দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ১৮

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ১৮
তাসফিয়া হাসান তুরফা

বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হওয়ায় মায়ের সাথে ওভাবে আর কথা হয়নি দোলার। পরদিন শুক্রবার হওয়ায় সবাই বাসাতেই আছে। ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই দোলা লক্ষ্য করলো আজকে যেন পারভীন বেগমকে একটু খুশি খুশি লাগছে।

এমন নয় যে অন্যদিন তিনি মনমরা হয়ে থাকেন, কিন্তু তবু যেন আজক তার চোখেমুখে হাসির রেখা স্পষ্ট দৃশ্যমান। সকাল থেকেই এটা সেটা ভালো খাবার রান্না করছেন, একা একাই বিড়বিড় করছেন আবার কি মনে করে যেন নিজে নিজেই হাসছেন। দোলার কাছে মায়ের এমন আচরণ মোটেও ঠিক লাগছেনা! একেতো সে আছে নিজের অশান্তিতে, তার উপর মায়ের এমন উদ্ভট আচরণ সবমিলিয়ে যেন ওর শান্তি কেড়ে নিয়েছে বলা চলে। তাই নিজ রুম থেকে উঠে গিয়ে মায়ের কাছে চলে গেলো সে।
তার পানে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—কি হয়েছে, মা? তোমায় এত খুশি দেখাচ্ছে যে?
মেয়ের কথায় ঠোঁটের হাসি যেন আরেকটু গাঢ় হলো পারভীন বেগমের। মেয়ের গাল টিপে বললেন,
—কেন হবোনা? তুই শুনলে তুইও খুশি হবি!
মায়ের কিসের কথা বলছে দোলার বোধগম্য হলোনা৷ সে আবার প্রশ্ন করলো,

—মানে? কিসের কথা বলছো?
—আরে বোকা, তোর আর…
উনার কথা শেষ হবে এর আগেই ওখানে কামিনি চলে এলো। অভিযোগ এর সুরে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
—এটা কোন ধরনের কথা, মা? তুমি পোলাও করেছো ভালো কথা। কিন্তু এর সাথে বেগুন ভাজা করেছো শুধু। তুমি কি জানোনা আমার বেগুনে এলার্জি? তোমার বাকি দুই ছেলেমেয়ে খাবে দেখে রান্না করলে আর আমাকে ভুলে গেলে? মেজো সন্তান বলে কি আমার মূল্য নেই তোমার কাছে?
কামিনির কথার তালে দোলাকে বলা কথা ভুলে গেলেন পারভীন বেগম। মাথা চাপড়ে বললেন,

—তা ভুলবো কেন? ওমা, তোর জন্য তো মাছ ভাজা আছেই। সবাই খাবে সাথে তুইও খাবি।
—না, আমি আলুভাজা খাবো। আমার জন্য আলাদা কিছু করো।
—সবকিছু করা শেষ প্রায়। এ সময় এসে এগুলো আজগুবি বায়না যেন করিসনা, মিনি। খুব বিরক্ত লাগে আমার!
—আমি বললে তো বিরক্তই লাগবে তোমার। কিন্তু আমার জায়গায় যদি দোলাপু অথবা শিমুল বলতো তাহলে তুমি ঠিকি করতে।
কথাগুলো বলে কামিনি চলে গেলো রুম থেকে। তা দেখে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালেন পারভীন বেগম। দোলার উদ্দেশ্যে বললেন,

—তোর বোনকে নিয়ে আর পারা গেলোনা। ওর কোনো একটা কথা না শুনলেই এসব বলবে। ভাল্লাগে এগুলো?
অতঃপর রুমের বাহিরে যেতে যেতে বললেন,
—যাই এখন মহারানীর আবদার পূরণ করি নয়তো ওটা নিয়েই দেখবি সারাবেলা মুখ ফুলিয়ে থাকবে। তোরা কেউ আর মা-কে শান্তিতে থাকতে দিলিনা! বলি আর কেউ কিছু খেতে চাস? চাইলে সেটাও বল! মা-কে না খাটাতে পারলে তো আর ভাল্লাগবেনা তোদের!

একা একাই গজগজ করতে করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন পারভীন বেগম। দোলা সেদিক চেয়ে মাথা নাড়লো। এসব দৃশ্য তাদের বাসায় অহরহ চলে। এগুলো নিয়ে সে মাথা ঘামায়না, বরং মাথা ঘামাচ্ছে মা কি বলতে চাচ্ছিলো তা নিয়ে। দোলা কিছুক্ষণ ভাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে কোনো আন্দাজ সে করতে পারলোনা। একবার ওর মাথায় এলো, কোনোভাবে কি রাকিবের সাথে মামা-মামি ওর বিয়ের প্রস্তাব তুলেনি তো?

বিষয়টা মাথায় আসতেই দোলার ভেতরটা গুলিয়ে উঠলো। জীবনে আর কাউকে বর হিসেবে দেখুক না দেখুক, রাকিবকে সে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবেনা। তার উপর মা বলছিলো, খবরটা শুনলে দোলা খুশি হবে। সেক্ষেত্রে তো এটা বিয়ের খবর হওয়ার কথা না। কেননা, দোলার মা ভালো করেই জানে যে সে এ মুহুর্তে বিয়ের কথা ভাবছেনা মোটেও। তবে কি বলতে চাইছিলেন তিনি?

ভেবে ভেবে দোলা অস্থির হয়ে যায়। কিন্তু সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে৷ খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেলে মায়ের থেকে শুনবে সবকিছু ভালোমতো। একিসাথে রাকিবের ব্যাপারেও ওকে সব বলে দিবে!

বিকেলে খাওয়া শেষে খানিকটা জিরিয়ে নিতেই দোলার রুমে ওর মা চলে এলেন। বোরকা পরিহিত মা-কে দেখে অবাক হয়ে গেলো সে। বিস্মিত হয়ে শুধালো,
—এ সময় কোথায় যাচ্ছো, মা? তাও ছুটির দিনে?
পারভীন বেগম পুরোপুরি উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন,
—ভাবি মার্কেটে যাচ্ছিলেন, আমাকেও ডাকলেন। ভাবছি বসেই যখন আসি আমিও ঘুরে আসি। তুই তো বাড়িতেই আছিস তাইনা? ভাইবোন দুটোরে দেখিস।
মায়ের কথায় দোলাকে খানিকটা বিরক্ত দেখালো। তা দমন না করে সে বললো,

—মামি ডাকলো আর তুমি চলে যাচ্ছো? তোমার কি কোনো বিশেষ দরকার আছে মার্কেটে যে যাচ্ছো? আর তুমি বা সবসময় সবার ডাকে সাড়া দেও কেন! একবার নিজের শরীর দেখেছো? তাছাড়াও, মামিরও বা কি দরকার সবক্ষেত্রে তোমাকে ডাকার আমি বুঝিনা! একেতো সারাদিন স্কুল থেকে এসে বাসায় কাজ করো, রেস্ট পাওনা। আজ ছুটির দিনে বাসায় আছো, রেস্ট করো। বিশ্রাম দরকার তোমার! তুমি যেয়োনা আজকে।
মেয়ের কথায় খানিকটা চটে গেলেন পারভীন বেগম। চোখ পাকিয়ে বললেন,

—তুই কবে থেকে এভাবে কথা বলা শিখলি? মামা-মামি বড় মানুষ। আমাদের উপর তাদের কত উপকার আছে ভুলিস না। আর তাছাড়াও ভাবি যখন ডেকেছে আমার না যাওয়াটা কেমন দেখায়? আমার যদি যেতে কোনো অসুবিধে না হয় তবে তোর কি সমস্যা আমায় বল? এগুলো কথা একদমই বলা উচিত নয়, দোলা। এ শিক্ষা আমি দেইনি তোকে!
মায়ের কথায় মনে মনে মাথা চাপড়ায় দোলা। ভুল জায়গায় তীর ছুড়েছে সে। মায়ের সামনে মামা-মামির ব্যাপারে কিছু বলা মানেই দেয়ালের সাথে তর্ক করা। তাই সে চুপচাপ মাথা নেড়ে সায় জানালো। কিন্তু মুখে বললো,

—যাচ্ছো ভালো কথা। জলদি বাসায় ফেরার চেষ্টা করো৷ আমার কিছু জরুরি কথা বলার আছে তোমার সাথে।
—কি কথা?
—এখন তাড়াহুড়োয় বলা সম্ভব নয়। বল্লেও তুমি বুঝবেনা। তাই বাড়ি ফিরো সন্ধ্যার মধ্যে, যা বলার ঠান্ডা মাথায় তখন বলবো। শুধু আমায় ভুল বুঝোনা তাহলেই হবে।
পারভীন বেগম উৎসুক হলেন মেয়ের কথায়। মাথা নাড়িয়ে বললেন,

—বেশ তবে। আমারও তোর সাথে দরকারি কথা আছে৷ আমিও তখনই বলবোনি। মিনির জন্য তো সকালে বলা হলোনা আর!
এরপর পারভীন বেগম চলে গেলেন। দোলা কিছুক্ষণ বইপত্র ঘাটাঘাটি করে ক্ষ্যান্ত হয়ে বাসায় ঘুরে বেড়ালো। ভাইবোনের রুমে গিয়ে উকি দিলো। শিমুল সিনেমা দেখছে, আর কামিনি ঘুমোচ্ছে নিজ রুমে। সে নিজেও এদিক-সেদিক করে বারান্দায় চলে গেলো। দিন ছোট হয়ে আসায় বেশ আগেই এখন সূর্য ডুবে যায়। রোদের ছিটেফোঁটা নেই বললেই চলে। মা-ও বাসায় নেই, ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনা উচিত। দোলা মাথায় ওড়না পেচিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে চলে গেলো।

যথারীতি ছাদে উঠে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ফুলের গাছ নেড়েচেড়ে সে কাপড় তুললো। ছাদের রেলিং ধরে একবার এলাকার মোড়ের টং এর দোকানেও কি মনে করে যেন উঁকি দিলো! কিন্তু দোলার চোখ যাকে খুজলো, তাকে পেলোনা। মেয়েটা মনে মনে খানিকটা অবাক হলো। আজকের ছুটির দিন, নিশীথের তো এ সময় এখানেই থাকার কথা, সচারচর ওখানেই থাকে। তবে কি আরও সন্ধ্যে হলে আসবে আজকে?

পরক্ষণেই নিজ ভাবনায় নিজেই বেকুব বনে গেলো সে। নিশীথ যখন আসার আসুক, ওর কি? সে কেন এত ভাবছে? তাই নিজের ভাবনায় পানি ঢেলে পেছন ফিরতেই ওর চোখদুটো কপালে উঠলো যেন!
দোলার সামনে নিশীথ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? সে কি ভুল দেখছে? দোলার ভাবনাচ্ছেদ হলো তখনই যখন নিশীথকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো ওর দিকে! লম্বা চওড়া বলবান ছেলেটার দিক চেয়ে দোলার কোনোভাবেই মনে হলোনা এটা ভ্রম, বরং নিশীথকে দেখতে মনে হলো যেন বাস্তবতার মতোই কঠিন।

বলাবাহুল্য, নিজেদের বাসার ছাদে নিশীথকে দেখে দোলা ভীষণভাবে চমকে গেলো। ফলস্বরূপ, হাতের কাপড়গুলো সব মাটিতে পড়ে গেলো। কোনোরকম সেগুলো তুলে উল্টোপথে প্রস্থান করতে নিবে এমন সময় নিশীথ গিয়ে ছাদের দরজা লাগিয়ে দিলো। ওর এহেন কান্ডে দোলার হৃদপিণ্ড ধক করে উঠলো!
মনে মনে ভাবলো, নিশীথ হঠাৎ এমন করছে কেন?
কি করতে চাইছে ও? ঠিক সেই মুহুর্তে নিশীথের হিম শীতল কণ্ঠ ভেসে এলো।

—ছেলেটা কে ছিলো, দোলনচাঁপা? কি করেছিলো ও তোমার সাথে?
দোলা ঘাবড়ে গেলো। এ মুহুর্তে নিশীথকে দেখতে খুব একটা ভালো মনে হচ্ছেনা। ওকে কিছু বলাটাও ঠিক হবেনা। দোলা আনমনেই ভাবছিলো। কিন্তু ওর ভাবনার মাঝেই নিশীথ গ’র্জে উঠলো,
—চুপ করে আছো কেন? স্পিক আপ, ফাস্ট! আর একদম মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা করবেনা আমার সাথে। নয়তো ভালো হবেনা। ছেলেটা কে এবং ও কি করেছে তোমার সাথে, এর ফুল ডিটেইলস আমি চাই! টেল মি রাইট নাও!
নিশীথ এর গলা শুনে দোলা যেমন ভয় পেলো, তেমনি ঘাবড়েও গেলো। এটা ওদের নিজেদের বাসা নয়। বাড়ির মালিক বা অন্য কেউ শুনতে পেলে বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে ওকে। মা জানলে তো আরেক কেলেংকারী হয়ে যাবে। তাই সে নম্র সুরে মিনতি করে বললো,

—ধীরে কথা বলুন, নিশীথ ভাই। দোহাই লাগে আপনার। আপনি আস্তে বল্লেও আমি শুনতে পাবো। আর আপনি এখানে কিভাবে এলেন? প্লিজ চলে যান। এগুলো কিন্তু মোটেও ভালো কাজ নয়। অন্য কেউ আমাদের এভাবে দেখলে বা শুনলে বিষয়টা একদমই ভালোভাবে নিবেনা বুঝার চেষ্টা করছেন না কেন?
দোলার কথায় সামান্য কাজ হলো। নিশীথ কিছুটা রাগ দমন করলো। স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
—ঠিক আছে। এখন ভালোভাবে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি বিপদে আছো আমায় বলো! এরপর আমি নিজে থেকেই চলে যাবো। তোমায় কিছু বলবোনা, কেউ জানবেও না আমি এখানে এসেছিলাম। আর এটা আমার বন্ধুদের বাসা। ও বাহিরেই আছে, ও জানে আমি এখন ছাদে আছি তোমার সাথে। তাই অন্য কেউ জানার চান্স নাই। ডোন্ট ওরি এবাউট দ্যাট।

নিশীথের কথায় দোলা ফোস করে এক শ্বাস ফেললো। ছেলেটার জিদ ও একগুঁয়ে স্বভাব সম্পর্কে এ ক’দিনে বেশ ভালোই ধারনা জন্মেছে ওর। তাই ওর সাথে তর্ক করা উচিত হবেনা। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে দোলা বললো,
—আমি কি একবারও আপনার সাহায্য চেয়েছি? তবে কেন যেচে পড়ে আমার হেল্প করে এসেছেন? আমি যদি ডাকতাম তবে এক কথা ছিলো। এভাবে বিনা অধিকারে কারও জীবনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করা উচিত না। আমি এর আগেও আপনাকে বুঝিয়েছি এ ব্যাপারে। তবে কেন…

দোলা আর কথা বলতে পারলোনা। এর আগেই নিশীথ এগিয়ে এসে ওর ঠোঁটে আংগুল দিয়ে থামিয়ে দিলো। এবার দোলার মনে হলো নিশীথ এত কাছে আসায় ওর হৃদপিণ্ড বক্ষ থেকে বেরিয়ে আসবে যেন! তবে নিশীথকে তেমন একটা বিচলিত দেখা গেলোনা। সে সরাসরি দোলার চোখের দিক তাকালো। অত্যন্ত স্বাভাবিক ও শীতল কণ্ঠে বললো,

—বারবার অধিকার নেই বলে বলে আমার মাথা গরম করাও কেন? তুমি কি চাইছো আমি পূর্ণ অধিকার নিয়ে তোমার কাছে আসি? হ্যাঁ? যদি তুমি এটাই চাও তবে জবাব দাও!
কিন্তু দোলা জবাব দেওয়ার পরিস্থিতিতে নেই। সে শুধু নিশীথের কাছে থেকে নিজেকে সরানোর চেষ্টা করতে ব্যস্ত। ওর অস্বস্তি দেখে নিশীথের বোধহয় মায়া হলো। সে ওর কাছে থেকে নিজ হতেই সরে এলো। দুজনের মধ্যে সামান্য দূরত্ব রেখে বেশ নরম সুরে বললো,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ১৭

—আমায় বিয়ে করবে, দোলনচাঁপা? কথা দিচ্ছি, সারাজীবন তোমার খেয়াল রাখবো! হুট করে জীবনে চলে আসা কাউকে এভাবে ভালো লাগবে আমি কোনোদিনও ভাবিনি। কিন্তু আজকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি আর পারছিনা তোমায় ছাড়া থাকতে। তোমার জীবনে আমার স্থান করে নেওয়ার সুযোগ দিবে? আমার ঘ্রাণহীণ জীবনটাকে তোমাতে সুবাসিত হওয়ার অনুমতি দিবে?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ১৯