দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ৫

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ৫
অনন্যা অসমি

প্রিন্সিপালের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাফাইত, সিয়াম এবং তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তোহা। উনি যে বেশ রেগে আছেন তা ওনার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

” এসব কি সাফাইত? সিনিয়র হয়ে যদি তোমরা এরকম আচরণ করো তাহলে নতুনরা কি শিখবে? তোদের কার্যক্রম ইতোমধ্যে ভার্সিটি পেরিয়ে বাইরের মানুষের কানে পৌঁছে গিয়েছে। শখানেক জায়গায় তোমাদের মারামারি ভিডিও শেয়ার হয়েছে। পরিচিতরা আমাকে তাতে মেনশন দিচ্ছে। ভার্সিটি নিয়ে নিন্দা করছে সবাই।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

” সরি স্যার। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হয়ে গিয়েছে।” মাথা নিচু করে বলল সাফাইত।
রিফাত সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন, ” সরি বললেই কি সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে? এটা তোমার রাগ দেখানোর জায়গা নয়। রাগ দেখাতে হলে, গুন্ডামী করতে হলে ভার্সিটির বাইরে গিয়ে দেখাবে তখন কেউ কৈফিয়ৎ চাইবেনা।”
সাফাইত পরবর্তীতে কিছু বলার সাহস পেল না। তোহা এতো সময় চুপ করে থাকলেও এবার মুখ খুলল।

” স্যার আমার কিছু বলার আছে।”
সরু চোখে তাকালেন রিফাত সাহেব।
” তুমি সেই মেয়েটা না যে ওকে চড় মেরেছিলে?”
” জ্বি স্যার, আমার নাম তোহা।”
” তুমি কেন এর মাঝে এসেছ? কোন অধিকারে ওর গায়ে হাত তুলেছিলে তুমি?”

সাফাইত কিছু বলবে তার আগে তোহা তাকে ইশারায় থামিয়ে নিজে বলল, ” আমি সাফাইতের বেস্টফ্রেন্ড। তাদের মাঝে আসার কারণ ঘটনা মূলত আমাকেই ঘিরে। আজ সকালে করিডোর দিয়ে আসার সময় সিয়াম নামক ছেলেটি আমার সাথে অসভ্যতা করেছিল, সবার সামনে আমার হাত ধরে টানাহেঁচড়া করেছিল৷ সাফাইত এটা শুনে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। তাই রাগের বশে এসব করে ফেলেছে। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি স্যার। কোন শাস্তি দিতে হলে আমাকে দিতে পারেন।”

সিয়াম ভেবেছিল সে ভিক্টিম কার্ড প্লে করে বেঁচে যাবে কিন্তু তোহার কথা শুনে প্রিন্সিপালের দিকে তাকিয়ে বুঝল আর তার রক্ষে নেয়।
” তুমি কি সিয়ামের কোন শাস্তি চাও?”
তোহা একদম সরাসরি বলে দিল, ” জ্বি স্যার। পড়াশোনার করার স্থানে এধরণের নিম্নমানের কাজ খুবই অসন্তোষজনক। আমি শাস্তির বিষয়টা আপনাদের উপর ছেড়ে দিসি। আশা করবো আপনারা এর যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।”

” ঠিক আছে। তোমরা দু’জন এখন আসতে পারো তবে দ্বিতীয়বার যেন এরকম কিছু না হয়। কোন সমস্যা হলে আমাদের জানাবে, নিজে থেকে কিছু করতে যাবে না।”
” ঠিক আছে স্যার, ধন্যবাদ।”

রুম থেকে বেরিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিল তোহা। সাফাইতকে টেনে মেডিসিন রুমে নিয়ে এলো সে। হাত এবং মুখে আঘাত পাওয়া জায়গাগুলোতে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। তার এই নীরবতা সাফাইতের ভালো লাগছেনা।
” কিরে তোহারাণী কথা বলছিস না কেন? আচ্ছা বাবা সরি আমি আর কখনো এরকম করবো না। এবার তো কথা বল।”

তোহা কোনরূপ উওর দিল না৷ ব্যান্ডেজ করে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো তবে বেশিদূর যেতে পারল না। কয়েককদম যেতে পেছন থেকে সাফাইত তার ব্যাগ টেনে নিজের সামনে নিয়ে এলো।
” এরকম করছিস কেন? আমি কি ভূল করেছি বল? ওকে শিক্ষা না দিলে হতো না।”

” সাফাইত ব্যাগ ছাড় আমার।” ব্যাগ ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলে এবার সাফাইত তার হাত টেনে ধরল। এবার খানিকটা রাগী স্বরে বলল, ” এবার কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তোহা। এরকম করছিস কেন তুই? আমি তো ভূল কিছু করিনি? প্রিন্সিপালের রুমে যেতে হয়েছে বলে তুই মন খারাপ করেছিস? আরে উনি তো আমাদের বকা দেননি তাহলে কি হয়েছে?”

তোহা কোনপ্রকার উওর না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
” এই তোহা তুই কি সিয়ামের ওইসব কথায় মন খারাপ করেছিস? আমার দিকে তাকা।” সাফাইত তার মুখ নিজের দিকে ফেরালো। তোহার চোখে জল দেখে সাফাইত অস্থির হয়ে উঠল। বুঝল সিয়ামের কথায় সে আঘাত পেয়েছে।
” আরে আরে তোহারাণী কান্না করছিস কেন? দেখ ও তো বাজে ছেলে, ওর চিন্তাভাবনাও বাজে। তুই কেন শুধু শুধু ওর কথা মাথায় নিয়ে বসে আছিস বলত? দেখ আমার দিকে, আমরা তো জানি আমরা স্বচ্ছ, আমাদের বন্ধুত্ব স্বচ্ছ। তাহলে বাইরের মানুষের কথা কেন গায়ে মাখব?”

তোহার কি হলো সে জানে না আচমকা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। সাফাইত যত্নসহকারে তার কপালটা নিজের বুকে ঠেকাল। বেশ কিছুসময় পর নিজেই তা সরিয়ে যত্ন সহকারে চোখের জল মুছে দিল।
” হয়েছে এবার বাচ্চাদের মতো কান্না বন্ধ কর। আমার শার্টটা ভিজিয়ে দিয়েছিস। দেখ তোর নাকটা পুরো লাল টমেটো হয়ে গিয়েছে। ইশ… তুই নাক মুছেছিস নাকি শার্টে? ইউ….” বমির নাটক করে বলল সাফাইত। তোহা তার হাতে একটা চাপড় দিল, পরমুহূর্তে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

” শান্তিতে একটু কান্নাও করতে দিবি না।”
” না দেবো না। তোমাকে শান্তিতে দেখলে আমার জ্বলে।”
” যা শয়তান আমার সাথে কথা বলবিনা।”
সাফাইত তোহার ব্যাগ টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

” আমার অনেক ক্ষিধে পেয়েছে। মন ভালো করার মতো কিছু খেয়েনি, খাওয়া শেষে বিলটা দেওয়ার পর আর কথা বলিস না।”
” সাফাইতের বাচ্চা, ছাড় আমার ব্যাগ। আমি যাবোনা তোর সাথে।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। সাফাইত ভাবলেশহীনভাবে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল।

নিউজফিড স্ক্রল করছে ইশরা। তার পুরো নিউজফিড জুরে ক্যাম্পাসে হওয়া সকালের ঘটনার ভিডিও ছড়াছড়ি। কেউ রোমান্টিক ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে তা এডিট করেছে তো কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে পোস্ট করেছে। পরিচিতরা সকলে তাকে মেসেজ দিয়ে জানতে চাইছে সাফাইতে চড় মেরেছে মেয়েটা কে৷ ইশরা তা দেখেও কোনরূপ জবাব দিল না। এবার ইশরার তোহার উপর খানিকটা রাগ হচ্ছে।

” কেন চড় মারতে গেল? ও কি বুঝতে পারেনি এতে সাফাইতের কথাটা সম্মানহানী হবে? এতোটা নির্বোধ মানুষ কি করে হয়? কি এমন হয়েছে যে সাফাইত এতোটা রেগে কাউকে আঘাত করেছে? আমাকে পর্যন্ত খেয়াল করেনি। কিন্তু তোহা আসতেই সে শান্ত হয়েছে গেল!”

ভাবনায় ছেদ পড়ল ফোনের রিংটোনে। স্ক্রিনে সাফাইত নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোন দেখে ইশরার সকালে ধাক্কা দেওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। রাগ হলো তার, ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বালিশ দিয়ে কান চেপে শুয়ে রইল। অনবরত ফোনের রিংটোন সহ্য করতে না পেরে উঠে বসল সে। রিসিভ করে গমগম কন্ঠে বলল,
” কি সমস্যা তোমার? দেখছ ফোন রিসিভ করছিনা তাও বারবার কেন ফোন দিচ্ছো?”

রিসিভ করতেই এতো রাগী কন্ঠ শুনে হকচকিয়ে গেল সাফাইত। তোতলানো কন্ঠে বলল,
” আরে আরে ইশু কুল কুল। এতো রাগে আছো কেন? কেউ কিছু বলেছে?”
” তা জেনে তুমি কি করবে? আমাকে আর কল দিবেনা। পুরো দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর উনি এসেছে ঢং দেখাতে৷ আরেকবার ফোন দিলে খবর আছে।”

” আরে ইশরা শোন তো। এতো রেগে আছো কেন? আচ্ছা বাবা সরি, তুমি তো দেখেছোই সকাল থেকে কি ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। তোহাটাও সারাদিন মন খারাপ করে ছিলো। এখন তুমিও যদি রাগ করে থাকো তাহলে আমি কোথায় যাবো?”

” আমার মাথার উপর যাও। থাকো তুমি তোমার তোহাকে নিয়ে। সেই তো সব, আমি কে? তাই তো সে আসতেই তুমি থেমে গেলে৷ আমি কতবার তোমাকে ডেকেছিলাম কিন্তু তুমি কি করলে? আর কখনোই আমার সাথে যোগাযোগ করবে না।” রাগে কষ্টে নিজের অজান্তে কথাগুলো বলে ফেলল ইশরা।

সিয়ামের কথাগুলো সে শুনেছে, তখন থেকেই তার মাথায় হাজারখানেক বাজে চিন্তা এসে ভর করেছে। ফলে নিজের মেজাজ আর অনুভূতি ঠিক রাখতে পারছে না সে৷ বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল ইশরা। সাফাইতকে সে ভীষণ ভালোবাসে। সে হারিয়ে গেলে ইশরা একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ৪

ইশরার কথা শুনে সাফাইত সকালের ঘটনাটা আবারো মনে করতে লাগল। তখন সে বুঝতে পারলো ভুলবশত সে ইশরাকে ধাক্কা দিয়েছিল। সাফাইত নিজের কপাল চাপড়ালো।
” হায় হায়, এটা আমি কি করে বসলাম। এবার কি করে ইশরাকে মানাবো! আরে ইয়ার, ধুর।”

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ৬