দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২০

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২০
তাসফিয়া হাসান তুরফা

মানুষের জীবনে যেকোনো বিষয় তিল থেকে তাল হবার আগেই তাকে দমন করা জরুরি। নয়তো ঘোর বিপদে পড়বার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তার মধ্যে বিষয়টা যখন বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনোকিছু, তখন তো তাল হবার আগেই তাকে আটকানো উচিত বলে দোলার মনে হলো।

যা ভাবা তাই কাজ- ঘটনার গাম্ভীর্য উপলব্ধি করে আর সময় নষ্ট না করে সে দ্রুতপদক্ষেপে চলে গেলো মায়ের কাছে। উদ্দেশ্য একটাই- বিয়ের ব্যাপারে মায়ের সাথে সবকিছু ক্লিয়ার করে ফেলা! এ বিষয়ে কোনোরুপ কনফিউশান, দ্বিধা কোনোটাই দোলা রাখতে চাইছেনা এখন৷ পারভীন বেগম ততক্ষণে ড্রয়িংরুমে সোফার উপর রাখা কাপড় গুছাতে শুরু করেছেন নিজের মতোন। দোলা গিয়ে তার পাশে বসে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—তুমি আমায় একবারো না বলে আগেই কেন বিয়ের কথা পাকা করতে গেলে, মা? অন্তত আমার সাথে একবার কথা বলাটা উচিত ছিলো!
পারভীন বেগম একবার কপাল কুচকে মেয়ের দিক তাকিয়ে বললেন,
—আরে তোকে আগেই বলতাম কিভাবে? তোকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই তো এসব করা, পাগলি!
—সারপ্রাইজ? কিসের সারপ্রাইজ, মা? এটা কোনো সারপ্রাইজের বিষয় নয়, রীতিমতো একটা ট্রমা।

চেঁচিয়ে উঠে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো দোলা। ওর আওয়াজ শুনে কামিনি-শিমুল বেরিয়ে এলো রুম থেকে। পারভীন বেগম পড়লেন মহা বিপাকে। মেয়ে যে তার এ বিয়ের কথা শুনে মোটেও খুশি হয়নি তা বুঝতে আর বাকি নেই উনার। এ ব্যাপারে একান্তে দোলার সাথে আলাপ করা জরুরি, তিনি বুঝলেন। হাতের কাপড় সরিয়ে রেখে দোলার হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে যেতে যেতে বাকি দুই ছেলেমেয়ের উদ্দেশ্যে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,
—কি সমস্যা তোদের? এখানে এসেছিস কেন? যা নিজেদের রুমে যা!

মায়ের ধমকে আর কথা না বাড়িয়ে সুরসুর করে চলে গেলো শিমুল-কামিনি। বলাবাহুল্য, সকলেই বুঝেছে এ মুহুর্তে বেশ সিরিয়াস কোনো কথা চলছে এখানে, অতএব তাদের ডিস্টার্ব দেওয়ার কোনো মানে হয়না। পারভীন বেগম রুমে এসে দোলার হাত ছেড়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। মেয়েকে বসিয়ে নিজে তার সামনে বসে শান্তভাবে বললেন,
—কি হয়েছে তোর? তুই কি রাকিবের সাথে বিয়ের কথা শুনে খুশি নয়? তোর কি ওকে ভালো লাগেনা?
মায়ের প্রশ্নে দোলা সাহস ফিরে পায়। মনের সকল জড়তা কাটিয়ে মুখ ফুটে বলে,

—না, মা। আমি রাকিবকে পছন্দ করিনা। আর ওকে কখনোই আমি মামাতো ভাই ব্যতীত অন্য কোনো নজরে দেখিনি। এজন্যই তোমরা হঠাৎ করে এভাবে আমায় না বলে ওর সাথে বিয়ে ঠিক করায় আমি মেনে নিতে পারছিনা!
পারভীন বেগম বেশ মনোযোগ দিয়ে মেয়ের কথা শুনলেন। দোলার গম্ভীর মুখ, কণ্ঠের স্বাভাবিকতা বলে দিচ্ছে ওর কথার সত্যতা! কিন্তু তিনি হিসেব মেলাতে পারলেন না। কেননা, বিষয়টা যদি এমনই হয় তবে ভাই-ভাবীর বাসায় তিনি যা শুনলেন তার ভিত্তি কই? চিন্তিত মুখে নিজ ভাবনায় মত্ত পারভীন বেগমকে দেখে দোলা তার হাত ঝাকিয়ে ডাকলো বার দুয়েক!

—মা?
—হ, হ্যাঁ?
—কি হয়েছে তোমার? তুমি কি আদৌ আমার কথা বুঝতে পারছো?
—হুম! কিন্তু আমি একটা কথা বুঝতে পারছিনা রে, দোলা।
—কি কথা, মা? আমায় বলো!
—তুই বলছিস তুই রাকিবকে পছন্দ করিস না। ওকে বিয়ে করার কথা কল্পনাতেও ভাবিস না। অথচ তোর মামা-মামি যে আমায় অন্য কথা বললো রে, মা।
মায়ের কথায় দোলার ভ্রুযুগলে ভাজ পড়ে। দ্বিধাযুক্ত কণ্ঠে শুধায়,

—মামা-মামি আবার তোমায় কি বলেছে আমার ব্যাপারে?
—শুধু তোর ব্যাপারে না। ভাইসাহেব তো বললেন রাকিব তাদের বলেছে তোরা দুজন একে-অপরকে পছন্দ করিস। ও তোকে বিয়ে করতে চায়। তুই তো লজ্জায় আমায় বলতে পারবিনা এজন্য রাকিব ভাই-ভাবিকে এ কথা বলেছে। তাই উনারা নিজে থেকে আমায় এ প্রস্তাব দিলেন।
মায়ের কথায় দোলা আঁতকে উঠে বললো,

—রাকিব ওনাদের মিথ্যা কথা বলেছে, মা। বিশ্বাস করো আমাদের মধ্যে মোটেও এমন কিছু নেই। আমি সারাজীবন একা থাকতে রাজি তবু কোনোদিন রাকিবকে বিয়ে করবোনা!
দোলার কথায় পারভীন বেগম বেশ বিপাকে পড়েন। মেয়ে তার যেভাবে বিয়ের বিপক্ষে কথা বলছে, মনে হয়না দোলাকে রাজি করানো যাবে। কিন্তু এদিকে যে তিনি ভাই-ভাবিকে কথা দিয়ে এসেছেন। সেটার কি হবে? তারা এত আন্তরিক ভাবে মেয়ের হাত চেয়েছেন যে পারভীন বেগম পিতৃতুল্য বড় ভাইয়ের অনুরোধ ফেলতে পারেননি আর! ফলস্বরূপ, আর দ্বিতীয় কোণ চিন্তা-ভাবনা না করে নিজের সবচেয়ে আদরের জৈষ্ঠ্য কন্যা তাদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। তাইতো দোলাকে বুঝানোর মতো করে তিনি বললেন,

—দেখ দোলা, আমি জানি তুই এতদিন বিয়ের ব্যাপারে একদমই ভাবছিলিনা বলেই তোর বিয়ের খবর শুনে এরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু জীবনে অনেকসময় এমন অনেক কিছুই করতে হয় যা আমরা আগে থেকে ভেবে রাখিনি। তুই যথেষ্ট ম্যাচিউর। আশা রাখছি তুই আমাকে বুঝবি।
—মা, আমি তোমার সব কথা মানতে রাজি শুধু বিয়ের ব্যাপারে না।
—কিন্তু কেন, দোঁলন? তুই না আমার লক্ষ্মী মেয়ে? মায়ের সব কথা শুনিস? তবে এবার কেন বারণ করছিস সোনা? মা কি তোর খারাপ চাবে?

মায়ের কথায় দোলার চোখ ছলছল করে উঠলো। একিসাথে রাকিবের কুকর্মের কথা মাথায় আসায় চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো জল। মায়ের কোলে মাথা রেখে বললো,
—আমি যদি তোমায় বলি এ বিয়ে আমার জন্য মোটেও ভালো হবেনা তবে কি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে, মা?
মেয়ের মাথায় হাত রেখে বিস্ময় নিয়ে পারভীন বেগম প্রশ্ন করলেন,

—এভাবে বলছিস কেন তখন থেকে? তোর মামা-মামী কেমন মানুষ তা কি তুই জানিস না? আল্লাহ দিলে তারা সবদিকেই ভালো। ওখানে কিসের অভাব হবে তোর? বরং আমি এ বাসায় এ অভাবের সংসারে তোকে যা দিতে পারিনি, ওখানে গেলে ভালোবাসার পাশাপাশি তুই সেগুলো সবই পাবি। এখানে ক্ষতি কোথায়?

—কিন্তু বিয়েটা তো আমার রাকিবের সাথে হচ্ছে, মা। ও যে ভালো না! এটা তোমায় কিভাবে বুঝাই?
—কি যাচ্ছেতাই কথা বলছিস তখন থেকে, দোলা? ভালো করে বল তো! আর রাকিবের সাথে কিসের এত সমস্যা তোর আমি বুঝলাম না! ও কি এমন করেছে তোর সাথে, হ্যাঁ?
মায়ের কোলে বিষাদময় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোলা মাথা তুললো। এবার সময় এসে গেছে মা-কে সবটা সত্যি বলে দেবার। তাই আর কালক্ষেপন না করে আস্তেধীরে সে রাকিবের ব্যাপারে সবটা পারভীন বেগমকে বলতে আরম্ভ করলো!

পরদিন ব্যস্ত সময় পার করে সবেমাত্র নিশীথ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় পেয়েছে নিশীথ! পরীক্ষার বেশিদিন বাকি নেই। সময় খুব কম হাতে। তাই সে খুব সিরিয়াসলি পড়াশুনা করছে এবার। কেননা, এমবিএর এই রেজাল্ট ওর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর ভিত্তিতে বড় কোনো মাল্টিন্যাশনালে এপ্লাই করার টার্গেট নিশীথের। বাবার ব্যবসায় যোগ দেওয়ার তেমন ইচ্ছে ওর নেই। এজন্য যতটুকু সম্ভব সময় লাগিয়ে পড়াশুনা করে নিজের প্রস্তুতি এগিয়ে রাখছে নিশীথ। হাতঘড়িতে সময় দেখলো সন্ধ্যে ৬টা বাজে। বাইরে বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। সন্ধ্যেবেলা হালকা হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে বাইরে। গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে ফোন হাতে একে-একে বন্ধুদের ফোন লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে পড়লো সে।

কিছুক্ষণের মাঝেই টং এর দোকানে আড্ডা জমলো বেশ। সকলের হাত তখন চা, সিগারেট কিছু না কিছু আছেই। বরাবরের ন্যায় কবিরের স্ট্যান্ড করে রাখা বাইকের উপর বসে আছে নিশীথ। বন্ধুমহলে কি হয়েছে না হয়েছে এসব শুনছে মনোযোগ দিয়ে। মাঝেমধ্যে স্বভাবসুলভ ভাবে এটা-সেটা বলছে। এর মধ্যে আকাশ হঠাৎ বললো,

—ভাই, রাগ না করলে একটা কথা জিজ্ঞস করতাম!
নিশীথ কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই সে ঢোক গিলে প্রশ্ন করলো,
—বলছিলাম, ভাবি কি এখনো রাজি হয়নি তোমার প্রস্তাবে?
নিশীথ আড়চোখে তাকাতেই সে ঘাবড়ে গিয়ে বললো,

—সত্যিই প্রশ্নটা করতে চাইনি। কিন্তু মনের মধ্যে এতটাই উশখুশ করছিলো যে এখন যদি না জিজ্ঞেস করতাম আমি শান্তিতে ঘুমোতে পারতাম না আজ রাতে। প্লিজ মেরোনা আমায়!
ওর কথায় নিশীথ ফোস করে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তবে বিপরীতে কোনো উত্তর দেয়না। থমথমে মুখে বসে থাকে শুধু। এমন নয় যে আকাশের প্রশ্ন শুনে ওর খারাপ লেগেছে, বরং বাস্তবতাকে স্বীকার করার মতো সৎ সাহস নিশীথের বরাবরই ছিলো।
তাই সে বললো,

—দেখ আকাশ, আমার পক্ষে যতটুকু বুঝানো সম্ভব ছিলো সবটুকুই বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি ওকে ছাদে। এখন রাজি হওয়া না হওয়া সম্পূর্ণটাই দোলনচাঁপার ইচ্ছা। আমি দোলনচাঁপাকে ভালোবাসি , ওকে নিজের করে পেতে চাই ঠিকি কিন্তু একিসাথে ওকেও আমায় ভালোবাসার জন্য কিছুটা সময় দিতে হবে।
নিশীথের কথার মাঝে ফোড়ন কেটে তূর্য বললো,

—আর কত সময় দেবে, ভাই? ওর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে এতদিন সুরসুর করে তোমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতো। বরং তুমি যে ওর প্রতি এতটা ধৈর্য দেখাচ্ছো এটাতেই আমি অবাক! তোমায় তো আমরা কম সময় ধরে আর চিনিনা! তুমি তো কখনো এমন ছিলেনা! যে তুমি বিয়ের নাম শুনলেও এড়িয়ে যেতে, সেই তুমি কিনা সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এসেছো শুনেই তো আমাদের মাথা ঘুরছে!

তূর্যর কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে নিশীথ। কথাগুলো নেহাৎ ভুল বলেনি ছেলেটা। বরং সে নিজেও কখনো এত তাড়াতাড়ি বিয়ের মতোন সিরিয়াস সম্পর্কে জড়াবার কথা ভাবেনি। কিন্তু এ ক’দিনে দোলার সাথে যতটুকুই মিশেছে, কথা বলেছে বা ওকে পর্যবেক্ষণ করেছে, নিশীথ বুঝেছে এ মেয়ে প্রেম করার মতো নয়, বরং বিয়ে করে ঘরে আনার মতো মেয়ে। তাই নিশীথ সেভাবেই জবাব দিলো,

—পরিস্থিতি কখন কাকে দিয়ে কি করিয়ে নেয়, কে-ই বা বলতে পারে? আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এখন দেখা যাক দোলা রাজি হয় কিনা!
-যদি ভাবি মানা করে দেয়?

জান হাতে নিয়ে কবির প্রশ্নটা করেই আকাশ ও তূর্যর পেছনে লুকিয়ে গেলো। নিশ্চিত এবার ওর মরণ হবে নিশীথের হাতে! কিন্তু ওর ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে নিশীথ বেশ স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
—আমি ওকে বলেছি ওর যত ইচ্ছা সময় নেক, আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবো ওর জবাবের। যতদিন কিছু না বলবে ওকে ডিস্টার্ব দিবোনা। আমার মনে হচ্ছে, আজ নয়তো কালের মধ্যে দোলার পক্ষ থেকে জবাব আসবে।
—তারপর?

আকাশ কৌতুহলের সাথে শুধায়।
—তারপর আবার কি? দোলনচাঁপা যদি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়, তবে সাথে সাথে বিয়ে করবো। আর যদি রাজি না হয় তবে….
নিশীথ থেমে গেলো। যেন সময় নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো। ওর মুখে গাম্ভীর্যের পাশাপাশি নিদারুণ উদাস ভাব বিরাজ করলো। ততক্ষণ ছেলেরা ধৈর্য ধরে, শ্বাস রোধ করে ওর পূর্ণাঙ্গ উত্তরের অপেক্ষা করলো। অতঃপর নিচু স্বরে বললো,
—আ,আমি ওকে ভুলে যাবো।

বাক্যটি বলার সময় নিশীথের গলা খানিকটা কাপলো। ওর কথায় যেন মুহুর্তের মাঝে বিস্ফোরণ ঘটলো আড্ডামহলের মাঝে। সবার চোখ কপালে উঠে গেলো! বলছে কি নিশীথ? এটা কিছুতেই মানতে পারছেনা ছেলেগুলো। ওদের নিশীথ ভাইয়ের মন ভাঙ্গতে দেওয়া যাবেনা। দোলনচাঁপাকে রাজি হতেই হবে। যেভাবেই হোক না কেন!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ১৯

যে দোলনচাঁপাকে পাওয়ার জন্য সে এতকিছু করলো, যাকে ভালোবেসে এত স্বপ্ন দেখলো, এখন কিনা তাকে না পেয়েই নিশীথ ভুলে যাবে!
এটা আদৌ সম্ভব? নিয়তি কি এত নিষ্ঠুর হতে পারে?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২১