তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ১৪

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ১৪
Israt Bintey Ishaque

স্যার ফাইলটি সাইন করেছেন?
স্যার শুনতে পাচ্ছেন?
স্যার আপনার কি শরীর খারাপ করছে?
অফিসের একজন এমপ্লয়ে জিসান আহমেদ সাহেব একটা ফাইল চেক করে সাইন করে দেওয়ার জন্য দিয়েছেন রাদ শাহমাত কে। অথচ রাদ শাহমাত এক দৃষ্টিতে ফাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। নড়াচড়া নেই কিছু নেই। এরকম অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে জিসান আহমেদ সাহেব।
রাদ শাহমাত শুকনো কাশি দিয়ে বলল,

—” না কিছু হয়নি আপনি বিচলিত হবেন না।
তারপর রাদ শাহমাত সাইন করে ফাইল দিয়ে দিলে জিসান আহমেদ সাহেব চলে যান।
রাদ তার নরম চেয়ারে মাথা হেলিয়ে রাখে। গতকাল রাতের নজরাত এর মুখশ্রী বার বার তার মানসপটে ভেসে ওঠে। অফিসে মন বসে না তার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সন্ধ্যা বেলা রাদ শাহমাত অফিস থেকে ফিরেই নজরাত কে রুমে ডেকে পাঠালো।
নজরাত ইউটিউব ভিডিও দেখে সন্ধ্যার নাস্তা তৈরি করছিল। পাশে মণি তাকে সাহায্য করছে। তখন রাহা এসে বলল,
—” ভাবীমণি তোমাকে ভাইয়া জরুরি ভিত্তিতে তলব করেছে। তুমি তারাতাড়ি গিয়ে তাকে শান্ত কর হা হা হা।
নজরাত ভিডিও দেখতে দেখতে বলল,

—” মজা করছো না?
—” মোটেও না সত্যি বলছি আমি তুমি গিয়ে দেখে আসো গিয়ে।
নজরাত ফোনের ভিডিওটি অফ রেখে বলল,
—” কাউকে হাসাবার উদেশ্যেও কৌতুক করে মিথ্যা বলা বৈধ নয়। মহানবী (সঃ) বলেছেন, “সর্বনাশ সেই ব্যক্তির, যে লোককে হাসাবার উদেশ্যে মিথ্যা বলে। তাঁর জন্য সর্বনাশ, তাঁর জন্য সর্বনাশ।[১]
(সহিহুল জ’মে ৭০১৩ নং)
রাহা মন খারাপ করে বলল,

—” তুমি আমাকে বিশ্বাস ই করছো না। আমি সত্যি বলছি ভাইয়া তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।
রাহা এবার বিশ্বাস করলো। ফোন রেখে বলল,
—” আমাকে কেন ডাকবেন তিনি? কখনো তো এভাবে ডাকেন নি।
—” এখন থেকে ডাকবে বুঝছো? এবার যাও।
নজরাত যেতে নিলে রাহা বলল,

—” ধন্যবাদ ভাবীমণি, এভাবে হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলার জন্য। আমি আমার বন্ধুদের সাথেও কখনো দুষ্টুমি করে মিথ্যা বলবো না ইনশা আল্লাহ।
নজরাত ক্ষীণ একটু হেসে উপরের দিকে গেল।
রাদ শাহমাত দুই হাতে মুখশ্রী চেপে ধরে সোফায় বসে আছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। গায়ে পরিহিত ব্লেজার টা বিছানায় ছুড়ে ফেলে রেখেছে। এতো শীতের মাঝেও যেন তার শীত অনুভব হচ্ছে না।
নজরাত আসতে উঠে দাঁড়ায় সে। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলল,

—” আমি পাপী! ভীষণ পাপী। সবকিছু জেনেও কেন পরে আছেন এখানে? চলে যান এখান থেকে। নিজের মতো করে বাঁচুন। প্লিজ আমাকে মুক্তি দিন প্লিজ?
নজরাত আজকে নিজেকে সংযত করতে পারল না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে তার। রাদ শাহমাত এর সার্ট এর কলার চেপে ধরে তেজী চোখে চেয়ে বলল,

—” এখন কি পর নারীতে আসক্ত হয়ে আছেন? আমি চলে গেলে আপনার পথ ক্লিয়ার হবে বুঝি? জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ করেছি আপনাকে বিয়ে করে! আপনি একটা লম্পট! চরিত্রহীন!
চোখমুখ রা’গে অপমানে অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে নজরাত এর। রাদ শাহমাত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আজকে প্রথম নজরাত কে এমন রুপে দেখছে সে। শান্ত শিষ্ট মেয়েটা ভীষণ ক্ষেপে গেছে তাকে দমানো খুব কঠিন কাজ। নজরাত আর দাঁড়াল না। ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ তার উত্তপ্ত মাথাটিকে ঠান্ডা করল। তারপর স্থির মাথায় ভাবতে বসল।
কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কিছু ভাবলো। তারপর রুমে ফিরে এসে রাদ শাহমাত কে কোথাও দেখতে না পেয়ে। সাজেদা চৌধুরীর কাছে যাওয়া ধরল। এই একটা মানুষ যখন স্নেহের স্বরে কিছু বলে তখন নজরাত একদম শান্ত হয়ে যায়। নতুন করে তার পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যায়।

—” মা কি করছেন?
সাজেদা চৌধুরী বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নজরাত এগিয়ে গিয়ে বলল,
—” মা এই ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন যে?
—” মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে আছে ব‌উমা তাই বাহিরের ঠান্ডা গায়ে লাগছে না।
—” কেন মা? আমাকে বলুন আপনার মন খারাপ কেন?
—” তোমার জন্য আমার খারাপ লাগে ব‌উমা। আমি যে পাপ করেছি আমার ছেলের সাথে বিয়ে…
নজরাত সাজেদা চৌধুরী কে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলল,

—” মা প্লিজ। এভাবে বলবেন না। আমাকে আর কটা দিন সময় দিন। তাছাড়া এসব চিন্তা না করে। রাহার কথা ভাবুন। বিয়ের দিন তো ঘনিয়ে আসছে। কিভাবে কি করতে হবে তা তো পরিকল্পনা করে ঠিক করতে হবে তো নাকি?
—” তুমি যেখানে আছো সেখানে আমার চিন্তা কিসের? আমি নিশ্চিত মনে আছি তুমি আছো বলে।
নজরাত ক্ষীণ একটু হাসে।

রাদ শাহমাত লাইব্রেরী কক্ষে রাখা ডিবানে শুয়ে আছে। নজরাত তার খাতা পত্র রাখা গোল টেবিলে বসে কিছুক্ষণ কি সব লিখল। তারপর রাদ শাহমাত এর দিকে নির্নিশেষ চোখে চেয়ে বলল,
—” আপনি কি রুপকথা কে বিয়ে করছেন?
রাদ শাহমাত কপাল থেকে হাতটা নামিয়ে তাকায় নজরাত এর দিকে। তারপর শূন্য দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল,
—” না। ও একটা ফেইক। আমি কখনো ওর ছায়া ও সহ্য করতে পারবো না। আমাকে ঠকিয়েছে ওই মেয়ে।

—” আমি সবটা শুনেছি। যা বুঝলাম আপনি কখনো কোন মানুষ কে ভালোবাসেন নি। ভালোবেসেছেন শুধু সাহিত্য কে।
রাদ শাহমাত উঠে বসে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নজরাত এর দিকে। নজরাত আবারো বলে,
—” যেদিন কোন মানুষ কে ভালোবাসতে পারবেন সেদিন ই তাকে নিজের করে পাবেন। তা না হলে নয়।
—” আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে!
—” যেমন?
রাদ শাহমাত বিরস মুখে বলে,

—” যাকে আমার স্বপ্নের রানী ভেবেছিলাম সেই আসলে ফেইক। যাকে ভালোবেসে এতো দূর সেই বিবাহিত। এই সব কিছুর মাঝে ঘরে স্ত্রী রেখে মরীচিকার পেছনে দৌড়ে বেরিয়েছি। পাপ করেছি যার কঠিন শাস্তি পেতে হবে আমাকে। এতো কিছুর পরেও কোন মুখে কাউকে ভালোবাসবো আমি?
নজরাত গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে স্নেহভরে বলল,
—” ফিরে আসুন আল্লাহর পথে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। নিয়মিত সালাত আদায় করুন তাহলে অন্তর কুলসিত হবে না ইনশা আল্লাহ।

—” আমার এতো গুলো পাপ কি ক্ষমা করবেন আল্লাহ তা’আলা? আমি যে আমার মায়ের সাথেও বেয়াদবি করেছি যার কোন মাফ হয় না। তাই বলছি আপনি নতুন করে জীবন শুরু করুন। আপনি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন।
—” আপনি একটা কাপুরুষ!
—” হুম জানি।
—” এভাবে চললে হয় না। আমি আপনি একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই বলছি,

আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ চিত্তে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি ক্ষমা করে দেবেন। কেননা আল্লাহপাক কোরআনের শতাধিক আয়াতে নিজেকে ক্ষমাশীল বলে ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দাদের জানিয়ে দাও যে নিশ্চয়ই আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও অপরিসীম দয়ালু।[১]
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, ‘এর পরেও কি তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে না (অর্থাৎ তাওবা করবে না) এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? অথচ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান।[২]
বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ অসীম। আল্লাহ বলেন, ‘বলো, হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

ক্ষমা লাভের উপায় : কোরআন ও হাদিসে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করার অনেক উপায় বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি উপায় এখানে উল্লেখ করা হলো—
ঈমান ও নেক কাজ : যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে, আল্লাহ তাদের ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে ও সত্কর্ম করে, আল্লাহ তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের।[৪]
—” আপনি কি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন?
রাদ শাহমাত এর এহেন জিজ্ঞাসাবাদে নজরাত এর খুব হাসি পাচ্ছে। বিয়ের এতো গুলো মাস পর তার স্বামী নামক মানুষটি জিজ্ঞাসা করছে সে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে কিনা? খুবই হাস্যকর ব্যাপার….

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ১৩

রেফারেন্স:
[১](সুরা হিজর, আয়াত : ৪৯)
[২](সুরা মায়েদা, আয়াত : ৭৪)
[৩](সুরা জুমার, আয়াত : ৫৩)
[৪](সুরা ফাতহ, আয়াত : ২৯; সুরা মায়েদা, আয়াত : ৯)

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ১৫