দুজন থেমে গেলো। রাকিব চুল ঠিক করতে করতে বলে উঠলো,
“আল্লাহ গো আল্লাহ! এইডা মাইয়া নাকি দ’জ্জাল? এত জোর কইত্তে আহে? বান্দর ও তোর থেইকা ভালো আছে।”
তানিশা পাল্টা কিছু বলতে যাবে তার আগেই বেলী ধমকে বলে উঠলো,
“একদম চুপ।”

ওরা দুজনেই চুপ হয়ে গেলো। পরিস্থিতে বুঝে রাকিব বলে উঠলো,
“আমার খিদা লাগছে। খাইয়া আহি। তোরা খাবি? খাইলে আয়, না খাইলে ভাগ…”
তানিশ বিরবির করে বলে উঠলো,
“রা’ক্ষস একটা।”

রাকিব ওর কথায় পাত্তা দিলো না। ওর মধ্যেই ওদের সামনে দিয়ে একটা বয়স্ক লোক যাওয়ার সময় শব্দ করে বায়ু ছেড়ে গেলো। বিশ্রি গন্ধে বেলী সাথে সাথে মুখ চেপে ধরলো। তানিশা নাক চে’পে ধরে রাগী স্বরে বলে উঠলো,
“হা’লার ঘরে হা’লায়। পা”দ মা’রার আর জায়গা পাইলো না। কি গন্ধরে বাবা। ওয়াক ‘থু’। গ’রু ম’রা খাইয়া আইছে নাকি?”

বলে থুথু ফেলতে লাগলো। বেলী হাসবে নাকি কাঁদবে ভাবতে পেলো না। রাকিব ওর কথা শুনে বলে উঠলো,
“তুই তো মাঝে মাঝে এমন বায়ু দূর্ষণ করস। তাইলে মাইনসেরে এমনে কস কেন?”

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ৯

কথাটা তানিশার কানে যেতেই তানিশা রাকিবের পিঠে ধুম করে কি’ল বসিয়ে দে দৌড়। আর রাকিব জোরে তানিশার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো। বেলী কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। ওদের এই ঝগড়ার শেষ কোথায়?

তুমি নামক প্রশান্তি পর্ব ১১