দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ৬

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ৬
অনন্যা অসমি

সবকটা ফুল নাড়াচাড়া করে দেখছে তোহা। ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে বিষাদের হাসি। এই ফুল সে নিজের পছন্দের মানুষকে দেওয়ার জন্য কিনছে তবে এই ফুলের তোড়া তার পছন্দ পুরুষটা দেবে অন্য এক রমণীকে যার নাম ইশরা। বেশ কয়েকটা তোড়া দেখার পর একটা তোড়া পছন্দ করলো সে। সাফাইত বিনা বাক্যে সেটাই নিয়ে নিল।
পাশাপাশি নীরবে হাঁটছে তোহা এবং সাফাইত৷ নীরবতা ভেঙে সাফাইত অস্থির কন্ঠে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,

” ইশরা মানবে তো?”
তোহা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, ” চেষ্টা করে দেখ।”
” আমি সত্যি বলছি ওকে আমি খেয়াল করিনি। না-বুঝে ওভাবে সরিয়ে দিয়েছিলাম।” অনুশোচনা করে বলল সে।
” মেয়েরা স্বভাবগত একটু কোমল হয়। তোর হঠাৎ আচরণে তার মন খারাপ হয়েছে তবে তা ক্ষণস্থায়ী। দেখবি তুই ওর সাথে একটু ভালোবেসে ব্যবহার করলে ও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

কথা বলতে বলতে দু’জনে ক্যান্টিনে চলে এসেছে। কোণার একটা টেবিলে দেখল ইশরা একা বসে বই পড়ছে। ফুলের তোড়াটা তোহার কাছে রেখে সাফাইত ছুটে তার পেছনে এসে দাঁড়াল এবং হুট করে হাত দিয়ে চোখজোড়া চেপে ধরল। ঘাবড়ে গেল ইশরা। চোখ থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করতে লাগল।

” কে এটা? চোখ ছাড়ো বলছি।” বিরক্তি নিয়ে বলল সে। সাফাইত খানিকটা কন্ঠস্বর পাল্টে বলল,
” বাবু তুমি আমাকে চিন্তা পারছ না? আমি আকাশ, তোমার আকাশ।” বলে মুখ টিপে হাসল সে।
” কে আকাশ? কোন আকাশ? ছাড়ুন আমার চোখ তারপর যা বলার বলুন। কি হলো ছাড়ুন।”

সাফাইত ঘাড় গুঁড়িয়ে কিছু দূরে থাকা তোহার দিকে তাকাল। সে ইশরায় বলল ছেড়ে দিতে। এরই মাঝে ইশরা ঝাড়া দিয়ে হাতটা সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল, ” এই কে আপনি? হুট করে…..” সাফাইতকে দেখে কথা বন্ধ হয়ে গেল তার। রাগের পরবর্তীতে মুখশ্রীতে গম্ভীরতা ছেঁয়ে গেল। চুপচাপ চলে আসতে যাবে কিন্তু সাফাইত দিল না। জোর করে তাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজেও পাশে বসল। যেন উঠতে না পারে তাই হাতজোড়া চেপে ধরল।

” ইশরা আমি সত্যিই দুঃখিত, অনুতপ্ত আমি। ছেলেটা তোহার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে জেনে আমার মেজাজ ঠিক ছিল না তখন। তাই না বুঝতে তোমাকে আঘাত করে বসেছি। প্লিজ ইশরা এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। তুমি এভাবে কথা না বলে থাকলে যে আমার ভালো লাগছেনা, দমবন্ধ লাগছে। প্লিজ ইশু এবারের মতো ভুলটা ক্ষমা করে দাও।”

কথার মাঝে তোহারকাছ থেকে ইশরার অগোচরে তোড়াটা নিয়ে নিলো সাফাইত। সেটা ইশরার দিকে বাড়িয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো বলল,
” যদি তুমি এটা নাও তাহলে বুঝব আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ।”
বেশ কিছুসময় পরেও যখন ইশরা তা নিল না তখন সাফাইতের মন ভেঙে গেল। মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, ” কি ব্যর্থ প্রেমিক আমি। প্রেমিকার রাগ ভাঙাতে পারছিনা। প্রেমিক নামে কঙ্কল আমি। প্রেমিক সমাজ থেকে না আমাকে বিতারিত করে দেয়।”

এই সিরিয়াস মোমেন্টে সাফাইতের এধরণের হেয়ালিপনা দেখে ইশরা ফিক করে হেসে ফেলল। যা দেখে সাফাইতের খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
” এই তুমি হেসেছ তাই না? তার মানে তুমি আর রেগে নেয়।”
” কই হেসেছি? আমি তো হাসিছি।” হাসি আটকে রেখে বলল সে। সাফাইত বুঝল ইশরা তার মজা নিচ্ছে। তাই সেও মজা নিতে বলল,

” ও… তাহলে হয়তো আমিই ভুল দেখেছি। থাক আর কি করার। এই ফুলের তোড়া দেখি কাকে দেওয়া যায়৷ সাথে প্রেমিক সমিতি থেকে নামটা কেটে দিতে হবে।”

ইশরা তোড়াটা কেড়ে নিয়ে বলল, ” কাকে দেবে শুনি? আমার জন্য আনা জিনিস অন্যকাউকে দিলে খবর আছে।”
সাফাইত চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালে ইশরা না হেসে পারলনা। তাদের এই মান অভিমানের পালা শেষ হয়েছে দেখে তোহা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। এতোসময় পর সাফাইতে প্রাণ খুলে হাসতে দেখে তারও মন ভালো হয়ে গেল। নীরবে সেখান থেকে সরে এলো সে।

ভাসির্টির সময় তখন প্রায় শেষ। সেসময় কোন পূর্বাভাস ছাড়াই ঝুম করে বৃষ্টি নামল। তোহার কাছে সবসময় ছাতা থাকে বিধায় তার কোনরূপ চিন্তা ছিল না। একহাতে ছাতা অপর হাতে পায়জামা খানিকটা উঁচু করে ধরে সাবধানে মাঠ পেরিয়ে গেটের কাছে যাচ্ছিল তোহা। সেরকম কোথা থেকে দু’জন ছুটে এসে তার ছাতায় ঢুকে তাকে দু’পাশ থেকে চেপে ধরল। আচমকা এধরণের ঘটনায় চমকে উঠল সে। তবে নিজের পাশে সাফাইত এবং ইশরা দেখে ভীতি দূর হলো তার।

” উফ… তোরা! আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কে না কে ধরেছে ভেবে।”
” তোকে আসলেই তুলে নিয়ে যাওয়া দরকার। তুই একা ছাতা নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছিস৷ এদিকে যে আমাদের কাছে ছাতা নেয়, তুই তো একবারো আমাদের খোঁজ নিলি না।”

তোহা খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বলল, ” তোমাদের কাছে যে ছাতা নেয় তা আমি কি করে জানব? আমি কি অন্তর্যামী? তুমি আমাকে না বলেই কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছ। নিজেও তো একবার ফোন করোনি।”
” আরে বাবা কুল কুল। এতো রেগে যাচ্ছিস কেন? এই বৃষ্টির দিনে ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় মাথা গরম করা ঠিক না। তোর বেশি মাথা গরম হলে যা কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে আয়।”

তোহা রাগী চোখে তার দিকে তাকাল। ইশরা পাশ থেকে বলল,
” উফ… তুমিও না। সারাদিন আপুর পেছনে লেগে থাকো। আর বিরক্ত করো নাতো। আপু রেগে গেলে ঠেলে তোমাকে ছাতা থেকে বের করে দেবে। তখন ভিজে ভিজে যেতে হবে।”
” আমি ওকে ভয় পাই নাকি? আমাকে ছাতা থেকে বের করে দিলে ওকে আমি ছেড়ে দেবো?”

তার কথার মাঝে তোহা ছাতাটা সাফাইতের হাত ধরিয়ে দিয়ে ছুটে একটা রিকশায় উঠে গেল। তার দিকে একবারো ফিরে তাকালো না সে, রিকশাচালকে দ্রুত রিকশা টানতে বলল। ঘটনা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গিয়েছে যে সাফাইত এবং ইশরার বিষয়টা বুঝতে কিছুটা সময় লাগল।
” এটা কি হলো?” অবাক কন্ঠে বলল সাফাইত।
” আমিও তাই ভাবছি। আপু কোন কথা না বলে এভাবে চলে গেল কেন?”

রিকশা থেকে নেমে একছুটে বাড়ির ছাদে চলে গেল তোহা। ছাদের দরজা বন্ধ করে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে চোখের জল বির্সজন দিতে লাগল সে। প্রথমে নীরবে কান্না করলেও একসময় নিজের অনুভূতিকে আর ধরে রাখতে পারল না। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল সে। চিৎকার করে কান্না করতে লাগল। বৃষ্টির শব্দে আশেপাশের কেউ শুনতে পাবেনা বলে সে প্রাণ খুলে কান্না করতে লাগাল।

” কেন, আমার সাথেই কেন এরকমটা হলো? কি ক্ষতি করেছি আমি? কেন আমি নিজের অনুভূতিকে আটকে রাখতে পারিনি? কেন আমি সাফাইতকে দেখলে দুর্বল হয়ে পড়ি? কেন তাদের দু’জনকে একসাথে দেখলে আমার কষ্ট হয়? সাফাইত ইশরার মাঝে কি এমন পেয়েছে যা আমার মধ্যে ছিল না? কোন গুণের কারণে সাফাইত ইশরাকে বেছে নিয়েছে? এতোবছর ধরে সে আমাকে দেখছে একটুও কি বুঝলো না আমার অনুভূতি?”

পরক্ষনেই সে চোখ মুছে ফেলল।
” না না এসব আমি কি বলছি। সাফাইত কিভাবে বুঝবে? সে যেন না বুঝতে পারে সেই চেষ্টাই তো আমি করছি। নিজের অনুভূতিকে নিজের মধ্যে দাফন করে রাখেছি। এতে সাফাইতের তো কোন দোষ নেই৷ ইশরা যথেষ্ট ভালো মেয়ে। সাফাইত এরও তো নিজস্ব অনুভূতি আছে। আমি তাকে জানাতে পারিনি এটা আমার ব্যর্থ।না না, এখন তাদের সুখের নজর দেওয়া উচিত হবেনা।”

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ৫

এসব বলে নিজেকে বোঝাল তোহা। তবে তখনো তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে এখন দোটানায় ভুগছে। প্রতিনিয়ত পছন্দের মানুষকে অন্যজনের পাশে দেখে একপাক্ষিক প্রণয়ের অনলে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে সে।

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব ৭