তোমার নিরব অভিমানীনি বোনাস পর্ব

তোমার নিরব অভিমানীনি বোনাস পর্ব
Israt Bintey Ishaque

আহম্মেদ সবাইকে এয়ার পোর্ট পৌঁছে দিয়ে এসে দেখে নাদিয়া বাসায় নেই। আরুষি কে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, কোথায় গেছে তাকে কিছু বলে যায়নি নাদিয়া।
আহম্মেদ খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। নাদিয়ার ফোনে কল করেও কাজ হয়নি। ফোন বন্ধ রাখা।

রাত বেড়ে যায় তখনো নাদিয়া বাসায় ফিরে না। নাদিয়া যেখানে যেখানে যায় এমন কয়েক জায়গায়, আহম্মেদ গাড়ি নিয়ে খুঁজে বেরায় কিন্তু নাদিয়ার কোন হদিস পায় না। শেষে না পেয়ে বাসায় ফিরে আসে। নামাযের মোনাজাতে নাদিয়ার হেফাজতের জন্য দু’আ করে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এর আধা ঘন্টা পর নাদিয়া বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু সে একদমই নিজের মধ্যে নেই। ড্রিংস করেছে যার দরুন ঢুলতে ঢুলতে ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে কার্পেটে শুয়ে পড়ে। বাসার একজন হেল্পিং হ্যান্ড এ খবর আহম্মেদ কে জানালে, সে আলহামদুলিল্লাহ বলে দ্রুত পায়ে ড্রয়িং রুমে আসে।

নাদিয়ার বাহ্যিক দিক দেখেই আহম্মেদ এর বুঝতে বাকি থাকে না। নাদিয়া ঠিক কি করেছে এতোটা সময়।
মেয়েটার গায়ে ওয়েস্টান ড্রেস। পিঠ অবধি চুল গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলোমেলো হয়ে আছে। কালো কাজলে চোখের কোল লেপ্টে আছে। মুখে আবলতাবল বকে যাচ্ছে। সাথে মাকে নিয়ে হাজারো অভিযোগ!
আহম্মেদ কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে চিনি ছাড়া লেবুর শরবত নিয়ে আসলো। নাদিয়া কে খাওয়াতে চাইলে সে একটু মুখে নিয়ে ওয়াক করে বলে,

–” কি বাজে! কি এনেছো এসব? আমি খাবো না এগুলো।
আহম্মেদ তবুও জোর করে খাইয়ে দেয় শরবত টা। এর ফলে বুমি করে ভাসিয়ে দেয় নাদিয়া। আহম্মেদ হেল্পিং হ্যান্ড সীমান কে ডেকে পরিষ্কার করতে বলে। নাদিয়া কে রুমে নিয়ে যায়।

সকাল বেলা ঘুম ভা‌ঙ্গতে উঠে বসে নাদিয়া। মাথাটা কেমন ভারী লাগছে তার।
আহম্মেদ অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। তার ঘুম ভেঙ্গেছে দেখে বিদ্রুপ করে বলল,
–” আমার মাথায় ঢুকে না তোমার মত মেয়ে ফুফু মণির সন্তান হয় কি করে!
নাদিয়া বুঝতে পারলো তাকে ঠান্ডা মাথায় অপমান করল আহম্মেদ। তাই চোখমুখ রা’গে অপমানে অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করতে লাগল। তেজী চোখে চেয়ে বলল,

–” তোমার ফুফু মণি কি পীর আউলিয়া! যে তার মেয়ে হয়ে বিরাট ভুল হয়ে গেছে?
আহম্মেদ আফসোসের স্বরে মাথা নাড়ায়। আর খুব ম্লান হেসে বলে,
–” আল্লাহ তা’আলা যতক্ষন পর্যন্ত তোমাকে হেদায়েত দান না করছেন ততক্ষন পর্যন্ত কারো শক্তি নেই তোমাকে আলোর পথে ফিরানোর। দু’আ করি আল্লাহ তা’আলা যেন তোমাকে একটু করুণা করেন।

–” আমি এতোই যখন খারাপ তখন আমাকে নাচতে নাচতে বিয়ে করলে কেন? এখন সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করতে হবে তোমাকে! তা যদি করতে না পারো তবে ডিভোর্স দিয়ে দাও?
আহম্মেদ বিষন্ন গলায় বলল,

–” আমি না হয় ডিভোর্স দিয়ে দিলে তুমি মুক্তি পেয়ে যাবে। কিন্তু এই ক্ষণিকের দুনিয়ায় আল্লাহর অবাধ্যতা করে মৃ’ত্যুর পর জাহান্নামের কঠিন শা’স্তি সহ্য করতে পারবে তো? হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত যে, রাসুল( সাঃ) সুরা আল ইমরান (১০৩ আয়াত) আয়াতটি তেলাওয়াত করেন।
অর্থ; হে বিশ্ব বাসীগন তোমরা আল্লাহ কে ভয় করো।

ভয় করার মতো ভয় করো। সাবধান কখনো মৃত্যু বরণ করো না। প্রকৃত মুমিন মুসলমান না হওয়া পর্যন্ত।
রাসুল (সাঃ) বলেন, যদি যাক্কুমের একটি ফোটা দুনিয়ায় পড়তো তবে দুনিয়া বাসীদের খাদ্য- পানীয় সব নষ্ট হয়ে যেত। তাহলে কেমন যাদের (জাহান্নামীদের) খাদ্যই হবে শুধু যাক্কুম।৷
ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণঃ

জাহান্নামীদের খাদ্য ও পানীয়ঃ উল্লেখ যে পরকালে কোন মৃত্যু নেই। যত কঠিন শাস্তিই দেয়া হোক না কেন,তাতে কারো মৃত্যু ঘটবে না। বরং আগুনে পুড়ে অংগার হওয়ার সাথে সাথে নতুন ভাবে চামড়া, গোস্ত ও রক্ত দিয়ে পুনরায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে।যাতে নতুন ভাবে পূর্ণ মাত্রায় আযাব ভোগ করতে পারে।

এতো গেল আগুনে পুড়িয়ে আযাব দেওয়ার কথা, মূলত সর্ব ক্ষেএে তাদের কে আযাব দেওয়া হবে। খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেএে যে আযাব হবে তার ধরন হবে এই যে, পানীয় বলতে তাদের কে দুর্গন্ধযুক্ত গিসলীন নামীয় পূঁজ পান করানো হবে। যা পেটে পৌছার পূর্বেই বমি হয়ে বেরিয়ে যাবার উপক্রম হবে। অথচ পিপাসার অতিশয্যে তারা উহাই পান করে তৃষ্ণা মেটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করবে। আর খাদ্য হিসেবে তাদের কে দেওয়া হবে অতিশয় তিক্ত যাক্কুম নামক খাদ্য। যার তিক্ততা সম্মন্ধে বলা হয়েছে যে, যাক্কুমের একটি মাত্র ফোটা ও যদি দুনিয়ার পড়তো তাহলে দুনিয়ায় মানুষ, পশু – পাখি ও কীট- পতঙ্গের খাদ্য পানীয় সব তেতো হয়ে যেত। এখন অনুমান করেন যে, যাদের কে যাক্কুম পেট পুরে খাওয়ানো হবে তাদের অবস্থা কেমন হবে? তারাও জঠর জ্বালা মেটানোর জন্য উক্ত যাক্কুম খেতে বাধ্য হবে।

আহম্মেদ এর কথা গুলো একটুও ইফেক্ট করল না নাদিয়া কে। সে মুখ বাঁকিয়ে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যা দেখে আহম্মেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেড়িয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে।
নাদিয়া তার ইচ্ছা মতো জীবন যাপন করতে লাগলো। আহম্মেদ মাঝে মাঝে কোর‌আনের আলোকে ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝায় কিন্তু কোন কথাই আমলে নেয় না নাদিয়া। উল্টো এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া করে। নামাযের সময় অনেক অনুরোধ করেও তাকে জায়নামাজে দাঁড় করাতে পারে না আহম্মেদ।

তাওফিক ও হেদায়েত আল্লাহ্‌র হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিতে চান তাকে হেদায়েত দেন; আর যাকে পথ ভ্রষ্ট করতে চান তাকে পথ ভ্রষ্ট করেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “এটা আল্লাহ্‌র পথনির্দেশ, তিনি তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন। আল্লাহ্‌ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন হেদায়াতকারী নেই।
“[সূরা যুমার, ৩৯:২৩]

তিনি আরও বলেন: “আল্লাহ যাকে পথ দেখান সে-ই পথ পায় এবং যাদেরকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।”[সূরা আল-আরাফ, ৭:১৭৮]
আহম্মেদ বুঝতে পারে যে, সে যত‌ই জোর করে না তাতে কোন কাজ হবে না। যতক্ষন পর্যন্ত না আল্লাহ তা’আলা চাইবেন। তাই আহম্মেদ আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করে দু’আ করতে থাকে।
__________
প্রতিদিনের মত আজও পার্টি থ্রু করে রাত করে বাসায় ফিরে নাদিয়া। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আরুষি খাবার খাওয়ার কথা বললে, সে জানায় বাহিরে থেকে খেয়ে এসেছে। তাই খাবে না।
নিজের প্রাণ প্রিয় ফুফু মণির মেয়ে বলে কিছু বলে না আরুষি। অন্য কেউ হলে থা’প্পড় দিয়ে সোজা করত। তবে সেও দুআ করে নাদিয়ার জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা যেন তাকে হেদায়েত দান করেন। তার ভাইয়া কে যেন এসব সহ্য করতে আল্লাহ ধৈর্য দেন। এই বলে অনেক দুআ করে। কেননা “দু’আর শক্তি এতো বেশি যে, দু’আ বান্দার তাকদির পর্যন্ত বদলে দিতে পারে! সুবহান আল্লাহ।

সকাল বেলা ফোনের রিং টোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে নাদিয়ার। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফোন রিসিভ করে কর্নধারে রাখে। অতঃপর যা শুনে তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না নাদিয়া। হাত থেকে ফোন পড়ে যায় ফ্লোরে। থরথর করে কাঁপতে থাকে তার পুরো শরীর। কাঁপা কাঁপা পায়ে কোন রকম ড্রয়িং রুমে আসে। আহম্মেদ কে দেখতে পেয়ে বলে,
–” আমাকে নিয়ে চলো!

আহম্মেদ কফি হাতে ব‌ই পড়ছিল। হঠাৎ নাদিয়ার কথা শুনে যেন তার কর্নগোচর হলো না। চেয়ে রইল নাদিয়ার দিকে।
নাদিয়া আবারো বলল,
–” নিয়ে চলো আমাকে?
এবার আহম্মেদ মুখ খুলে, বলে,
–” কোথায়?
–” নৌসির বাসায়!
সামান্য কম্পিত কন্ঠস্বর তার। তাই আহম্মেদ আর প্রশ্ন না করে নিয়ে চলল তাকে। কি হয়েছে ওখানে পৌঁছালেই হয়তো জানতে পারবে তাই আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না।

ভরা মানুষের মাঝখানে নৌসির নিথর,
প্রাণহীন দে’হটা পড়ে আছে ফ্লোরে! গতকাল রাতেও কত আনন্দ ফুর্তি করল মেয়েটা। অথচ আজকে তাকে মানুষ লা’শ বলে সম্বোধন করছে! এই জন্যই বলে মৃ’ত্যু কখনো বলে কয়ে আসে না। মৃ’ত্যুর কোন বয়স নেই।

নাদিয়া কে দেখতে পেয়ে তার আরেকটি বান্ধবী যে তাকে খবরটি দিয়েছে সে কাছে এসে, নাদিয়া কে জরিয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিন্তু নাদিয়ার চোখে পানি নেই। কেমন যেন পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাদা কাপড়ে ঢাকা লা’শের উপর। গতকাল রাতেও তো কতশত মজা করল দুই বান্ধবী। অথচ আজকে সে নাই। কি অদ্ভুত এ দুনিয়া! অথচ এরপরেও আমরা এই দুনিয়ার মোহে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। পরকালের কথা একবার ও স্মরণ করে নিজেকে সুধরে নেওয়ার চেষ্টা করি না। ত‌ওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসি না আফসোস।

এই ঘটনার পর থেকে নাদিয়া নিস্তেজ হয়ে যায়। বিষন্ন মনে বসে থাকে বাসায় এক কোণে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আহম্মেদ বুঝায় তাকে, আমাদের মৃ’ত্যু নির্ধারিত। তাই সময় থাকতে পরপারের জন্য আমল সংগ্রহ করতে হবে। আমল ছাড়া আমরা কিছুতেই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো না। এ দুনিয়ায় যত কষ্ট সহ্য করবো পরকালে তত‌ই আনন্দ ভোগ করতে পারবো ইনশা আল্লাহ। ফিরে এসো আল্লাহর পথে।

এরপর থেকে নাদিয়া অনুসূচনায় দগ্ধ হতে থাকে। মৃ’ত্যু ভয় জেঁকে ধরে তাকে।
এতো গুলো দিন আল্লাহর ইবাদত পালন না করে, অবহেলায় কাটানোর জন্য মনে গভীর দা’গ কা’টে। আহম্মেদ এর আহ্বান গ্রহণ করে নামাযের সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। চোখের পানি ঝরে তার অনর্গল।
এরপর থেকে আহম্মেদ এর সাথে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে উঠে। দু’জনে দুজনের চোখের মণি হয়ে উঠে আলহামদুলিল্লাহ।

হজ্জ পালন করে নজরাত তারা যখন ফিরে এসে নাদিয়ার পরিবর্তন দেখতে পায় তখন খুশিতে কেঁদে দেয় নজরাত। দুই রাকাত নফল নামায পড়ে আল্লাহ তা’আলার কাছে শুকরিয়া আদায় করে। আল্লাহর ঘর পবিত্র মক্কায় কতোই না দুআ করেছে মেয়ের হেদায়েত এর জন্য। সেই দুআ আল্লাহ তা’আলা কবুল করে নিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। দুআ কবুলের আনন্দে বারংবার কেঁদে ওঠে নজরাত। পাশে তাকে শান্তনা দিয়ে রাদ শাহমাত বলে,
–” রাসূল (সা.) বলেছেন, দোয়া ছাড়া আর কিছুই আল্লাহর সিদ্ধান্তকে বদলাতে পারে না। (তিরমিজি, হাদিস নম্বর ২১৩৯)
সুবহান আল্লাহ।

সমাপ্ত

(আসসালামু আলাইকুম।
অনেকেই গল্পটার সিজন-২ চাইছেন। কিন্তু সিজন-২ লিখতে চাইছি না বলে এই পর্বটা বোনাস হিসেবে দেওয়া। ভুল গুলো মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইল। “জাযাকুমুল্লাহু খাইরান”।)

তোমার নিরব অভিমানীনি শেষ পর্ব