তুমি শুধু আমারই হও পর্ব ৩৫

তুমি শুধু আমারই হও পর্ব ৩৫
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

রাতের ডিনার সেরে সকলেই যার যার ঘরে চলে গেছে। এখন নিচে শুধু শায়লা বেগম আর অর্নি আছে। টেবিলের সবকিছু দুজনে গোছগাছ করছে। সব কাজ সেড়ে শায়লা বেগম নিজের ঘরে চলে গেলেন। অর্নিও এক জগ পানি নিয়ে উপরে নিজদের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। পথিমধ্যে দেখা হলো ইশার সাথে। ইশা কিছু একটা বলতে চায় অর্নিকে। যা ইশার চোখমুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা বলতে সংকোচ করছে। অর্নিই হাসিমুখে বললো,

–“কিছু বলবেন আপু?”
ইশা চমকে তাকালো অর্নির দিকে। মেয়েটা কি সুন্দর ভাবে হাসিমুখে কথা বলছে ওর সাথে। যা ইশা কখনো আশা করেনি। সেদিন কি বাজে বিহেভিয়ার করেছিলো ওর সাথে। এরপরও সব ভুলে কি সুন্দর আপু ডাকছে। ইশা আমতা আমতা করে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–“আ্ আসলে অর্নি আ’ম স্যরি। আমি সেদিন তোমাকে___”
–“ইট’স ওকেহ আপু। আমি সেসব মনে রাখিনি। আপনার দিকটা আমি বুঝি। আপনি উৎসবকে ভালোবাসেন তাই উনার পাশে আমাকে সহ্য করতে পারেননি। এটাই স্বাভাবিক, আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারি না৷ কিন্তু আপু এখানে আপনার ভালোবাসাটা এক তরফা ছিলো।”

–“বুঝতে পেরেছি, আর যাই হোক না কেন জোর করে ভালোবাসা হয় না। উৎসব তোমাকে ভালোবাসে। আমি চাই উৎসব সারাজীবন হ্যাপি থাকুক। সেটা তোমার সাথে হলে তাই হবে৷ আমি আর আসবো না তোমাদের মাঝে। আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ।”
মাথা নিচু করে কথাগুলো বললো ইশা। অর্নি আচমকাই একহাতে ইশাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো,

–“আপনি বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক। আই হোপ, আল্লাহ আপনার লাইফে উৎসবের থেকেও বেটার কাউকে রেখেছে।”
ইশাও আলতো হেসে অর্নির পিঠে হাত রাখলো। এমন সময় ঘর থেকে উৎসব ক্ষানিকটা চেঁচিয়ে বললো,
–“অর্নি? কোথায় তুমি?”
অর্নি ইশাকে ছেড়ে দাঁড়ালো। ইশা মৃদু হেসে বললো,
–“উৎসব ডাকছে তোমাকে, তুমি যাও।”

অর্নি মুচকি হেসে ঘরে ঢুকে পড়লো। ইশা সেদিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো৷ বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে ও। ভালোবাসে তো, প্রচন্ড ভালোবাসে উৎসবকে। কিন্তু উৎসব যে ওর ভাগ্যে নেই। এটাই মেনে নিতে হবে এখন।
অর্নি পানির জগটা টেবিলের উপর রাখতেই উৎসব এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো অর্নিকে। অর্নি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

–“ছাড়ুন তো, সময় পেলেই শুধু জাপ্টে ধরার বাহানা।”
উৎসব আবারো এগিয়ে গেলো জড়িয়ে ধরতে। অর্নি সরে গেলো। উৎসব মুখ ভার করে বললো,
–“অন্যায়টা কি এতে? নিজের বউকেই তো জড়িয়ে ধরি।”
অর্নি পাত্তা দিলো না সেদিকে৷ চুপচাপ বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। উৎসব বিছানায় বসে অর্নিকে টান দিয়ে নিজের কোলে বসালো। বললো,

–“আসতে এত সময় লাগলো কেন?”
–“ইশা আপুর সাথে দেখা হয়েছিলো।”
কথাটা শুনে উৎসবের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
–“কি বলেছে তোমায়? আবার উল্টাপাল্টা কিছু?”
–“রিল্যাক্স, উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি। স্যরি বলেছে সেদিনের বিহেভিয়ার এর জন্য।”
নরম হয়ে এলো উৎসব৷ শান্ত গলায় বললো,

–“ওহ।”
অর্নি উৎসবের দিকে ঘুরে বসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
–“একটা কথা বলবো?”
উৎসব শক্ত করে অর্নির কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো,
–“হ্যাঁ বলো।”
–“সাতদিন পর তো আমাদের বিয়ে।”
–“হ্যাঁ তো?”

–“আমি চাচ্ছিলাম বিয়ের আগ অব্দি আমাদের বাসায় গিয়ে থাকতে। একেবারে বউ সেজে তারপর আপনার সাথে আবার এ বাড়িতে পা রাখবো আমি।”
–“উঁহু, এতদিন ছেড়ে থাকা পসিবল না। আর তাছাড়া আমরা তো একই রিসোর্টে উঠছি। রিসোর্টে গিয়ে না হয় তুমি তোমাদের পরিবারের সাথে থাকবে।”
–“উঁহু, লোকে কি বলবে? বউ বিয়ের দিনও শ্বশুর বাড়ির লোকের সাথে রিসোর্টে এসেছে। কেমন দেখায় না এটা?”
–“লোকের কথায় আমার কিচ্ছু যায় আসে না।”

–“আমার যায় আসে উৎসব। বোঝার চেষ্টা করুন। যাই না আমাদের বাড়ি। সাতদিনেরই তো ব্যাপার। আবার তো আপনার কাছেই চলে আসবো আমি।”
–“আচ্ছা দিয়ে আসবো। তবে কালই না। রিসোর্টে যাওয়ার আগের দিন বিকেলে।”
অর্নি অসহায় চোখে তাকালো। বুঝলো এর থেকে বেশি এই ছেলেকে মানানো সম্ভব না। তাই আর কিছু বললো না৷

নূর আর অর্নি ইচ্ছে ওদের বিয়েতে রঙ খেলা, সঙ্গীত, মেহেন্দি, হলদু, এবং বিয়ে মোট পাঁচদিনে পাঁচটা অনুষ্ঠান করা হবে। সেই মোতাবেকই উৎসব অর্নব শান্ত সবকিছু রেডি করছে। যতই হোক ওদের ইচ্ছে তো আর অপূর্ণ রাখা যায় না৷
বিয়ের কেনাকাটা করতে এসেছে আজ সকলে মিলে। সবার পার্টনার সবাইকে তার মেহেন্দি থেকে শুরু করে বিয়ের ড্রেস সব চুজ করে দিবে৷ শুধুমাত্র রংখেলার ড্রেস কোড সকলের একই হবে। ছেলেরা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর মেয়েরা সাদা শর্ট কামিজ, সাদা ধুতি আর সাথে রংবেরঙের ওড়না। তাই রঙ খেলার ড্রেস ব্যাতিত বাকী সব ড্রেস যার যার পার্টনার চুজ করে দিবে।

টায়রার ইচ্ছে বিয়েতে বেনারসি শাড়ি নিবে। ওর মতে, বাঙালি মেয়েদের বিয়েতে শাড়িতেই বেস্ট লাগে। তাই ওর ইচ্ছে অনুযায়ী অর্নব টায়রার জন্য শাড়ি চুজ করছে। আর অন্যদিকে অর্নি আর নূর দুজনেই লেহেঙ্গা নিবে। ওদের মত অনুযায়ী ওরা বিয়েতে শাড়ি সামলাতে পারবে না। এক-জোড়া বিয়ে হলে একটা কথা ছিলো। সেখানে যে কোনো ড্রেস পড়ে গেট ধরা থেকে শুরু করে বরের জুতা সামলানো যেকোনো কিছু অনায়াসে করা যেতো।

কিন্তু এখানে তো, তিন-জোড়া বিয়ে হবে৷ আর বিয়ের শাড়ি পড়ে গেট ধরা, জুতা সামলানো কিছুই পসিবল না। তাই ওরা বিয়েতে লেহেঙ্গা পড়বে।

অর্নির কথা হলো, নূর ওর একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড প্লাস ননদিনী, তার বিয়েতে মজা করবে না এটা কি কখনো হয়? কখনোই না। একই দিনে নিজের বিয়ে তো কি হয়েছে? নূরের বিয়েতে মজা তো সে অবশ্যই করবে। বরের গেট ধরা, শরবত খাওয়ানো, হাত ধোয়ানো, জুতা সামলানো এভ্রিথিং। এভ্রিথিং করবে অর্নি। কিচ্ছুটি বাদ রাখবে না। উৎসবও এ নিয়ে কিছু বলেনি। জানে অর্নিকে থামানো যাবে না সেদিন। নূরের বিয়ে বলে কথা। তাই ওদের ইচ্ছে মতোই বিয়ের জন্য লেহেঙ্গা চুজ করে দিলো।

সব কেনাকাটা করে একেবারে রাতের ডিনার সেরে সকলে বাড়ি ফিরলো। অর্নি আর নূর সবকিছু শায়লা বেগমকে দেখিয়ে তারপর উপরে গেলো। অর্নি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা নূরের সাথে ওর রুমে গিয়েই ধপাস করে শুয়ে পড়লো। সারাদিন প্রচুর হাটাহাটি পড়েছে সকলেই টায়ার্ড। উৎসব ওদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে একটা কাজে বেরিয়েছে৷ তাই অর্নি নূরের ঘরে চলে এলো। এসময়ে একা ভালো লাগবে না ঘরে৷ কয এ সময়ে উৎসব সবসময় বাড়িতেই থাকে। শুয়ে শুয়ে দুই বান্ধবী নিজেদের বিয়ে নিয়ে বেশ কিছু প্ল্যান করলো৷ কি করবে কিভাবে নাচবে সব। কথা বলতে বলতে দুজনে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তার কোনো হদিস নেই।

প্রতিদিনকার মতো ঘরে গিয়ে অর্নিকে দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো উৎসব৷ ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে বারোটা বাজে। অফিসের কাজটা সারতে সারতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। এই সময় যাবে কোথায় ও? নিচে তো লাইট অফ দেখলো তার মানে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। নূরের রুমে গেছে? হয়তো বা৷ এই মেয়েকে দিয়ে তো আবার বিশ্বাস নেই। কখন কি করে বসে। এসব ভেবে ফ্রেশ হতে গেলো উৎসব৷

লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে৷ তারপর নূরের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। উৎসবের সন্দেহই ঠিক হলো। নূরের ঘরেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে অর্নি৷ দেখলো দুজনে লাইট অন করেই ঘুমিয়ে আছে৷ দুজনেই গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। উৎসব ফ্যানের গতি কমিয়ে নূরের গাঁয়ে কাঁথা দিয়ে দিলো। তারপর অর্নিকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো৷ করিডোরে শায়লা বেগমের সাথে দেখা হলো। শায়লা বেগম চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলল,

–“কিরে অর্নির কিছু হয়েছে কি?”
–“রিল্যাক্স আম্মু কিছু হয়নি, ঘুমোচ্ছে ও। আমার আসতে দেরী হচ্ছে দেখে মেবি নূরের সাথে শুয়েছিলো। তাই নিয়ে এলাম। তুমি একটু নূরের ঘরের লাইট অফ করে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আসো প্লিজ।”
শায়লা বেগম মুচকি হেসে বললো,

–“তুই যা। আমি নূরের ঘরের লাইট অফ করে দিয়ে দরজা চাপিয়ে দিবো।”
উৎসব আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে। অর্নিকে শুইয়ে দিয়ে দরজা আটকে উৎসব নিজেও শুয়ে পড়লো অর্নির পাশে৷ অর্নির কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো।

অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে উৎসব। অর্নি বিছানায় বসে পা ঝুলিয়ে উৎসবের দিকেই তাকিয়ে আছে। অর্নি উঠে উৎসবের শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিলো। গলায় টাই বেঁধে দিলো। উৎসব অর্নির কপালে চুমু দিয়ে বললো,
–“আসছি বউ।”
–“আজ তাড়াতাড়ি ফিরবেন কিন্তু।”
উৎসব ভ্রু কুঁচকে ফেললো। জিজ্ঞেস করলো,

–“কেন?”
–“সেকি ভুলে গেলেন? কাল তো আমরা রিসোর্টে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়বো। সেই হিসেবে তো আজ আমাকে আমাদের বাসায় দিয়ে আসার কথা।”
–“বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা কিছুতেই ভুলছো না দেখছি।”
–“ভুলবো কেন?”
উৎসব অসহায় কন্ঠে বললো,

–“আজ রাত সহ, হলুদের রাত অব্দি পাঁচ পাঁচটা রাত তোমাকে ছাড়া থাকতে হবে বউ।”
–“বেশি না তো। মাত্র পাঁচ রাত। তাছাড়া দিনের বেলায় তো আপনার চোখের সামনেই থাকছি।”
উৎসব তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
–“আচ্ছা, অফিস থেকে এসে দিয়ে আসবো।”
কথাটা বলে কিছুক্ষণ অর্নিকে জড়িয়ে ধরে রেখে বেরিয়ে পড়লো উৎসব।

সন্ধ্যা নাগাদ অর্নিকে নিয়ে বের হলো উৎসব। অর্নিকে ওদের বাসায় রেখে আসতে যাচ্ছে৷ মিনিট দশেক বাদেই অর্নিদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামালো উৎসব। অর্নি নামতে গেলে উৎসব অর্নিকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখে বেশ কিছুক্ষণ। অর্নির কপালে গভীর ভাবে একটা চুমু দিয়ে বললো,
–“কাল দেখা হচ্ছে তাহলে, ততক্ষণে কেয়ারফুলি থাকবা।”
–“ওকে ডিয়ার হাজবেন্ড। আপনিও সাবধানে থাকবেন।”

এই বলে অর্নি উৎসবের গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর নেমে গেলো গাড়ি থেকে৷ অর্নি গাড়ি থেকে নেমে বললো,
–“বাসায় চলুন না, আম্মু আর ভাইয়ার সাথে দেখা করে যাবেন।”
–“উঁহু, এখন না। পরে কখনো আসবো।”
অর্নি কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,

–“আচ্ছা শ্বশুর বাড়ির সামনে থেকে এভাবে চলে যাওয়াটা কেমন দেখায় বলুন তো? বিয়ের এতগুলো মাসে আপনি কয়বার এসেছেন আমাদের বাড়ি?”
উৎসব অর্নির দিকে ঝুঁকে গিয়ে অর্নির নাক টেনে দিয়ে বললো,
–“আসবো আসবো, আপাতত আপনি ভিতরে যান। নয়তো পরে দেখা যাবে আপনাকে আবার আমার সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছি আমি। তখন কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবেন না।”
অর্নি চোখ রাঙিয়ে তাকালো। উৎসব মৃদু হাসলো। হেসেই বললো,

তুমি শুধু আমারই হও পর্ব ৩৪

–“ভিতরে যাও এবার।”
অর্নি মৃদু হেসে উৎসবকে বিদায় জানিয়ে বাসার ভিতর ঢুকে পড়লো। উৎসবও গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলো নিজ বাসায়। অর্নি আবারো বাইরে এসে তাকিয়ে রইলো উৎসবের গাড়ির দিকে। যতক্ষণ গাড়িটা চোখের আড়াল না হলো ততক্ষণ একই ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো ওখানে। গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই অর্নি ভিতরে চলে গেলো। সত্যি বলতে অর্নির নিজেরও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে উৎসবকে ছেড়ে আসায়। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে খুব অমূল্য কিছু পেছনে ফেলে এসেছে।

তুমি শুধু আমারই হও পর্ব ৩৬